শান্তিপূর্ণ আন্দোলনের ক্রাশ কোর্স
২১ আগস্ট ২০২৪ ১৪:২০
আমি মনে করি, শেখ হাসিনা বৈষম্য-বিরোধী ছাত্র আন্দোলনের পক্ষে ছিলেন—কিন্তু কিভাবে? শেখ হাসিনার অনুসারীরা বারবার দাবি করেছে যে বিএনপি, জামাত, শিবির, হেফাজত, এবং পাকিস্তানের এসআইএস এই আন্দোলনে উস্কানি দিয়েছে। তাদের মতে, ছাত্রদের ব্যবহার করে আন্দোলনকে সফল করেছে বিএনপি, জামাত, শিবির, হেফাজত, এবং পাকিস্তান। এরপর আমেরিকাও যুক্ত হয়েছে বলে তাদের বক্তব্য।
তবে, যদি আমরা আন্দোলনটিকে প্রথম থেকেই পর্যবেক্ষণ করি, তাহলে দেখতে পাবো ছাত্ররা ১ জুলাই থেকে ১৪ জুলাই পর্যন্ত শান্তিপূর্ণভাবে আন্দোলন করেছে—কোথাও একটি ঢিলও ছোঁড়া হয়নি। ১৪ জুলাই শেখ হাসিনা প্রথমবারের মতো ছাত্রদের সাথে একাত্মতা প্রকাশ করে ‘রাজাকারের নাতি-পুতি’ উল্লেখ করেন। এতদিনের শান্তিপূর্ণ আন্দোলন একটি শব্দে উত্তাল হয়ে ওঠে। এর মাধ্যমে ধারণা করা যায়, শেখ হাসিনা হয়তো চেয়েছিলেন আন্দোলনকে আরও জোরালো করতে এবং আন্দোলনকে তীব্র করার জন্য প্রয়োজনীয় সব রসদ তিনি সরবরাহ করেছেন।
তার একান্ত অনুগত ওবায়দুল কাদের পরদিন ছাত্রলীগকে নির্দেশ দিয়ে আন্দোলনকে বৃহত্তর মাত্রায় নিয়ে যাওয়ার কথা বলেন। তিনি দাবি করেন, ছাত্রদের শায়েস্তা করার জন্য ছাত্রলীগই যথেষ্ট। এরপর আওয়ামী লীগের একাধিক মন্ত্রী আন্দোলনকে সফল করার জন্য সর্বোচ্চ চেষ্টা করেছেন।
শান্তিপূর্ণ আন্দোলনকে সশস্ত্র করার পিছনে শেখ হাসিনা এবং ওবায়দুল কাদেরের ভূমিকা ছিল সবচেয়ে বেশি। এখন যে আওয়ামী লীগ এই আন্দোলনের সফলতার জন্য বিএনপি, জামাত, শিবির, হেফাজত এবং পাকিস্তানকে বাহবা দিচ্ছে, তা হয়তো রাজনৈতিক কৌশল। আওয়ামী লীগের রাজনীতির কৌশল বোঝা খুবই কঠিন। আমি মনে করি, ছাত্রদের আন্দোলন সফল করার পেছনে সবচেয়ে বড় ভূমিকা পালন করেছে শেখ হাসিনা এবং আওয়ামী লীগ।
অতএব, যদি ভবিষ্যতে আওয়ামী লীগ এবং ছাত্রদের আন্দোলনের সাথে সম্পর্কিত দলগুলো এক প্ল্যাটফর্মে কাজ করে, এতে অবাক হওয়ার কিছু থাকবে না। এর মাধ্যমে রাজনৈতিক কৌশল এবং সম্পর্কের জটিলতার এক নতুন অধ্যায় শুরু হতে পারে, যা আমাদের চিন্তাভাবনায় নতুন দৃষ্টিভঙ্গি যোগাবে।
আদতে, এটি খুবই স্বাভাবিক যে একটি আন্দোলনের সফলতা এবং তার পেছনে থাকা রাজনৈতিক কৌশল একসাথে কাজ করে। আওয়ামী লীগ, ছাত্রদের আন্দোলন এবং তাদের ‘পূর্বসূরী’ রাজনৈতিক শিবিরদের মেলবন্ধন হঠাৎ করেই কেমন নতুন উদ্ভাবনী ধারণার জন্ম দেবে, ভাবুন তো! হয়তো আগামী দিনে তারা একসাথে এমন কিছু করবে যা ‘রাজনীতির গাইডবুক’ লিখে দিতে বাধ্য করবে। ইতিহাসের পাতায় এক নতুন অধ্যায় শুরু হতে পারে, যেখানে দেখানো হবে কিভাবে একসাথে মঞ্চে দাঁড়িয়ে পুরনো বিবাদ ভুলে এক নতুন যুগের সূচনা করা যায়—তবে অবশ্যই ‘রাজনীতির কারিগরি’ এবং ‘নতুন কৌশল’ সম্পর্কে সঠিক দিকনির্দেশনার ভিত্তিতে!
