সরকারের পতন হলেও অপশক্তির উত্থান বন্ধ হবে কী?
১২ আগস্ট ২০২৪ ১৫:২২
আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের মধ্য দিয়ে যদি বাংলাদেশ দ্বিতীয় কিংবা তৃতীয়বারে মতন স্বাধীনও হয়; তবে অপশক্তির উত্থান বন্ধ হবে কী? এ একটা প্রশ্ন রেখেই লিখাটি শুরু করছি। আওয়ামী লীগ সরকার ২০০৯ সালে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে সুষ্ঠু নির্বাচনের মধ্য দিয়ে ক্ষমতায় আসলেও পরবর্তীতে স্বদলীয় সরকার ও মন্ত্রিসভার মাধ্যমে প্রহসনের নির্বাচনের মাধ্যমে বার বার ক্ষমতা কুক্ষিগত করেছে। এতে, করে যেমন দিনে দিনে দলটির স্বেচ্ছাচারিতা বেড়ে গেছে, পাশাপাশি দলটির পতন দেলজার জন্যও, বিভিন্ন অপশক্তি দানা বেঁধেছে, বিভিন্ন সময় মাথাচাড়া দিয়েছে। যদিও এসব অপশক্তি কখনোই সফল হতে পারেনি। এখন ভয় হয়, আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের ফলে, সেসব অপশক্তি কখন জানি মাথা তুলে! আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের মুল কারণ ছিল, ক্ষমতার লোভ, দাম্ভিকতা এবং এবং বিরোধী মতের প্রতি দমন নিপীড়ন। আওয়ামী লীগ সরকার মনে করেছিল, দেশটা তাদের বাপ-দাদার সম্পত্তি, কিন্তু তারা এটা ভুলে গিয়েছিল, জনগণেই সকল ক্ষমতার উৎস।
যেহেতু একটা দল দীর্ঘ পনের বছর শাসন শোষণ করেছে, সেক্ষেত্রে স্বাভাবিকভাবেই দলটির প্রতি সাধারণ মানুষেরও মতবিরোধ থাকবে, সেক্ষেত্রে যদি সে সরকার বা দল ক্ষমতার অপব্যবহার করে, মানুষের ভোটাধিকার হরণ করে, মতামত প্রকাশের স্বাধীনতা ক্ষুন্ন করে, তবে ত কথাই নেই। আর, শেখ হাসিনার সরকার ঠিক এটাই করে ছিল। যার ফলে, শেখ হাসিনা ও আওয়ামী লীগের রাজনীতির সাথে জড়িত নেতা-কর্মীদের প্রতিও একটা চাপা ক্ষোভ যে মানুষের জমে আছে, তা স্বীকার করতেই হবে। তবুও, এহেন পরিস্থিতি সবাইকে শান্ত থাকতে হবে, এবং পরস্পরের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হয়ে কাজ করতে হবে। বিজয় অর্জনের পর, পরাজিত পক্ষের উপর জুলুম নির্যাতনের যে রাজনৈতিক সংস্কৃতি, আমাদের তরুণ প্রজন্মকে সেখান থেকে বের হয়ে আসতে হবে। এবং, আমাদের তরুণ প্রজন্ম যে দলকানা নয়, সবাই যে দলীয় লেজুড়বৃত্তি পছন্দ করে না; কোটা সংস্কার আন্দোলন তার জ্বলন্ত দৃষ্টান্ত। আমরা শত শত আওয়ামী লীগের রাজনীতির, ছাত্রলীগের সাথে জড়িত ব্যক্তি বিশেষকে দেখেছি, তাদের ত্যাগ করে কোটা আন্দোলনে সাধারণ ছাত্রদের সমর্থন দিতে। সুতরাং, একুশ শতকে আমাদের দলকানা না হয়ে, মানবিকতার পরিচয় দিতে, পরস্পরের প্রতি সহমর্মিতার হাত বাড়িয়ে দিতে হবে। যাতে, দীর্ঘদিন লুকিয়ে থাকা, যে অপশক্তি দানা বেঁধেছে, তারা মাথাচাড়া দিয়ে উঠতে না পারে। আমার দেশের কোনো মানুষের উপর, কোনো ব্যক্তির উপর, প্রতিষ্ঠানের