Friday 22 Nov 2024
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

গণমাধ্যম: লিঙ্গ বৈষম্যের প্রচারক নাকি পরিবর্তনের হাতিয়ার

মো. বজলুর রশিদ
৫ সেপ্টেম্বর ২০২৪ ১৬:৪২

বাংলাদেশে গণমাধ্যম লিঙ্গভূমিকা নির্মাণে একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। এটি আমাদের সমাজে লিঙ্গ সম্পর্কিত যে ধারণাগুলো প্রচলিত আছে, সেগুলোকে প্রতিফলিত করার পাশাপাশি সেগুলোকে আরও জোরদার করে। গণমাধ্যমের মাধ্যমে আমরা প্রতিনিয়ত এমন বার্তা পাই যা পুরুষ ও নারীর ভূমিকা সম্পর্কে নির্দিষ্ট ধারণা তৈরি করে।

ঐতিহাসিকভাবে বাংলাদেশের গণমাধ্যমে পুরুষদের চিত্রণে পিতৃতান্ত্রিক সমাজের প্রভাব স্পষ্ট। পুরুষদেরকে সাধারণত পরিবার ও সমাজের নেতা হিসেবে দেখানো হয়েছে। তারা বুদ্ধিমান, সাহসী এবং শক্তিশালী হিসেবে উপস্থাপিত হয়েছে, যাদের দায়িত্ব পরিবারের ভরণপোষণ, নেতৃত্ব দেওয়া এবং পরিবারকে রক্ষা করা। এই ধরনের চিত্রায়ন পুরুষদেরকে একধরনের আদর্শ হিসেবে উপস্থাপন করে যা সমাজের প্রচলিত লিঙ্গভূমিকার সাথে মিলে যায়।

বিজ্ঞাপন

অন্যদিকে, সমাজে নারীদেরকে প্রায়শই ঘরের কাজের মধ্যেই সীমাবদ্ধ করে দেখানো হয়। তাদেরকে শুধু মা, স্ত্রী এবং পরিবারের যত্ন নেওয়ার দায়িত্বে থাকা ব্যক্তি হিসেবে চিত্রিত করা হয়। নারীদেরকে কোমল, আজ্ঞাবহ এবং অতিরিক্ত সংবেদনশীল হিসেবে দেখার প্রবণতা রয়েছে।

আমাদের দেশের টেলিভিশন নাটক, চলচ্চিত্র এবং বিজ্ঞাপনে নারীদের চিত্রণে স্পষ্টভাবে লক্ষ্য করা যায় যে তাদেরকে প্রায়শই পুরুষের উপর নির্ভরশীল হিসেবে দেখানো হয়। এই ধরনের চিত্রায়ন নারীদের স্বতন্ত্র পরিচয়কে অস্বীকার করে এবং তাদেরকে পুরুষের সাথে সম্পর্কিত করেই তাদেরকে সংজ্ঞায়িত করে। এমনকি সংবাদমাধ্যমেও এই অসাম্য দেখা যায়। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে, সংবাদ উপস্থাপক, বিশেষজ্ঞ বা মন্তব্যকারী হিসেবে পুরুষদেরকেই বেশি গুরুত্ব দেওয়া হয়। নারীদের কণ্ঠস্বর কম শোনা যায় এবং তাদেরকে কম গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে কথা বলতে দেখা যায়।

বিজ্ঞাপন

গণমাধ্যমে নারী-পুরুষের ভূমিকা নিয়ে যে ভুল ধারণা ছড়ানো হয়, তা সমাজের উপর খুবই খারাপ প্রভাব ফেলে। যখন গণমাধ্যম বারবার পুরুষ ও নারীর একটা নির্দিষ্ট ধরনের ভূমিকা দেখায়, তখন মানুষ সেটাকেই স্বাভাবিক ভাবে নিতে শুরু করে। এইভাবে সমাজে নারী-পুরুষের মধ্যে অসমতা আরও দৃঢ় হয়ে ওঠে এবং পুরুষতান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থা টিকে থাকে।

