Thursday 05 September 2024
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

গণতন্ত্রের আড়ালে নিপীড়নের নীতি

আবু মকসুদ
৩ সেপ্টেম্বর ২০২৪ ১৬:৪৬

শামসুদ্দিন আহমদ মানিক একজন প্রাক্তন বিচারপতি এবং শেখ হাসিনার সরকারের একজন সুপরিচিত অনুগত ব্যক্তি ছিলেন। তিনি বিভিন্ন মিডিয়ায় শেখ হাসিনা সরকারের পক্ষে কথা বলতেন, যা একটি গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় স্বাভাবিক বলে গণ্য করা উচিত। সরকার বা এর নীতিমালার পক্ষে বা বিপক্ষে কথা বলা প্রত্যেক নাগরিকের অধিকার। একজন নাগরিকের সমর্থন বা সমালোচনা কোনওভাবেই বেআইনি নয়, বরং এটি গণতান্ত্রিক চেতনার একটি মৌলিক অংশ। যদিও শামসুদ্দিন আহমদ মানিকের বক্তব্যে কিছুটা উদ্ধত ভাব ছিল, তবুও সেটিকে মত প্রকাশের স্বাধীনতার চেয়ে বড় কিছু মনে করা ঠিক হবে না।

আওয়ামী লীগ সরকারের সময়কালে মত প্রকাশের স্বাধীনতা অনেক সময় বাধাগ্রস্ত হয়েছে। ইতিহাস ঘাঁটলে দেখা যাবে, আওয়ামী লীগ শাসনামলে মত প্রকাশের স্বাধীনতাকে নিয়ন্ত্রণ করার অসংখ্য উদাহরণ রয়েছে। বিশেষ করে ফরহাদ মজহার, মাহমুদুর রহমান, শহিদুল আলম, আদিলুর রহমান প্রমুখ ব্যক্তিদের ওপর নিপীড়ন চালানোর ঘটনাগুলো আমাদের স্মৃতিতে অম্লান। তারা আওয়ামী লীগ সরকারের রোষানলে পড়েছিলেন, কারণ তারা ভিন্নমত প্রকাশ করেছিলেন। এর ফলে তাদের বিরুদ্ধে ৫৪ ধারা প্রয়োগ করে নিপীড়ন চালানো হয়েছিল, যদিও পরবর্তীতে তাদের বিরুদ্ধে নির্দিষ্ট মামলা দায়ের করে দীর্ঘদিন কারাগারে আটকে রাখা হয়।

এই ধরনের নিপীড়নমূলক কর্মকাণ্ড রাজনৈতিক প্রতিহিংসার একটি রূপ এবং এটি গণতন্ত্রের মূল ভিত্তির পরিপন্থী। একজন ব্যক্তি যদি মতামত প্রকাশ করতে গিয়ে ক্ষমতাসীন দলের রোষানলে পড়ে এবং তার বিরুদ্ধে রাজনীতিক মামলা করা হয়, তবে তা গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের পরিপন্থী। আমাদের সমাজে এমন অনেক উদাহরণ রয়েছে যেখানে সরকার ভিন্নমত দমনের জন্য বেআইনি কার্যকলাপ করেছে, এবং এটি শুধু বর্তমান সরকারের জন্য প্রযোজ্য নয়, অতীতের সরকারগুলোর ক্ষেত্রেও দেখা গেছে।

শামসুদ্দিন আহমদ মানিকের গ্রেপ্তারও আমার কাছে রাজনৈতিক প্রতিহিংসার একটি অংশ বলে মনে হচ্ছে। তিনি কোনও আইন বহির্ভূত কাজ করেছেন বলে মনে হয় না। তার বক্তব্যের ধরন হয়তো সবার পছন্দ হবে না, তবে এটি মত প্রকাশের অধিকার থেকে বঞ্চিত করার যুক্তি হতে পারে না। গণতান্ত্রিক একটি সরকারের কাজ হওয়া উচিত মতামতের বৈচিত্র্যকে শ্রদ্ধা করা এবং তা রক্ষা করা। যারা সেদিন ৫৪ ধারার বিরুদ্ধে কথা বলেছিলেন, আজ তারাই সেই ৫৪ ধারার মাধ্যমে একজন ‘বাক স্বাধীনতার চর্চাকারী’ ব্যক্তিকে ফাঁসানোর চেষ্টা করছেন, যা অত্যন্ত নিন্দনীয়।

