Tuesday 15 Jul 2025
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

নেলসন ম্যান্ডেলা: বর্ণবাদহীন পৃথিবীর স্বপ্নদ্রষ্টা

অলোক আচার্য
১৫ জুলাই ২০২৪ ১৩:৫৮
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

পৃথিবী জুড়েই আজ নানা ধরনের বৈষম্য বিদ্যমান। সাদা-কালো, উঁচু-নিচু, ধনী-গরীব ইত্যাদি বৈষম্যপূর্ণ শব্দে বিভক্ত। এই পৃথিবীতেই কেউ কেউ জন্মগ্রহণ করেছেন যারা প্রকৃতপক্ষেই চেয়েছিল পৃথিবীতে মানুষের পরিচয় হোক মনুষ্যত্বে। এদের একজন হলেন নেলসন ম্যান্ডেলা। তার একটি বক্তব্য হলো- ‘আমি সাদাদের আধিপত্যের বিরুদ্ধে লড়াই করেছি এবং আমি কালোদের আধিপত্যের বিরুদ্ধে লড়াই করছি। আমি আদর্শিক গণতন্ত্র এবং মুক্ত সমাজের প্রশংসা করি, যেখানে সকল ব্যক্তি শান্তিপূর্ণভাবে সহাবস্থান করবে এবং সমান সুযোগ লাভ করবে। এটি হচ্ছে একটি আদর্শিক অবস্থান, যার মধ্যে দিয়ে বাঁচা দরকার এবং আমি তা অর্জনের আশা করি, কিন্তু এটি এমন এক আদর্শ, যদি প্রয়োজন পরে, তার জন্য আমি জীবন দিতেও প্রস্তুত’। এই কথাগুলো এমন একজন মানুষের যে তার জীবনের সব শক্তি দিয়ে বৈষম্য, ভেদাভেদ, অগণতান্ত্রিক পরিবেশ, বিশৃঙ্খলা এবং নৈরাজ্যের বিরুদ্ধে লড়াই করেছেন। বিশেষ করে বর্ণবাদের বিরুদ্ধে লড়ায়ের একজন সাহসী নেতা হিসেবে তিনি অধিক পরিচিত। পৃথিবীতে কিছু মানুষ জন্ম নেয় যারা স্রোতে গা ভাসায় না। যারা প্রথার বিরুদ্ধে গিয়ে কথা বলতে আরম্ভ করে। তখন সমাজে ধারণার পরিবর্তন ঘটে। এই যেমন বর্ণবাদ। এখনও বর্ণবাদ পৃথিবী থেকে দূর হয়নি। কিন্তু মানব জাতির একটি বড় অংশই বর্ণবাদের বিপক্ষে। বর্ণবাদকে ঘৃণা করে। বর্ণবাদ বলতে মূলত দক্ষিণ আফ্রিকার ঐ সময়ের শেতাঙ্গ ও কৃষ্ণাঙ্গর মধ্যেকার ব্যাপক ভেদাভেদ বোঝানা হয়। সময়ের সাথে সাথে বর্ণবাদ ধারণাটি আরো বিস্তৃত হয়েছে। ঘৃণা করলেও এক শ্রেণির মানুষ আজও অন্তরে বর্ণবাদকে জিইয়ে রেখেছেন। মাঝে মধ্যেই সেই খবর আমরা গণমাধ্যমে দেখি। খেলার মাঠ থেকে শুরু করে সবখানেই এই বিদ্বেষ লক্ষ্যণীয়।

