জাতির সংকট ও আহমদ ছফার প্রাসঙ্গিকতা
৩০ জুন ২০২৪ ১৬:৩৩
বহুমাত্রিক লেখক, চিন্তাবিদ, সংগঠক ও গণবুদ্ধিজীবী আহমদ ছফার ৮১তম জন্মদিন আজ। সবদিক থেকেই তিনি ছিলেন সম্পূর্ণ আলাদা ও অনন্য। চিন্তায়, রচনায়, জীবন-যাপনে তার স্বাতত্রিক বিশিষ্টতা সুস্পষ্ট।
১৯৪৩ সালের ৩০ জুন চট্টগ্রাম জেলার দক্ষিণাঞ্চলের চন্দনাইশ উপজেলার গাছবাড়িয়া গ্রামের এক মধ্যবিত্ত পরিবারে তার জন্ম। চট্টগ্রামে মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক পর্যায়ের লেখাপড়া সমাপ্ত করে ছফা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়ন করেন। তিনি রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিষয়ে এমএ ডিগ্রি অর্জন করেন। উচ্চতর গবেষণাও শুরু করেছিলেন তিনি। কিন্তু মননশীল রচনায় ব্যস্ত হয়ে সেদিকে আর নজর দিতে পারেননি।
তার সমকালে আহমদ ছফা ছিলেন মেধায়, মননে, সৃজনে অনন্য একজন। ষাট, সত্তর, আশি দশকের সাহিত্যধারায় তার উজ্জ্বলতম উপস্থিতি সে প্রমাণবহ। ২০০১ সালের ২৮ জুলাই তার মৃত্যুর দিনটি চিহ্নিত হয়ে আছে বাংলা ভাষার একজন বিশিষ্ট ও তুলনা-রহিত লেখক ও গণবুদ্ধিজীবীর চিরপ্রস্থানের বেদনাময় স্মৃতিতে।
গল্প, উপন্যাস, কবিতা, প্রবন্ধ, সমালোচনা, অনুবাদ, শিশুসাহিত্য ইত্যাদি ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য কৃতিত্ব দেখান তিনি। বিভিন্ন সময়ে সাহিত্য-সাময়িকপত্র সম্পাদনাও করেন। বাংলাদেশের কথাসাহিত্যে তিনি এক সফল লেখক। জীবনের বহু বিচিত্র অভিজ্ঞতাকে তিনি গল্প-উপন্যাস রচনায় কাজে লাগিয়েছেন। তার আখ্যানমূলক রচনায় বাংলাদেশের মানুষের আশা-আকাঙ্ক্ষা, বেঁচে থাকার অনুপ্রেরণা, মুক্তিকামনা ও স্বাধীনতাস্পৃহা এবং সামাজিক অসঙ্গতি ও বৈষম্যের চিত্র রূপায়িত হয়েছে। সাহসী উচ্চারণে ও বুদ্ধির দীপ্তিতে তিনি ছিলেন সমৃদ্ধ।
আহমদ ছফার রচনাবলী:
আহমদ ছফা রচনা করেছেন- সূর্য তুমি সাথী (১৯৬৭), উদ্ধার (১৯৭৫), একজন আলী কেনানের উত্থান পতন (১৯৮৯), অলাতচক্র (১৯৯০), ওঙ্কার (১৯৯৩), গাভীবৃত্তান্ত (১৯৯৪), অর্ধেক নারী অর্ধেক ঈশ্বরী (১৯৯৬), পুষ্পবৃক্ষ ও বিহঙ্গপুরাণ (১৯৯৬) উপন্যাস এবং নিহত নক্ষত্র (১৯৬৯) গল্পগ্রন্থ। কবিতায়ও আহমদ ছফার স্বতন্ত্রতা রয়েছে। জল্লাদ সময়, একটি প্রবীণ বটের কাছে প্রার্থনা, লেনিন ঘুমোবে এবার ইত্যাদি একাধিক কাব্যগ্রন্থের প্রণেতা তিনি।
