Saturday 23 Nov 2024
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

পানিতে ডুবে মৃত্যু ও অভিভাবকের করণীয়

অলোক আচার্য
২৫ জুলাই ২০২৪ ১৪:৫৪

নদীর দেশ বাংলাদেশ। খাল-বিলের দেশ বাংলাদেশ। অর্থাৎ পানির দেশ বাংলাদেশ। আমাদের দেশে অনাকাঙ্খিত শিশু মৃত্যুর পেছনে যেসব কারণ রয়েছে তার মধ্যে একটি কারণ হলো পানিতে ডুবে মৃত্যুর ঘটনা। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এটি এক ধরনের অবহেলাজনিত মৃত্যু। প্রতি বছর দেশের বিভিন্ন স্থানে পানিতে ডুবে শিশু মৃত্যুর ঘটনা ঘটে থাকে। পরিবারের অসতর্কতা এর অন্যতম একটি কারণ। অথচ একটু সতর্ক হলেই এই ধরনের মৃত্যু থেকে শিশুকে আমরা রক্ষা করতে পারি। অভিভাভকের অগোচরেই একটি শিশু চলে যায় পাশের কোনো খালে। তারপর তার করুণ পরিণতি ঘটে। ২০২১ সালের জানুয়ারিতে প্রকাশিত গ্লোবাল হেলথ আ্যাডভোকেসি ইনকিউবেটরের (জিএইচএআই) সহযোগিতায় গণমাধ্যম ও যোগাযোগ বিষয়ক প্রতিষ্ঠান ‘সমষ্টি’ পরিচালিত জাতীয় ও স্থানীয় পর্যায়ের গণমাধ্যমে প্রকাশিত পানিতে ডুবে মৃত্যুর সংবাদ বিশ্লেষণের তথ্যে দেখা যায়, পানিতে ডুবে মৃত্যুর মধ্যে মোট ৮২ শতাংশই ১৮ বছরের কম বয়সী শিশু। এদের ৮০ শতাংশের বয়স আবার ৯ বছরের কম। পরিবারের সদস্যদের অসর্তকতার কারণেই মৃত্যু ঘটছে এদের সিংহভাগের। পানিতে ডুবে মোট মৃতুদের ৮১ শতাংশই পরিবারের অগোচরে পানিতে গিয়ে মারা যায়। এই তথ্য ২০২০ সালের ১ জানুয়ারি থেকে ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত পরিচালিত এ বিশ্লেষণে দেখা যায়, ২০২০ সালে ৪২৫ টি পৃথক ঘটনায় সারাদেশে ৭৬৯ ব্যকিত পানিতে ডুবে মারা যায়। যার ৮২ শতাংশই শিশু। আবার বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার ২০১৪ সালের বৈশি^ক প্রতিবেদন অনুযায়ী, বাংলাদেমে ৫ বছরের কম বয়সী শিশু মৃত্যুর ৪৩ শতাংশের কারণ পানিতে ডুবে মারা যাওয়া। যুক্তরাষ্ট্রের ইনস্টিটিউট অব হেলথ মেট্রিক্স অ্যান্ড ইভ্যালুয়েশনের (আইএইচএমই) ২০১৭ সালে প্রকাশিত ‘গ্লোবাল বারডেন অব ডিজিজ ষ্টাডি’ শীর্ষক প্রতিবেদন অনুযায়ী, বাংলাদেমে ওই বছর ১৪ হাজার ২৯ জন পানিতে ডুবে মারা যায়। দেশে পানিতে ডুবে মৃত্যুর বিষয়ে দেশব্যাপী জরিপ হয় ২০১৬ সালে। ‘বাংলাদেশ হেলথ অ্যান্ড ইনজুরি সার্ভে’ নামে ওই জরিপ করে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর। ফলাফল বলছে, প্রতিদিন অনূর্ধ্ব-৫ বছর বয়সী ৩০ শিশুর মৃত্যু হয় পানিতে ডুবে। শিশুদের পানিতে ডুবে মৃত্যুর ৮০ ভাগ ঘটনা ঘটে বাড়ির ২০ গজের মধ্যে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা শিশুদের ডুবে মৃত্যুরোধে ১০টি প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়ার কথা বলেছে। এর মধ্যে রয়েছে শিশু দিবাযত্ন কেন্দ্র স্থাপন, সাঁতার শেখানো, প্রাথমিক চিকিৎসা প্রভৃতি। এই ব্যবস্থার পাশাপাশি ডুবে মৃত্যু রোধে একটি জাতীয় কর্মপন্থাও করতে বলেছে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা। দেশে অনূর্ধ্ব পাঁচ বছর বয়সী শিশুদের মৃত্যুর চতুর্থ প্রধান কারণ এখন পানিতে ডুবে মৃত্যু। জাতিসংঘের টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা (এসডিজি) অনুযায়ী, ২০৩০ সালের মধ্যে প্রতি এক হাজার জীবিত জন্মে অনূর্ধ্ব-৫ বছর বয়সী শিশুমৃত্যুর হার কমপক্ষে ২৫-এ নামিয়ে আনা।

