বন্যার ধ্বংসলীলা, ঘুরে দাঁড়াবে আবার ফেনী
১১ সেপ্টেম্বর ২০২৪ ২১:০৮
বানভাসি মানুষ দেখেছি, দেখেছি বাংলাদেশের নাগরিক হবার কারণে। দেশের উত্তরাঞ্চলে বছরের ২-৩ বার এই করাল গ্রাসে নিমজ্জিত হয়। গল্প, উপন্যাস সিনেমা, নাটকে দেখেছি বন্যা, পানির সাথে যুদ্ধ করে বেঁচে থাকার লড়াই। কী ভয়াবহ! আজ ফেনীর সন্তান হয়ে দেখেছি আমার শহর, গ্রাম ডুবতে। কিভাবে মুহূর্তে কি হয়ে গেল বুঝিনি। ২০ আগস্ট থেকে নিউজ দেখছি পরশুরাম ও ফুলগাজী বন্যায় প্লাবিত। ঘরবাড়ি ছাড়ার আশংকা। নিজের সহকর্মী সাংবাদিক তার বাড়িঘর ডুবার কথা লিখছে ফেসবুকে। সন্তান,বৌ নিয়ে দিগ্বিদিক সে! ২১ আগস্ট ওর শেষ পোস্ট। এরপর মোবাইল নেটওয়ার্ক বিচ্ছিন্ন। ইন্টারনেট তো একেবারেই বিকল! বিকেল পর্যন্ত ফেনী বন্যায় গ্রাস করে ফেলেছে ছাগলনাইয়া সহ ফেনী সদর। যেখানে বৃষ্টির পানি জমে না সেখানে! উদগ্রীব হয়ে গেলাম ফেনীর জন্য। আমার বাসা, স্বজন সবার জন্য! কী এক অশান্তির সময় গেছে বলে বোঝাতে পারবো না।আমি তখন ঢাকায় অবস্থান করছি। কিন্তু অনুভব হচ্ছিলো আমার ফেনী কতোটা বিপর্যস্ত হয়ে গেছে ২১ আগস্ট রাতে!
২৪ তারিখ রাতে শুনি আমার বাসা পর্যন্ত। সমুদ্রের জোয়ার যেভাবে ছুটে আসে সেভাবে। এর উপর কারেন্ট চলে যায়, ২১ আগস্ট থেকে পুরো ফেনী শহরে। মোবাইল নেটওয়ার্ক বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে পুরো শহর থেকে। গোটা ফেনী অন্ধকারে তলিয়ে যায় ! আমি আতন্কে দিশেহারা হয়ে পড়ি। হাজার হাজার প্রবাসীর কান্না। টেলিভিশন চ্যানেলে শত ,শত ফুটেজ। সামাজিক মাধ্যমে আমরা যারা ভিডিও ফুটেজ ছবি সংগ্রহ করে পোষ্ট করছিলাম তাদের সব দেখে প্রবাসীদের অন্তর অজানা ভয়ে কেঁপে উঠে মা-বাবার বৌ, বাচ্চার সাথে দীর্ঘ ৫-৭ দিন কোন খবর নেই তাদের। যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে তারাও। ফোনে , ম্যাসেঞ্জারে কত জনের একটু হতাশা কাতরতা দেখেছি ,শুনেছি পরিবারের একটু খবরের জন্য আব্দার। যখন একটুও যদি কারো কাছে খবর পায়, শুনে যে তাদের পরিবার অমুকের ছাদে বসে আছে খাদ্য বিহীন দীর্ঘ সময়। তখন তারা চিৎকার করে কাঁদতে থাকে। লক্ষ টাকা আয় করেও পরিবারের জন্য কিচ্ছু করতে পারে না সুদূর প্রবাস হতে। প্রবাসীরা লক্ষ টাকা উপার্জনের এই প্রতিদান প্রকৃতির কাছে যেন একেবারে অসহায় হয়ে পড়ে।
