Friday 22 Nov 2024
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

ফয়সালাবাদ: অভিশাপ বনাম আশীর্বাদ

ড. অরুণ কুমার গোস্বামী
১১ সেপ্টেম্বর ২০২৪ ২০:২৫

“সোচতা হে ও কিতনে মাসুম থে, ক্যায়সে কেয়া হো গেয়া দেখতে দেখতে।” এই গজলটির রচয়িতা ও মূল শিল্পী নুসরাত ফতেহ আলী খাঁন সাহেব এর জন্ম পাকিস্তানের ফয়সালাবাদ, যা আগে লায়ালপুর নামে পরিচিত ছিল। যদিও পরে এটি শহীদ কাপুর ও শ্রদ্ধা কাপুর অভিনীত ২০১৮ সালের মুম্বাইয়ের ড্রামা ফিল্ম “বাত্তি গুল মিটার চালু”তে আতিফ আসলাম এই গজলটির পরিবর্তিত ভার্সন গেয়েছেন। এই গজলটিকে কেন্দ্র করেই বর্তমান লেখার আলোচনা সাজানো হয়েছে।

বিজ্ঞাপন

একটি ভিডিওতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কয়েকজন শিক্ষার্থীকে এই গজলটি গাইতে দেখা যাচ্ছে। এটি পাকিস্তান, ভারত ও বাংলাদেশে জনপ্রিয় একটি গজলের প্রথম লাইন। এটি আমারও প্রিয় একটি গজল। উপরে উল্লেখিত এই গজলের প্রথম লাইনটির অর্থ হচ্ছে, ধারনা করেছিলাম ও কত নিষ্পাপ (মাসুম) ছিল, কিন্তু দেখতে দেখতে (কী হতে) কী হয়ে গেল। ভিডিওতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের যে শিক্ষার্থীরা এই গজলটি গাইছেন তাদের মধ্যে বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদও আছেন। ভিডিওটি বছর দেড়েক আগেকার।

বিজ্ঞাপন

গজলটির প্রথম লাইনের কথার সাথে সামঞ্জস্য রেখে বাংলাদেশের একজন রাজনৈতিক ব্যাখ্যাকার তথা বিশ্লেষক দেশের বর্তমান পরিস্থিতি কোথা থেকে কোথায় গিয়ে পৌঁছালো বা পৌঁছাচ্ছে, তা বুঝানোর চেষ্টা করেছেন। তবে, ‘সোচতাহে ও কিতনে মাসুম থে…’ উর্দু গজলের চেয়ে বাংলাদেশের কণ্ঠশিল্পী হায়দার হোসেনের গাওয়া “কী দেখার কথা, কী দেখছি,কী শোনার কথা, কী শুনছি,কী ভাবার কথা, কী ভাবছি,কী বলার কথা, কী বলছি, তিরিশ বছর পরেও আমি স্বাধীনতাটাকে খুঁজছি” এই কথার মধ্যে কিন্তু বাংলাদেশের মানুষের মনো ইতিহাস জিজ্ঞাসা স্পষ্টভাবে ফুটে উঠেছে! হায়দার হোসেন বাংলাদেশের স্বাধীনতার তিরিশ বছরের সময় এই গানটি গেয়েছিলেন। তবে চুয়ান্ন বছর পরেও বাঙালি শিল্পী হায়দার হোসেনের গানের কথাগুলো প্রাসঙ্গিক!

