Thursday 05 September 2024
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

বন্যা কী খাদ্য নিরাপত্তার জন্য হুমকি?

ড. মিহির কুমার রায়
২৭ আগস্ট ২০২৪ ১২:৩৫

প্রতিটি মানুষের জন্য সুষম খাদ্যের নিরাপত্তা সরকারের অর্থনৈতিক নীতিমালার একটি অগ্রাধিকার বিষয় হলেও প্রতিটি দুর্যোগ বা ঘূর্ণিঝড় কিংবা বন্যা হউক না কেন তা আলোচনার প্রথম সারিতে চলে আসে। বর্তমান চলমান বন্যায়ও এই দৃষ্টিভঙ্গীর কোন ব্যাপ্তি নেইে।এখানে উল্লেখ্য যে আকস্মিক বাঁধ ছেড়ে দেওয়ার ফলে বণ্যায় তলিয়ে যায় আবার শুষ্ক মৌসুমে পানি আটকিয়ে রেখে দেশের নদী সমূহ শুকিয়ে মারা হয়। পৃথিবীর কোন দেশেই বাংলাদেশের মতো পানি আগ্রাসনের শিকার হয় না।প্রথমত: আমাদের দেশের সমতলভূমির পাশেই ভারতের পাহাড়ি এলাকা। সেখানে অতিরিক্ত বৃষ্টিপাত হলে বৃষ্টির সব পানি বাংলাদেশের সমতল ভূমিতে চলে আসে। এর ফলে বাংলাদেশ বন্যাকবলিত হয়। উপরন্তু পাহাড়ের বিভিন্ন স্থানে বাঁধ দিয়ে ভারত তার প্রয়োজনে পানি আটকিয়ে রাখে আর অতিবৃষ্টি হলে বাঁধ ছেড়ে দেয়। এর প্রভাবে বাংলাদেশের চট্টগ্রাম বিভাগ বিশেষ করে ফেনী, লক্ষীপুর, নোয়াখালী, কুমিল্লা সহ আরও ৮টি জেলা পানির নীচে যা বাংলাদেশের ইতিহাসে ভয়াবহ বণ্যা যেখানে প্রায় ৫০ লাখ মানুষের ও ৪ লাখ ৪০ হাজার ৮৪০টি পরিবার জীবনে নেমে এসেছে চরম দুর্গতি। ফেনী, নোয়াখালীসহ দেশের ১২ জেলায় বন্যায় ২ লাখ ৩০ হাজার হেক্টর জমির ফসল তলিয়ে গেছে। বৃহস্পতিবার (২২ আগস্ট) পর্যন্ত পাওয়া তথ্যে প্রাথমিকভাবে এ প্রতিবেদন দিয়েছে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর। সংস্থাটি বলছে, ১২ জেলায় এক লাখ ৩৮ হাজার ৬১৯ হেক্টরের আমন ধান, ৫৭০ হেক্টরের বোনা আমন ও ১২ হাজার ৯১০ হেক্টরের আমন বীজতলা প্লাবিত হয়েছে। এছাড়া ৬৮ হাজার ২০৯ হেক্টরের আউশ, ৯ হাজার ৫১৯ হেক্টরের শাকসবজি, ৩৮ হেক্টরের আখ এবং ১৯১ হেক্টরের পান প্লাবিত হয়েছে। এতে জেলাভিত্তিক তথ্যে বলা হয়েছে, অতিবৃষ্টি ও উজান থেকে নেমে আসা পাহাড়ি ঢলে আক্রান্ত ফসলি জমির পরিমাণ মুন্সিগঞ্জে ২৩০ দশমিক ৭ হেক্টর, সিলেটে ৩ হাজার ৩৮৯ হেক্টর, মৌলভীবাজারে ৪৩ হাজার ২৭১ হেক্টর, হবিগঞ্জে ৬ হাজার ৮৯৪ হেক্টর। এছাড়া চট্টগ্রামে ১২ হাজার ৮৯ হেক্টর, কক্সবাজারে ৪ হাজার ২৮৯ হেক্টর, নোয়াখালীতে ৩৬ হাজার ৭৪৫ হেক্টর, ফেনীতে ৩১ হাজার ৫৪৫ হেক্টর, লক্ষ্মীপুরে ৯ হাজার ৪৭৮ হেক্টর, কুমিল্লায় ৬৫ হাজার ১৩৫ হেক্টর, ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় ৬ হাজার ৪১৪ হেক্টর এবং চাঁদপুরে ১০ হাজার ৯২২ হেক্টর।দ্বিতীয়ত: ভারত থেকে আসা ৫৪টি এবং মিয়ানমার থেকে তিনটিসহ মোট ৫৭টি নদী শাখা-প্রশাখায় বিভক্ত হয়ে বাংলাদেশের ভেতর দিয়ে প্রবাহিত হয়েছে। বাংলাদেশে একসময় ১২০০- এর বেশি নদী ছিল কিন্তু এখন ২০০ নদীও সচল নেই। সব শুকিয়ে চিকন মরা খালে পরিণত হয়েছে। চিহ্নই থাকছে না। আমাদের তিন দিক দিয়ে ঘেরা বৃহৎ প্রতিবেশী দেশ ভারত আন্তর্জাতিক নদীর সকল নিয়ম-কানুন লঙ্ঘন করে একতরফাভাবে উজানে বাঁধ দিয়ে পানি প্রত্যাহার করে বাংলাদেশকে মরুভূমিতে পরিণত করছে। রাজশাহীর পশ্চিম সীমান্তে অন্যতম প্রধান নদী পদ্মার ১৯ মাইল উজানে মুর্শিদাবাদ জেলার ফারাক্কা নামক স্থানে ভারত ১৯৬১ সালে বাঁধ দেয়ার কাজ শুরু করে এবং ১৯৭৪ সালে ফিডার কেনেলসহ নির্মাণকাজ শেষ করে পরীক্ষামূলকভাবে চালু করে। ফারাক্কা বাঁধ চালুর আগে বাংলাদেশে হার্ডিঞ্জ ব্রিজের কাছে শীত মৌসুমে ৪৭ হাজার কিউসেক পানি প্রবাহ থাকত এখন তা শুধুই অতীত, ফলে বাংলাদেশের নদী এখন মরুভূমি যা খাদ্য নিরাপত্তার জন্য হুমকি স্বরুপ।

