Tuesday 26 Nov 2024
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

আমরা বারবার ইতিহাস ভুলে যাই

এম আর লিটন
৪ সেপ্টেম্বর ২০২৪ ১৭:৪০

মানব ইতিহাসে বাঙালি জাতি তার আন্দোলন ও সংগ্রামের জন্য সুপরিচিত। বায়ান্নর ভাষা আন্দোলন থেকে শুরু করে একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ ও ১৯৯০ সালের গণঅভ্যুত্থানসহ বিভিন্ন সময় বাঙালি তার অধিকার ও সংস্কৃতির জন্য বহু লড়াই-সংগ্রাম করেছে। তবে দুঃখজনক হলেও সত্য, ওই আন্দোলনগুলোর ইতিহাস আমরা বারবার ভুলে যাই।

লেখক হুমায়ুন আজাদ যথার্থই বলেছেন, ‘বাঙালি আন্দোলন করে, সাধারণত ব্যর্থ হয়, কখনো কখনো সফল হয়; এবং সফল হওয়ার পর মনে থাকে না কেনো তারা আন্দোলন করেছিল।’ এই উক্তি বাঙালির সামাজিক ও ঐতিহাসিক অভ্যাসের কথা তুলে ধরে। সম্প্রতি প্রশ্ন উঠছে—এই জাতি ২০২৪ সালের ছাত্র আন্দোলনের কথা কি আদৌ মনে রাখবে?

বিজ্ঞাপন

ভাষা আন্দোলন আমাদের জাতির মৌলিক সত্ত্বাকে তুলে ধরেছে। কিন্তু তার চেতনা কি আজকের প্রজন্মের মনে যথাযথভাবে রয়েছে, নাকি তা কেবল একটি ঐতিহাসিক তারিখ হিসেবে রয়ে গেছে? ১৯৫২ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে ঢাকা শহরের রাস্তায় রক্ত ঝরেছিল শুধু মাতৃভাষার মর্যাদা রক্ষার জন্য। কিন্তু বর্তমানে আমরা এই ভাষার প্রতি আমাদের দায়িত্ব কীভাবে পালন করছি? একইভাবে, ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে আমরা স্বাধীনতা অর্জন করেছিলাম। কিন্তু তার ইতিহাসও আমরা সঠিকভাবে ধারণ করতে পারিনি। আমাদের মধ্যে ওই সোনালি ইতিহাস ভুলে যাওয়ার প্রবণতা দেখা যাচ্ছে, যেন তা কেবলমাত্র একটি পুরনো অধ্যায়।

বাঙালির শিল্প, সাহিত্য ও সংস্কৃতির অবস্থাও একই রকম। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, কাজী নজরুল ইসলাম, লালন শাহ, সত্যেন সেন, সুকান্ত ভট্টাচার্য ও জসিমউদ্দিনসহ অসংখ্য কবি, সাহিত্যিক, লেখক, সংগীতশিল্পী, গীতিকার, সুরকার, নাট্যকার, অভিনেতা—আমাদের সমৃদ্ধ সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য গড়ে তুলেছিলেন। তবে আজকের দিনে বাঙালি সমাজে তাদের প্রভাব আগের মতো কি আছে? নতুন প্রজন্ম কী তাদের যথাযথ মূল্যায়ন করছে, নাকি তাদের মহৎ কাজগুলো কেবল একাডেমিক পাঠ্য হিসেবে রয়ে গেছে?

বিজ্ঞাপন

প্রযুক্তির উত্থান ও সামাজিক মাধ্যমের ব্যাপক ব্যবহার ও গুজব ছড়ানোর ফলে ঐতিহাসিক ঘটনাগুলোর গুরুত্ব কমে যাচ্ছে। তরুণ প্রজন্মের একাংশ ইতিহাসের গুরুত্ব না বুঝে ভবিষ্যতের দিকে ধাবিত হচ্ছে। আমরা এ কারণে বারবার রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক সংকটে পড়ছি।

