বাংলাদেশে সমাজবিজ্ঞান চর্চা: একটি সংক্ষিপ্ত পর্যালোচনা
৩০ জুন ২০২৪ ১৬:৪৩
বাংলাদেশে সমাজবিজ্ঞান চর্চার একটি দীর্ঘ এবং সমৃদ্ধ ইতিহাস রয়েছে। সমাজবিজ্ঞান এমন একটি বিদ্যা যা সমাজ, সংস্কৃতি, সম্পর্ক এবং সামাজিক কাঠামো নিয়ে বিশদভাবে আলোচনা করে। এই শাস্ত্রের মাধ্যমে আমরা সমাজের বিভিন্ন দিক, যেমন অর্থনৈতিক অবস্থা, রাজনৈতিক ক্ষমতা, ধর্মীয় বিশ্বাস, এবং সামাজিক আচরণ সম্পর্কে গভীরতর ধারণা লাভ করতে পারি। বাংলাদেশে সমাজবিজ্ঞান চর্চার শুরু হয়েছিল ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক আমলে, এবং এটি স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে আরও বিস্তৃত এবং গভীরতর হয়েছে।
বাংলাদেশে সমাজবিজ্ঞানের প্রাতিষ্ঠানিক চর্চা শুরু হয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ১৯৫৭ সালে সমাজবিজ্ঞান বিভাগ প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে। এরপর থেকে, সমাজবিজ্ঞানের বিভিন্ন শাখায় গবেষণা ও শিক্ষা কার্যক্রম ব্যাপকভাবে প্রসারিত হয়েছে। বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় ও গবেষণা প্রতিষ্ঠান সমাজবিজ্ঞানকে উন্নত করার জন্য কাজ করে যাচ্ছে, যার ফলে সমাজবিজ্ঞানের মানোন্নয়ন এবং গবেষণার ক্ষেত্র বৃদ্ধি পাচ্ছে।
বাংলাদেশের সমাজবিজ্ঞানীরা বিভিন্ন সামাজিক সমস্যার ওপর গুরুত্ব দিয়ে গবেষণা পরিচালনা করেছেন। তারা গ্রামীণ সমাজের সমস্যা, নারীর অধিকার ও ক্ষমতায়ন, জনসংখ্যা সমস্যা, পরিবেশগত পরিবর্তন, এবং দারিদ্র্য বিমোচন নিয়ে কাজ করেছেন। এ সমস্ত গবেষণা দেশের নীতিনির্ধারণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। বিশেষত, নারীর ক্ষমতায়ন এবং গ্রামীণ উন্নয়ন নিয়ে গবেষণার মাধ্যমে বাংলাদেশের সমাজবিজ্ঞানীরা আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে পরিচিতি লাভ করেছেন।
সমাজবিজ্ঞান চর্চার অন্যতম একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক হল, এটি সমাজের বিভিন্ন স্তরের মানুষের জীবনের বাস্তবতাকে বিশ্লেষণ করে। এই শাস্ত্রের মাধ্যমে আমরা বুঝতে পারি কিভাবে সামাজিক কাঠামো এবং সাংস্কৃতিক প্রভাব মানুষের জীবনে প্রভাব ফেলে। উদাহরণস্বরূপ, বাংলাদেশের গ্রামীণ সমাজের পিতৃতান্ত্রিক কাঠামো এবং ধর্মীয় প্রভাব কিভাবে নারীর জীবনে প্রভাব ফেলছে, তা সমাজবিজ্ঞানের গবেষণার মাধ্যমে উদঘাটিত হয়েছে।