অনেকে মনে করতে পারেন আমি উপরের অংশ ব্যঙ্গাত্মক ভাবে লিখেছি। আমি আসলে অন্যভাবে মূল্যায়ন করে দেখাবার চেষ্টা করেছি,কি ভাবে কি ঘটে গেলো!বাস্তব অবস্থা উপলব্ধি করতে না পেড়ে যারা এখনো মন খারাপ করে আছেন তাদে জন্য আমার আহ্বান-
প্রিয় ভ্রাতা-ভগ্নিগণ, মন খারাপের ব্যামো থেকে বেরিয়ে আসুন; আওয়ামী লীগের বর্তমান দুরবস্থায় অবাক হওয়ার কিছু নেই। এটি একদিন না একদিন হওয়ারই কথা ছিল। আওয়ামী লীগ এতদিন নিজেদের অজেয় মনে করেছিল, ধরাকে রাজাকার জ্ঞান করেছিল। কিন্তু এখন তারা উপলব্ধি করছে, পিতার স্বপ্নের ভুল ব্যাখ্যার জটিলতা কতটা গভীর। নিজেরাই নিজেদের সর্বনাশের পথ তৈরি করেছে।
আওয়ামী লীগ সবসময় নিজেদের একটি অপ্রতিরোধ্য শক্তি ভাবত, একটি বিশাল হাতি, যাকে কেউ সরাতে পারবে না। কিন্তু হাতি যখন পাঁকে পড়ে, তখন চামচিকার লাথিও তার জন্য বিপজ্জনক হয়ে ওঠে। এটি কোনো অপ্রত্যাশিত ঘটনা নয়। ক্ষমতার অপব্যবহার, অবিচার ও প্রতিহিংসার বীজ বপন করলে সেসবই একদিন ফিরে আসে। বাংলাদেশের রাষ্ট্রক্ষমতা এমন এক অভিশপ্ত স্থান, যেখানে গিয়ে এখন পর্যন্ত কেউ শাপমুক্ত থাকতে পারেনি। ক্ষমতার এ অভিশাপ কোনো সাধারণ অভিশাপ নয়; এটি রাবণের অভিশাপের চেয়েও ভয়ংকর। যারা একবার রাষ্ট্রক্ষমতার স্বাদ পেয়েছে, তাদের অনেকেই নিজেদের নীতিগত অবস্থান থেকে সরে গেছে। অনেক পীর, মহাপীর, এমনকি অনেকে নিজেদের পয়গম্বর বলেও ভাবতে শুরু করেছে, কিন্তু ক্ষমতার প্রলোভন তাদের শয়তানের চ্যালায় পরিণত করেছে।
আওয়ামী লীগ যেভাবে প্রতিহিংসাপরায়ণ ছিল, সেই প্রতিটি প্রতিহিংসা তাদের দিকেই ফিরে আসছে। যে মায়ের বুক খালি হয়েছে, যে সন্তান এতিম হয়েছে, যে স্ত্রী বিধবা হয়েছে—তাদের প্রত্যেকের প্রতিশোধের আগুনে আওয়ামী লীগের পতন শুরু হয়েছে। ইলিয়াস আলী বা আবু সাঈদের পরিবার কখনোই আওয়ামী লীগকে ক্ষমা করবে না। রাজনৈতিক প্রতিহিংসা, নির্যাতন, গুম এবং খুনের মাধ্যমে আওয়ামী লীগ যে ক্ষত তৈরি করেছে, তা আজ তাদের নিজেদের দিকেই ফিরে আসছে।
এই পতন শুধু তাদের রাজনৈতিক ভাগ্যের পরিণতি নয়, এটি নৈতিক এবং সামাজিক পতনেরও প্রতিফলন। এতদিন বিএনপি-জামাতকে নর্দমায় সাঁতার কাটতে হয়েছে, এখন সেই নর্দমায় আওয়ামী লীগকেও নামতে হবে। এটাই সময়ের নির্মম সত্য।
পৃথিবীতে কোনো কিছু হারায় না; সবকিছুই সময়ের সিন্দুকে জমা থাকে। এই সিন্দুক একদিন খুলবেই, এবং তখন প্রতিটি অন্যায়ের জন্য চরম মূল্য দিতে হবে। আওয়ামী লীগ নিজেদের পাপে নিজেই ধ্বংস হবে। তাদের পতনের মধ্যে শুধুমাত্র দলীয় ধ্বংস নয়, জাতির কয়েকটি মহামূল্যবান অর্জনও ধ্বংস হয়েছে। স্বাধীনতা, মুক্তিযুদ্ধ, বঙ্গবন্ধু—এই কয়েকটি শুদ্ধতম বিষয়কে প্রশ্নবিদ্ধ করে গেছে আওয়ামী লীগ।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা নিয়ে গোটা কয়েক কুলাঙ্গার ছাড়া কেউ প্রশ্ন তুলত না। মুক্তিযুদ্ধের গৌরব এবং বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্ব নিয়ে কখনোই প্রশ্ন ওঠেনি। কিন্তু আওয়ামী লীগের স্বেচ্ছাচারিতা, দুর্নীতি এবং ক্ষমতার অপব্যবহারের কারণে মানুষ এখন বাঙালির এই মহত্তম অর্জনগুলোকেও প্রশ্নবিদ্ধ করছে। এই শাসনামল কেবল আওয়ামী লীগের নয়, পুরো বাংলাদেশের মর্যাদাকে প্রশ্নবিদ্ধ করেছে। আজ যখন তারা ধ্বংসের মুখোমুখি, তখন তাদের উচিত নিজের ভুলগুলো স্বীকার করে জাতির কাছে ক্ষমা চাওয়া। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনকভাবে, তাদের বর্তমান অবস্থা দেখে মনে হচ্ছে, তারা সেই ক্ষমাও পাবে না।
লেখক: যুক্তরাজ্য প্রবাসী, ছোটকাগজ ‘শব্দপাঠ’ সম্পাদক
সারাবাংলা/এসবিডিই