বিজ্ঞাপন

বর্ণবাদ দ্বারা সেই দৃষ্টিভঙ্গি এবং কাজ বোঝানো হয় যেখানে কোনো নির্দিষ্ট বৈশিষ্ট্যের জন্যই উঁচু-নিচু, বা কতৃত্ববাদ এবং ব্যাপকভাবে কোনো নির্দিষ্ট গোষ্ঠিকে সুবিধা দেয়া বা বঞ্চিত করা বোঝানো হয়। শরীরের রংয়ের ভেতরই কেবল এই ভেদাভেদ সীমাবদ্ধ নেই। বর্ণবাদ আসলে একটি প্রভেদ নির্দেশ করে যা ব্যক্তিকে সামাজিকভাবে হেয় করে এবং কখনো কখনো এটি মাত্রা ছাড়িয়ে যায়। ১৯৪৮ সাল থেকে ১৯৯৪ সাল পর্যন্ত দক্ষিণ আফ্রিকার শ্বেতাঙ্গশাসিত সরকার পৃথকীকরণ যা আপার্টহাইট নামে পরিচিত এবং এই পৃথকীকরণ নীতিতে কৃষ্ণাঙ্গ, শেতাঙ্গ, দক্ষিণ এশিয় বা বর্ণসংকর এসব বর্ণে ভাগ করে অশে^তাঙ্গদের বাসস্থান, নির্বাচনের অধিকার, যাতায়াতের অধিকার এবং বিভিন্ন রাজনৈতিক অধিকারসহ নানাভাবে বেষম্যমূলক আচরণ করে। এ সব কিছুর বিরুদ্ধেই প্রতিবাদের প্রতীক ছিলেন নেলসন ম্যান্ডেলা। তিনি এ বিশে^র এক মহান আদর্শিক নেতা নেলসন ম্যান্ডেলা। ১৯৬৪ সালে রিভোনিয়া ষড়যন্ত্র মামলার শুনানি চলাকালে প্রদান করা বক্তৃতায় তিনি এসব বলেন। তার আরও মূল্যবান বক্তব্য থাকলেও এই একটি কথাতেই তিনি আধিপত্যবাদের বিরুদ্ধে এবং গণতন্ত্রের পক্ষে লড়াই করার দৃঢ় মনোভাব ব্যক্ত করেন।

দক্ষিন আফ্রিকার মহান এই নেতা ১৯১৮ সালের ১৮ জুলাই জন্মগ্রহণ করেন। তিনি ছিলেন দক্ষিণ আফ্রিকার গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত প্রথম রাষ্ট্রপতি। পৃথিবীতে যুগে যুগে সাদা চামড়া-কালো চামড়া নিয়ে বিভেদ চলে এসেছে। আজকের এই প্রগতিশীল পৃথিবীতেও এই বৈষম্য রয়ে গেছে। নেলসন ম্যান্ডেলা এমন একটা সময়ে জন্মগ্রহণ করেছিলেন যখন সাদা চামড়ার মানুষদের ছিল আধিপত্য। বিপরীতে কালোদের প্রতি পদক্ষেপে বঞ্চনার শিকার হতে হয়েছে। তিনি এমন একটি দক্ষিণ আফ্রিকার স্বপ্ন দেখেছেন যেখানে সব জাতি, সব বর্ণের মানুষ সমান সুযোগ নিয়ে একসাথে থাকতে পারে। তার সারা জীবন তিনি এই আদর্শ নিয়েই লড়াই করে গেছেন। ইতিহাস তাকে তাই দিয়েছে রাজার আসন। স্কুলের এক শিক্ষক তার নাম রেখেছিলেন নেলসন। তবে দক্ষিণ আফ্রিকার মানুষের কাছে তিনি ছিলেন ‘মাদিবা’। ম্যান্ডেলা সারা বিশ্বের গণতন্ত্র ও সামাজিক ন্যায়ের প্রতীক। ম্যান্ডেলা তার পরিবারের প্রথম সদস্য যে স্কুলে পড়াশোনা করেছেন। ম্যান্ডেলার রাজনীতিতে জড়িত হন তার এক ঘনিষ্ট বন্ধুর সুবাদে। তার ঘনিষ্ট বন্ধু ছিলেন ট্রান্সকেইয়ের সিংহাসনের উত্তরাধিকারী কাইজার (কে ডি) মাটানজিমা। এই বন্ধুর সুবাদেই পরবর্তীকালে ম্যান্ডেলা বান্টুস্থানের রাজনীতি ও নীতিনির্ধারণে জড়িত হন। নেলসন ম্যান্ডেলা বরাবরই এই বর্ণবাদের বিরুদ্ধে ছিল। সক্রিয়ভাবে আফ্রিকান ন্যাশনাল কংগ্রেসে জড়িয়ে তিনি ১৯৫২ সালে অসহযোগ আন্দোলনে যোগ দেন। ১৯৫৫ সালে তিনি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন এবং মুক্তি সনদ প্রণয়ন করেন যা বর্ণবাদবিরোধী আন্দোলনের মূল ভিত্তি হিসেবে ধরা হয়। মহাত্মা গান্ধীর রাজনৈতিক দর্শনের প্রভাব ছিল তার ওপর। তিনি অহিংস নীতিতে বিশ্বাস করতেন। এভাবে আন্দোলনে জড়িয়ে পরার ফলে তিনি শ্বেতাঙ্গবাদী সরকারের বিরাগভাজন হন এবং ১৯৫৬ সালে তাকে দেশদ্রোহিতার অপরাধে গ্রেফতার করা হয়। তবে তার মুক্তির পর তিনি অহিংস আন্দোলন থেকে সরে এসে বর্ণবাদ সরকারকে হটাতে অন্তর্ঘাতী ও চোরাগোপ্তা হামলা পরিকল্পনা করেন।