বুক চাপড়ে কতো কান্না তাদের। পরিবার বাড়িঘর থেকে রাতে ছুটে বেরিয়ে গেছে অজানা স্রোতে । অজানা পথে। আশ্রয়ের মহাযজ্ঞ লেগে গেছে ফেনী! কি কাড়াকাড়ি,কী অসহায়! কি ছুটাছুটি! ধনী গরীব সব এক কাতারে। চোখের সামনে লাখ লাখ গবাদিপশু, হাঁস -মুরগী, মুরগির খামার, মাছের পুকুর সব সর্বনাশা রাজনৈতিক বন্যা নিয়ে গেছে। আদরের পালা গরুগুলো স্রোতের সাথে ভেসে যাচ্ছিল মালিক হতভাগা তখন হতভম্ব! চিৎকার করে কান্না ছাড়া উপায় নেই! তখন মালিক নিজেও স্রোতে ভাসছে। এক দিকে বন্যার করার গ্রাস অন্যদিকে অঝোর বৃষ্টি। যে বৃষ্টির সাথে বন্যার পানি একাকার হয়ে মিলেমিশে ফেনীকে ডুবিয়ে দিতে বদ্ধপরিকর হয়ে উঠে।
টেকনাফে হতে তেঁতুলিয়ার অগণিত স্বেচ্ছাসেবক এমন কি সাধারণ প্রশিক্ষণ ছাড়াই মানুষ নৌকা,বোট খাদ্য নিয়ে ফেনীর জন্য ঝাঁপিয়ে পড়ে। এতো ঐকান্তিক প্রচেষ্টা ও হৃদয় নিংড়ানো ভালবাসা উপচে উঠে সারাদেশে! নোয়াখালী ও কুমিল্লা নিয়ে যতোটা উদ্বিগ্ন দেশের মানুষ তারচেয়ে বেশি উদ্বিগ্ন ছিল ফেনীকে নিয়ে। কুমিল্লার মানুষ নিজেরাও ডুবেও বলেছে ফেনীকে বাঁচান। যে কুমিল্লা ও ফেনী সারাবছর প্রতিবেশী ঝগড়া করে থাকে। ফেনীর সংকট মুহূর্তে ভালবাসা জেগে উঠে কুমিল্লার। ছুটে এসেছে নোয়াখালীও । যারা নিজেরাই ডুবে আছে।যে নোয়াখালী থেকে ফেনীর সৃষ্টি। সন্তানের জন্য বাবা-মায়ের ভালোবাসা কেঁদে উঠেছে। এই হচ্ছে ফেনীতে স্মরণকালের বন্যায় প্রাথমিক গল্প।
কতো করুণ গল্প এখানে ফেনীতে প্রতি টা পরিবারের। হিসাব শেষ হবে না। কতো হারানো বেদনা জেগে উঠেছে সর্বনাশা পানি নেমে যাবার পর। বাড়ি ঘর নিশ্চিহ্ন! কোথায় ঘর বাড়ি খুঁজে পেতে দিশেহারা। শখের সাজানো ঘর থেকে বুকফাটা আর্তনাদ! কিচ্ছু যেন নেই। শুধু মাটি কাঁদা স্তুপ! ঘরের প্রতিটি ফার্নিচার মাটির তলায় চলে গেছে। ফেনীর স্বেচ্ছাসেবকদের নিজের ঘর বাড়ি পানির নিচে, যারা পরিবারকে কোথাও আশ্রয়ে রেখে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল অন্যদের বাঁচাতে। পানি নামলে নিজের ঘরের অবস্থা দেখে হতাশ হলেও কোদাল দিয়ে মাটির তলা থেকে উঠায় ফ্রিজ টিভি, আলমিরা, খাট টেবিল, চেয়ার! ভাবতে পারেন দেশবাসী কেমন বন্যা গ্রাস করেছে ফেনীকে। মৃত মানুষের দাফনের শুকনা জায়গা না পেয়ে কলা গাছের ভেলায় চিরকুটে লেখা – উনি একজন মুসলিম মহিলা। কেউ পেলে উনাকে দাফন করবেন।” এমন অবস্থা! কেউ বৌ বাচ্চা নিয়ে বৃদ্ধ মাকে তালা দিয়ে চলে যায়। পরে উদ্ধার কর্মী এসে দেখে মৃত সেই মা! পানি