Friday 22 Nov 2024
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

অর্থনীতি পুনরুদ্ধারে নতুন সরকারের চ্যলেঞ্জ

ড. মিহির কুমার রায়
১১ আগস্ট ২০২৪ ১৬:২১

কথায় বলে শেষ ভাল যার সব ভাল তার। কিন্তু, এখনদেখা যাচ্ছে শুরু ভাল যার সব ভাল তার। নতুন অর্থবছরের প্রথম মাসেই কোটা সংস্কার আন্দোলন ঘিরে দেশে যে পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছলি তা অর্থনীতির জন্য শুভ ছিল না। ১ জুলাই আন্দোলন শুরু হয় এবং ৫ আগস্ট প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার পদত্যাগের মধ্য দিয়ে তা শেষ হয়। এরপর আন্দোলনকারীরা তাদের পছন্দমতো সরকার গঠনের জন্য কর্তৃপক্ষের সঙ্গে আলোচনা করে। যথারীতি ৮ ই আগষ্ঠ ১৭ সদস্য বিশিষ্ঠ কেয়ার টেকার সরকার শপথ গ্রহন করে যাদের ঘোষিত মুল দায়িত্বের মধ্যে রয়েছে জননিরাপত্তা ও অর্নৈতিক পুনরুদ্ধার।এখানে উল্লেখ্য যেএবারের শিক্ষার্থী আন্দোলন চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যের দিক থেকেও ছিল ব্যতিক্রম। সরকারি চাকরিতে কোটা সুবিধা সংস্কারের দাবিতে আন্দোলন শুরু হলেও শেষ পর্যন্ত তা একদফা দাবিতে পরিণত হয়। সেই দাবি ছিল প্রধানমন্ত্রীসহ সরকারের সব মন্ত্রীর পদত্যাগ। দেশে এবারকার আন্দোলন ঘিরে সংঘাত-সহিংসতা এমন পর্যায়ে পৌঁছে যে, আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে সবখানে। মাত্র কদিনে ঘটে রেকর্ড প্রাণহানি। অনিশ্চয়তা হয়ে ওঠে তীব্র। সুদীর্ঘ সময় পর দেশে জারি হয় কারফিউ; নামানো হয় সেনাবাহিনী। ঘোষিত হয় ‘সাধারণ ছুটি’। তার আগে ইন্টারনেট হয় বন্ধ। এরও সুগভীর প্রভাব পড়ে জনজীবনে আর অর্থনীতিতে নেমে আসে স্থবিরতা। শুরতে শুধু পণ্য চলাচল ব্যাহত হলেও পরে ডিজিটাল লেনদেনের সুযোগ হয় রহিত।

বিজ্ঞাপন

সরকার পতনের সময় থেকে নুতন সরকারের দায়িত্ব গ্রহন পযন্ত এ তিনদিন দেশে কোন প্রশাসন না থাকায় সারা দেশের নিরাপত্তা ব্যবস্থা ভেঙ্গে পরতে দেখা যায়। ফলে সমাজ বিরোধীদের দৌরাত্ত, চুরি, ডাকাতি, লোটপাট, সংখ্যালঘুদের বাড়ীতে আক্রমনি ইত্যাদির কারনে জনজীবনে এক আতঙ্কের সৃষ্টি হয় যাছিল উল্লেখ করার মত। যখন কোটা সংস্কার আন্দোলন শুরু করে, তখন তা ছিল শান্তিপূর্ণ ও অহিংস। কিন্তু পরবর্তীকালে পরিস্থিতি অহিংস থাকেনি।একপর্যায়ে বাংলাদেশ টেলিভিশন ভবন, মেট্রোরেল, সড়ক ভবনসহ বিভিন্ন রাষ্ট্রীয় গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনায় হামলা চালিয়ে ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগ করা হয়। এটা স্পষ্ট, শিক্ষার্থীরা এসব হামলার সঙ্গে জড়িত ছিল না।তারা বলেছে, তারা কোনো রাষ্ট্রীয় স্থাপনায় হামলা চালায়নি। যা হোক, আন্দোলন সহিংস রূপ ধারণ করলে আইন প্রয়োগকারী সংস্থার সদস্যরা তা কঠোর হাতে দমনের চেষ্টা করে। এতে অনেক তাজা প্রাণ অকালে ঝরে যায়। কারও কারও মতে, মৃতের সংখ্যা তিন শতাধিক। তাদের মধ্যে শিক্ষার্থীর সংখ্যাই বেশি। বেশকিছু শিশু-কিশোর নিহত হয়েছে। এদেশের ইতিহাসে আর কোনো আন্দোলনে এত বিপুলসংখ্যক মানুষের প্রাণহানি ঘটেনি। সেনাপ্রধান জাতির উদ্দেশে দেওয়া তার ভাষণে বলেছেন, প্রতিটি হত্যাকাণ্ডের বিচার করা হবে।