তিনি জানতেন বর্ণবাদী সরকারকে হটাতে আর কোনো উপায় নেই। এএনসি সশস্ত্র সংগ্রাম শুরু করলে সরকার উৎখাতের ষড়যন্ত্রের অভিযোগ এনে তাকে গ্রেফতার করা হয়। বিচারে তার যাবজ্জীবন সাজা ঘোষণা করা হয়। এই দীর্ঘ কারাজীবন ম্যান্ডেলার জীবনের দুঃসহ সময়। তাকে দেয়া হয় দক্ষিণ আফ্রিকার কুখ্যাত রুবেন দ্বীপে। তাকে কারাবন্দী করলেও বর্ণবাদ সরকার স্থির থাকতে পারেননি। তার বিরুদ্ধে আন্দোলন চলতেই থাকে। কৃষ্ণাঙ্গ যুবকরা সেসব আন্দোলনে প্রাণ হারান। নেলসন ম্যান্ডেলাকে কারাবাস দেয়ার পরপরই তাকে মুক্তির জন্য শেতাঙ্গ সরকারের ওপর চাপ বাড়তে থাকে। এভাবে কেটে যায় ২৭ বছর। এই দীর্ঘ কারাভোগের পর ১৯৯০ সালে তাকে মুক্তি দেয়া হয়। কারাগার থেকে বেরিয়ে দেয়া বক্তৃতায় ম্যান্ডেলা তার সমর্থকদের উদ্দেশ্যে আবারো বলেন, তিনি সেই দক্ষিণ আফ্রিকার স্বপ্ন দেখেন, যেখানে সব জাতি, সব বর্ণের মানুষ সমান সুযোগ নিয়ে তার বিচারের থাকতে পারবে’। অর্থাৎ তিনি একটি বৈষম্যহীন দক্ষিণ আফ্রিকার স্বপ্ন দেখতেন। কারাগারে কষ্ট সহ্যকরাকালীনও তিনি দক্ষিণ আফ্রিকার বৈষম্যহীন সমাজের স্বপ্ন দেখতেন। মুক্তির পর ম্যান্ডেলার সামনে এক বিরাট চ্যালেঞ্জ ছিল। নতুন দক্ষিণ আফ্রিকা গড়ার চ্যালেঞ্জ। পুরনো দক্ষিণ আফ্রিকাকে নতুন করে বৈষম্যহীন করে গড়ে তোলার স্বপ্ন। তিনি সাবেক শেতাঙ্গদের দিকে বন্ধুত্বের হাত বাড়িয়ে দিলেন যারা একসময় তার ওপর হিংসাত্মক ব্যবহার করেছিল। এরপর ১৯৯৪ সালে আসে সেই সময় যেদিন দক্ষিন আফ্রিকার মানুষ তাদের প্রিয় নেতাকে বেছে নেয় তাদের প্রেসিডেন্ট হিসেবে। জনগণের বিপুল ভোটে তিনি নির্বাচিত হন। তার রাজনৈতিক জীবনের মতো তার ব্যক্তিগত জীবনও ছিল ঘাত-প্রতিঘাতে ভরা। তিনি তার সারা জীবনই নিপীড়িত মানুষের অধিকার আদায়ে কাজ করে গেছেন। তাই