রথযাত্রার ইতিহাস ও তাৎপর্য
৭ জুলাই ২০২৪ ১৭:০৭
কথায় বলে, রথ দেখা আর কলা বেচা। সামনেই রথযাত্রা। আর রথযাত্রা সনাতন ধর্মাবলম্বীদের এক ভক্তিপূর্ণ উৎসব। বারো মাসে তের পার্বণের দেশ বাংলাদেশ। আর সনাতন ধর্মের রয়েছে নানা পূজা, উৎসব আয়োজন। এর মধ্যে প্রতিবছর মহাধুমধামের সাথে পালিত হয় রথযাত্রা। রথযাত্রা বা রথদ্বিতীয়া একটি আষাঢ় মাসে আয়োজিত অন্যতম প্রধান হিন্দু উৎসব। বিশাল কাঠের চাকার উপর সাজানো রথের উপর উপবিষ্ট থাকেন জগন্নাথদেব, বলরাম এবং সুভদ্রা দেবী। জগন্নাথ দেবসহ এই তিন দেব সাতদিনের জন্য রথে চড়ে মাসীর বাড়ি যান এবং সাত দিন পর ফিরে আসেন রথে চড়েই। পুরাণে এমনটা বর্ণিত যে, তাদের তিন ভাইবোনের ঘনিষ্ঠ এবং স্নেহপরায়ণ সম্পর্কের জন্যই তাঁরা পূজনীয়। রথযাত্রাও তাদেরকে কেন্দ্র করেই। এই হলো রীতি। বলা ভালো, জগন্নাথ দেব হলেন বিষ্ণু এবং নারায়ণেরই এক রুপ। একদিকে ঝুম বৃষ্টি অন্যদিকে জগন্নাথদেবকে রথে চড়িয়ে যাত্রা এ এক অনন্য পার্বণ। বাংলাদেশসহ ভারতে ব্যাপক উৎসাহে রথযাত্রা উদযাপন করা হয়। সবচেয়ে বড় এবং ঐতিহ্যবাহী রথযাত্রা অনুষ্ঠিত হয় পুরীতে। তবে গত কয়েক বছর ধরে ইসকনের (আন্তর্জাতিক কৃষ্ণভাবনামৃত সংঘ) আয়োজনে সারা বিশ্বেই এই রথযাত্রা অনুষ্ঠিত হচ্ছে। পুরীর রথযাত্রা ছাড়াও পশ্চিমবঙ্গের পূর্ব মেদিনীপুরের মহিষাদল, শ্রীরামপুর শহরের মাহেশের রথযাত্রা, গুপ্তিপাড়ার বৃন্দাবনচন্দ্র মঠের রথ, কলকাতার রথ এবং বাংলাদেশের ইসকনের রথ ও ধামরাই জগন্নাথ রথ বিশেষ প্রসিদ্ধ। অন্যান্য দেবতার থেকে গড়নে একটু আলাদা জগন্নাথ দেব, সুভদ্রা ও বলরামের। এ নিয়ে ব্যাখাও রয়েছে। কঠোপনিষদে বলা হয়েছে, “না আত্মানং রথিনংবিদ্ধি শরীরং রথমেবতু”। অর্থাৎ, এই দেহই রথ আর আত্মা দেহরূপ রথের রথী। ঈশ্বর থাকেন অন্তরে। তার কোনো রূপ নেই। তিনি সর্বত্র বিরাজী। বেদ বলছে, “অবাঙমানসগোচর”। অর্থাৎ, মানুষ বাক্য এবং মনের অতীত। মানুষ তাই তাকে মানবভাবে সাজায়। এ বিষয়ে কৃষ্ণ যজুর্বেদিয় শ্বেতাশ্বতর উপনিষদের তৃতীয় অধ্যায়ে বলা হয়েছে- তার লৌকিক হস্ত নাই, অথচ তিনি সকল দ্রব্য গ্রহণ করেন। তার পদ নাই, অথচ সর্বত্রই চলেন। তার চোখ নাই, অথচ সবই দেখেন। কান নাই, কিন্তু সবই শোনেন। তাকে জানা কঠিন, তিনি জগতের আদিপুরুষ। এই বামনদেবই বিশ্বাত্মা, তার রূপ নেই, আকার নেই। ঈশ্বরের রুপ যে কোনো হতে পারে। তাই সেটি বড় কথা নয়।
