Saturday 23 Nov 2024
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

শিক্ষকদের জন্য স্বতন্ত্র পে-স্কেল জরুরী

মাহামুদুল হক
১৪ জুলাই ২০২৪ ১৪:২৬

বর্তমান সরকারের সবচেয়ে যুগান্তকারী ও জনবান্ধব স্কিম হচ্ছে ১৭ আগস্ট ২০২৩ প্রধানমন্ত্রী ঘোষিত সর্বজনীন পেনশন স্কিম। প্রধানমন্ত্রী যেদিন ঘোষণা করেন সেদিন শুধু বেসরকারি চাকরিজীবীসহ সাধারণ নাগরিকদের জন্য ঘোষণা করেন এই টেকসই পেনশন স্কিম। জনবান্ধব এই স্কিমকে বির্তকিত করার জন্য বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে এর আওতায় নিয়ে আসা হলো ২৪ মার্চ আরেক প্রজ্ঞাপনমূলে। শিক্ষকরা তা বাতিলে কর্মবিরতির আন্দোলনে এখন। সকল পাবলিক বিশ্ববিদ্যায়ের ক্লাস-পরীক্ষা-আ্যাকাডেমিক ও প্রশাসনিক কাজ বন্ধ রয়েছে ১ জুন থেকে। ৭ জুন সংবাদপত্রের এক প্রতিবেদনে জানা যায় ‘সরকার শিক্ষকদের আন্দোলনকে তেমন গুরুত্ব দিচ্ছে না। কারণ শিক্ষক সমিতিগুলোর নেতৃত্বে রয়েছেন সরকার-সমর্থক শিক্ষকগণ।’সরকারের এ ধারণা ভুল। কারণ এবারের আন্দোলনে দল-মতাদর্শ নির্বিশেষে শিক্ষকদের স্বতস্ফূর্ত অংশগ্রহণ রয়েছে। এছাড়া ‘প্রত্যায় স্কিম’ বাতিলের দাবির সাথে আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ দাবি হচ্ছে স্বতন্ত্র পে-স্কেল আদায়। ‘প্রত্যায় আন্দোলন’ একটা উছিলা মাত্র। স্বতন্ত্র পে-স্কেল-এর জন্য সাধারণ শিক্ষকরা ফুঁসে উঠেছেন। গত কয়েকদিনে ধরে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের দ্বারা পরিচালিত বিভিন্ন অনলাইন-ভিত্তিক ফোরামে প্রতিক্রিয়া পর্যবেক্ষণ করে এবং বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের সঙ্গে কথা বলে আমার মনে হয়েছে স্বতন্ত্র পে-স্কেল ঘোষণা করে শিক্ষকদের বেতন বাড়ানো ছাড়া তাদের ক্লাসে ফেরানো কঠিন হবে। কেননা, শিক্ষকরা মনে করেন বেতন অন্যান্য সমগ্রেডভুক্ত পেশার চেয়ে বেশি হওয়া উচিত। কেননা, কোন চাকরিতেই চারটি প্রথম শ্রেণি আবশ্যকীয় যোগ্যতা চাওয়া হয় না। শুধু পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়েই শিক্ষক হতে যোগ্যতা চাওয়া হয় চারটি প্রথম শ্রেণি। বিশ্ববিদ্যালয়েই একমাত্র প্রতিষ্ঠান যেখানে ৯৯ শতাংশই শিক্ষক হন টপ বা সর্বোচ্চ রেজাল্টধারীগণ। আর বিশ্ববিদ্যালয় ছাড়া অন্য যেকোন প্রতিষ্ঠানে এক শতাংশ টপ রেজাল্টধারী চাকরি করেন, বাকি ৯৯ শতাংশই থাকেন সাধারণ গ্রাজুয়েট। সকলেই মেধাবী কিন্তু সকলেই পড়ুয়া নন। পড়ুয়াগণই অ্যাকাডেমিক টপার হন। বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য পড়ুয়া-গবেষক শ্রেণির গ্রাজুয়েট প্রয়োজন পড়ে নতুবা শিক্ষক হয়ে জ্ঞান উৎপাদন ও বিতরণ করতে পারবেন না। শিক্ষা জাতির মেরুদন্ড কিন্তু এই পড়ুয়া গোষ্ঠী ধরে রাখতে না পারলে জাতীর মেরুদন্ড দূর্বল হবে, উচ্চ শিক্ষাদান মানসম্পন্ন করা যাবে না। শিক্ষকদের সুযোগ-সুবিধার অভাবে ব্রেইন-ড্রেইন হবে, বিদেশে পাড়ি জমাবে। ইউনেস্কোর তথ্যমতে, ২০১৫ সালে বাংলাদেশ থেকে প্রায় ২৪ হাজার ১১২ জন শিক্ষার্থী বিদেশে যায়। ২০২০ সাল নাগাদ এ সংখ্যা চারগুণ হয়েছে। বিদেশ থেকে পড়ে কয়জনই ফিরে শিক্ষকতায় যোগদান করছে সে হিসেবটাও গুরুত্বপূর্ণ। বাংলাদেশে চাকরির সংকট রয়েছে, রয়েছে মেধাবী বা পড়ুয়াদের অবমূল্যায়ন। এসব কারণেই বিদেশে পাড়ি জমাচ্ছেন তারা।