বাংলাদেশে সমাজবিজ্ঞান চর্চার আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ দিক হল, এটি বিভিন্ন সামাজিক আন্দোলনের সঙ্গে নিবিড়ভাবে জড়িত। ভাষা আন্দোলন, মুক্তিযুদ্ধ, এবং পরবর্তী সময়ের বিভিন্ন সামাজিক আন্দোলনে সমাজবিজ্ঞানীরা তাদের গবেষণা এবং তত্ত্বের মাধ্যমে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখেছেন। সমাজবিজ্ঞানীরা কেবলমাত্র সমাজের সমস্যাগুলো বিশ্লেষণ করেন না, তারা সমাজের পরিবর্তনের জন্য নীতি এবং কৌশলও প্রস্তাব করেন।
বর্তমান সময়ে বাংলাদেশে সমাজবিজ্ঞান চর্চার আরও বিস্তৃতি ঘটেছে। তথ্যপ্রযুক্তির উন্নয়নের ফলে সমাজবিজ্ঞানের গবেষণা এবং তথ্য সংগ্রহের পদ্ধতি আরও উন্নত হয়েছে। বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থার সহযোগিতায় বাংলাদেশের সমাজবিজ্ঞানীরা বৈশ্বিক সমস্যাগুলো নিয়ে কাজ করছেন, যা তাদের গবেষণাকে আরও সমৃদ্ধ করেছে।
সামগ্রিকভাবে, বাংলাদেশে সমাজবিজ্ঞান চর্চা একটি গুরুত্বপূর্ণ এবং প্রয়োজনীয় শাস্ত্র হিসেবে বিকশিত হয়েছে। এটি দেশের সামাজিক, অর্থনৈতিক, এবং রাজনৈতিক সমস্যাগুলোকে বিশ্লেষণ করে এবং সমাধানের পথে এগিয়ে নিয়ে যায়। সমাজবিজ্ঞান চর্চার মাধ্যমে বাংলাদেশের সমাজবিজ্ঞানীরা কেবলমাত্র দেশের নয়, বিশ্বব্যাপী সমাজবিজ্ঞানের উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখে চলেছেন।
তবে, বাংলাদেশে সমাজবিজ্ঞান চর্চার ক্ষেত্রে বিভিন্ন সমস্যা বিদ্যমান, যা সমাজবিজ্ঞানীদের গবেষণা ও শিক্ষা কার্যক্রমে বাধা সৃষ্টি করছে। এসব সমস্যা চিহ্নিত করা এবং তাদের সমাধানের উপায় খুঁজে বের করা সমাজবিজ্ঞান চর্চার উন্নয়নের জন্য অপরিহার্য।
প্রথমত, অর্থায়নের অভাব একটি বড় সমস্যা। সমাজবিজ্ঞানের গবেষণার জন্য পর্যাপ্ত তহবিলের অভাব রয়েছে, যা গবেষকদের কাজকে সীমিত করে। সরকারি এবং বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের তরফ থেকে সমাজবিজ্ঞানের গবেষণায় পর্যাপ্ত বিনিয়োগ করা হয় না, ফলে গবেষণার মান ও ব্যাপ্তি প্রভাবিত হয়। এছাড়া, আন্তর্জাতিক গবেষণা অনুদান পাওয়ার প্রক্রিয়াও জটিল এবং সময়সাপেক্ষ।
দ্বিতীয়ত, প্রশিক্ষণের অভাব একটি বড় প্রতিবন্ধকতা। সমাজবিজ্ঞান চর্চায় সংশ্লিষ্ট গবেষক ও শিক্ষকদের জন্য পর্যাপ্ত প্রশিক্ষণ ও উন্নয়ন কার্যক্রমের অভাব রয়েছে। নতুন গবেষণা পদ্ধতি এবং তথ্যপ্রযুক্তির ব্যবহার সম্পর্কে অনেক শিক্ষক এবং গবেষক সঠিক ধারণা রাখেন না। এর ফলে গবেষণার গুণগত মান হ্রাস পায় এবং আন্তর্জাতিক মানের সঙ্গে প্রতিযোগিতা করা কঠিন হয়ে পড়ে।
তৃতীয়ত, গবেষণা অবকাঠামোর অভাবও একটি বড় সমস্যা। বাংলাদেশে বেশিরভাগ বিশ্ববিদ্যালয়ে এবং গবেষণা প্রতিষ্ঠানে পর্যাপ্ত গবেষণা সুবিধা নেই। উন্নতমানের গ্রন্থাগার, তথ্যভাণ্ডার, এবং গবেষণাগার সুবিধার অভাব গবেষকদের কাজকে জটিল এবং সময়সাপেক্ষ করে তোলে। এর ফলে, গবেষণা কার্যক্রমে বিলম্ব হয় এবং অনেক সময় মানসম্মত গবেষণা সম্ভব হয় না।