পূর্বে উল্লেখিত রাজনীতি বিশ্লেষক অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের দর্শন সম্পর্কিত আলোচনার শুরুতেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কতিপয় শিক্ষার্থীদের গাওয়া “সোচতাহে ও কিতনে…” ভিডিওটির অংশবিশেষ উপস্থাপন করেছেন। তিনি বলতে চেয়েছেন দেখতে “মাসুম” বা নিষ্পাপ মনে হলেও বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব পুরো রাষ্ট্রযন্ত্র সংস্কারের পরিকল্পনা অনেক আগে থেকেই করছিলেন। অর্থাৎ বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের মূল ছয়জন সমন্বয়ক নাহিদ ইসলাম, আসিফ মাহমুদ, সার্জিস আলম, হাসনাত আবদুল্লাহ, নুসরাত তাবাসসুম, এবং আবু বাকের মজূমদার অনেক আগে থেকেই প্রস্তুত হচ্ছিলেন। তবে, পরে জানা গিয়েছে পর্দার অন্তরালে এই গ্রুপে আরও একজন ছিলেন তিনি হলেন মো. মাহফুজ আলম। যিনি কয়েক দিন পরে প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের বিশেষ সহকারীর পদে নিয়োগ লাভ করেছেন। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে মাহফুজ আলমকে জুলাই আন্দোলনের মাস্টার মাইন্ড হিসেবে আখ্যায়িত করা হচ্ছে। এছাড়া আগামী ২৩-২৭ সেপ্টেম্বর, ২০২৪ নিউইয়র্কে অনুষ্ঠেয় জাতিসংঘের ৭৯তম সাধারণ অধিবেশনে যোগদানের জন্য প্রধান উপদেষ্টা ড. ইউনূস যে সফরে যাচ্ছেন তাতে যে সাতজন তার সঙ্গী হচ্ছেন তাদের মধ্যে প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী মো. মাহফুজ আলম‌ও আছেন। অন্যান্য সফরসঙ্গীরা হচ্ছেন ড. ইউনূসের মেয়ে দিনা আফরোজ ইউনূস, এসডিজি বিষয়ক মূখ্য সমন্বয়ক লামিয়া মোরশেদ, অর্থনৈতিক অবস্থার শ্বেতপত্র প্রণয়ন কমিটির প্রধান দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য ও দৃক-এর ব্যবস্থাপনা পরিচালক শহীদুল আলম, প্রধান উপদেষ্টার সহকারী একান্ত সচিব শাব্বীর আহমদ ও ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী আয়েশা সিদ্দিকা তিথি। জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের অধিবেশনে যোগ দিতে বাংলাদেশ থেকে এপর্যন্ত যাওয়া দলগুলোর মধ্যে এবারই সবচেয়ে ছোট দল নিয়ে সফর করবেন ড. ইউনূস।

‘সোচতাহে ও কিতনে মাসুম থে’ গজল দিয়ে শুরু করা বিশ্লেষণের উল্লেখিত ব্যাখ্যাকার বা বিশ্লেষক আরও যা উল্লেখ করেন নি, তাহলো, বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলনের মাস্টার মাইন্ডেরা ২০২৪ এর জুলাইয়ে যেধরনের পরিকল্পনা পরিকল্পনা করেছেন তা প্রকৃত পক্ষে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, পাকিস্তান বা চীনের কোন পরিকল্পনার অংশ কিনা?

পাশাপাশি এটাও উল্লেখ করা সমীচিন যে ১৯৭১ এর পূর্বেও এদেশের ছাত্র নেতৃত্ব দেশ স্বাধীনের জন্য মুক্তিযুদ্ধ সংগঠিত করতে এইধরনের পরিকল্পনা করেছিলেন। লেখক ও গবেষক মহিউদ্দিন আহমদ ‘সিরাজুল আলম খান এবং স্বাধীনতার নিউক্লিয়াস’ শীর্ষক নিবন্ধে লিখেছেন, ‘১৯৬২ সাল থেকেই “ছাত্র সংগঠনের ভেতরে একটি নিউক্লিয়াস বাংলাদেশের স্বাধীনতার লক্ষ্যে কাজ করে যাচ্ছিল।’ মাহবুব আরিফ তার “নিউক্লিয়াস, বঙ্গবন্ধু ও স্বাধীনতা” শীর্ষক নিবন্ধে বলছেন, ‘…নিউক্লিয়াস’ দ্রুত গতিতে এগিয়ে যায় ১৯৬৪ সাল থেকে। এভাবেই ১৯৬৮ সাল নাগাদ গোটা বাংলাদেশে (পূর্ব পাকিস্তান) স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়ে বিপ্লবী পরিষদ বা নিউক্লিয়াসের ৩০০ ইউনিট গঠন করা হয়। প্রতি ইউনিটে ৯ জন করে সদস্য ছিলেন। প্রতি মহকুমায় চার-পাঁচজন সদস্য থাকতেন। মহকুমার অধীনে বড় বড় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে পাঁচজন সদস্য নিয়ে গোপন কমিটি গঠিত হতো। ১৯৬৮-‘৭০ সালে ‘নিউক্লিয়াস’-এর সদস্য বৃদ্ধি পেয়ে সাত হাজারে দাঁড়ায়। ১১ দফা আন্দোলনকে বেগবান করে শেখ মুজিবের মুক্তি ও এক দফার অর্থাৎ স্বাধীনতার আন্দোলনকে এগিয়ে নেয়া হয় নিউক্লিয়াসের মাধ্যমেই। এক কথায় তখন ছাত্র সংগঠনের উপরে পুরো কর্তৃত্ব ছিল নিউক্লিয়াসের। পরবর্তীতে শ্রমিক সংগঠন গঠিত হয় নিউক্লিয়াসের কর্মপরিকল্পনা অনুসারে এবং বলাই বাহুল্য শ্রমিক সংগঠনওৎপরিচালিত হতো বিপ্লবী পরিষদ বা নিউক্লিয়াসের নেতৃবৃন্দের দ্বারা।’ মাহবুব আরিফ আরো বলছেন স্বাধীন বাংলাদেশের এই নিউক্লিয়াস গঠিত হয়েছিল বঙ্গবন্ধুর প্রত্যক্ষ নির্দেশে। (স্বাধীনতার আগে) বঙ্গবন্ধুর অনুসারী সিরাজুল আলম খান শুরুর সময় অর্থাৎ ১৯৬২ সাল থেকে সক্রিয় স্বাধীন বাংলাদেশ নিউক্লিয়াসের অন্যতম একজন নেতা। নোয়াখালীর বেগমগঞ্জে জন্মগ্রহণ করেছিলেন সিরাজুল আলম খান। অপর দিকে নোয়াখালীর রামগঞ্জে জন্ম গ্রহণ করেছেন প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী এবং জুলাই আন্দোলনের মাস্টার মাইন্ড মো. মাহফুজ আলম।