২০২৪ সালের ছাত্র আন্দোলনের প্রসঙ্গও উঠে আসে ওই ইতিহাসের ধারাবাহিকতায়। এই আন্দোলনও কি একদিন আমাদের স্মৃতিতে ধূসর হয়ে যাবে, যেমন আগের আন্দোলনগুলো? সামাজিক ও রাজনৈতিক অন্যায়ের বিরুদ্ধে ছাত্রসমাজ বারবার পথে নেমেছে, কিন্তু ওই লড়াই কতটা স্থায়ী প্রভাব ফেলে আমাদের সমাজে, তা নির্ভর করে সেই আন্দোলনের স্মৃতিকে আমরা কীভাবে ধারণ করি তার ওপর। যদি আমরা আমাদের অতীতের ভুল থেকে শিক্ষা না নিই, তবে ভবিষ্যতেও আমরা একই ভুল করতে থাকব।

আমাদের ইতিহাসে দেখা যায়, স্বাধীনতা আন্দোলনের মতো বিশাল ঘটনাও ধীরে ধীরে ম্লান হয়ে যায়। শিক্ষিত সমাজের একটি বড় অংশ এখন ঐতিহাসিক আন্দোলনগুলোর প্রকৃত মূল্যায়ন করতে ব্যর্থ হচ্ছে। ছাত্র আন্দোলনগুলো সাধারণত ক্ষণস্থায়ী জোয়ারের মতো দেখা যায়—তাতে অংশগ্রহণকারীরা কিছুদিন আন্দোলনের উত্তাপে থাকে, তবে এরপর সবকিছু থেমে যায়।

আন্দোলনের বিস্মৃতির জন্য শুধু প্রজন্মকে দায়ী করা ঠিক হবে না। আমাদের শিক্ষাব্যবস্থা, সমাজ ও রাজনীতি এর জন্য অনেকাংশে দায়ী। শিক্ষাব্যবস্থায় ইতিহাসের সঠিক চর্চা না থাকার ফলে প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে আমাদের গৌরবময় সংগ্রামের কথা ক্রমশ ম্লান হয়ে যাচ্ছে। আমরা জাতীয় আন্দোলনের গৌরবকে শুধুমাত্র বিশেষ দিনগুলোতে স্মরণ করার মধ্যে সীমাবদ্ধ রেখেছি।

বাঙালির ইতিহাস ভুলে যাওয়ার প্রবণতা একটি গভীর সমস্যা। এ কারণে আবারও ভবিষ্যতে জাতির অস্তিত্বের সংকট তৈরি করতে পারে। ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলন ও ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধ—প্রত্যেকটি ঘটনাই বাঙালির আত্মপরিচয়ের অংশ। এগুলোকে ভুলে যাওয়া মানে নিজেদের শিকড়কে ভুলে যাওয়া। একটি জাতির জীবনে ইতিহাসের গুরুত্ব অপরিসীম। ইতিহাসই জাতিকে পরিচয় দেয় এবং ভবিষ্যৎ গঠনের পথ দেখায়। বাঙালির ইতিহাস শুধুমাত্র অতীতের গল্প নয়, এটি বর্তমানের সমস্যা সমাধানের উপায় নির্দেশ করে এবং ভবিষ্যতের জন্য শিক্ষার গুরুত্বপূর্ণ উৎস।

অতীতের স্মৃতি রক্ষা করা মানে বর্তমানকে সঠিকভাবে মূল্যায়ন করা এবং ভবিষ্যতের প্রতি দায়িত্বশীল হওয়া। ইতিহাসের প্রতিটি সংগ্রাম থেকে আমরা শিখতে পারি কীভাবে জাতীয় ঐক্য ও গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের পথে এগিয়ে যেতে হবে। তাই, বাঙালিকে তার ইতিহাসকে সচেতনভাবে ধারণ করতে হবে, স্মৃতি সংরক্ষণ করতে হবে এবং পরবর্তী প্রজন্মের কাছে সঠিকভাবে পৌঁছে দিতে হবে।

লেখক: গণমাধ্যমকর্মী ও অনলাইন অ্যাক্টিভিস্ট

আমরা বারবার ইতিহাস ভুলে যাই এম আর লিটন মুক্তমত

বিজ্ঞাপন

আরো

সম্পর্কিত খবর