উপর, ধর্মের উপর যেন জুলুম, অত্যাচার ও ভাঙচুর করতে না পারে। আমাদের এ অর্জনকে আমরা স্বাধীনতা বলি আর স্বৈরাচারের পতন বলি, যে নামেই আখ্যায়িত করি, তা ব্যর্থ হয়ে যাবে; যদি এ সুযোগ আবার জাতির পতাকা খামচে ধরে পুরোনো শকুন! যদি আবারও ধর্মীয় মতভেদ ও বিশ্বাসের কারণে সংখ্যালঘুদের উপর হামলা হয়, ধর্মশালায় ভাঙচুর হয়, সেক্ষেত্রে আমাদের এ অর্জন ম্লান হয়ে যাবে। কীভাবে এ অপশক্তির উত্থান হতে পারে, কারা এ পুরনো শকুন; তাদের ভবিষ্যৎ কর্মপন্থা কী হতে পারে এবং এর থেকে পরিত্রাণের উপায় লিখেই শেষ করব।
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র সমাজের ব্যানারে, কোটা সংস্কার আন্দোলনের যৌক্তিক দাবির প্রেক্ষিতে ছাত্রসমাজ যে স্বাধীনতা ছিনিয়ে এনেছে, এর পেছনে এদেশের সর্বমহলের হাত রয়েছে। বিশেষ করে, আমাদের নারী সমাজ যে ভুমিকা রেখেছে, আমাদের মায়েরা যে ভুমিকা রেখেছে, জাতি আজীবন এটা মনে রাখবে। এ আন্দোলন শুরু থেকেই সাধারণ ছাত্রদের আন্দোলন ছিল বলেই, শেষ পর্যন্ত সাধারণ জনগণ এবং বাবা-মায়েরাও স্বতঃস্ফূর্তভাবে অংশ নিয়েছে। তবে, এতে করে যারা রাজনৈতিক হীনমন্যতা চরিতার্থ করার জন্য, সাধারণ ছাত্রদের মধ্যে ঢুকে পড়েছে, বিভিন্ন ধংসাত্মক কর্মকাণ্ড চালিয়েছে তারা কখনোই সাধারণ ছাত্র হতে পারে না। একইভাবে সরকার পতনের পরও যারা বিভিন্ন সরকারি অফিস আদালতে হামলা চালিয়েছে, আওয়ামী লীগের রাজনীতির সাথে জড়িত নেতা-কর্মীদের বাড়ি-ঘরে হামলা চালিয়েছে, অগ্নিসংযোগ করেছে, তারাও কখনো সাধারণ ছাত্র হতে পারে না। যারা এ কাজ গুলো করছে, তারাই জাতির পুরনো শকুন! হয়তো, নতুনভাবে ফিরে এসেছে, ফিরে আসছে। জাতির এ অপশক্তিধর গোষ্ঠী সুযোগ বুঝে, আবার জ্বালাও পোড়া এর সংস্কৃতি চালু করবে। সংখ্যালঘুদের উপর হামলা করে, ধর্মীয় রায়ট সৃষ্টির পয়তারা করবে। এখন, কথা হচ্ছে তারা কারা? তারা হল, যাদের এক সময় আমরা এ বাংলাদেশকে বিতাড়িত এবং অবাঞ্চিত ঘোষণা করেছি। যারা, একসময় এ দেশটাকে লুটেপুটে খেয়ে দেশ ছেড়ে পালিয়েছে। যারা এ দেশের ধর্মের নামে মানুষ হত্যা করেছে। তাদেরকে প্রতিহত করাও আমাদের সাধারণ ছাত্রদের দায়িত্ব, সাধারণ জনগণের দায়িত্ব ; নতুবা দেখবেন; ধীরে ধীরে এদেশটাও তালেবানদের দখলে চলে যাবে; হয়ে যাবে আফগান! এ অপশক্তি, প্রথমে সাধারণ ছাত্র ও জনগণের সাথে মিশে স্বৈরাচারদের বিচার চাইবে, তারপর সাধারণ ছাত্রদের নামে আওয়ামী লীগ ও সংখ্যালঘুদের উপর নির্যাতন করবে, এরপর ধীরে ধীরে নিজেদের শক্তির জানান দিবে, তারপর একদিন আবারও পুরনো রুপে ফিরে আসবে। তখনও আমাদের টিকে থাকা দায় হবে। সুতরাং, অর্জনের স্রোতে গা না ভাসিয়ে, আমাদের মনে রাখতে হবে, ‘স্বাধীনতা অর্জনের চেয়ে স্বাধীনতা রক্ষা করা কঠিন’।
