Saturday 23 Nov 2024
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

বাঙালির আজগুবি মন

মনোয়ার পারভেজ
৭ জুলাই ২০২৪ ১৭:১৫

বাঙালির পরিচয় দিতে গিয়ে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বলেছেন, ‘বাঙলা দেশে জন্মিয়াছে বলিয়াই যে সে বাঙালি তা নয়, বরং সে বাঙলা ভাষা ও সংস্কৃতির মধ্য দিয়া চিত্তলোকে যাতায়াত করিতেছে বলিয়াই, তাহারা বাঙালী।’ বাঙালির ইতিহাস ঐতিহ্য সবকিছুই স্বর্ণাক্ষরে লেখা আছে আছে। অথচ বাঙালি হিশাবে আমরা বলতে গেলে প্রায়ই অকৃতজ্ঞ জাতি, যাদের মন একটা আজগুবি ধরনের। বলা চলে আজব বাঙালির আজব লীলা। এই কথা বলতে খারাপ লাগলেও এটাই সত্যি ! কখন যে শত্রুর জন্য শোকসভা করি আবার কখন যে ইতিহাসের বীরকে তুচ্ছ করে ফেলি আর নয়তো ভুলে যাই তাঁর কোনো ঠিক ঠিকানা নেই। আমরা প্রয়োজনে খুব সহজেই ইতিহাসের বীরদের কৃতিত্বের অবদান ভুলে যাই। আবার দেখা যায় যে ইতিহাসের বিলেন বা খল নায়ককে মাথায় করে নাচতে থাকি। এজন্যই বলতে হয় আমাদের বাঙালিদের মন বা কার্যক্রম এক প্রকার আজগুবি মনের মতো। কখন যে কি করি তার কোনো ইয়াত্তা নেই। তবে যাই করিনা কেন কৃতিত্বের অবদানের কথা যখন আমরা ভুলে যাই সেটা আমাদের জন্য খুব লজ্জাজনক ও হতাশাজনক বটে। হুমায়ূন আজাদ বলেছেন, ‘মানুষের ওপর থেকে বিশ্বাস হারানো পাপ, তবে বাঙালির ওপর বিশ্বাস রাখা আরো বেশি বিপদজনক।’ বাঙালির আজগুবি মনের দিকে খেয়াল করলে হুমায়ূন আজাদের এই কথাটির সাথে মিল পাওয়া। সুতরাং বলা চলে বাঙালির ওপর পুরোপুরি ভরসা রাখতে নেই, আবার ভরসা হারালেও ভুল হতে পারে !

বিজ্ঞাপন

বাংলাদেশের ইতিহাস হয়তো খুব অল্প দিনের তবুও কম নয় কিন্তু বাঙালির ইতিহাস দীর্ঘ দিনের। কেননা বাঙালির ইতিহাস কিন্তু ১৯৭১ বা ১৯৪৭এ শুরু হয় নি। বাঙালির ইতিহাস আরও প্রাচীন। ইতিহাসের পাতায় খোঁজ খবর নিলে দেখা যাবে আমাদের আছে কত গৌরবময় ইতিহাস ও দুঃসাধ্য অর্জন আবার আজগুবি কত শত কার্যক্রম। বাঙালির ইতিহাস নিয়ে সমরনাথ কুণ্ডুর মতে, ‘বাঙালীদের বীরত্বের ইতিহাসের শুরু তো আজকে নয়। সেই তো কবে থেকেই বাঙালির লড়াই শুরু। দিনে দিনে তা শুধু রং পাল্টে নতুন মোড়ক ধারণ করেছে। আর কিছু না।’ একদম ঠিক তাই। তবে আমাদের বাঙালিদের আজগুবি মন ও কিছু ছোট ছোট ভুলের নিমিত্তেই ধরা চলে আমাদেরকে কিছু কিছু সহজ যায়গায়ও ব্যার্থ হতে হয়েছে। উদাহরণ হিশেবে বলা যায় আমাদের কিছু ভুলের নিমিত্তেই ইংরেজ শাষনের উপর থাকতে হয়েছে প্রায় ২০০ বছর। কেননা সিরাজউদ্দৌলার পরাজয়ে আমাদের বাঙালিদের কিছু ভুল অবশ্যই ছিল। সিরাজউদ্দৌলাকে যখন ব্রিটিলরি নৌকা পথে নিয়ে যায় তখন তাদের মাত্র তিনটি নৌকার বিপরীতে নদীর দুই পাড়ে হাজার হাজার জনতা শুধুমাত্র চেয়েই দেখেছে ! তাদের তখন যেন কিছুই করার ছিল। তাদের কিছু না করতে পারার পিছনে অবশ্য একটি কারণ আছে। কেননা নেতৃত্বহীন বাঙালি আসলে ভঙ্গুরে। তখন বাঙালির নেতৃত্ব দেওয়ার মতো কেউ ছিল না, আর তারাও তখন নেতৃত্বের আশায় বসে থেকে নিজে থেকে আর তাদের নিজে থেকে করার কিছুই ছিল না ! এখন এই লেখা ও কথার মূল প্রেক্ষাপটে আরেকটি কথা এখানে পরিস্কার করে রাখা উচিত। বাঙালি বলতে কিন্তু শুধুমাত্র বাংলাদেশের বাঙালিদের বুঝানো হয়না। যা আমি রবীন্দ্রনাথের কথার মধ্য দিয়ে প্রথমেই বলে দেওয়ার চেষ্টা করেছি। কেননা পৃথিবীতে বাংলা ভাষাভাষী সবাই মিলে আমরা বাঙালি। তবে আমার এই লেখাটি মূলত বিশেষ এক কারণে শুধুমাত্র বাংলাদেশের বাঙালিদের নিয়েই আলোচনা করা। কেননা বাঙালির ইতিহাস নিয়ে আলোচনা করতে গেলে সবাইকে নিয়েই আলোচনা করতে হবে এবং করা যায় কিন্তু যখন বিষয়টি মনের বা আজব কার্যক্রমের আলোচনা সমালোচনার বিষয় আসবে তখন একজন বাংলাদেশী হিশেবে বাংলাদেশের বাঙালিদের আলাদা করাই শ্রেয়। কেননা আমাদের নিজের দোষ গুলোর কারণে সবাইকে এক পাল্লায় বিচার করা উচিত নয়।

