Friday 22 Nov 2024
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

বাংলাদেশের গ্রামীণ সমাজের রূপান্তর

মো. বজলুর রশিদ
১০ জুলাই ২০২৪ ১৪:০৯

বাংলাদেশের গ্রামীণ সমাজে গত কয়েক দশকে ব্যাপক পরিবর্তন এসেছে। দেশের উন্নয়ন ও আধুনিকায়নের ধারাবাহিকতায় গ্রামীণ জীবনযাত্রা, অর্থনীতি এবং সামাজিক কাঠামোতে এই পরিবর্তনের ছোঁয়া লেগেছে। পাকা সড়ক, বিদ্যুৎ সংযোগ, আধুনিক প্রযুক্তি এবং বিভিন্ন উন্নয়ন প্রকল্পের মাধ্যমে গ্রামের চিত্র পাল্টে যাচ্ছে।

বাংলাদেশের গ্রামীণ এলাকায় সড়ক যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নতি সাম্প্রতিক সময়ে অত্যন্ত উল্লেখযোগ্য। গ্রামীণ অভ্যন্তরীণ সড়ক যোগাযোগ অনেক উন্নত হয়েছে এবং এখন প্রায় প্রতিটি গ্রাম পাকা সড়কের সাথে সংযুক্ত। এই সড়ক সংযোগ উন্নয়নের মূল চালক হিসেবে কাজ করছে। সড়ক যোগাযোগের বিস্তৃত প্রভাব জনজীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে পড়েছে। শিক্ষা, স্বাস্থ্য, কৃষি এবং বাণিজ্য সব ক্ষেত্রেই এসেছে অভাবনীয় অগ্রগতি।

বিজ্ঞাপন

গ্রামীণ সড়কগুলো পাকা হওয়ায় ঐতিহ্যবাহী গরুর গাড়ি এখন প্রায় বিলুপ্তির পথে। এর পরিবর্তে ভ্যান, ব্যাটারিচালিত ভ্যান, মোটরসাইকেল ও ছোট লরি বহুল ব্যবহৃত হচ্ছে। এমনকি মাইক্রোবাস ও প্রাইভেট কারও এখন গ্রামে প্রবেশ করছে। ফলে যোগাযোগে এসেছে গতি এবং মানুষের সময় ও ব্যয় কমেছে। গ্রামের মানুষ সার্বক্ষণিক চলাচলের সুযোগ পাচ্ছে।

বাংলাদেশের অধিকাংশ গ্রাম এখন পল্লী বিদ্যুতের আওতায় এসেছে। বিদ্যুৎ সার্বিক জীবনযাত্রা, পরিবহন, ব্যবসা-বাণিজ্য এবং উৎপাদনে ইতিবাচক প্রভাব ফেলছে। চাষাবাদের জন্য গভীর নলকূপে বিদ্যুৎ সংযোগ দেওয়া হচ্ছে। বাড়িতে বিদ্যুৎ সংযোগের ফলে নতুন নতুন চাহিদার সৃষ্টি হচ্ছে। ক্ষুদ্র ও মাঝারি ব্যবসা-বাণিজ্যের প্রসারে বিদ্যুৎ সংযোগ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে। মাছ চাষ, কোল্ড স্টোরেজ এবং বড় বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানগুলো শহর সংলগ্ন গ্রামগুলোতে গড়ে উঠছে।

