Saturday 23 Nov 2024
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

নৌকা চলে তবু জীবন চলে না

খোরশেদ মাহমুদ
৩০ আগস্ট ২০২৪ ১৭:৪৫

“মনমাঝি তোর বৈঠা নে রে/আমি আর বাইতে পারলাম না/সারা জনম উজান বাইলাম/ভাটির নাগাল পাইলাম না”। আমাদের নদীমাতৃক বাংলার লোকগানের এই পঙ্ক্তি এখনো নদ-নদীর উত্তাল ঢেউয়ের সঙ্গে তাল মিলিয়ে ভেসে বেড়ায়। বাতাসে কান পাতলেই শোনা যায় তার সুর। এ গান যাদের কণ্ঠে মাদকতা ছড়ায় তাদেরই একজন নূরুল হক (৬৬)। পেশায় সে মাঝি। তাকে এই সম্প্রদায়ের বৈজষ্ঠ্যে প্রতিনিধি বলা যায়। হয়তো বা শেষ প্রতিনিধিও, কেননা এক সময়ের কত স্রোতস্বিনীই তো এখন মরা খাল! নদী এখন মৃতপ্রায় ।

বিজ্ঞাপন

রাজধানীর পাশ দিয়ে বয়ে চলা বুড়িগঙ্গাও তিতাসের মতোই একটি নদী ছিলো। তার তীরে বসবাসরত মানুষের জীবনও এক সময় বয়ে চলতো এ নদীর ওপর নির্ভর করেই। শত-শত বছর ধরে প্রবহমান বুড়িগঙ্গার জলের মতোই ছিল তাদের জীবন। সহজ সরল আর স্বাভাবিক। তবে দিন দিন বেড়ে যাওয়া আধুনিক শহরের আগ্রাসী ক্ষুধা আর শিল্পায়ন তছনছ করে দিয়েছে বুড়িগঙ্গা আর তার ওপর নির্ভর মানুষগুলোর জীবন। এমনই একজন নূরুল হক। প্রায় তিনযুগ ধরে নৌকা বেয়ে চলেছেন বুড়িগঙ্গার বুকে। বর্তমানে মৃতপ্রায় এই নদীর মতো তিনিও বেঁচে আছেন মুমূর্ষু অবস্থায়।

বিজ্ঞাপন

দখলে দূষনে বিপন্ন বুড়িগঙ্গাকে নিয়ে প্রতিবেদন করতে সরেজমিনে গিয়ে দেখা হয় তার সাথে। মাঝি নূরুল হকের বয়সের ভার আর নৌকা চালানোর ভঙ্গি আমার মনে ধরল। বয়োজ্যেষ্ঠ এই মাঝিকে নিয়ে একটা ফিচার লিখতে ইচ্ছে করলো। তাই বুড়িগঙ্গা নদীতে আমার ফিরে যাওয়া ।
ঘাটে ভিড়ল নূরুল হকের ছোট্ট ডিঙ্গি। এগিয়ে গেলাম। আমার হাতে ক্যামেরা দেখে নূরুল হক একটু আরষ্ট হলো? এ অসম্ভব নয়। অনেক বড়-বড় ব্যাক্তিরাও দেখেছি এমন করে । তাকে স্বাভাবিক করতে নিজেই কথা বললাম। পরিচয় দিলাম। কিন্তু যতটা ভেবেছিলাম ততটা সাড়া দিল না। ফ্যাল-ফ্যাল করে আমাকে দেখতে লাগল। কথা বলল না। এবার পাশের এক মাঝি ধমকে উঠলেন, এ কাহা, কথা কইস্নে ক্যান? ছারে সুম্বাদিক। ভালো কোরে কথা কও।ধমক খেয়েই সম্ভবত নূরুল হক স্বাভাবিক হলো । জানতে চাইলাম জলে ভাসা জীবনের কথা।

মঙ্গলবার, বুড়িগঙ্গার বুকে বয়ে চলা তার নৌকায় বসে বলেন তার জীবনের গল্প। যে গল্পে আছে এক মধুময় অতীত, দুর্বিষহ বর্তমান আর অনিশ্চিত ভবিষ্যৎ। সূর্য ওঠার আগেই বৈঠা হাতে বাসা থেকে বের হয়ে ঘাটে আসেন নূরুল হক। তারপর মধ্যরাত পর্যন্ত বিরামহীন নৌকা চালনা। তারপরও সংসার চলে না। সারা দিনে যা আয় তার সিংহভাগ যায় ঘাট মালিক আর বাজারে দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির যাতাকলে ।