বিজ্ঞাপন

এ রিপোর্ট অনুযায়ী পানিতে ডুবে মৃত্যুর দিক থেকে কমনওয়েলথ দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান পঞ্চম। একটি বিষয় স্পষ্ট যে পানিতে ডুবে মৃত্যুর ঘটনায় শিশুর অভিভাবকের চরম দায়িত্বহীনতা কাজ করে। কাজ করে অসচেতনতা। শিশুর প্রতি একটু সচেতনা না হলে যে কতবড় দুর্ঘটনা ঘটতে পারে তার প্রমাণ পানিতে ডুবে মৃত্যুর ঘটনা। অভিভাবকের সচেতনতার সাথে সাথে আর একটি বিষয় হলো সাঁতার শেখা যা পানিতে নিজেকে ভাসিয়ে রক্ষার কৌশল। একসময় নয়-দশ বছরের একটি শিশুর সাঁতার জানা ছিল একেবারেই স্বাভাবিক বিষয়। তার কম বয়সীরাও অনায়াসেই সাঁতার কাটতে সক্ষম ছিল। বাংলাদেশ নদীর দেশ। বাংলাদেশ খাল-বিল, পুকুর, ডোবার দেশ। নদী-নালা খাল বিলের সাথে আমাদের দেশের মানুষের আত্মার সম্পর্ক। এদেশের বাড়ির বাইরে দু’পা ফেললেই এসব জলাভূমির দেখা মেলে। সুতরাং এ কথা দৃঢ়ভাবে বলতে হয় যে আমাদের দেশে সাঁতার শেখাটা একরকম বাধ্যতামূলক কাজ বা শিশুদের সাঁতার শেখানোটা অভিভাবকের দায়িত্বের মধ্যেই পরে। মাত্র দুই তিন দশক আগেও এমন শিশু খুব কমই খুঁজে পাওয়া যেতো যে সাঁতার জানেনা বা শিশু থেকে শেখেনি। নদীতে ঝাঁপাঝাপি করা, সাঁতার কাটা, মাছ ধরা এসব ছিল শৈশবেরই একটি অংশ। এখন সময় বদলেছে। শহরায়নের হাওয়া লেগেছে সবখানে। সেই নগরায়ণের ফলে হারিয়ে যাচ্ছে দেশের নদ-নদী, পুকুর-ডোবা, খাল-বিল।