অবসরে যাওয়ার পরেও তার এই ব্যস্ততা থামেনি। মৃত্যুর আগ পর্যন্ত তিনি চেষ্টা করেছেন মানুষের পাশে থাকতে। তিনি অবসরে যাওয়ার পর জনকল্যানমূলক কাজে ঝাপিয়ে পরেন। তার এক ছেলে এইডসে মারা যান। তিনি এ ঘটনার পর চেয়েছিলেন দক্ষিণ আফ্রিকায় এইডস প্রতিরোধ এবং এর চিকিৎসা নিয়ে সোচ্চার ভূমিকা পালন। তাকে একবার প্রশ্ন করা হয়েছিল, তাকে কিভাবে মনে রাখলে খুশী হবেন তিনি? তিনি উত্তর দিয়েছিলেন, ’আমি চাই আমার সম্পর্কে এরকম কথাই বলা হোক, এখানে এমন এক মানুষ শায়িত আছেন, যিনি পৃথিবীতে তার কর্তব্য সম্পাদন করেছেন। আমি চাই এটুকুই বলা হোক আমার সম্পর্কে। একজন মানুষ এবং তার প্রকৃত মূল্যায়ন সম্পর্কে এর চেয়ে বেশি বলা সম্ভব নয়। কারণ মানুষের প্রকৃত পরিচয় হয় কর্মে। নেলসন ম্যান্ডেলা ছিলেন একজন চমৎকার মানুষ, আকর্ষনীয় ব্যক্তিত্ব, একজন ভালো বন্ধু এবং উদার মানুষ। তিনি একটি বৈষম্যহীন সমাজের স্বপ্ন দেখেছিলেন। তার এসব গুণ তাকে দক্ষিণ আফ্রিকার মানুষের এবং বিশ্বের নির্যাতিত মানুষের প্রাণ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেছে। বর্ণবাদের বিরুদ্ধে প্রতিরোধের কথা উঠলেই নেলসন ম্যান্ডেলার নামটিই প্রথমে আসে। যদিও আজও বর্ণবাদ পুরোপুরিভাবে বিলুপ্তি হয়নি। বর্ণবাদ ফিরে আসে খেলার মাঠে, বর্ণবাদ ফিরে আসে বন্দুকের নলে। উন্নত বিশ্বেও বর্ণবাদের শিকার হয়ে প্রাণ দিতে হয়। কিন্তু একজন এটি বিলোপ করতে চেয়েছিলেন। আজও অনেকেই চান। একদিন হয়তো তার স্বপ্ন পুরোপুরিভাবে বাস্তবায়িত হবে। সেদিন ম্যান্ডেলার লড়াই স্বার্থক হবে।

লেখক: কলামিষ্ট

সারাবাংলা/এসবিডিই

অলোক আচার্য নেলসন ম্যান্ডেলা: বর্ণবাদহীন পৃথিবীর স্বপ্নদ্রষ্টা মুক্তমত

বিজ্ঞাপন

বরিশালে এনসিপির পদযাত্রা
১৬ জুলাই ২০২৫ ০১:৪৩

আরো

সম্পর্কিত খবর