তাই পাঁচ ছেলে-মেয়ে আর অসুস্থ স্ত্রীসহ তার জীবন এখন দুর্বিষহ । নূরুল হক বলেন, প্রায় তিনযুগ ধরে নদীতে নৌকা বাই। কিন্তু সুখের দেখা আজো পাইলামনা। আমাগো কপালই সুখ নাই। বাড়িতে স্ত্রী চিকিৎসার অভাবে বিছানায় পড়ে আছে। কী আর করবো। নৌকা চালিয়ে পোলাপানগো ভাত কাপড়ই দিতে পারি না, তার ওপর ওষুধ কিনবো কি দিয়ে তখন কেমন ছিল এ নদীএমন এক প্রশ্নের জবাব দিতে একটু সময় নেন তিনি। যেন এই সময়টুকুতে তিনি হাতড়ে নিলেন তার স্মৃতির হরানো দিন গুলির । তারপর আবার শুরু করলেন, তখন ঢেউয়ে উত্তাল ছিল বুড়িগঙ্গা। এ নদীর বুকে চলতো কত্ত বড়-বড় নৌকা। দেশ-বিদেশের নৌকা চকবাজার, ফরাশগঞ্জ, লালকুঠির ঘাটে ভিড়তো। ওই সময় নৌকাই ছিল যানবাহন। এহনতো কতকিছু হইছে। তারপর একটা দীর্ঘশ্বাস নিয়ে আবার বলেন, আমি প্রতিদিন সে সময় প্রায় ২০ টাকার কাম করতাম। কত সুখে দিন কাটতো। খুব ভালো আছিলাম। দেখতে-দেখতে গাংটা কেমন বদলাইয়া গেল। তারপর বেজার মুখে আবার বলেন, সব সময়ের দোষ বাবা সব সময়ের দোষ বাবা ।

বর্তমানে বুড়িগঙ্গার নোংরা-আবর্জনার কালো জলে নৌকা বায় প্রায় কয়েক হাজার মাঝি। তাদের জীবনের গল্পও হয়তো নূর“ল হকের মতোই। খোঁজ নিয়ে জানা যায়, বাবুবাজার ব্রিজ থেকে পোস্তগোলা ব্রিজ পর্যন্ত বিভিন্ন ঘাটে প্রায় চৌদ্দ হাজার মাঝি বুড়িগঙ্গায় নৌকা চালিয়ে জীবনধারণ করেন। এসব মাঝি ফজরের আজান থেকে শুরু করে রাত দুপুর পর্যন্ত নৌকা চালায়। জনপ্রতি পারাপারে নৌকাভাড়া ৫ টাকা। তবে ঘাট বিশেষে তা কমবেশি হয়। নৌকা চালিয়ে একজন মাঝি দিনে ৩০০ থেকে ৫০০ টাকা পর্যন্ত আয় করেন। তবে এই আয় থেকে দিনে ঘাটভাড়া দিতে হয় ৬০-৭০ টাকা। তারপর নৌকা ভাড়া বাবদ ৫০ থেকে ৬০ টাকা। তারপর রয়েছে ঊর্ধ্বমুখী বাসা ভাড়া আর সংসার খরচ। এভাবেই চলে যায় আয়ের সিংহভাগ। আফসোস করে মাদবর বাজার ঘাটের মাঝি নূরুল হক আমার সময় পত্রিকাকে বলেন, ঘাটে নৌকা নামালেই ইজারাদারকে ৭০ টাকা দিতে হয়। খ্যাপ হোক বা না হোক। এমনকি নৌকাওয়ালাকে দিনে ৬০ টাকা করে ভাড়া দিতে হয়। বাকি যা থাকে তা দুপুরের খাবারেই শেষ হয়ে যায়। এই জন্য বাসা ভাড়াও নিতে পরি না। তাই রাতে নৌকাতেই ঘুমাই। এসব ছাড়াও নূরুল হক তাদের পরিবারের সদস্যদের আবদার আর সন্তানের লেখাপড়া করাতে গিয়ে ভুলেছেন তার নিজের জীবনের কথা। তারা শুধু বয়ে চলেন নদীর মতো। তাদের আনন্দ আর দুঃখ মিলেমিশে এক হয়ে গেছে বুড়িগঙ্গার জলে। এবার নৌকা থেকে নামবো হঠাৎ নূরুল হক প্রশ্ন করে বসল, ‘এসব জেনে, ছবি দিয়ে আপনে কী কোরবেন? নামতে গিয়ে থমকে দাঁড়াই। তার দিকে তাকাই। কিন্তু কিছু বলতে পারি না। নিরুত্তর থেকে মাথা নিচু করে নৌকা থেকে নেমে আসি। সামনের দিকে পা বাড়াই। নূরুল হক চেয়ে থাকে।

লেখক: সাংবাদিক ও কলামিস্ট

সারাবাংলা/এজেডএস

খোরশেদ মাহমুদ নৌকা চলে তবু জীবন চলেনা