বিজ্ঞাপন

প্রাথমিক বিবেচনায় খুব কাছাকাছি সময়ের মধ্যে আমাদের দুটি স্বাধীনতা আছে। একটি ব্রিটিশদের কাজ থেকে ভারত বর্ষের স্বাধীনতা। যখন ভারত বর্ষ স্বাধীন হয় তখন কিন্তু দেশ ভাগ হয়নি। সুতরাং ঐ স্বাধীনতায় আমরাও ভাগিদার। বর্তমান ভারত ঐ দিনকে স্বাধীনতা দিবস উদযাপন করে আসলেও আমাদের কিন্তু আর কোনো সাড়া নেই। আমরা যখন পাকিস্তানের নিকট হতে স্বাধীনতা লাভ করলাম তখন এক স্বাধীনতার আড়ালে অন্য স্বাধীনতার কথা চাপা পড়ে গেছে। যদিও আমার মতে বাংলাদেশের বাঙালিদের উচিত ব্রিটিশদের দখল থেকে মুক্তির কথা স্মরণ করে এই দিনটিকে উদযাপন করা। কিন্তু এই উদযাপন তো চাপা গেছে সেটাতো এক বিষয়, আরও কিন্তু হচ্ছে ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনে আমাদের বীরদের যখন ভুলে যাই সেটাতো তখন লজ্জার। আমাদের চট্টগ্রামের সাহসী বীর মাষ্টারদা সূর্য সেন তখন জীবন দিলেন। কথা হচ্ছে আমরা মাষ্টারদা সূর্য সেন সহ আরও যত বাঙালি ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনের নায়ক আছেন আমরা তাদেরকে কয়জন মনে রাখছি? এটা আমাদের অকৃতজ্ঞতার প্রমাণ। বাঙালি যে একটা নতুন পেয়ে গেলে পুরাতনটাকে ভুলে যাই সেটার প্রমাণ। এইতো সেদিন ৮ সেপ্টেম্বর ২০২২ তারিখে যখন ব্রিটেনের রানী দ্বিতীয় এলিজাবেথ মারা গেলেন তখন সেই রানীর মৃত্যুতে আমাদের দেশে তিন দিনের রাষ্ট্রীয় শোক ঘোষণা করলাম। এদেশে শত্রুর বংশধরদের জন্য রাষ্ট্রীয় শোক ঘোষণা করা যায় অথচ জাতির বীরদেরকে যথাযথভাবে কোনো শোকসভা আয়োজন তো দূরের কথা তাদেরকে স্মরণ করতেও ভুলে যাই অনেক সময় ! এমনকি দ্বিতীয় রানী এলিজাবেথ শুধু শত্রুর বংশধর নন, আমাদের উপর তাদের সম্রাজ্যবাদের সময়েরও একজন। একজন ব্যক্তি এলিজাবেথের মৃত্যুতে আমাদের শোক আছে, কিন্তু কিং জর্জ সিক্সথ এর কন্যা দ্বিতীয় রানী এলিজাবেথের মৃত্যুতে গুষ্ঠিগত শোক বা এতো লম্বা রাষ্ট্রীয় শোক প্রকাশ করাটা ভিন্নতার পরিচয়। মনে তখন প্রশ্ন জাগে, আমরা কি এখনো ব্রিটিশের গোলামি থেকে মুক্ত হতে পারিনি?