বিজ্ঞাপন

প্রধানমন্ত্রী, অর্থমন্ত্রীসহ মন্ত্রী-সচিব, জজ-ব্যারিস্টার সকলে এমনকি শিক্ষক নিজেও কোন না কোন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান-শিক্ষকের শিক্ষার্থী। শিক্ষকের জ্ঞান-বীজ দিয়েই বিকাশিত হন শিক্ষার্থী, প্রবেশ করেন কর্মক্ষেত্রে। সুতরাং জ্ঞানের জনক বা শিক্ষক সর্বদাই সম্মান একটু বেশি চাইবেন সেটাই স্বাভাবিক। আর্ন্তজাতিক মানের অধ্যাপক তৈরিতে অর্ন্তজাতিক মানের সুযোগ-সুবিধা নিশ্চিত করার বিকল্প নেই। সাধারণ বেতন-কাঠামোয় তা অসম্ভব। এজন্য বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকদের জন্য স্বতন্ত্র পে-স্কেল ঘোষণা জরুরি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক কামরুল হাসান মামুন তার এক লেখায় রমেশ চন্দ্র মজুমদারের ‘জীবনের স্মৃতিদ্বীপে’ গ্রন্থ থেকে উল্লেখ করেছেন যে ১৯২৬-২৭ সালের দিকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক পদের বেতন ছিল ১০০০-১৮০০ রুপি। ওইসময় কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন অধ্যাপক বেতন পেতেন ৮০০-১০০০ রুপি। অর্থাৎ তখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক বেশি বেতন পেতেন কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপকের চেয়ে। ওইসময় ঢাবির অধ্যাপক মাসের বেতন দিয়ে ৪৫০ মণ চাল কিনতে পারতেন যার বাজারমূল্য এখন প্রায় ছয় লক্ষ টাকা। বর্তমানে একজন অধ্যাপক মাসের বেতন দিয়ে বড়জোড় ৭০ মণ ধান কিনতে পারেন। সার্কভুক্ত অন্যান্য দেশের চেয়ে বাংলাদেশের অধ্যাপকদের বেতন কম। প্রতিদিন ‘টেনশনে’ থাকেন অধ্যাপকগণ, গবেষণা করবেন নাকি সংসারের হিসেব-নিকেশ কষবেন-এই নিয়ে! বাংলাদেশের বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপকের সবোর্চ্চ বেতন ৭৮,০০০ টাকা (৬৬৪ ডলার)। অথচ ভারতে একজন সুপারগ্রেড অধ্যাপকের বেতন ৪৩৩,২৯৬ টাকা (৩,৬৮৪ ডলার)। এমনকি, পাকিস্তানে একজন অধ্যাপকের বেতন ২৮৮,৯৮১ টাকা (২৪৫৭ ডলার)। অন্যান্য দেশের শিক্ষকদের বেতনের সঙ্গে মিল রেখে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের জন্য স্বতন্ত্র বেতন স্কেল নির্ধারণ করা খুবই জরুরী। নইলে শিক্ষকতা পেশায় টপ রেজাল্টধারী মেধাবীগণ আসতে চাইবেন না। জাতীয় শিক্ষা নীতি-২০১০ এও শিক্ষার সকল স্তরে স্বতন্ত্র বেতন স্কেল প্রণয়নের উপর গুরুত্বারোপ করা হয়েছে।