জার্মান কবি গ্যেটের বিখ্যাত কাব্য ফাউস্ট-এর অনুবাদ এবং বার্ট্রান্ড রাসেলের সংশয়ী রচনার বাংলা রূপান্তর আহমদ ছফাকে অনুবাদক হিসেবেও খ্যাতি এনে দিয়েছে। গবেষক ও প্রাবন্ধিক হিসেবেও তার অবদান অনবদ্য।
আহমদ ছফার গবেষণার বিষয় ছিল বাঙালি মুসলমান সমাজ। এ সমাজের গঠন, বিকাশ, জাগরণ ও প্রতিষ্ঠা এবং বুদ্ধিবৃত্তির পরিচর্যা নিয়ে শুধু চিন্তাই করেননি তিনি, এক অসামান্য কৃতিত্বপূর্ণ বিশ্লেষণও উপস্থাপন করেছেন। বুদ্ধিবৃত্তির নতুন বিন্যাস (১৯৭৩) ও বাঙালি মুসলমানের মন (১৯৭৬) নামক গ্রন্থদ্বয়ের পাতায় পাতায় সে স্বাক্ষর বিদ্যমান।
সমাজ, রাজনীতির পাশাপাশি ইতিহাসের প্রতিও আহমদ ছফা সমান আগ্রহী ছিলেন। ‘সিপাহি যুদ্ধের ইতিহাস’ তেমনি একটি রচনা। জাতীয় অধ্যাপক আবদুর রাজ্জাকের সঙ্গে আলাপচারিতায় রচিত ‘যদ্যপি আমার গুরু’ সমাজ, শিক্ষা, সংস্কৃতির রূপান্তরকে চিত্রিত্র করেছে।
প্রতিবাদী আহমদ ছফা বিভিন্ন আর্থসামাজিক, সাংস্কৃতিক ইস্যুতে লড়েছেন, করেছেন সংগঠন। লেখকের দায় ও দায়িত্বকে তিনি রাজপথ পেরিয়ে বৃহত্তর সমাজে সম্প্রসারিত করেছেন। বাংলাদেশের লেখালেখির জগতে আলাদা ও স্বতন্ত্র অবস্থানের মতো ব্যক্তিত্বের দিক থেকে তার উপমা তিনি নিজেই।
সক্রেটিস যে সবার আগে নিজেকে চিনতে বলেছেন, আবিষ্কার করতে বলেছেন, আহমদ ছফাও নিজেকে চিনতে পেরেছেন, আবিষ্কার করতে পেরেছেন। সমাজ তার মূল্য না বুঝলেও তিনি নিজের মূল্য বুঝেছেন। এজন্যই তিনি তার ‘অর্ধেক নারী, অর্ধেক ঈশ্বরী’ গ্রন্থে বলেছেন, “আমার নিজের কাজের মূল্য আছে, তার স্বীকৃতি অন্যেরা দিতে কুণ্ঠিত হয়,আমি বসে থাকবো কেনো? কেউ না দেখুক, আমি তো নিজে আমাকে দেখছি!” (পৃষ্ঠা- ১১৯)
ছফার লেখার আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো তারুণ্য। তরুণদের কর্মকাণ্ড তাকে সবসময় ভাবিয়ে তুলতো। এ প্রসঙ্গে তিনি আর ‘নিহত নক্ষত্র’ গ্রন্থে বলেছেন, “রাজনীতিবিদেরা যুবকদের সমাজ পরিবর্তনের কাজে না লাগিয়ে, তোষামোদের কাজে লাগিয়েছে। তাতে করে যুবশক্তির মেরুদণ্ড ভেঙে দিয়েছে। এ স্যাঁতসেঁতে পরিবেশ থেকে বাঁচতে হলে একেকজন যুবককে একেকটি পারমানবিক বোমার মতো বিস্ফোরণক্ষম হতে হবে।” (পৃষ্ঠা- ২৭)
জাতির এই ক্রান্তিকালে একজন আহমদ ছফার শূন্যতা আমাকে মিলিয়ে আমাদের কী ভাবাচ্ছে? এই প্রজন্ম কি ছফার মতো প্রতিবাদী হতে পেরেছে?
লেখক: কলামিস্ট
সারাবাংলা/এসবিডিই