বিজ্ঞাপন

এখন কোটা সংস্কার আন্দোলনের সঙ্গে সংযুক্ত ছাত্রনেতারা বলছেন দেশের সকল অঙ্গে তারা সংস্কার চায় যেমন ১. গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানকে শক্তিশালী করার জন্য বিচার বিভাগ, নির্বাচন কমিশন এবং দুর্নীতিবিরোধী সংস্থাসহ গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলোর স্বাধীনতা ও কার্যকারিতা নিশ্চিত করা; ২. রাজনীতিতে তরুণ নেতা ও পেশাজীবীদের অংশগ্রহণকে উৎসাহিত করা; ৩. যুবকদের মধ্যে নাগরিক কর্তব্যবোধ গড়ে তোলার জন্য নাগরিক শিক্ষাকে জাতীয় পাঠ্যক্রমে একীভূত করতে হবে; ৪. দুর্নীতিবিরোধী আইন শক্তিশালী করা, সরকারি লেনদেনে স্বচ্ছতা বাড়ানো এবং সরকারি কর্মকর্তাদের জবাবদিহির মাধ্যমে দুর্নীতিকে কার্যকরভাবে মোকাবিলা করার জন্য প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ; ৫. রাজনৈতিক সংলাপকে উৎসাহিত করতে রাজনৈতিক দল, সুশীল সমাজ এবং অন্যান্য স্টেকহোল্ডারের মধ্যে সংলাপের জন্য প্ল্যাটফরম স্থাপন বিভাজন দূর করা; ৬. শিক্ষার্থী এবং সুশীল সমাজের উদ্বেগগুলোকে গুরুত্ব দেওয়া ;৬. মানবাধিকার ও আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা করা; ৭. ভবিষ্যৎ নেতৃত্বের জন্য, বিশেষ করে তরুণ প্রজন্মের জন্য রাজনৈতিক, পেশাগত ও নৈতিক সংস্কারকে আরও ভালোভাবে মানিয়ে নিতে বাংলাদেশের রূপান্তরের জন্য বেশকিছু গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক সংস্কার; ৮. এ সংস্কারগুলো বাস্তবায়নের মাধ্যমে দেশে একটি অধিকতর অন্তর্ভুক্তিমূলক, গণতান্ত্রিক ও স্বচ্ছ রাজনৈতিক ব্যবস্থা গড়ে উঠতে পারে, যা তরুণ নেতৃত্বকে উৎসাহিত করবে।

এই সকল বিষয়গুলো সংস্কার করতে যতদিন সময় লাগবে ততদিন গনতান্ত্রিক প্রকৃয়ায় যেতে অপেক্ষা করতে হবে বলে মনে করেন ছাত্র নেতৃবৃন্দ। কিন্তু জীবন জীবিকার জন্য অথর্নৈতিক কমকান্ড চালিয়ে যেতে হবে এবং নতুন সরকারের কাছে এটি একটি বড় চ্যলেঞ্জ হিসাবে বিবেচিত হওয়া উচিত। কারন কোটা সংস্কার আন্দোলনের কারণে দেশের অর্থনীতির যে ক্ষতি হয়েছে, তা কোনোভাবেই উপেক্ষা করা যায় না। কারও কারও মতে, আন্দোলনের সময় দেশে উৎপাদন এবং অন্যান্য খাতে যে আর্থিক ক্ষতি হয়েছে, তার পরিমাণ ১ লাখ কোটি টাকা থেকে ১ লাখ ২০ হাজার কোটি টাকা। কিন্তু এটা পূর্ণাঙ্গ হিসাব নয়। সরকারিভাবে এখনো ক্ষয়ক্ষতির কোনো পরিসংখ্যান প্রকাশ করা হয়নি। তবে ক্ষতির পরিমাণ যে ব্যাপক এতে কোনো সন্দেহ নেই। আন্দোলনের কারণে দেশের উৎপাদনব্যবস্থা বিপর্যস্ত হওয়া ছাড়াও অবকাঠামোর ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে। এগুলো মেরামত করে ব্যবহার উপযোগী করতে বেশ কিছুটা সময় ও অর্থের প্রয়োজন হবে। অর্থনীতিবিদরা বলছেন, চলমান পরিস্থিতি অর্থনীতির সংকটকে আরো বাড়িয়ে তুলবে। কারণ উচ্চ মূল্যস্ফীতি, ডলার সংকট ও রপ্তানি কমে যাওয়ার কারণে গত কয়েক বছর ধরেই বাংলাদেশ কঠিন চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করছে। আর সাম্প্রতিক পরিস্থিতি সংকটকে আরো দীর্ঘায়িত করবে।