কিন্তু প্রশ্ন থাকে এই বিষয়টির তাত্ত্বিক বিশ্লেষণ নিয়ে যার মধ্যে রয়েছে প্রথমত: খাদ্যের প্রাপ্যতা (availabilities of food) যার মধ্যে রয়েছে আভ্যন্তরীণ উৎপাদন, খাদ্য আমদানি, খাদ্য সাহায্য এবং খাদ্যের মজুদ; দ্বিতীয়ত: খাদ্যের প্রবেশাধিকার (access to food) যার মধ্যে রয়েছে খাদ্যের ক্রয়ের সক্ষমতা এবং তৃতীয়ত: খাদ্যের সঠিক ব্যবহার (utilization of food)। আমরা যদি প্রথমটির বিশ্লেষণে যাই তাহলে দেখা যায় যে আভ্যন্তরীণ খাদ্য উৎপাদনে এ বছরে সংকেত বিশেষত: নতুন অর্বছরের শুরুতে দেশের দক্ষিন পূর্বাঞ্চলীয় বারটি জেলায় অকাল বন্যায় আমন ধান ক্ষেতএকেবারে পানিতে তলিয়ে গেছে যা দেশের সামগ্রিক খাদ্য ভান্ডারে একটি বিশাল ঘাটতির সৃষ্টি করব। অপরদিকে সেই অঞ্চলের ক্ষতিগ্রস্ত লোকদের মধ্যে বিনামূল্যে চাল বিতরণ, দারিদ্র্য বান্ধব চাল কর্মসূচি ইত্যাদির কারণে সরকারের চাল মজুদের পরিমাণ হ্রাস পাবে। অপর দিকে সরকারের চাল সংগ্রহ অভিযান তেমন সফল হয়নি বিশেষত: চাল কল মালিকদের অসহযোগিতার কারণে। দেখা যায় চালের সরকারি মজুদ গত মার্চ মাসে ৬ লাখ টনের নিচে নামলে চাল ব্যবসায়ী/চাল কলের মালিকেরা চালের মজুদ শুরু করে। গত এপ্রিলে সরকারি গুদামে চালের মজুদ ছিল ৩ লাখ টনের নিচে। খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে জুন-জুলাই মাসে কমপক্ষে ১৫ লাখ টন চাল খাদ্য গুদামে মজুদের প্রয়োজন ছিল। কিন্তু তা না করে ফলে খুচরা বাজারে রমজানের ঈদের আগে- পরে কয়েক দফায় চালের দাম বেড়েছে প্রকার ভেদে ৫০ টাকা থেকে ৭০ টাকা পর্যন্ত যা এখন পর্যন্ত অপরিবর্তিত রয়েছে। সরকারের চাল আমদানির পদক্ষেপও দামের পতন ঘটাতে সহায়ক হয়নি। আমরা যদি দ্বিতীয় প্রসঙ্গটিতে আসি তা হলে দেখা যাবে যে খাদ্য ক্রয়ের সক্ষমতা স্বভাবতই বন্যার্থদের মধ্যে থাকবে না যতক্ষণ পর্যন্ত তারা পুনর্বাসিত হয়ে অর্থনৈতিক কর্মকান্ডে যোগদান করতে পারবে। কারণ নিত্যপ্রয়োজনীয় মৌলিক খাদ্য (Basic needs goods) যেমন চাল, ডাল, সবজি, মাছ, মাংস, ডিম, পেঁয়াজ প্রভৃতির দাম সাধারণ মানুষের ক্রয় ক্ষমতাকে চ্যালেঞ্জ করেছে। এরি মধ্যে ২৪ আগস্ট শনিবার বিকেলে রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন যমুনায় এনজিও প্রতিনিধিদের সঙ্গে বৈঠকে এ আহ্বান জানান সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস এবং বন্যা মোকাবিলাকে সরকারের সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার উল্লেখ করে বেসরকারি প্রতিষ্ঠান ও দেশবাসীকে তা মোকাবিলায় সরকারের সঙ্গে একযোগে কাজ করার আহ্বান জানিয়েছেন। তিনি বলেছেন, সরকার এই মুহূর্তে বন্যা মোকাবিলাকে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দিচ্ছে। আমাদের অবশ্যই এ পরিস্থিতি মোকাবিলা করতে হবে। সবাইকে এ দায়িত্ব পালনে এগিয়ে আসতে হবে। গত ২৪ আগস্ট উপকূল ও দুর্গত এলাকায় কর্মরত ৪৪টি এনজিওর কর্তাব্যক্তিরা বৈঠকে অংশগ্রহণ করেন। বন্যা মোকাবিলায় উদ্ধার কার্যক্রম ও ত্রাণ বিতরণসহ আনুষঙ্গিক কার্যক্রমের ক্ষেত্রে সমন্বয় বাড়ানোর ওপর গুরুত্বারোপ করে ড. ইউনূস বলেন, বন্যা মোকাবিলায় সরকার, এনজিওসহ যারা যারা কাজ করছেন, তাদের সবার মধ্যে সমন্বয় বাড়াতে হবে। সম্ভব হলে জেলা পর্যায়েও বন্যা মোকাবিলার কাজে সমন্বিতভাবে করতে হবে। তিনি আরও বলেন, কোটি কোটি মানুষ বন্যায় উদ্ধার কার্যক্রম ও ত্রাণ নিয়ে এগিয়ে আসছে। তাদের মহৎ উৎসাহের যথার্থ ব্যবহার নিশ্চিত করা। এখন বিভিন্ন রাজনৈতিক, সামাজিক, ধর্মীয় ও এনজিও সংগঠন তাদের ত্রাণসামগ্রী নিয়ে আলাদাভাবে এগোচ্ছে যা সঠিক নয় যার কারণে সম্পদের অপব্যবহার হচ্ছে এবং দুর্নীতি ছড়াচ্ছে যা একক সংগঠনের মাধ্যমে হওয়া উচিত। এখন প্রশ্ন আসে এই অব্যাহত বন্যা পরিস্থিতি খাদ্য নিরাপত্তার জন্য কতটুকু হুমকি স্বরূপ? অবশ্য অব্যাহত বন্যার কারণে গ্রামীণ অর্থনীতির কৃষির অংশ যার সঙ্গে শস্য উৎপাদন জড়িত তা ভীষণভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে চলছে এবং এমন একটা সম্ভাবনা দেখা দিয়েছে চাল ও সবজির ঘাটতির, এরপর শুরু হবে সনাতন হিন্দু ধর্মালম্বীদের শারদীয় উৎসব যেখানে চাল ও সবজির একটা বড় চাহিদা থাকবে। এই পরিস্থিতি সরকারকে যদি মোকাবিলা করতে হয় তবে খাদ্য আমদানি জোরদার তার সঙ্গে প্রাধিকারের ভিত্তিতে বিতরণ ব্যবস্থা সুসংহত করতে হবে। এর সঙ্গে সঙ্গে যে সব এলাকায় পানি সরে গেছে কিংবা সরছে সে সব এলাকায় কৃষি পুনর্বাসন কর্মসূচি বিশেষত: আমনের বীজ তলা তৈরি, সবজির বীজ তলা তৈরি ইত্যাদিতে কাজ শুরু করে দিতে হবে যাতে আমন ধান বিলম্ব হলেও কৃষকের ঘরে তুলে দেশের খাদ্য নিরাপত্তাকে জোরদার করা যায়। যে সব গবাদি পশু বেঁচে গেছে তাদের