লটকনের ভালো ফলনে কৃষকের হাসি
২৫ জুলাই ২০২৪ ১৫:০৬
স্থানীয়ভাবে লটকন ফলটি পরিচিত ‘বুগি’ নামে আবার কোথায়ও বুবি নামে। এই ফলটির বৈঙ্গানিক নাম Baccaurea motleyana। একসময় বলা হতো জংলি ফল। বন-বাদাড়, ঝোঁপঝাড়ে অনাদরে জন্ম নেওয়া এ ফলের দিকে কেউ ফিরেও চাইত না। তবে সময়ের সঙ্গে সঙ্গে বদলে গেছে চিত্র। ভিটামিন ‘সি’তে সমৃদ্ধ মৌসুমি ফল হিসেবে এখন এটি বহুল সমাদৃত। তাই ফলটি এখন রীতিমতো বাগান করে আবাদ করা হয়। লটকন মৌসুমি ফল। বছরের বর্ষা ও বর্ষা-পরবর্তী কিছু সময়ই কেবল ফলটি পাওয়া যায় । লটকনের যে ভরা মৌসুমই চলছে এখন। আর দেশে সেই লটকন আবাদে এগিয়ে থাকা জেলাটির নাম নরসিংদী। এ বছরও জেলাটিতে গত বছরের তুলনায় লটকনের আবাদ বেড়েছে। অনুকূল আবহাওয়ার কারণে এ বছর ফলনও ভালো। নরসিংদীর লটকন বাগানগুলোতে তাই এখন কেনাবেচার ধুম পড়েছে। ভালো দাম পাওয়ায় লটকন চাষিদের মুখে ফুটেছে হাসি।
তথ্য থেকে যানা যায় আজ থেকে ত্রিশ বছর আগে নরসিংদী জেলার বেলাব উপজেলার লাখপুর গ্রামে লটকনের চাষাবাদ শুরু হয়। এর পর থেকেই লাল মাটি বেষ্টিত বেলাব ও শিবপু উপজেলার বিভিন্ন ইউনিয়নে এর ব্যাপক প্রসার ঘটে। প্রতি বছর এর ফলন বাড়ছে কেবল চাহিদা ও লাভের কারনে। এর জন্য এ দুটি উপজেলায় ব্যবসায়িক হিসাবে এর চাষাবাদ শুরু হয়েছে এবং স্থানীয় অর্থনীতিতে এ অবদান দৃশ্যমান হিসাবে বিবেচিত। অনেকে মনে করেন আজ থেকে একশত বছর আগে হাজি হাকিম আব্দুল আজিজ নরসিংদীর আজকিতোলা গ্রামে তিনটি গাছের চারা রোপন করে যার থেকে এর বিস্তৃতি ছরিয়ে পরে।
নরসিংদী জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের তথ্য অনুযায়ী, চলতি মৌসুমে জেলায় এক হাজার ৯০০ হেক্টর জমিতে লটকনের আবাদ হয়েছে। গত বছরের তুলনায় আবাদ বেড়েছে প্রায় ২০০ হেক্টর জমিতে। অন্যান্য এলাকার তুলনায় মাটির গুণ ও আবহাওয়ার জন্য জেলার শিবপুর, বেলাব ও রায়পুরা উপজেলায় লটকনের আবাদ বেশি। প্রতি হেক্টর জমিতে গড়ে ১৭ টন ফলন ধরে এ বছর এক হাজার ৯০০ হেক্টর জমিতে প্রায় ৩০ হাজার টন লটকন উৎপাদন হিসাব করা হয়েছে জেলাতে। নরসিংদীর শিবপুর, বেলাব ও রায়পুরা উপজেলার বিশাল অঞ্চলজুড়ে টিলা ও ঢালাসমৃদ্ধ লালমাটির এলাকা, যা লটকন আবাদের জন্য বিশেষভাবে উপযোগী। ফলটির গাছ মাঝারি আকারের চিরসবুজ প্রকৃতির। ফল গোলাকার, পাকলে যা হলুদ রঙ ধারণ করে। ছায়াঘেরা