বিজ্ঞাপন

সাঁতার বিষয়টি তো আর এমন নয় যে বইয়ে পড়েই কেউ শিখে যাবে। বরং এটি অভ্যাসের বিষয়। সেই অভ্যাস আজকের শিশু কোথায় করবে? সেই সুযোগ আজ তার কোথায়? ফলে একটি প্রজন্ম বড় হয়ে উঠছে অত্যন্ত প্রয়োজনীয় একটি চর্চা ছাড়াই। যদিও পানিতে ডুবে মৃত্যুর ঘটনার জন্য কেবল সাঁতার শেখাই যে একমাত্র দায়ী এমনটা নয়। অভিভাবকের অসচেতনতার কথাও বলা হয়েছে জোরালোভাবে। অনেক সময়ই একা একা শিশু সবার অলক্ষ্যে চলে যায় পুকুরঘাটে বা নদীতে বা পাশ্ববর্তী কোনো খালে। কেউ লক্ষ্য করে না। যখন খেয়াল হয় তখন অনেক দেরী হয়ে যায়। আবার সাঁতার শেখানোর প্রতিও অভিভাবকের তেমন কোনো আগ্রহ নেই। অন্তত আগের চেয়ে কমেছে বলেই মনে হয়। শিশুর এই অতি গুরুত্বপূর্ণ শিক্ষা দিতে নিজেরাই আগ্রহী হচ্ছে না। এর ফলেও শিশুরা সাঁতার শেখার বাইরে থেকে যাচ্ছে। শহরাঞ্চলের অনেক পরিবার তাদের সন্তানকে সাঁতার শিখতে ভর্তি করিয়ে দেয় অথবা কোনো সুইমিংপুলে নিজেরাই চর্চা করায়। গ্রামে গঞ্জে আজও শিশুরা সাঁতার শেখার সুযোগ পাচ্ছে নিজ থেকেই। তবে সেই হার কমে আসছে। অথচ পানিতে ডুবে যাওয়া প্রতিরোধকল্পে শিশুদের সাঁতার প্রশিক্ষণ শীর্ষক কর্মসূচির কাজ চলমান রয়েছে। নজরদারি ও সচেতনতার অভাব, সাঁতার না জানা এবং ডুবে যাওয়ার পর তাৎক্ষণিক ব্যবস্থা নেওয়ার বিষয়ে অজ্ঞতার কারণে এত শিশুর ডুবে মৃত্যুর ঘটনা ঘটছে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা।‘সমাজভিত্তিক সমন্বিত শিশু-যত্ন কেন্দ্রের মাধ্যমে শিশুর প্রারম্ভিক বিকাশ ও সুরক্ষা এবং সাঁতারসুবিধা প্রদান’ শীর্ষক একটি প্রকল্প হাতে নিয়েছে মহিলা ও শিশুবিষয়ক মন্ত্রণালয়। দুই বছর মেয়াদি প্রকল্পটি ২০২২ সালে শুরু হওয়ার কথা থাকলেও এখনো শুরু হয়নি। প্রকল্পের মাধ্যমে ১৬টি জেলার ৪৫টি উপজেলায় আট হাজার দিবাযত্ন কেন্দ্র প্রতিষ্ঠা করা হবে। সেখানে দুই লাখ শিশুর যতœ নেওয়া হবে এবং নির্দিষ্ট বয়সে সাঁতার প্রশিক্ষণ দেওয়া হবে। ২৭১ কোটি টাকা ব্যয়ের প্রকল্পটির পরিচালনায় রয়েছে বাংলাদেশ শিশু একাডেমি।এরপরও পানিতে ডুবে শিশু মৃত্যু রোধ করা যাচ্ছে না। দেখা যাচ্ছে যে প্রধানত অসেচতনতা পানিতে ডুবে শিশু মৃত্যুর জন্য সর্বাধিক দায়ী, তাই প্রথমে সমাজকে সচেতন হতে হবে এবং শিশুর প্রতি সতর্ক দৃষ্টি রাখতে হবে। আর এরপর শিশুকে সাঁতার শেখানোর কাজটি করতে হবে। তা হলেই এ ধরনের অনাকাঙ্খিত মৃত্যু আমরা রোধ করতে সক্ষম হবো।

লেখক: কলামিস্ট

সারাবাংলা/এসবিডিই

অলোক আচার্য পানিতে ডুবে মৃত্যু ও অভিভাবকের করণীয় মুক্তমত

বিজ্ঞাপন

বাঘায় কৃষককে গলা কেটে হত্যা
২৩ নভেম্বর ২০২৪ ১৬:৪৩

আরো

সম্পর্কিত খবর