চতুর্থত, নীতি নির্ধারণ এবং বাস্তবায়নের মধ্যে সমন্বয়ের অভাব রয়েছে। সমাজবিজ্ঞান চর্চার উন্নয়নের জন্য প্রণীত নীতিমালা এবং তাদের সঠিক বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে ঘাটতি দেখা যায়। সরকারের বিভিন্ন সংস্থা এবং শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে সমন্বয়হীনতা সমাজবিজ্ঞান চর্চার উন্নয়নে বাধা সৃষ্টি করে। এছাড়া, রাজনৈতিক প্রভাব এবং অটোক্রেসির কারণে অনেক সময় গবেষণার স্বাধীনতা ব্যাহত হয়।
পঞ্চমত, শিক্ষার্থীদের মধ্যে সমাজবিজ্ঞান বিষয়ে আগ্রহের অভাব রয়েছে। অনেক শিক্ষার্থী সমাজবিজ্ঞানকে ক্যারিয়ারের ক্ষেত্রে উচ্চ মূল্যায়ন করে না। তাদের মধ্যে অনেকেই মনে করেন যে সমাজবিজ্ঞানে ক্যারিয়ারের সুযোগ সীমিত এবং আর্থিক লাভ কম। এর ফলে, মেধাবী শিক্ষার্থীরা সমাজবিজ্ঞান বিষয়ে আগ্রহ হারিয়ে ফেলেন এবং অন্য বিষয়গুলোতে মনোনিবেশ করেন।
এছাড়াও, গবেষণার ফলাফল প্রয়োগের ক্ষেত্রেও সমস্যা রয়েছে। সমাজবিজ্ঞানের গবেষণা প্রায়ই প্রাতিষ্ঠানিক নীতি নির্ধারণে এবং সমাজের উন্নয়নের ক্ষেত্রে পর্যাপ্ত প্রয়োগ হয় না। গবেষণার ফলাফল প্রায়ই প্রয়োজনীয় কর্মপন্থায় রূপান্তরিত হয় না, ফলে গবেষণার ব্যবহারিক মূল্য সীমিত থেকে যায়।
সমাজবিজ্ঞান চর্চার এই সমস্যাগুলো সমাধানের জন্য বিভিন্ন পদক্ষেপ নেওয়া প্রয়োজন। প্রথমত, গবেষণার জন্য পর্যাপ্ত তহবিলের ব্যবস্থা করতে হবে এবং গবেষকদের জন্য প্রশিক্ষণ ও উন্নয়ন কার্যক্রম চালু করতে হবে। দ্বিতীয়ত, উন্নতমানের গবেষণা অবকাঠামো গড়ে তোলা এবং তথ্যপ্রযুক্তির ব্যবহারে দক্ষতা বৃদ্ধি করতে হবে। তৃতীয়ত, নীতি নির্ধারণ এবং বাস্তবায়নের মধ্যে সমন্বয় নিশ্চিত করতে হবে এবং গবেষণার ফলাফল কার্যকরভাবে প্রয়োগের ব্যবস্থা করতে হবে। অবশেষে, শিক্ষার্থীদের মধ্যে সমাজবিজ্ঞান বিষয়ে আগ্রহ বাড়ানোর জন্য সচেতনতা কার্যক্রম চালু করতে হবে এবং সমাজবিজ্ঞানকে ক্যারিয়ারের ক্ষেত্রে আরো আকর্ষণীয় করে তুলতে হবে।
এভাবে, বাংলাদেশের সমাজবিজ্ঞান চর্চার সমস্যাগুলো চিহ্নিত করে এবং তাদের সমাধানের উপায় খুঁজে বের করে আমরা সমাজবিজ্ঞানের উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারি।
লেখক: সহকারী অধ্যাপক, সমাজবিজ্ঞান বিভাগ, তেজগাঁও কলেজ, ঢাকা
সারাবাংলা/এসবিডিই
বাংলাদেশে সমাজবিজ্ঞান চর্চা: একটি সংক্ষিপ্ত পর্যালোচনা মুক্তমত মো. বজলুর রশিদ