লটকন বাগানে অধিকাংশ গাছের গোড়া থেকে একদম শীর্ষ পর্যন্ত থোকায় থোকায় জড়িয়ে রয়েছে লটকন। দেখে মনে হয় যেন লটকনের ফুল ফুটছে! শিবপুরের চৈতন্যা গ্রামের মো. আসাদ মিয়া দুই দশক ধরে লটকন আবাদ করে আসছেন। বছর বিশেক আগে ২০ হাজার টাকা খরচ করে চার বিঘা জমিতে ৮৫টি লটকনের চারা লাগিয়েছিলেন। এর পাঁচ বছর পর থেকেই ফলন পেতে শুর করেন। এখন তার বাগানে ৭০টি লটকন গাছ রয়েছে। গাছের গোড়া থেকে আগা পর্যন্ত সবখানে থোকায় থোকায় ধরে রয়েছে লটকন। আসাদ মিয়া বলেন, ‘ফলন আসার আগে থেকেই গাছের গুঁড়ি পরিষ্কার করা, পানি দেওয়া, জৈব সার প্রয়োগসহ নানা কাজ থাকে। এ বছর আমার বাগানে মোট ২০ থেকে ২৫ হাজার টাকা খরচ হয়েছে। আশা করি সব খরচ বাদ দিয়ে তিন থেকে সাড়ে তিন লাখ টাকা লাভ হবে। বেলাব উপজেলার লাখপুর গ্রামের বিল্লাল হোসেন বলেন, বৈশাখ-জ্যৈষ্ঠ মাস লটকন গাছ লাগানোর সবচেয়ে উপযুক্ত সময়। এ ছাড়া বর্ষার শেষের দিকে, অর্থাৎ ভাদ্র-আশ্বিন মাসেও গাছ লাগানো যায়। লটকনের গাছ লাল মাটিতে ভালো জন্মায়। প্রতি বছর মাঘ-ফাল্গুনে লটকন গাছে মুকুল আসা শুরু হয়। আষাঢ় মাসে এ ফল পরিপক্বতা পায়। চাষিরা বলছেন, একবার লটকন গাছ বড় হয়ে গেছে এই ফল আবাদে আর তেমন কোনো খরচ নেই। শুধু নিয়মিত পরিচর্যা করতে হয়। গোড়ার চারদিকে জৈব সারে ফলন বাড়ে। পিঁপড়া বা পোকামাকড়ের হাত থেকে ফল বাঁচাতে ছত্রাকনাশক দিতে হয়।তবে লটকন চাষিরা কৃষি কর্মকর্তাদের পরামর্শ প্রত্যাশা করছেন। তারা বলছেন, কৃষি কর্মকর্তারা বাগান পরিদর্শন করে পরামর্শ দিলে তারা আরও ভালো ফলন পেতে পারতেন। আর্থিকভাবেও বেশি লাভবান হতে পারতেন।এ বছর পাইকারিতে মানভেদে প্রতি মণ লটকনের দাম উঠেছে সাড়ে তিন হাজার টাকা থেকে পাঁচ হাজার টাকা পর্যন্ত। খুচরা বাজারে মান ও আকারভেদে প্রতি কেজি ৭০ টাকা থেকে শুরু করে ১৫০ টাকা পর্যন্ত বিক্রি হচ্ছে লটকন রায়পুরা উপজেলার পুটিরবাজার এলাকার লটকন চাষি তৌফিক আহমেদ জানান, লটকন বিক্রি নিয়ে তাদের খুব একটা ভোগান্তি পোহাতে হয় না। নিজেরা হাটে বা বাজারে নিয়ে বিক্রি করতে পারেন। পাইকাররাও বাগানে গিয়েই লটকন কিনে নেন। তাছাড়া পাইকারদের কাছে বাগান বিক্রিও করে দেওয়া যায়। তৌফিক বলেন, ‘লটকনের ফল ধরার পর বাগান বিক্রি করে দেওয়া যায়। পাইকাররা বাগান থেকেই লটকন কিনে নিয়ে যাচ্ছেন।’
