পোশাক শিল্পে অস্থিরতার নেপথ্যের ক্রীড়ানক
১৫ সেপ্টেম্বর ২০২৪ ১৮:০৮
বাংলাদেশের পোশাক শিল্প খাতে অস্থিরতা বিরাজ করছে। কারখানা বন্ধ, ছুটি ইত্যাদি কারণে পোশাক শিল্পের ওপর বিরুপ প্রভাব ফেলছে যা ক্রয়াদেশের উপরও প্রভাব বিস্তার করছে। এই সুযোগে আমাদের প্রতিযোগী মার্কেটগুলো লাভবান হচ্ছে। অথচ তৈরি পোশাক শিল্প আমাদের অর্থনীতির প্রাণ। ১৯৭৮ সালে বাংলাদেশে প্রতিষ্ঠিত হয় প্রথম রপ্তানিমুখী তৈরি পোশাক কারখানা। এরপর এই পোশাক শিল্পই দেশের অর্থনীতির মূল কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হয়েছে। দেশের মোট জিডিপির ১০ শতাংশ আসে পোশাক খাত থেকে। এরমধ্যে কেবল গত বছরই ৫৪ বিলিয়ন ডলারের পোশাক রপ্তানি করেছে ঢাকা। বিশ্বে পোশাক রপ্তানির দিক দিয়ে বাংলাদেশের ওপরে আছে চীন। ব্রিটেনের প্রভাবশালী সাময়িকী দ্য ইকোনোমিস্ট এক প্রতিবেদনে বিশ্লেষণ সাময়িকীটি বলেছে, ভারত হলো বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহৎ তুলা উৎপাদানকারী দেশ। এসব তুলা বাংলাদেশে রপ্তানি করে তারা। তবে ভারতে অনেক তুলা উৎপাদন হলেও তৈরি পোশাক খাতের দিক দিয়ে দেশটি বাংলাদেশের চেয়ে অনেক পিছিয়ে আছে। তবে ভারতের ত্রিপুরার রাজ্যের কয়েকটি রপ্তানিকারক প্রতিষ্ঠান জানিয়েছে, বাংলাদেশে অস্থিরতার কারণে তারা নতুন করে ৫৪ মিলিয়ন ডলারের অর্ডার পেয়েছে। নয়াদিল্লির বাইরের আরেকটি গ্রুপ জানিয়েছে, গত আগস্টে তারা স্প্যানিশ ফ্যাশন ফার্ম জারার কাছ থেকে ১৫ শতাংশ বেশি অর্ডার পেয়েছে। এর মানে হলো আমাদের অভ্যন্তরীণ কারণে যদি পোশাক শিল্প বন্ধ থাকে বা বিশৃঙ্খলা বিরাজ করে তাহলে আমরা আমাদের অবস্থান হারাতে পারি। ক্রেতারা আস্থা হারাবে এবং তারা বিকল্প বাজার খুঁজবে। যেখানে আমরাই চেষ্টা করছি নতুন নতুন বাজার তৈরিতে। সেখানে যদি আরও বাজার সংকুচিত হয় তাহলে সামনে এই খাতে অশনি সংকেত ঝুলছে। কারণ দেশের শ্রম বাজারের একটি বিরাট অংশের চাহিদা পূরণ করে পোশাক শিল্প। কৃষিভিত্তিক অর্থনীতির অগ্রযাত্রারা সাথে আশির দশকে যে শিল্প যাত্রা শুরু করে সেই পোশাক শিল্পই আজ আমাদের অর্থনীতির প্রধান নিয়ামক। প্রতিযোগীতামূলক বিশে^ আমরা পেছনে ফেলেছি পোশাক রপ্তানির বড় বড় দেশকে। আজ বাংলাদেশ তৈরি পোশাকের এক অন্যতম দেশ।