আমরা বাঙালিরা বরাবরই অতি আবেগপ্রবণ জাতি। এই অতিরিক্ত আবেগ কখনই ভালো নয়। এইযে ধরুন চলছে কাতার ফুটবল বিশ্বকাপ-২০২২। এই বিশ্বকাপ নিয়ে আমাদের আবেগের শেষ নেই ! আবেগের বশবর্তী হয়ে বিশ্বকাপকে কেন্দ্র করে ভিন্ন দেশের আমরা প্রাণ দিতেও প্রস্তুত, আর নিজেদের মধ্যে তো মারামারি, অশ্লীল গালাগালি আর ভিন্ন দেশের পতাকা তৈরির এক অসুস্থ প্রতিযোগিতা তো আছেই। এটা শুধু এই বিশ্বকাপের চিত্র নয়। বরাবরই এমন। অথচ দেশের স্বার্থে, দেশের জাতীয় ইস্যুতে এই আবেগী বাঙালিদের অধিকাংশেই খোঁজে পাওয়া যাবেনা। উদাহরণ হিশেবে ধরুন, আওয়ামীলীগ চাইলে আগামী আসন্ন ২০২৩ এর ডিসেম্বরের সম্ভাব্য দ্বাদশ সংসদ নির্বাচন এই বিশ্বকাপের সময়েই চালিয়ে নিতে পারতো। বাঙালি তখন বিশ্বকাপের ঘোর কাটিয়ে ঘুম থেকে উঠে দেখতো আওয়ামীলীগ আরও এক মেয়াদে ক্ষমতায় এসে বসে আছে ! তখন দেখবেন কোনো জবাবদিহিতা নেই। আবার সরকার চাইলে এই বিশ্বকাপের মাসে একটা দুর্ভিক্ষ বাধিয়ে দিতে পারে। কেননা দুর্ভিক্ষ এখন বাঙালির কিছুই করতে পারবে না ! বরং তারা ফুটবল বিশ্বকাপে মত্ত হয়ে তখন ফুটবলে খাবে, ফুটবলে ঘুমাবে। অথচ বাঙালির নিজের দেশের ফুটবলটাকে নিয়েও এতোটা চিন্তাভাবনা নেই ! আর বাদ বাকি সবকিছু তো বাদেই দিলাম ! এখন আমার ভাইয়েরা হয়তো বলবেন আমরা ফুটবল বিশ্বকাপে খেলতে না পারলে কি হয়েছে, আমরা তো ক্রিকেট বিশ্বকাপে খেলছি। আমার উত্তর হচ্ছে, ক্রিকেট বিশ্বকাপ আসলে আমাদের নিয়ে আমরা বাঙালি ছাড়া আর কাউকে এতো নাচতে দেখে যায়? আমাদের নিয়ে অন্যরাও কি মারামারি সংঘাতে জড়িয়ে পড়ে, পতাকা বানানো টাঙানো নিয়ে অসুস্থ প্রতিযোগিতায় নাম লেখায়?