নরসিংদীর মাটি লটকন চাষের জন্য বিশেষভাবে উপযোগী। ভালো ফলন ও দামের কারণে জেলায় লটকনের আবাদ বাড়ছে। নরসিংদী থেকে লটকন সারা দেশেই যায় বলে জানালেন লটকন ব্যবসায়ী আলতাফ হোসেন। তিনি বলেন, ‘নরসিংদী থেকে লটকন কিনে ঢাকা, সিলেট, কুমিল্লা, মানিকগঞ্জসহ দেশের বিভিন্ন জায়গায় পাঠাই। বর্তমানে দেশের চাহিদা মিটিয়ে বিদেশেও রফতানি শুরু হয়েছে। লটকন চাষি ও ব্যবসায়ীদের আরেকটি দাবি রয়েছে স্থায়ী বাজার বা হাট নিয়ে। জেলার শিবপুর উপজেলার চৈতন্যা ও মরজালে ঢাকা-সিলেট মহাসড়কের গাঁ ঘেঁষে সবচেয়ে বড় লটকনের বাজার বসে। লটকন চাষি কাউছার মিয়া বলেন, ‘মহাসড়কের পাশে বাজার হওয়ায় তীব্র যানজট তৈরি হয়। প্রতিদিনই ছোটখাটো দুর্ঘটনা লেগেই আছে। লটকনের একটা স্থায়ী বাজার হলে আমরা সবাই উপকৃত হব।
নরসিংদী কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের উপপরিচালক আজিজুর রহমান বলেন, ‘লটকনের আবাদ বাড়াতে বিজ্ঞানসম্মত উপায়ে চারা উৎপাদন করাসহ কৃষকদের প্রয়োজনীয় পরামর্শ দেওয়া হচ্ছে। দেশের চাহিদা মিটিয়ে বিদেশের বাজারে রফতানি হওয়ায় কৃষকরা এখন লটকনের ন্যায্য দাম পাচ্ছেন। এখানকার মানুষ লটকন চাষের দিকে আরও বেশি ঝুঁকে পড়ছেন।’ফলটির চাহিদা অনেক। তাই লটকনের এমন কোনো জাত উদ্ভাবন করা যায় কি না যেটি বছরের অন্য সময়ও ফলন দেবে, এ বিষয়ে গবেষনার প্রয়োজন।
২০০৮ সালের পরে ইউরোপ ও মধ্যপ্রাচ্যেও বিভিন্ন দেশে লটকনের রফতানী শুরু হয়। লটকনের হাটের নাম মরিজাল যা ঢাকা সিলেট হাইওয়েতে অবস্থিত এবং মৌসুমে সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত চাষীরা লটকন নিয়ে বাজারে আসে এবং পাইকাররা ক্রয় করে তা ঢাকা সহ দেশের বিভিন্ন মোকামে সরবরাহ করে থাকে। আবার অনেক ব্যবসায়ীরা সরাসরি চাষীদের কাছ থেকে আগাম লটকন বাগান কিনে থাকে ভাল ব্যবসার আশায়। শীবপুর উপজেলার জয়নগর গ্রামের সুমন দাস বলেন এটি অত্যন্ত লাভজনক ফল যার প্রতি ঘিাতে খরচ পরে দশ হাজার টাকার মত এবং লাভ হয় তার ছেয়ে অনেক বেশী। এই ফলটি টক-মিষ্টিতে ভরপুর এবং এর বহদি ব্যবহার রয়েছে যেমন জেলি তৈরীতে, মেডিসিন শিল্পে, জ্বালানী কাঠে ইত্যাদি। এই ফলটি শিশুদের কাছে খুবই প্রিয় ফল। লটকনের উপর বেশ কিছু গবেষনা হয়েছে কৃষি গবেষনা ইনষ্ঠিটিউট কর্তৃক এবং লটকন-১ তার মধ্যে অন্যতম যার সম্প্রসারন জরুরী।
লেখক: গবেষক ও অর্থনীতিবিদ
সারাবাংলা/এসবিডিই