বাংলাদেশ কখনোই কোনো রাজনৈতিক দলের কিংবা নেতার ছিলো না। আজকে যিনি নেতা বা আদর্শ কালকে তিনিই হবেন খলনায়ক! ইতিহাসের পিছনে তাকালে, আমরা যুগে যুগে, দেশে দেশে সেই দৃশ্যই দেখতে পায়। সুতরাং, আমাদের একটা জিনিস বুঝতে হবে, সময় মানুষকে নেতা বানায়, আবার মীরজাফরও বানায়। আজকে যারা, মোড়ে মোড়ে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ভাস্কর্য ভাঙচুর করছে, তারা অনেকেই জানে না; একদিন তাদেরই বাবা-দাদারা এ শেখ মুজিবের কথায় রাজপথে নেমেছিল, যুদ্ধ করেছিল, বাংলাদেশ স্বাধীন করেছিল। সুতরাং কালের পরিবর্তন বঙ্গবন্ধুর গৌরব হারিয়ে গেছে, একইভাবে, আমরা যদি ধৈর্য না ধরি, এ জ্বালাও পোড়া এবং ভাঙচুর এর পদ্য দীর্ঘ করি; এর মাশুলও আমাদেরই দিতে হবে। আজকে যে থানা কিংবা পুলিশ কার্যালয়, রাষ্ট্রীয় স্থাপনা ধংস করছি, আগামীকাল সেগুলো আবার আমাদের তথা রাষ্ট্রের টাকা দিয়ে মেরামত করতে হবে। যেহেতু সরকার পদ ত্যাগ করদছে, সাধারণ ছাত্রদের উচিত, সমন্বয়কদের উচিত কাল বিলম্ব না করে, যৌথ ঘোষণা দিয়ে ঘরে ফিরে যাওয়া। যাতে, তাদের মধ্যে থেকে, কেউ দীর্ঘদিনের রাজনৈতিক ক্ষোভের প্রতিশোধ নিতে না পারে। এ মুহুর্তে কেউ কেউ বলছেন, অস্থায়ী সরকার গঠনের জন্য ছাত্রদের মতামত, রূপরেখা ইত্যাদি গ্রহণ কিংবা প্রাধান্য দেওয়ার জন্য, এটা সম্পূর্ণই অযৌক্তিক! যে ছাত্ররা আন্দোলন করেছে, তারা সবাই মেধাবী ছাত্র! দেশ কীভাবে চালাবে, কে চালাবে সেটা এখনো তাদের স্তরের বিষয় নয় এবং তাদের পড়াশোনার বাইরে আপাতত রাজনীতির মত বিষয়ে না জড়ানোই উত্তম। আমি মনেকরি, দেশ চালাতে যে বুদ্ধি ও প্রজ্ঞা সেটা সেনাবাহিনীর এবং অস্থায়ী সরকারের তালিকায় যে সুশীলদের নাম শোনা যাচ্ছে, তাদের আছে। তবে হ্যাঁ, ছাত্ররা একটা দাবি করতেই পারে, এ মুহুর্তে কোনো রাজনৈতিক মতাদর্শের লোক যেন, অস্থায়ী সরকারে না থাকে। এছাড়াও সেনাবাহিনীর উপর ভরসা করে, নিজেদের শান্ত রাখা, যাতে রাজনৈতিক পশুরা দেশে আর কোনো হত্যা ও ধংসাত্মক কার্যকলাপ চালাতে না পারে! অন্যথায়, এ ধংস লীলা আমাদের এ অর্জনকে ম্লান করার পাশাপাশি রাষ্ট্রের বড়ো ধরনের ক্ষতির কারণ হতে পারে। যেহেতু, ইতোমধ্যে ছাত্ররা চেয়েছিল, সেনাবাহিনী দেশের ক্ষমতা গ্রহণ করুক, এবং অবশেষে সেনাবাহিনী দেশের দায়িত্বভার নিয়েছে, সেই সাথে আন্দোলনকারীদের সব দাবি মেনে নিয়ে বিচারের নিশ্চয়তা দিয়েছে, সেক্ষেত্রে সাধারণ ছাত্রদের আর কোনো নতুন দাবি-দাওয়া না করেই, ঘরে ফিরে যাওয়া উত্তম। আমাদের আন্দোলনকারী সাধারণ ছাত্র-ছাত্রী ও আমজনতার আপাতত এ বোধদয় হলেই বাঁচি! হবে কি?
লেখক: কবি ও প্রাবন্ধিক
সারাবাংলা/এসবিডিই
আসহাবে কাহাফ মুক্তমত সরকারের পতন হলেও অপশক্তির উত্থান বন্ধ হবে কী?