এ ধরনের একটি পরিস্থিতিতে যা প্রয়োজন হবে তা হলো- এক: রেমিট্যান্স বাড়ানোর জন্য প্রবাসী বাংলাদেশিরা যাতে বৈধ চ্যানেলে রেমিট্যান্স দেশে প্রেরণ করে, সেজন্য তাদের উদ্বুদ্ধ করতে হবে। অর্থনীতির একটি বড় সমস্যা হচ্ছে বৈদেশিক মুদ্রা রিজার্ভের স্ফীতি ক্রমেই হ্রাস পাওয়া। গত এক বছরে বৈদেশিক মুদ্রা রিজার্ভের পরিমাণ প্রায় ১ হাজার কোটি মার্কিন ডলার কমেছে। আইএমএফের হিসাব পদ্ধতি মোতাবেক জুলাই শেষে রিজার্ভের পরিমাণ ছিল ২ হাজার ৪৮ কোটি মার্কিন ডলার। এক বছর আগে এটি ছিল ৩ হাজার কোটি মার্কিন ডলার। বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ বাড়াতে হলে রপ্তানি আয় এবং রেমিট্যান্স প্রবাহ বৃদ্ধির কোনো বিকল্প নেই; দুইঃ সম্প্রতি মার্কিন ডলারের বিনিময় হার ক্রলিং পেগ পদ্ধতিতে নির্ধারণের ব্যবস্থা করা হয়েছে। যেখানে প্রতি মার্কিন ডলারের বিনিময় হার ছিল ১১০ টাকা এখন তা ১১৮ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। মার্কিন ডলারের বিনিময় হার বৃদ্ধির ফলে আমদানি ব্যয় বৃদ্ধি পেয়েছে। এতে রিজার্ভের ওপর চাপ বেড়েছে। আগামীতে ধীরে ধীরে ডলারের বিনিময় হার বাজারভিত্তিক করতে হবে; তিন: আন্দোলন চলাকালে দেশের বিভিন্ন স্থানে অবকাঠামোয় ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে। ক্ষতিগ্রস্ত অবকাঠামো দ্রুত পুনঃনির্মাণ/সংস্কারের ব্যবস্থা করতে হবে। যোগাযোগ ব্যবস্থাকে দ্রুত স্বাভাবিক পর্যায়ে নিয়ে আসতে হবে; চার: বিশ্বব্যাংকের উদ্যোগে প্রকাশিত সর্বশেষ ‘ইজ অব ডুয়িং বিজনেস’ সূচকে ১৯০টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান ছিল ১৭৬তম। তাই দেশের বিনিয়োগ পরিবেশ উন্নত করার জন্য কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে; পাঁচ: নতুন সরকারের একটি বড় দায়িত্ব হবে ব্যাংক খাতের সমস্যা সমাধানে বাস্তবসম্মত উদ্যোগ গ্রহণ করা। এ খাত সংস্কারের জন্য প্রয়োজনে একটি শক্তিশালী কমিশন গঠন করা যেতে পারে। বর্তমানে খেলাপি ঋণের হার যেভাবে বৃদ্ধি পাচ্ছে, তা কোনোভাবেই কাম্য নয়। খেলাপি ঋণের আধিক্যের কারণে অধিকাংশ ব্যাংকই বিনিয়োগযোগ্য তারল্য সংকটে পতিত হয়েছে; ছয়: ব্যাংক খাত থেকে দীর্ঘমেয়াদি ঋণ গ্রহণের প্রবণতা রোধে পুঁজিবাজারকে আরও গতিশীল করতে হবে। রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন বড় প্রতিষ্ঠানগুলোকে পুঁজিবাজারে নিয়ে আসতে হবে। আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলোকে পুঁজিবাজারে আসার জন্য উদ্বুদ্ধ করা যেতে পারে। রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন প্রতিষ্ঠানগুলোতে অভ্যন্তরীণ সুশাসন নিশ্চিত করতে হবে; সাত: অর্থনৈতিক সংস্কার এবং সমাজকল্যাণের সঠিক পদক্ষেপ গ্রহণ এখন বাঞ্ছনীয়। বেকারত্ব এবং অর্থনৈতিক বৈষম্যের মতো সামাজিক অসন্তোষের মূল কারণগুলোকে মোকাবিলা করে এমন অর্থনৈতিক সংস্কার বাস্তবায়ন করার উদ্যোগ গ্রহণ জরুরি। রাজনৈতিক সহিংসতায় ক্ষতিগ্রস্তদের জন্য সহায়তা এবং পুনর্বাসন কর্মসূচি প্রদান করা, সামাজিক বিভাজন নিরাময়ে সহায়তা প্রদান করার সঠিক পদক্ষেপ প্রয়োজন; আট: সরকারি কর্মকর্তাদের জন্য কঠোর স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতার ব্যবস্থা নিশ্চিত করা প্রয়োজন। এর মধ্যে রয়েছে বাধ্যতামূলক সম্পদ ঘোষণা এবং স্বাধীন তদারকি সংস্থাগুলোর সঙ্গে শক্তিশালী দুর্নীতিবিরোধী আইন। মেধাভিত্তিক নিয়োগ নিশ্চিত করা, যা সরকারি অফিস ও সিভিল সার্ভিসে নিয়োগে রাজনৈতিক সংশ্লিষ্টতা বা স্বজনপ্রীতির পরিবর্তে যোগ্যতার ভিত্তিতে হতে হবে।

লেখক: গবেষক ও অর্নীতিবিদ

সারাবাংলা/এসবিডিই

অর্থনীতি পুনরুদ্ধারে নতুন সরকারের চ্যলেঞ্জ ড. মিহির কুমার রায় মুক্তমত

বিজ্ঞাপন

খুলনায় যুবকের পেটে মিলল ইয়াবা
২২ নভেম্বর ২০২৪ ১২:০২

আরো

সম্পর্কিত খবর