যাত্রা শুরুর পর থেকে অর্থনীতিতে এ খাতের অবদান ক্রমেই বৃদ্ধি পেয়েছে। কয়েকটি থেকে কয়েক হাজার পোশাক কারখানা হয়েছে। এর মধ্যে আবার সবুজ কারখানাও বাংলাদেশেই বেশি। পোশাক শিল্প আমাদের অর্থনীতিতে গতির সঞ্চার করে দেশকে একটি গতিশীল অর্থনীতির দেশে পরিণত হতে সাহায্য করেছে। আমাদের অর্থনীতিতে সর্বাধিক বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনকারী খাত তৈরি পোশাক শিল্প। এই খাতে সৃষ্টি হয়েছে বিপুল সংখ্যাক কর্মসংস্থান। আর কর্মসংস্থানের একটি বড় অংশই নারী। যা দেশের নারীদের সাবলম্বী করতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখে চলেছে। এই নারীদের একটি বড় অংশই অল্পশিক্ষিত বা অশিক্ষিত। করোনা অতিমারী শুরু হওয়ার পর থেকে অন্যান্য খাতের মতোই পোশাক খাতেও তার আঘাত লাগে। ক্রেতারা অর্ডার বাতিল করতে থাকে। পরিস্থিতি সামাল দিতে কেউ কেউ কর্মী ছাঁটাইয়ের পথে হাঁটতে বাধ্য হয়। করোনা অতিমারিতে ক্ষতিগ্রস্থ অর্থনীতি ঘুরে দাড়াতে শুরু করেছে। করোনার দুর্দিন কাটিয়ে এখন সুদিন ফিরতে শুরু করেছে পোশাক শিল্পে। আমাদের স্বপ্ন এখন ম্যান মেইড ফাইবারে পোশাক উৎপাদন করে অন্য দেশগুলোকে পেছনে ফেলা। গত এক দশকে দক্ষিণ এশিয়ার অন্যতম বড় অর্থনীতির দুই দেশ ভারত ও পাকিস্থানের রপ্তানি কমলেও একই সময়ে বাংলাদেশের তৈরি পোশাকের রপ্তানি বেড়েছে শতকরা ৮০ শতাংশ। দীর্ঘদিনের পরিকল্পনা ও পরিশ্রমের ফলে এই বাজারের সুনাম অর্জিত হয়েছে। আর এই কারণে বেড়েছে বিশ্বস্ততা। পোশাক শিল্পে প্রচলিত এবং অপ্রচলিত দুই ধরনের বাজার রয়েছে। অপ্রচলিত বাজারে পোশাক রপ্তানিতে গুরুত্ব প্রদান করায় সেখানে সাফল্যও আসছে।
তথ্যে জানা যায়, ৪৬ দশমিক ৮০ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের লক্ষ্যমাত্রার বিপরীতে ২০২২-২৩ অর্থবছরে ৪৬ দশমিক ৯৯ বিলিয়ন মার্কিন ডলার আয় হয়েছে যা আগের অর্থবছরের চেয়ে সাড়ে চার বিলিয়ন মার্কিন ডলার বেশি। আর প্রচলিত বাজারের চেয়ে নতুন বাজারের অগ্রগতি হয়েছে ৩১ দশমিক ৩৮ শতাংশ। সুতরাং এখানে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো পোশাক শিল্পের অপ্রচলিত বাজার। যা ইতিমধ্যেই আশার আলো দেখাচ্ছে। বর্তমানে মোট শিল্পখাতে নিয়োজিত শ্রমশক্তির ৩৩ শতাংশ এই খাতে নিয়োজিত। শুধু আমাদের দেশ না, বিশ্বের বড় বড় দেশের শিল্পও ধাক্কা খেয়েছে পরপর দু’টি ধাক্কায়। প্রথমে করোনা মহামারীর ধাক্কা এবং তারপরেই রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ। এতসব সমস্যা সামাল দিয়েই তৈরি পোশাক শিল্প এগিয়ে চলেছে। প্রচলিত বাজারে লক্ষ্যমাত্রা মাঝে মধ্যে ধাক্কা খেলেও অপ্রচলিত বাজার সেই জায়গা দখল করছে। দেশের পোশাক রফতানির প্রধান বাজার ইউরোপ, যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্য। এর বাইরের বাজারগুলো অপ্রচলিত বাজার হিসাবে পরিচিত। এই বাজারের মধ্যে রয়েছে জাপান, অস্ট্রেলিয়া, রাশিয়া, ভারত, কোরিয়া রিপাবলিক, চীন, সংযুক্ত