ঘরে উঠেছে দেখে আশ্রয় কেন্দ্রে চলে যায় এক নাছিমা নামে নারী। পানি নামলে ঘরে ফিরে ঘরের ভয়াবহ দৃশ্য দেখে স্ট্রোক করে মুহূর্তে মারা যায় ৩০ আগস্ট। ৫ দিন খাবার না পেয়ে ফেসবুকে শেষ পোষ্ট লিখে ” হয় খাবার চাই না হয় মৃত্যু।” পাঁচদিন উপবাসে ফেনী কদলগাজী রোডে একটা ভবনে আটক ছিল! হিন্দু পরিবার আশ্রয়ে বের হয়ে ফেনী বড় মসজিদে অবস্থান নেয়। এইরকম বহু ঘটনার সাক্ষী হয়ে থাকলো ৯২৮,৩৪ বর্গকিলোমিটারের ফেনী।
যে কথা বললেই নয়, ফেনী নোয়াখালী ও কুমিল্লার বানভাসির জন্য টিএসসিতে এক অভূতপূর্ণ সাড়া আসে। ছোট ছোট বাচ্চাদের তাদের জমানো টাকা যে টাকায় কেউ সাইকেল, কোন একটা বড় দামী খেলনা কিনবে সেই স্বপ্ন তারা তুলে দেয় বন্যায় ভাসা মানুষদের জন্য। যে অন্ধ লোক দুনিয়ার আলো দেখেনি সে তার ভিক্ষা করা খুচরা টাকা গুলো তুলে দেয় ,বুয়ারা তাদের বেতন তুলে দেয়, রিকশাচালক তার তিল তিল করে করে জমানো বাইশ হাজার টাকা তুলে দেয়। সেখানে এই বাংলদেশে কিভাবে হারে ? শেষবারের মতো হলেও বুঝলাম।এই বাঁধ নির্মাণ আর দেরি নয়। এই ভারতীয় আগ্রাসন থেকে দেশের একটা ফাইনাল সিদ্ধান্ত নিবারণ দরকার এখনি। যে রাষ্ট্রের নিজের খাবার নেই সেই ফিলিস্তিনি তারা পাঠিয়েছে খাদ্য। হায়রে মানবতা! একেই তো বলে। ফেনী বাসী প্রতি শুক্রবার ও অন্যান্য সময় ফিলিস্তিনি রাষ্ট্রের জন্য অঝোরে কেঁদেছে। তাদের কানে সেটা পৌঁছে গেছে। এই ঋণ কিভাবে শুধি বলেন!
অনেক স্বেচ্ছাসেবকের প্রান গেছে ফেনীকে বাঁচাতে। বিশেষ করে লক্ষীপুর জেলার একটা ছেলের খবরে ও নাম না জানা আরেক স্বেচ্ছাসেবক যারা নিথর দেহ দেখলাম ফেসবুক ফিডে। কি করে এই ঋণ মুছবো? ফেনীতে এসেছেন নামকরা চ্যানেলের সাংবাদিক , স্বেচ্ছাসেবক ও নানা সংগঠনের মানুষ। নিয়ে গেছেন নতুন অভিজ্ঞতা। ফেনীর মানুষের আতিথেয়তা ও সততা দেখে ওরা মুগ্ধ! ফেনীর প্রতি স্বাভাবিকভাবেই জেগে ওঠে এক অন্যরকম ভালোবাসা।তারা সেইসব অভিজ্ঞতা তুলে ধরেছেন ফেসবুকে।
ফেনী ,নোয়াখালী কুমিল্লা! কৃতজ্ঞতার ভাষা নেই। তবে জানি পুরো দেশ আমরা একটা পরিবার হতে শিখে গেছি ২০২৪ এর বন্যায়। যেমন একসাথে ছাত্র জনতার অভূথ্থানে স্বৈরশাসকের বিদায় তেমনি এই তিন জেলাকে বন্যার কবল থেকে জীবন বাজি রেখে উদ্ধার!
অবশেষে,ফেনীর সৌন্দর্য বন্যা নিয়ে গেছে। তারপরও আমরা ফেনীকে নতুন করে সাজাবো। নতুন এক ফেনীর উদয় হবে শ্রীঘ্রই!
লেখক: সাংবাদিক
সারাবাংলা/এজেডএস