গণমাধ্যমে নারীদের উপস্থাপনা প্রায়শই তাদের শারীরিক সৌন্দর্যকে অতিরিক্ত গুরুত্ব দেয়, যার ফলে তাদের গুণাবলি ও অর্জনের চেয়ে চেহারাই বেশি প্রকাশ পায়। এই ধরনের উপস্থাপনা নারীদেরকে একটি নির্দিষ্ট ধরনের সৌন্দর্যের আদর্শের মধ্যে আবদ্ধ করে রাখে এবং তাদেরকে কেবল একটি সৌন্দর্যের বস্তু হিসেবে দেখার দৃষ্টিভঙ্গি তৈরি করে। এই বস্তুবাদী চিন্তাধারা নারীদের সমাজে তাদের ভূমিকাকে সীমিত করে এবং তাদের পেশাগত ও বুদ্ধিবৃত্তিক ক্ষমতাকে অবহেলা করে।

গণমাধ্যমে নারী ও পুরুষের ভূমিকা যেভাবে তুলে ধরা হয়, তা আমাদের সমাজের মানুষের চিন্তাধারাকে গভীরভাবে প্রভাবিত করে। যখন মানুষ বারবার দেখে যে নারীদেরকে শুধু ঘরের কাজের মধ্যেই সীমাবদ্ধ রাখা হয়, তখন তারা নিজেরাই এই ধারণাকে গ্রহণ করে নেয়। ফলে, তরুণীরা মনে করে যে তাদের মূল কাজ হল শুধু বিয়ে করে সন্তান লালন-পালন করা। এই ধরনের চিন্তাধারা তাদের স্বপ্ন ও লক্ষ্যকে সীমিত করে দেয় এবং সমাজে নারী-পুরুষের মধ্যে বৈষম্য বাড়িয়ে তোলে।

অপরপক্ষে, যদি ছেলেরা গণমাধ্যমে পুরুষদেরকে কেবল আক্রমণাত্মক এবং কর্তৃত্ববান হিসেবে দেখে, তাহলে তারা স্বাভাবিকভাবেই মনে করতে পারে যে এগুলোই পুরুষ হওয়ার প্রমাণ। ফলে তারা নিজেদেরকেও একইভাবে আচরণ করতে উৎসাহিত হতে পারে। এটি সমাজে বিষাক্ত পুরুষত্বের বীজ বপতে পারে এবং লিঙ্গভিত্তিক হিংসার ঘটনা বাড়তে পারে। গণমাধ্যম কেবল আমাদের মনোভাবকেই প্রভাবিত করে না, বরং সমাজের মূল্যবোধকেও গড়ে তোলে। ফলে পুরুষ এবং নারীর জন্য কী ধরনের আচরণ গ্রহণযোগ্য, সে সম্পর্কে আমাদের ধারণা গণমাধ্যমের উপর নির্ভর করে।

তবে সাম্প্রতিককালে বাংলাদেশের গণমাধ্যমে নারী ও পুরুষের ভূমিকা নিয়ে যে চিত্র তুলে ধরা হচ্ছে, তা আগের তুলনায় অনেক বদলে গেছে। বিশ্বব্যাপী নারীবাদী আন্দোলন, লিঙ্গ সম্পর্কে সচেতনতা বৃদ্ধি এবং সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের প্রভাব এই পরিবর্তনের পেছনে প্রধান কারণ। ফলে, গণমাধ্যমে নারী-পুরুষের ভূমিকা নিয়ে আরও বিস্তৃত এবং বাস্তবসম্মত আলোচনা হচ্ছে। এতে প্রচলিত ধারণাগুলোকে চ্যালেঞ্জ করা হচ্ছে এবং নতুন ধারণাগুলোকে সামনে আনা হচ্ছে।

আজকের টেলিভিশন নাটক ও চলচ্চিত্রে নারীদের চরিত্রে আমরা একটা বড় পরিবর্তন লক্ষ্য করছি। এই চরিত্রগুলো আর আগের মতো নিরব, দুর্বল নয়। এখন তারা শক্তিশালী, স্বাবলম্বী এবং পেশাগত জীবনে সফল। তারা নিজেদের জীবন নিজেরাই নির্ধারণ করে, কর্মজীবনকে গুরুত্ব দেয় এবং পুরনো পুরুষতান্ত্রিক ধারণাগুলোকে ভেঙে দিতে চায়। আগে যেখানে নারীদের ঘরের কাজে সীমাবদ্ধ রাখা হতো, সেখানে এখন তারা ডাক্তার, আইনজীবী, ব্যবসায়ী হিসেবে নিজেদের প্রতিষ্ঠিত করছে। এটা স্পষ্ট যে, আমাদের সমাজে নারীরা ক্রমশ কর্মক্ষেত্রে এগিয়ে আসছে।

সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের আবির্ভাবের ফলে সমাজের চিত্রটা পাল্টে গেছে। এই প্ল্যাটফর্মগুলো নারীদের জন্য তাদের কথা বলার একটি মঞ্চ হয়ে উঠেছে। আগে যেখানে মূলধারার মিডিয়ায় সবসময় একই ধরনের খবর ও মতামত দেখতে পাওয়া যেত, সেখানে সোশ্যাল মিডিয়া নতুন নতুন চিন্তাধারা ও দৃষ্টিভঙ্গি তুলে ধরেছে। নারীরা এই প্ল্যাটফর্মগুলোতে নিজেদের মতামত খোলাখুলিভাবে প্রকাশ করছেন, তাদের অভিজ্ঞতা শেয়ার করছেন এবং লিঙ্গ সমতা নিশ্চিত করার জন্য কাজ করছেন।

বাংলাদেশে গণমাধ্যমের দ্রুত বিকাশের সঙ্গে সঙ্গে লিঙ্গ সমতা প্রতিষ্ঠায় এর ভূমিকাও দিন দিন বাড়ছে। নারী-পুরুষের মধ্যে সমান অধিকার এবং সুযোগ নিশ্চিত করতে গণমাধ্যমের বিশাল ভূমিকা রয়েছে। বিভিন্ন ধরনের মিডিয়ায় নারীদের বিভিন্ন ভূমিকায় দেখানো এবং তাদের সাফল্যের গল্প তুলে ধরা হলে তা সমাজের লিঙ্গভিত্তিক ধারণাকে ভেঙে দিতে পারে। এতে তরুণীরা তাদের স্বপ্ন পূরণের জন্য অনুপ্রাণিত হবে এবং সমাজে নারীদের অবস্থান উন্নত হবে।

গণমাধ্যম পুরুষদেরকে যত্নশীল, সংবেদনশীল এবং সমান অংশীদারের ভূমিকায় দেখিয়ে পুরুষত্বের ধারণাকে নতুনভাবে গড়ে তুলতে পারে। এর ফলে সমাজে লিঙ্গ সমতা প্রতিষ্ঠিত হতে পারে এবং নারী-পুরুষের মধ্যে সম্পর্ক আরও সুস্থ হবে। একইসাথে, গণমাধ্যম নারী নির্যাতন এবং অন্যান্য সমস্যা সম্পর্কে মানুষকে সচেতন করে তুলতে পারে। এতে সমাজের বড় একটা অংশ এই সমস্যাগুলোর প্রতি সচেতন হবে এবং এর বিরুদ্ধে লড়াই করতে উৎসাহিত হবে।

গণমাধ্যমকে সত্যিকার অর্থে পরিবর্তন আনতে হলে, শুধুমাত্র বাইরের চেহারা বদলে দেওয়াই যথেষ্ট নয়। এর মূলে যেসব কাঠামোগত সমস্যা লিঙ্গবৈষম্যকে জন্ম দেয়, সেগুলোর মোকাবিলা করা জরুরি। এই জন্য গণমাধ্যমের সব স্তরে নারীদের অংশগ্রহণ বাড়ানো, নারীদের গল্প তাদের নিজস্ব দৃষ্টিকোণ থেকে তুলে ধরা এবং সমাজে প্রচলিত লিঙ্গ ভূমিকা সম্পর্কিত ধারণাগুলোকে চ্যালেঞ্জ করা জরুরি।

বাংলাদেশে গণমাধ্যমে নারীদের যথাযথ প্রতিনিধিত্ব নিশ্চিত করার লক্ষ্যে যদিও কিছু উন্নতি হয়েছে, তবে এখনও অনেক পথ পাড়ি দিতে হবে। আমাদের সমাজে গভীরভাবে রোপণ করা কিছু ধারণা এখনও নারীদের সমান অধিকারের বিষয়ে পরিবর্তন আনতে বাধা হয়ে দাঁড়াচ্ছে। প্রচলিত ধারণা ও মূল্যবোধ এখনও গণমাধ্যমের উপর গভীর প্রভাব ফেলে এবং এই ধারণাগুলোকে চ্যালেঞ্জ করতে অনেকেই দ্বিধা বোধ করে।