বিজ্ঞাপন

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৭০ নির্বাচনের প্রাক্কলে রেডিও ভাষণে বলেন শিক্ষায় বিনিয়াগই শ্রেষ্ঠ বিনিয়োগ। শিক্ষায় জিডিপির ৪ শতাংশ বরাদ্দ দেওয়ার কথাও বলেন তিনি। ১৯৭২ সালে সংবিধান নিয়ে এক আলোচনায় তিনি আবারো বলেন শিক্ষায় ৪ শতাংশের মধ্যে বেশিরভাগ খরচ করতে হবে শিক্ষকদের বেতন প্রদানে, ভবন নির্মাণে নয়। তার সময়ে গঠিত ড. কুদরাত-ই-খুদা শিক্ষা কমিশন ৫ শতাংশ বরাদ্দের প্রস্তাব করে শিক্ষা খাতে। অথচ এবারের বাজেটে শিক্ষায় বরাদ্দ মাত্র জিডিপির ১.৭৬ শতাংশ যা গত ১৫ বছরের মধ্যে সর্বনিম্ন। বিশ্বব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী জিডিপির শতাংশ হিসেবে বাংলাদেশের গড় শিক্ষা ব্যয় আফগানিস্তান, পাকিস্তান ও শ্রীলংকার চেয়েও কম। বাংলাদেশের পটভূমিতে অপ্রয়োগযোগ্য নতুন মূল্যায়ন পদ্ধতি, প্রাথমিক থেকে উচ্চশিক্ষা উন্নয়নে অবহেলা, এবং অপ্রতুল বাজেট প্রণয়ন করে শিক্ষাখাতকে ধ্বংস করার জন্য কে বা কারা কলকাটি নড়াচ্ছেন তা সরকারের খতিয়ে দেখা উচিত। আমলারা হয়তো মনে করছেন মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক পর্যায়ের তথ্য মুখস্ত করেইতো বিসিএস পাস করা যায়। অযথা গুনগত শিক্ষার মাধ্যমে বিদ্যার্জনের প্রয়োজন কী! এজন্যই হয়তো শিক্ষার মান উন্নয়নে বরাদ্দ বাড়ছে না, বরং কমছে। বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকদেরও রাস্তায় নেমে আন্দোলন করতে হচ্ছে যেটা সম্মানজনক একটি পেশার জন্য বিব্রতকরও বটে।

বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকদের সবোর্চ্চ সংগঠন ‘বাংলাদেশ বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক ফেডারেশন শিক্ষকদের মর্যাদার উন্নয়নে আন্দোলনে নেতৃত্ব দিচ্ছে। প্রধানমন্ত্রী ২০১৫ সালের আন্দোলনের সময় এসব প্রতিশ্রুতি পূরণের আশ্বাস দিয়েছিলেন। প্রধানমন্ত্রীর সামনে এসব বিষয় জোরালোভাবে উপস্থাপন করতে হবে। কারণ এদেশে তিনিই সিদ্ধান্ত গ্রহণের একমাত্র মালিক! স্বতন্ত্র বেতন-স্কেল, সুপারগ্রেডসহ শিক্ষকের সার্বিক মর্যাদা আদায় করতে না পারলে বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতি ফেডারেশেনকে সাধারণ শিক্ষকেরা ‘অপ্রয়োজনীয় বোবা’ সংগঠন মনে করবেন নিশ্চিয়। জনবান্ধব সর্বজনীন পেনশন স্কিমকে বির্তকিত করার জন্য কারা কী উদ্দেশ্যে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে এর আওতায় নিলেন সরকার তা নিশ্চয়ই তদন্ত করবে। শিক্ষার্থীদের শিক্ষাবঞ্চিত করে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর কার্যক্রম বন্ধ রাখার দায়ও তাদের নিতে হবে।

লেখক: সহকারী অধ্যাপক, গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগ, বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়, রংপুর

সারাবাংলা/এসবিডিই

মাহামুদুল হক মুক্তমত শিক্ষকদের জন্য স্বতন্ত্র পে-স্কেল জরুরী

বিজ্ঞাপন

আরো

সম্পর্কিত খবর