বর্তমানে আমরা দেখতে পাচ্ছি যে, সরকারের প্রভাবশালী ব্যক্তিরা নিজেদের সমালোচনার মুখোমুখি হতে নারাজ। তারা ভিন্নমতকে দমন করতে চাইছেন এবং এর ফলে মত প্রকাশের স্বাধীনতা প্রতিনিয়ত হুমকির মুখে পড়ছে। গণতান্ত্রিক একটি সমাজে এই ধরনের পরিস্থিতি কোনভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়। মতামতের স্বাধীনতা রক্ষা করার জন্য আমাদের আরও জোরালোভাবে আওয়াজ তুলতে হবে এবং সরকারের উচিত এই স্বাধীনতাকে সুরক্ষিত করা। কারণ, স্বাধীনতার জন্য সংগ্রাম করে অর্জিত এই দেশটিতে মত প্রকাশের অধিকারকে সংবিধান সম্মতভাবে রক্ষা করা উচিত।

এই সরকার যখন ক্ষমতায় আসে, তখন তারা গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারের কথা বলেছিল। কিন্তু বাস্তবে আমরা দেখতে পাচ্ছি যে, এই সরকার পূর্ববর্তী সরকারের চেয়ে বেশি ফ্যাসিবাদী এবং স্বৈরাচারী পদক্ষেপ নিচ্ছে। আমরা সমাজে অরাজকতা এবং বিশৃঙ্খলার উদাহরণ প্রতিনিয়ত দেখতে পাচ্ছি। সরকার যেসব পদক্ষেপ নিচ্ছে তা গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার পরিবর্তে গণতন্ত্রের ক্ষতি করছে।

শিক্ষকদের কান ধরে উঠবস করানো, গাছের সাথে বেঁধে পদত্যাগে বাধ্য করা কিংবা কোনও প্রতিক্রিয়ার ভয়ে সিদ্ধান্ত বদলানো – এই সমস্ত কার্যক্রম কোনও গণতান্ত্রিক সরকারের কাজ হতে পারে না। বরং এটি স্বৈরাচারী এবং দমনমূলক আচরণের পরিচায়ক। যারা সুশাসন এবং ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার প্রতিশ্রুতি দিয়ে ক্ষমতায় এসেছে, তাদের কাছ থেকে এ ধরনের আচরণ আশা করা যায় না। গণতন্ত্রের মূল ভিত্তি হল মানুষের অধিকার, মতামত এবং স্বাধীনতা রক্ষা করা। কিন্তু বর্তমান সরকার তার বিপরীত কাজ করছে, যা অত্যন্ত দুঃখজনক।

একইসঙ্গে, সরকারের উপদেষ্টারা প্রতিনিয়ত স্বাধীনতার কথা বললেও, বাস্তবে তা শুধুমাত্র কথার মধ্যেই সীমাবদ্ধ। স্বাধীনতা শব্দটির প্রকৃত অর্থ কী, তা তারা বুঝতে পারছেন না, কিংবা বুঝতে চাইছেন না। বাস্তবিক অর্থে স্বাধীনতা তখনই প্রতিষ্ঠিত হয়, যখন প্রতিটি নাগরিকের অধিকার ও মতামত রক্ষা করা হয়। কিন্তু বর্তমানে আমরা যা দেখছি, তা স্বাধীনতার অপব্যবহার।

এছাড়াও, বর্তমান সরকারের কার্যক্রমে একটি অরাজকতার ঝোঁক লক্ষ্য করা যায়, যেখানে তারা পূর্ববর্তী সরকারের মতামত দমনের অভিযোগকে বারবার উল্লেখ করছে। কিন্তু এই অভিযোগের মধ্য দিয়ে বর্তমান সরকারও একই পথে হাঁটছে, যা অত্যন্ত উদ্বেগজনক।