এছাড়াও, গণমাধ্যমের বাণিজ্যিক চরিত্র এই পরিবর্তনের গতি ধীর করে দিতে পারে। মুনাফা অর্জনের লক্ষ্যে গণমাধ্যম সংস্থাগুলো নতুনত্বের চেয়ে নিরাপদ পথ বেছে নেয়। তারা এমন বিষয়বস্তু তৈরি করতে পছন্দ করে যা সবসময় জনপ্রিয় থাকে এবং বেশি দর্শক টানে। ফলে লিঙ্গ, সমাজ এবং সংস্কৃতি সম্পর্কিত প্রচলিত ধারণাগুলোকেই বারবার তুলে ধরা হয়। এতে নতুন চিন্তাধারা এবং বৈষম্যহীন সমাজ গড়ার পথে বাধা সৃষ্টি হয়।

এই সমস্যাগুলোর সমাধানে একটি বৈচিত্র্যময় ও সবার জন্য সমান অধিকার সম্পন্ন গণমাধ্যমের পরিবেশ গড়ে তোলা জরুরি। এই লক্ষ্য অর্জনের জন্য সরকারকে কঠোর নীতিমালা প্রণয়ন করতে হবে। যেমন, লিঙ্গভেদকে আইনত দণ্ডনীয় অপরাধ বানানো এবং গণমাধ্যমে নারীদের যথাযথ প্রতিনিধিত্ব নিশ্চিত করার জন্য কঠোর নির্দেশাবলী জারি করা যেতে পারে।

গণমাধ্যমের মাধ্যমে লিঙ্গবৈষম্য সম্পর্কে মানুষকে সচেতন করে তোলা এবং তাদের সমালোচনামূলক চিন্তা শক্তি বাড়ানোর মধ্য দিয়ে আমরা এই সমস্যার সমাধানের দিকে একটি পদক্ষেপ নিতে পারি। যখন মানুষ গণমাধ্যমে প্রচারিত বিষয়বস্তুগুলোকে বিশ্লেষণ করতে শিখবে, তখন তারা সহজেই লিঙ্গবৈষম্য চিনতে পারবে এবং এই সমস্যা সমাধানের জন্য প্রয়োজনীয় পরিবর্তন আনার চাপ সৃষ্টি করতে পারবে।

বাংলাদেশের গণমাধ্যমে নারী-পুরুষের ভূমিকা যেভাবে তুলে ধরা হয়, তা আমাদের সমাজের পুরুষতান্ত্রিক চিন্তাধারাকে প্রতিফলিত করে। এই ধরনের উপস্থাপনা লিঙ্গবৈষম্যকে আরও বাড়িয়ে তোলে। তবে সুখের খবর হল, সাম্প্রতিক সময়ে এই চিত্রে কিছুটা পরিবর্তন আসছে। নারী-পুরুষের সমান অধিকারের দাবি আরও জোরালো হচ্ছে এবং গণমাধ্যমেও এই পরিবর্তন ধীরে ধীরে লক্ষ্য করা যাচ্ছে।

গণমাধ্যমে নারীদের যথাযথ প্রতিনিধিত্ব নিশ্চিত করতে হলে আমাদের দৃঢ় ও ব্যাপক পরিকল্পনার প্রয়োজন। এই পরিকল্পনার মাধ্যমে আমরা সমাজে প্রচলিত লিঙ্গভেদকে দূর করতে এবং নারীদের সকল ক্ষেত্রে সমান অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে পারব। এছাড়াও, জনসচেতনতা বাড়ানোর মাধ্যমে আমরা গণমাধ্যমে নারীদের প্রতি নেতিবাচক ধারণা পরিবর্তন করতে পারি। এভাবেই গণমাধ্যম হয়ে উঠতে পারে লিঙ্গ বৈষম্যের বিরুদ্ধে পরিবর্তনের এক শক্তিশালী হাতিয়ার।

লেখক: সহকারী অধ্যাপক, সমাজবিজ্ঞান বিভাগ, তেজগাঁও কলেজ, ঢাকা

গণমাধ্যম: লিঙ্গ বৈষম্যের প্রচারক নাকি পরিবর্তনের হাতিয়ার মুক্তমত মো. বজলুর রশিদ

বিজ্ঞাপন

আরো

সম্পর্কিত খবর