সুরক্ষা, যারা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে তাদের ঋণ সহায়তা দেয়া, যে সব মৎস্য খামারির মাছের ঘের বন্যায় ভেসে গেছে তাদের আর্থিক সহায়তা প্রদান ইত্যাদি পুনর্বাসন কর্মসূচির প্রাধিকারভুক্ত কাজ হতে হবে যাতে অর্থনৈতিক কর্মকান্ডগুলো তাদের আয়ের পথে সহায়ক হতে পারে। এখন অর্থনৈতিক কর্মকান্ডগুলো সংগঠিত করার জন্য তাদের আশ্রয়স্থল বাসস্থান মেরামত অগ্রাধিকার ভিত্তিতে করতে হবে। বন্যার্তদের মনোবল সুদৃঢ় করার জন্য সামাজিক সংগঠনগুলো উদ্বুদ্ধকরণ কর্মসূচি হাতে নেবে যাতে তাদের ভরসার জায়গাটি আবার পুনঃস্থাপিত হতে পারে। অনেক গবেষক মনে করেন সরকারের টার্গেট খাদ্য কর্মসূচি অভিষ্ট গোষ্ঠীর হাতে সঠিকভাবে পৌঁছায় না এবং যা পৌঁছায় তা অপ্রতুল বলে প্রতীয়মান। সেই অবস্থার মোকাবিলায় যা করতে হবে তা হলো- প্রথমত: বন্যার্তদের ত্রাণ কার্যে অনিয়ম, দুর্নীতি, অব্যবস্থাপনা পুরোপুরি বন্ধ করতে হবে; দ্বিতীয়ত: চালের বাজারে সম্ভাব্য কারসাজি কঠোর হাতে দমন করতে হবে; তৃতীয়ত: সরকারি গুদামে চালের মজুদ দ্রুত বাড়াতে হবে এবং আমদানি ও আভ্যন্তরীণ কাজ দিয়ে প্রমাণ করতে হবে তারা খাদ্য ব্যবস্থাপনায় পারদর্শী, কথা দিয়ে নয়। মনে রাখতে হবে বানভাসি গ্রামীণ জনপদের মানুষগুলোকে মূল ধারায় ফিরিয়ে আনতে সরকারি প্রতিষ্ঠানের দায়িত্ব সবচেয়ে বেশি আর বেসরকারি সংগঠন তার সহযোগী। খাদ্য মানুষের মৌলিক অধিকার আর তা নিশ্চিত করতে হবে মানবিকতার সঙ্গে, ব্যবসা দিয়ে নয়। এ ব্যাপারে সামাজিক উদ্যোগক্তাদেরও ভূমিকা কম নয়।তবে খাদ্য নিরাপত্তার বিষয়টি যেহেতু খুব স্পর্শকতার তাই অত্যন্ত সতর্কতার সঙ্গে বিষয়টি সরকারের খাদ্য মন্ত্রণালয় অনুশীলন করবে এবং তথ্য প্রবাহের ব্যাপারে স্বচ্ছ হবে। গত কয়েকদিন যাবৎ দেশের সংবাদ মাধ্যম এই বিষয়টি নিয়ে আশঙ্কায় সংবাদ পরিবেশন করে চলছে যা দূর করতে হবে সরকারের সংশ্লিষ্ট দফতরের এবং বর্তমান চাহিদা মজুদের বিষয়টি নিশ্চিত হয়ে খাতটি (যদি থাকে) তা পূরণের সব ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। এ ব্যাপারে খাদ্য-বাণিজ্য-অর্থ এই তিনটি মন্ত্রণালয়ের মধ্যে সুষ্ঠু সমন্বয় সাধন করতে হবে এই প্রত্যাশা রইল।

লেখক : গবেষক

সারাবাংলা/এসবিডিই

ড. মিহির কুমার রায় বন্যা কী খাদ্য নিরাপত্তার জন্য হুমকি? মুক্তমত


বিজ্ঞাপন
সর্বশেষ
সম্পর্কিত খবর