সরকারের উচিত ছিল, তাদের সমালোচনা গ্রহণ করা এবং তা থেকে শিক্ষা নেওয়া। কিন্তু তারা বরং আরও কঠোরভাবে মতামত দমন করতে উদ্যত হয়েছে। এই ধরনের আচরণ কেবল সমাজে অস্থিরতা এবং অসন্তোষ বৃদ্ধি করবে এবং গণতন্ত্রের ভিত্তিকে দুর্বল করবে।

এক্ষেত্রে একটি উদাহরণ উল্লেখ করা প্রাসঙ্গিক হবে: বর্তমানে সমাজে চলমান বিভিন্ন সংকট এবং বিশৃঙ্খলার পেছনে ১৬ বছরের ইতিহাসের ক্ষোভকে দায়ী করা হচ্ছে। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, ১৬ বছরের জমে থাকা ক্ষোভ কি ১৬ দিনে দূর করা সম্ভব? আমরা যখন কোনও পরিবর্তনের দাবি জানাই, তখন বলা হয় যে, ১৬ বছরের জঞ্জাল ১৬ দিনে সরানো সম্ভব নয়। এই যুক্তিই প্রমাণ করে যে, বর্তমান সরকারও পূর্ববর্তী সরকারের পথেই হাঁটছে এবং তাদের কাছ থেকে কোনও ভিন্নতর চর্চার আশা করা সম্ভব নয়।

আমরা যদি সত্যিকার অর্থে একটি পরিবর্তন চাই, তবে আমাদের উচিত এই ধরনের যুক্তির ফাঁদ থেকে বেরিয়ে আসা। ১৬ বছরের অরাজকতার পরিবর্তে ১৬ দিনের মধ্যে গণতান্ত্রিক চর্চার সূচনা হতে পারে, যদি সরকারের সদিচ্ছা থাকে। কিন্তু বাস্তবে আমরা দেখতে পাচ্ছি, পরিবর্তনের কথা বলে ক্ষমতায় আসা সরকার এখন সেই ১৬ বছরের অজুহাত দিয়ে তাদের নিজেদের অপকর্মকে বৈধতা দিচ্ছে।

আমরা কোন কিছুরই আবদার করছি না, বরং আমরা দেখতে চাই যে পূর্বের সরকার থেকে এই সরকার সত্যিকারের ভিন্নতর চর্চা করছে। আমরা চাই, তারা মানুষের বাক স্বাধীনতার অধিকার স্বীকার করে নিক এবং গণতান্ত্রিক মূল্যবোধকে শক্তিশালী করুক। গণপদত্যাগ কিংবা অটো পাস কোনও গণতান্ত্রিক সরকারের পদক্ষেপ হতে পারে না। আমরা এ ব্যাপারে সরকারকে সতর্ক করার চেষ্টা করছি এবং তাদের কাছে আশা করছি যে, তারা গণতন্ত্রের প্রকৃত চেতনা প্রতিষ্ঠা করবে।

সর্বশেষে, আমি নিশ্চিত হয়ে বলতে চাই যে, যদি সুষ্ঠু এবং সঠিক তদন্ত হয়, তবে শামসুদ্দিন আহমদ মানিকের বিরুদ্ধে কোনও আইন ভঙ্গের অভিযোগ প্রমাণিত হবে না। তিনি একজন প্রাক্তন বিচারপতি এবং আইন সম্পর্কে তার জ্ঞান রয়েছে। যতই অশালীন ভাষা ব্যবহার করেন না কেন, তিনি আইন ভঙ্গের মতো মূর্খতা করবেন না বলে আমি বিশ্বাস করি। আদালতে তার সঙ্গে যে আচরণ করা হয়েছে, সেটি অবশ্যই উদ্বেগের কারণ। আমরা যদি ফ্যাসিস্ট এবং স্বৈরাচারী সরকার থেকে উত্তরণের কথা বলি, তবে আমাদের উচিত সেই ধরনের আচরণ থেকে বিরত থাকা এবং গণতন্ত্রের প্রকৃত চেতনা প্রতিষ্ঠা করা।

লেখক: যুক্তরাজ্য প্রবাসী, ছোটকাগজ ‘শব্দপাঠ’ সম্পাদক

সারাবাংলা/এজেডএস

আবু মকসুদ তন্ত্রের আড়ালে নিপীড়নের নীতি


বিজ্ঞাপন
সর্বশেষ
সম্পর্কিত খবর