বিজ্ঞাপন

বাংলাদেশের গ্রামীণ চাষাবাদের ধরণে সাম্প্রতিক পরিবর্তন অত্যন্ত উল্লেখযোগ্য। এক সময়ের একফসলি জমি এখন আধুনিক কৃষি প্রযুক্তি এবং সেচব্যবস্থার উন্নতির ফলে তিন ফসলি জমিতে রূপান্তরিত হয়েছে। ধানের পাশাপাশি এখন আলু, সবজি, ফলমূল, এবং অন্যান্য অর্থকরী ফসল চাষ হচ্ছে, যা কৃষকদের আয় ও খাদ্য নিরাপত্তা বাড়িয়েছে। কৃষিকাজে কম্বাইন্ড হারভেস্টর, ধান মাড়াই মেশিন, এবং গভীর নলকূপের ব্যবহার চাষাবাদকে আরো সহজ এবং ফলনশীল করে তুলেছে। তবে রাসায়নিক সার ও কীটনাশকের ব্যবহার নিয়ে উদ্বেগ থাকলেও, অর্গানিক চাষাবাদের প্রতি আগ্রহ বাড়ছে। এভাবে চাষাবাদে বৈচিত্র্য আনার মাধ্যমে গ্রামীণ অর্থনীতি এবং জীবনযাত্রার মানের উন্নয়ন ঘটছে।

আশির দশকের মাঝামাঝি থেকে গভীর নলকূপ স্থাপনের মাধ্যমে এক ফসলি জমি তিন ফসলি জমিতে উন্নীত হয়েছে। উৎপাদন বৃদ্ধি পাওয়ায় কৃষকের আয় বাড়ছে। খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত হয়েছে। তবে বর্তমানে গভীর নলকূপ ব্যবস্থাপনা, পানির দাম এবং ভূগর্ভস্থ পানির স্তর নিয়ে উদ্বেগ রয়েছে।

জনসংখ্যা বৃদ্ধির ফলে প্রতি বছর আবাদি জমি কমছে। সরকার কৃষিজমি সুরক্ষায় বিশেষ গুরুত্ব দিলেও কার্যকর প্রয়োগ লক্ষ্য করা যাচ্ছে না। খোলা জায়গা, মাঠ ও উন্মুক্ত প্রান্তর সীমিত হয়ে পড়ছে। জমির চাহিদা বাড়ছে অবিশ্বাস্য গতিতে। সরকারি খাসজমির বড় একটা অংশ ক্ষমতাশালীদের দখলে।

আশি বা নব্বইয়ের দশকে গ্রামে রেডিও থাকলেও টেলিভিশন ছিল দুর্লভ। এখন প্রায় প্রতিটি বাড়িতে টেলিভিশন রয়েছে এবং ৬০টি চ্যানেল দেখা যায়। স্কুল, ইউনিয়ন তথ্যকেন্দ্র, কমিউনিটি ক্লিনিক ও পোস্টঅফিসগুলোতে কম্পিউটার সুবিধা চালু হয়েছে। গ্রামে কম্পিউটার শপ এবং মোবাইল প্রযুক্তি ব্যাপক ব্যবহৃত হচ্ছে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ব্যবহারের মাধ্যমে অসংখ্য ভার্চুয়াল কমিউনিটি গড়ে উঠছে এবং সামাজিক এজেন্ডা নিয়ন্ত্রণ করছে।

গ্রামে গেছে ওয়াইফাই ইন্টারনেট সংযোগ। এ সুযোগ শুধু মনোজগত নয়, পোশাক-আশাক ও খাদ্যভ্যাসেও ব্যাপক পরিবর্তন এনেছে। খাদ্যভ্যাসে এসেছে আমূল পরিবর্তন। প্যাকেটজাত খাবার ও কোমল পানীয় এখন স্বাভাবিক খাদ্য হিসেবে দেখা যাচ্ছে। গ্রামের মোড়ে মোড়ে নানা পণ্যের সরগরম বাজার জমে উঠেছে। এক সময় মানুষ স্থানীয় হাটে সপ্তাহে একবার বাজার করত, এখন সেই সুযোগ সারাক্ষণ।

প্রতিটি গ্রামে অধিকাংশ বাড়ি আজ পাকা। শহরের আদলে বাড়ির সঙ্গে অ্যাটাচড বাথরুম ও রান্নাঘর তৈরি হচ্ছে। অধিকাংশ বাড়িতে নিজস্ব ভূগর্ভস্থ পানির নলকূপ রয়েছে।