ফুটবল বিশ্বকাপের কথা তো মাত্র একটি উদাহরণ মাত্র। আমরা বাঙালিরা আসলে সবসময় আজগুবি বিষয় নিয়েই পড়ে থাকি। সেখানেই আমাদের সব আবেগ ঢেলে দেই। অথচ জাতীয় কত কত ইস্যু তৈরি তখন আর তাদের খোঁজে পাওয়া যায় না। বাঙালি মূলত রং তামাশার ইস্যু নিয়েই ব্যস্ত। সত্যজিৎ রায়ের একটি কথা আছে, ‘বাঙালী তার রসনার পরিচর্যায় যে সময় ব্যায় করে, তার কিয়দাংশও যদি জ্ঞান, বুদ্ধি ও বিজ্ঞান চিন্তায় ব্যবহার করতো, তবে বাঙালী আজ পৃথিবীর বুকে এক অনন্য জাতি হতে পারতো৷’ জ্ঞান, বুদ্ধি ও বিজ্ঞান চিন্তায় তো বাঙালি সময় ব্যয় করছেনা তারচেয়ে বড় কথা হচ্ছে তাদের অধিকাংশেই এখন দেশ-রাষ্ট্র, অর্থনীতি ও রাজনীতি নিয়েও ভালো কোনো চিন্তা নেই। আমাদের রাজনীতিতে এখন কলুষিত অধ্যায় চলছে। রাজনীতি যখন কলুষিত অর্থনীতির অবস্থা তখন নাজেহাল ! বাঙালির এই নিয়ে কোনো মাথা ব্যাথা নেই। অথচ বাঙালিরা যদি তাঁর সঠিক ইস্যুতে অগ্রসর হতে পারতো তাহলে অবশ্যই ভালো কিছু ফলাফল আসতো। কেননা আমাদের এরকম ইতিহাসও আছে। আমরা অনেক দুঃসাধ্য যুদ্ধে গিয়েও সফল হয়েছি। প্রয়োজন সঠিক সময়ে সবার একত্রীকরণ ও অগ্রসর হওয়া। আমরা একত্রিত হতে পারলে কি হতে তাঁর উদাহরণ হিশেবে চোখ দিতে পারেন আমাদের মুক্তিযুদ্ধের দিকে। বাঙালি সাহিত্যিক রাজশেখর বসুর মতে, ‘বাঙালীর হাজার বছরের যে ইতিহাস, তাতে সর্বশ্রেষ্ঠ কৃতিত্ব হলো মুক্তিযুদ্ধ। বাঙালী জাতি একত্রিত হলে যে দা, শাবল, বটি, কুড়াল নিয়েও ট্যাংক, কামানের মোকাবিলা করতে পারে, বাংলাদেশের এই মুক্তিযুদ্ধই তার প্রমাণ।’ এতো ইতিহাস ঐতিহ্য থাকার পরেও আমরা এখন সঠিক ধাচে নেই ! আরেকটি উদাহরণ টেনে এনে সংক্ষেপিত এই লেখাটি এখানেই শেষ করছি। এখানে সংক্ষেপিত বলেছি এই কারণেই যে বাঙালিদের মন নিয়ে লিখতে গেলে আসলে শেষ হবেনা। আর সবকিছু একসাথে শেষ করাও সম্ভব হয়না। উদাহরণ হচ্ছে, যেই বাংলাদেশের বাঙালিরা বায়ান্ন সালে রাষ্ট্রভাষার জন্য জীবন দিল তাদের উত্তরসূরিদের অধিকাংশেই আজ বাংলা চর্চা বাদ দিয়ে ইংরেজিতে কথা বলে ও বিদেশি ভাষায় নিজের স্মার্টনেস খোঁজে আনন্দ পায়। অথচ বায়ান্নর শহীদেরা সেদিন রাষ্ট্র ভাষার জন্য নিজের জীবন উৎসর্গ দিয়ে বাংলায় রাষ্ট্রভাষা বাংলা করে দিয়ে গিয়েছিল। কথা হচ্ছে তাদের প্রতি আমাদের কৃতজ্ঞতা কতটুকু? শুধুই কি একুশে ফেব্রুয়ারি দিনটি আসলে তাদেরকে স্মরণ করা আর দুই একদিনের জন্য ভাষার মায়া দেখানো। অথচ আমাদের সর্বত্র এখন বিদেশি ভাষায় ছড়াছড়ি ! কেউ বাংলায় শুদ্ধভাবে বক্তব্য দিতে পারলে লোকে বলবে এ আর কি, আর ইংরেজিতে দুয়েকটি বক্তব্য দিতে পারলেই তখন বাহবা দেওয়ার লোকের অভাব থাকে না। রাষ্ট্রভাষা বাংলার এইদেশে সম্মান/স্নাতকে বাংলা বিভাগে পড়ুয়া শিক্ষার্থীটি অবহেলায় ও অনিশ্চয়তা দিন পার করে এমনকি তাদেরকে তুচ্ছ করেও দেখা হয়। এই সময়ে এসে মনে হচ্ছে, আমরা বাঙালিরা আসলে মনে প্রাণে বাঙালি হয়ে উঠতে পারিনি। আজব আমাদের কারবার ও মনটা আমাদের আজগুবি।

লেখক: কলামিস্ট

সারাবাংলা/এসবিডিই

বাঙালির আজগুবি মন মনোয়ার পারভেজ মুক্তমত

বিজ্ঞাপন

আরো

সম্পর্কিত খবর