আরব আমিরাত, মেক্সিকো, সৌদি আরব, তুর্কি, দক্ষিণ আফ্রিকা, নিউজিল্যান্ড, চিলি, ব্রাজিল ও অন্যান্য দেশ। এই দেশগুলোর বাইরেও অপ্রচলিত বাজার হিসেবে নতুন এবং ঝুঁকিমুক্ত বিনিয়োগের দেশ খুঁজে বের করতে হবে। এটি আমাদের অর্থনীতির প্রাণস্বরুপ। কৃষিভিত্তিক অর্থনীতির দেশ থেকে শিল্প ভিত্তিক অর্থনীতি বিশেষত পোশাক শিল্প উত্তরণের এই চিত্র দেশের অর্থনীতিকেই পাল্টে দিয়েছে। পরিবেশবান্ধব পোশাক কারখানার সংখ্যার দিক থেকেও বিশ্বে শীর্ষে বাংলাদেশ। বাংলাদেশ পোশাক শিল্পের বৈশ্বিক প্রতিযোগীতায় ক্রমেই শক্তিশালী অবস্থানে যাচ্ছে। পোশাক শিল্পের বিদ্যমান প্রতিকূলতা অবকাঠামোগত সুবিধা বৃদ্ধি, উৎপাদন খরচ হ্রাস, পণ্য সরবরাহের সক্ষমতা বৃদ্ধি প্রভৃতি ক্ষেত্রে উন্নয়ন ঘটাতে হবে।
বাংলাদেশের মতো দ্রুত গতিতে এগিয়ে চলা দেশের জন্য এরকম একটি গুরুত্বপূর্ণ শিল্প পূর্ণ গতিতে চলা আবশ্যক। পোশাক শিল্পের মতো রপ্তানিমুখী একটি শিল্প যা আমাদের দেশের অর্থনীতিকে চাঙা করেছে, চাকরির বাজারে মহাগুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে,দেশে এবং দেশের বাইরে বাংলাদেশের পোশাকের একটি অবস্থান তৈরি করতে সক্ষম হয়েছে। এই ধারা অব্যাহত রাখতে হবে। আরো মজবুত করতে হবে। নতুন বজার খুঁজে বের করতে হবে। যেগুলো আছে সেখানে আরও জোর দিতে হবে। মানুষের মাথাপিছু আয় বৃদ্ধি ও জীবনমান উন্নয়নে অবদান রেখে চলেছে। প্রায় ৪০ লাখের বেশি নারী-পুরুষের কর্মসংস্থান সৃষ্টিতে ভূমিকা রেখেছে পোশাক শিল্প। এর মধ্যে শতকরা ৭০ ভাগই নারী। প্রত্যন্ত অঞ্চলের অবহেলিত নারীদের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা সৃষ্টি হয়েছে। প্রতিযোগীতামূলক বিশ্বে টিকে থাকতে একটি শিল্পকে এগিয়ে নিতে সঠিক পরিকল্পনা এবং তার বাস্তবায়নের বিকল্প নেই। বিশ্ব অর্থনীতির ধারায় এ খাতেও মাঝে মধ্যেই রফতানি শঙ্কা তৈরি হয়। তবে বাজারের বৈচিত্র্যতার দিকে নজর দিলে এ শঙ্কা অনেকটাই কমে আসবে। পোশাক শিল্পও গতি পাবে। এছাড়াও পোশাক শিল্পের অত্যাবশ্যকীয় উপাদান বিশেষত সুতার মূল্য কম রাখা এবং পোশাক শ্রমিকদের জীবনমান উন্নয়নে জোর দিতে হবে। তাদের নিরপত্তা এবং সুযোগ সুবিধা বৃদ্ধি করতে হবে। বর্তমান অস্থিরতার নেপথ্যের কারণ খুঁজে বের করে তা সমাধানের উদ্যোগ নিতে হবে। একটি গুরুত্বপূর্ণ সময়ে দেশের অর্থনীতির চাকা সচল রাখতে পোশাক শিল্পকে পুরোদমে কাজে লাগাতে হবে। নচেৎ অর্থনীতি ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্থ হবে।
লেখক: প্রাবন্ধিক ও কলামিস্ট
অলোক আচার্য পোশাক শিল্পে অস্থিরতা অর্থনীতির জন্য অশনি সংকেত মুক্তমত