নব্বইয়ের দশকে গ্রামে খাবার পানির সংকট ছিল। বর্তমানে প্রায় প্রতিটি বাড়িতে নলকূপ রয়েছে। বিশুদ্ধ পানি ব্যবহারের ফলে ডায়রিয়া ও কলেরার প্রকোপ কমেছে।

গৃহের আসবাবপত্র ব্যবহারে অমূল পরিবর্তন এসেছে। মাটির চুলার পরিবর্তে গ্যাসের চুলা, ফ্রিজ, কোথাও কোথাও ওভেন, প্রেশার কুকার ব্যবহার হচ্ছে। গ্রামের মানুষ খেজুরের পাতার পাটির পরিবর্তে ডাইনিং টেবিল ব্যবহার করছে। বাড়িতে চকচকে টাইলস ও টবে বর্ণিল ফুলের গাছ সহজেই চোখে পড়ছে।

আর্থিক সামর্থ্য বাড়ায় এলাকাবাসী তাদের সন্তানদের লেখাপড়া শেখাতে পারছে। এলাকায় গড়ে উঠেছে স্কুল, কলেজসহ নানামুখী শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। সাধারণ শিক্ষায় শিক্ষিতের পরিমাণ বাড়ায় শিক্ষিত বেকারের সংখ্যা বাড়ছে। অনেকে চাকরি না খুঁজে বিভিন্ন প্রজেক্ট ও গরু-ছাগলের খামার করছে। উদ্যোক্তা সৃষ্টির একটি নতুন প্রবণতা লক্ষ্য করা যাচ্ছে।

যুবকদের একটি বড় অংশ মধ্যপ্রাচ্য, মালয়েশিয়ায় শ্রমিক হিসেবে কাজ করছে। বিদেশ থেকে অর্থ আসছে, যা তাদের পরিবারের জীবনমান উন্নত করতে বিশেষ ভূমিকা রাখছে। প্রবাসী শ্রমিকেরা অনেক মূল্যবোধ বয়ে আনছে যা তাদের পরিবার ও নিজস্ব পরিসরেও চর্চিত হচ্ছে।

গ্রামের মানুষ দ্রুত টয়লেট ব্যবস্থার উন্নয়ন করেছে। এক সময় গ্রামের মানুষ টয়লেট বাড়ি থেকে দূরে তৈরি করতে পছন্দ করত, এখন তা শোবার ঘরের সাথে প্রতিস্থাপন করেছে। এখন অধিকাংশ বাড়িতে টয়লেট রয়েছে এবং উন্মুক্ত স্থানে মলত্যাগের প্রবণতা কমেছে।

ব্যাংকিং সুবিধা মানুষের দোরগোড়ায় পৌঁছে গেছে। ডাচ্-বাংলা ব্যাংক, বিকাশ, রকেটসহ বিভিন্ন মোবাইল ব্যাংকিংয়ের সেবা ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়েছে। মানুষ এখন ঘরে বসেই লেনদেন করতে পারছে। কৃষকেরা সহজে ঋণ পাচ্ছে। আর্থিক লেনদেনের পাশাপাশি সামাজিক লেনদেনও বেড়েছে।

গ্রামীণ অর্থনীতি বর্তমানে শহরকেন্দ্রিক চাহিদার সাথে সংযুক্ত হয়েছে। কৃষি পণ্য, পশু পালন, মৎস্য চাষ এবং ক্ষুদ্র শিল্পের বিকাশ ঘটছে। সারা দেশব্যাপী ক্ষুদ্র ঋণ প্রকল্প ও এনজিও গুলোর মাধ্যমে স্থানীয় কর্মসংস্থানের সুযোগ বাড়ছে। কৃষি এবং ক্ষুদ্র শিল্পের উপর নির্ভর করে বহু পরিবার স্বনির্ভর হয়ে উঠেছে। গরু ও মুরগি পালন, মাছ চাষ ও ক্ষুদ্র শিল্পে অধিক সংখ্যক নারী যুক্ত হচ্ছে।