এসবের পাশাপাশি, ফয়সালাবাদ তথা পাকিস্তান দেশটি সম্পর্কে ‘অভিশাপ ও আশীর্বাদ’ প্রসঙ্গের দিকে একটু আলোকপাত করা যেতেই পারে! বাংলাদেশীদের জন্য পাকিস্তান সম্প্রতি ভিসামুক্ত ভ্রমণ চালু করেছে। এটা অভিশাপ না আর্শিবাদ তা এখনই বোঝা যাচ্ছে না, আবার ফলাও যাচ্ছে না। উল্লেখিত গজলটির রচয়িতা এবং মূল শিল্পী নুসরাত ফতেহ আলী খাঁন সাহেব বর্তমান পাকিস্তানের পাঞ্জাব প্রদেশের লায়ালপুরে (যার বর্তমান নাম ফয়সালাবাদ) জন্মগ্রহণ করেছিলেন। ভারতীয় উপমহাদেশের জনপ্রিয় এই গজল শিল্পীর মত অনেকেই লায়ালপুরে বা ফয়সালাবাদে জন্মগ্রহণ করেছিলেন। কয়েকটি নাম এখানে উল্লেখ করছি। মুম্বাই চলচ্চিত্রের কিংবদন্তি অভিনেতা পৃথ্বীরাজ কাপুরের জন্ম লায়ালপুরে। এর পাশাপাশি, বর্তমান ভারতের খ্যাতিমান অনেকেই জন্মগ্রহণ করেছিলেন লায়ালপুর বা ফয়সালাবাদসহ পাকিস্তানের বিভিন্ন স্থানে। ভারতের রাজধানী দিল্লির সাবেক গভর্নর মদনলাল খুরানা, ভারতীয় চলচ্চিত্র পরিচালক বরুণ গ্রোভার, ভারতের খ্যাতিমান লেখক হরিসিং দিলবার, ভারতের খ্যাতিমান মলিকিউলার বায়োলজিস্ট ওম পি.বাহল, বিশ্ব শান্তি পরিষদের সাবেক সভাপতি রমেশ চন্দ্র প্রমুখ সবাই পাকিস্তানের পাঞ্জাব প্রদেশের লায়ালপুর বা ফয়সালাবাদে জন্মগ্রহণ করেছিলেন। কিন্তু বিশেষত ১৯৪৭ সালে ধর্মের ভিত্তিতে সাম্প্রদায়িক রাষ্ট্র পাকিস্তান জন্ম হওয়ার পর থেকে এইসব জ্ঞানী গুণী ব্যক্তিদেরকে জন্মভূমি ফয়সালাবাদ তথা পাকিস্তান ছাড়তে হয়েছে। পাকিস্তান তাদের জন্য হয়ে উঠেছিল অভিশপ্ত একটি দেশ। তাই বলছি, গীতিকার ও শিল্পী নুসরাত ফতেহ আলী খাঁন সাহেবের কাছে কিংবা আমার মত গজল প্রিয় মানুষের কাছে (উল্লেখিত গজলের সৃষ্টির শহর) ফয়সালাবাদ আশীর্বাদ মনে হলেও, পৃথ্বীরাজ কাপুর, মদনলাল খুরানা প্রমুখদের জন্য ফয়সালাবাদ তথা পাকিস্তান আশীর্বাদ থাকেনি, এটি হয়ে উঠেছিল জীবন্ত অভিশাপ হিসেবে! আশির্বাদ হলেতো তারা ফয়সালাবাদ তথা পাকিস্তানেই থেকে যেতেন। নিজ জন্মভূমি ছেড়ে ভারতে চলে যেতে হত না!