ইতিহাস থেকে জানা যায়, উড়িষ্যার প্রাচীন পুঁথি ‘ব্রহ্মা-পুরাণ’ এ জগন্নাথদেবের রথযাত্রার ইতিহাস প্রসঙ্গে বলা হয়েছে যে, এই রথযাত্রার প্রচলন হয়েছিল প্রায় সত্যযুগে। সে সময় উড়িষ্যা মালবদেশ নামে পরিচিত ছিল। সেই মালবদেশের সূর্যবংশীয় পরম বিষ্ণুভক্ত রাজা ইন্দ্রদ্যুম্ন স্বপ্নাদিষ্ট হয়ে ভগবান বিষ্ণুর জগন্নাথরূপী মূর্তি নির্মাণ করেন এবং রথযাত্রারও স্বপ্নাদেশ পান। পরবর্তীতে তাঁর হাত ধরেই পুরীতে জগন্নাথ মন্দির নির্মাণ ও রথযাত্রার প্রচলন শুরু হয়। বাংলায় রথ প্রচলনের আবার ভিন্ন প্রেক্ষাপট। পুরাবিদদের মতানুযায়ী, পুরীর জগন্নাথদেবের রথযাত্রা থেকে বাংলায়ও রথযাত্রার সূচনা৷ চৈতন্য মহাপ্রভু নীলাচল থেকে এই ধারাটি বাংলায় নিয়ে আসেন। চৈতন্যভক্ত বৈষ্ণবরা বাংলায় পুরীর অনুকরণে রথযাত্রার প্রচলন করেন। । অন্যদিকে, এর কাছাকাছি আরেকটি মিথও প্রচলিত আছে জগন্নাথদেবকে ঘিরে। লোকমুখে শোনা যায়, শ্রী কৃষ্ণ তাঁর ভক্ত রাজা ইন্দ্রদ্যুম্নের সম্মুখে আবির্ভূত হয়ে পুরীর সমুদ্রতটে ভেসে আসা একটি কাষ্ঠখ- দিয়ে তাঁর মূর্তি নির্মাণের আদেশ দেন।
মূর্তি নির্মাণের জন্য রাজা যখন একজন উপযুক্ত কাষ্ঠশিল্পীর সন্ধান করছেন, ঠিক তখন এক রহস্যময় বৃদ্ধ ব্রাহ্মণ কাষ্ঠশিল্পী তাঁর সম্মুখে উপস্থিত হন। তিনি রাজার কাছে মূর্তি নির্মাণের জন্য কয়েকদিন সময় চেয়ে নেন এবং জানিয়ে দেন, নির্মাণকালে কেউ যেন তাঁর কাজে বাধা না দেন। দরজার আড়ালে কাষ্ঠমূর্তি নির্মাণ শুরু হয়। রাজা-রানীসহ সকলেই নির্মাণকাজের ব্যাপারে অত্যন্ত কৌতূহলী হয়ে ওঠেন। প্রতিদিন তাঁরা বন্ধ দরজার কাছে যেতেন ভেতর থেকে খোদাইয়ের আওয়াজ শুনতে। কিছুদিন বাদে রাজা বাইরে দাঁড়িয়ে আছেন, এমন সময় আওয়াজ বন্ধ হয়ে যায়। অত্যুৎসাহী রানী কৌতূহল সংবরণ করতে না পেরে দরজা খুলে ভেতরে প্রবেশ করেন। তখন তারা দেখেন মূর্তি অর্ধসমাপ্ত এবং কাষ্ঠশিল্পী অন্তর্ধিত। এই রহস্যময় কাষ্ঠশিল্পী ছিলেন দেবশিল্পী বিশ্বকর্মা। মূর্তির হস্তপদ নির্মিত হয়নি বলে রাজা মুষড়ে পড়লেন, কাজে বাধাদানের জন্য অনুতাপ করতে থাকলেন। তখন দেবর্ষি নারদ রাজাকে সান্ত¡না দিয়ে বলেন, এই অর্ধসমাপ্ত মূর্তিই পরমেশ্বরের এক স্বীকৃত স্বরূপ। তিনি এমন রূপই চেয়েছিলেন। এভাবেই জগন্নাথ দেবের আবির্ভাব ঘটে।