গ্রামীণ এলাকায় স্বাস্থ্যসেবা এখন অনেক উন্নত হয়েছে। কমিউনিটি ক্লিনিক, স্বাস্থ্যকেন্দ্র এবং বেসরকারি হাসপাতালগুলো গ্রামবাসীর জন্য স্বাস্থ্যসেবা প্রদান করছে। স্বাস্থ্যকর্মীদের মাধ্যমে সুষ্ঠু স্বাস্থ্যসেবা পৌঁছে যাচ্ছে। শিশু ও মাতৃমৃত্যু হার কমছে এবং গর্ভবতী মায়েদের স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত হচ্ছে। গর্ভাবস্থার সময় নারীরা প্রশিক্ষিত ধাত্রী বা ডাক্তার দ্বারা প্রসব করানোর সুযোগ পাচ্ছে।

গ্রামীণ সংস্কৃতি ও বিনোদনেও পরিবর্তন এসেছে। স্যাটেলাইট টেলিভিশনের মাধ্যমে শহুরে বিনোদন গ্রামে পৌঁছে গেছে। গ্রামের লোকজন মেলা, নাটক, যাত্রা ও পালাগানের পরিবর্তে সিনেমা, নাটক এবং ক্রিকেট খেলা দেখতে বেশি পছন্দ করছে। এতে করে ঐতিহ্যবাহী সংস্কৃতির চর্চা কিছুটা কমে আসছে। তবে, বিভিন্ন সামাজিক ও ধর্মীয় উৎসব এখনো প্রানবন্তভাবে পালন করা হয়।

গ্রামীণ এলাকায় নারীর ক্ষমতায়ন ও স্বাধীনতাও উল্লেখযোগ্যভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে। মেয়েরা এখন স্কুল-কলেজে পড়াশোনা করছে এবং বিভিন্ন পেশায় যুক্ত হচ্ছে। নারী উদ্যোক্তা, এনজিও কর্মী এবং সামাজিক নেতৃত্বে নারীর অংশগ্রহণ বাড়ছে। নারীরা অর্থনৈতিক এবং সামাজিক সিদ্ধান্ত গ্রহণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে।

সামগ্রিকভাবে, বাংলাদেশের গ্রামীণ সমাজের এই পরিবর্তনসমূহ প্রমাণ করে যে উন্নয়ন ও আধুনিকায়নের ছোঁয়া গ্রামের প্রতিটি ক্ষেত্রে লাগছে। এই পরিবর্তনগুলো গ্রামীণ মানুষের জীবনমান উন্নত করছে, তাদের আর্থ-সামাজিক অবস্থানকে মজবুত করছে এবং একটি সমৃদ্ধশালী ও টেকসই গ্রামীণ সমাজের ভিত্তি রচনা করছে।

তবে, এই পরিবর্তনগুলোর সাথে সাথে পরিবেশ সংরক্ষণ, ঐতিহ্যবাহী সংস্কৃতির সংরক্ষণ এবং সমতাভিত্তিক উন্নয়নের দিকে লক্ষ্য রাখা জরুরি। এভাবেই আমরা একটি ভারসাম্যপূর্ণ এবং উন্নত গ্রামীণ সমাজ গড়ে তুলতে পারব, যা দেশের সামগ্রিক উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখবে।

লেখক: সহকারী অধ্যাপক, সমাজবিজ্ঞান বিভাগ, তেজগাঁও কলেজ, ঢাকা

সারাবাংলা/এসবিডিই

বাংলাদেশের গ্রামীণ সমাজের রূপান্তর মুক্তমত মো. বজলুর রশিদ

বিজ্ঞাপন

আরো

সম্পর্কিত খবর