বৈষম্য বিরোধী আন্দোলনের সময় যারা স্লোগান দিয়েছিলেন “ভারত যাদের মামা বাড়ি, বাংলা ছাড়ো তাড়াতাড়ি”, তারা প্রকারান্তরে কদর্য সাম্প্রদায়িকতার এই দগদগে ঘা এর উপর যে নুনের ছিটা দিচ্ছেন না কি? বিষয়টাকে কি একবারও তারা ভেবে দেখেছেন?

বাংলাদেশে এমন ভূড়ি ভূড়ি উদাহরণ আছে যেখানে অনেক মানুষ আছেন দেখা যায় বর্তমান স্বাধীন বাংলাদেশে তিনি অথবা তার পূর্বপুরুষ জন্মগ্রহণকারী করেছিলেন। কিন্তু জন্মভূমি বাংলাদেশ আর তার বা তাদের কাছে আশির্বাদ থাকে নি। প্রিয় জন্মভূমির সম্পত্তি ও স্বাধীনতার চিরন্তন অধিকার স্থায়ীভাবে ত্যাগ করে, স্বেচ্ছা বঞ্চনার স্থায়ী যন্ত্রণার জ্বালা বয়ে চলেছেন! শুধু জীবন নিয়ে পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতে আশ্রয় তথা চিরস্থায়ী বাসস্থান করে নিয়েছেন। বিষয়টি প্রাকৃতিক হলে অসুবিধা ছিল না। কারণ, মানুষ এক স্থান থেকে অন্য স্থানে যেতেই পারেন। কিন্তু বিশেষত বাংলাদেশ, ও পাকিস্তানের ক্ষেত্রে এই সাম্প্রদায়িকতার প্রসঙ্গটি আন্দোলনের সময়েও এসেছে। উল্লেখ্য, এই ধরনের সাম্প্রদায়িকতার কারণেই ভারতে সিএএ পাস হয়েছে। আর তাছাড়া ভারতে ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের জন্য সংখ্যালঘু বিষয়ক মন্ত্রণালয় আছে, যার কাজই হচ্ছে ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের বিভিন্ন ধরনের সমস্যা সমাধানের জন্য প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করা।

বাংলাদেশে পূর্ববর্তী সরকার সংখ্যালঘুদের জন্য বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণের আশ্বাস দিয়েছিলেন কিন্তু তা বাস্তবায়িত হয় নাই। বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. ইউনূসও পদক্ষেপ নেওয়ার ব্যাপারে সংখ্যালঘুদের আশ্বস্ত করেছেন। দায়িত্ব গ্রহণের পরই প্রধান উপদেষ্টা, আইন উপদেষ্টা ও ধর্ম উপদেষ্টা ঢাকেশ্বরী জাতীয় মন্দিরে গিয়ে হিন্দু, বৌদ্ধ ও খ্রিষ্টান সম্প্রদায় তথা সব নাগরিকদের সাংবিধানিক অধিকার সুরক্ষায় প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণের কথা বলেছিলেন। আমরা অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের এমন পদক্ষেপ গ্রহণের আশায় আছি যাতে বাংলাদেশের জাতিগত ও ধর্মীয় সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের মানুষদের জীবন বাঁচাতে দেশ ত্যাগ করতে না হয়!

লেখক: কলামিস্ট ও পরিচালক, সেন্টার ফর সাউথ এশিয়ান স্টাডিজ (সিএসএএস), ঢাকা

সারাবাংলা/এজেডএস

ড. অরুণ কুমার গোস্বামী ফয়সালাবাদ: অভিশাপ বনাম আশীর্বাদ