রথযাত্রা দুটি সংস্কৃত শব্দ থেকে উদ্ভূত হয়েছে, ‘রথ’ শব্দের আভিধানিক অর্থ অক্ষ, যুদ্ধযান বা কোনোপ্রকার যানবাহন অথবা চাকাযুক্ত ঘোড়ায় টানা হালকা যাত্রীবাহী গাড়ি। এই রথে চড়েই মহাভারতের মহারথীরা যুদ্ধ করেছিলেন। স্বয়ং ভগবান শ্রীকৃষ্ণ ছিলেন মহাবীর শ্রেষ্ঠ ধনুর্ধারী অর্জুনের রথের সারথী। সে যুদ্ধে হয়েছিল সত্যের বিজয়। সে অন্য ইতিহাস। তবে রথের ব্যাপক ব্যাবহার দেখা যায় সেখানে। অন্যদিকে জগন্নাথ শব্দটির ব্যুৎপত্তিগত অর্থ “জগৎ” বা বিশ্বব্রহ্মা-ের প্রভু”। “জগন্নাথ” কথাটি তৎপুরুষ সমাস। এটি “জগৎ” ও “নাথ” শব্দের সংমিশ্রণ গঠিত। যেমন “জগৎ” (যার মূল ধাতু “গম্”, অর্থাৎ “যা কিছু চলে”) এবং (“নাথ” অর্থাৎ, প্রভু বা আশ্রয়) শব্দটির সংমিশ্রণে গঠিত। সুতরাং “জগন্নাথ” অর্থ “যিনি এই বিশ্বব্রহ্মান্ডের আশ্রয় চলমান জগতের আশ্রয়দাতা অর্থাৎ প্রভু”। মোট কথা জগন্নাথ অর্থ হলো জগতের নাথ বা জগতের অধীশ্বর যিনি এই পৃথিবী চালনা করছেন।
রথযাত্রা প্রচলনের পিছনেও রয়েছে এক ইতিহাস। আষাঢ় মাসের শুক্ল দ্বিতীয়ায় বলরাম ও বোন সুভদ্রার সঙ্গে মাসির বাড়ি যান জগন্নাথ। মাসির বাড়ি অর্থাৎ ইন্দ্রদ্যুম্নের পতœী গুন্ডিচার বাড়ি। সেখান থেকে আবার সাতদিন পর মন্দিরে ফিরে আসেন জগন্নাথ। এটাকেই জগন্নাথ দেবের মাসির বাড়ি যাওয়া বলে। পরপর তিনটি সুসজ্জিত রথে চেপে মাসির বাড়ির উদ্দেশ্যে যান জগন্নাথ। এই যাওয়াকে সোজা রথ আর ফিরে আসাকে উল্টো রথ বলে। পুরীতে রথ টানতে প্রতি বছর লক্ষাধিক পূণ্যার্থীর সমাগম হয়। এখানে তিন দেবতাকে গু-িচা মন্দিরে জগন্নাথদেবের মাসির বাড়ি নিয়ে যাওয়া হয়। রথযাত্রা নিয়ে কবি গুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের একটা কবিতা আছে…
রথযাত্রা, লোকারণ্য, মহা ধুমধাম,
ভক্তেরা লুটায়ে পথে করিছে প্রণাম।
পথ ভাবে আমি দেব রথ ভাবে আমি,
মূর্তি ভাবে আমি দেব-হাসে অন্তর্যামী।”
বিশ্বকবি যে রথযাত্রার কথা কবিতায় লিখেছেন, সে রথযাত্রার রয়েছে সুদীর্ঘ ইতিহাস। সে ইতিহাসে আছে কল্পকাহিনী আর পুরাণের মিশেল, আছে ধর্মীয় ভাবগাম্ভীর্য আর আচার-প্রথার বর্ণনা। সেই ধর্মীয় ভাবগাম্ভীর্য নিয়েই আজও রথযাত্রা অনুষ্ঠিত হযে আসছে। যেখানে মিশে যাবে ভক্ত আর ভগবান।
লেখক: কলামিস্ট
সারাবাংলা/এসবিডিই