কেমন শিক্ষাব্যবস্থা চাই
১৭ সেপ্টেম্বর ২০২৪ ১৪:১৬
‘কেমন শিক্ষাব্যবস্থা চাই’ এই প্রশ্নের উত্তর খোঁজার আগে আমাদের আদর্শ শিক্ষাব্যবস্থার স্বরূপ অনুসন্ধান করা প্রয়োজন। গনঅভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে নতুন বাংলাদেশ গড়ার প্রয়াস থেকে আমাদের মধ্যে নতুন শিক্ষাব্যবস্থা তৈরি করার যে চেতনা জন্মেছে সেটি নিঃসন্দেহে সময়োপযোগী এবং বাস্তবিক। অল্প কিছুদিন আগেই ফিনল্যান্ডের আদলে ‘জাতীয় পাঠ্যক্রম ২০২১’ প্রণয়ন করা হয়েছিলো, কিন্তু দুঃখের বিষয় যে, এই পাঠ্যক্রম বাস্তবায়নে সাবেক সরকার দল ব্যর্থ হয়েছে এবং তাদের প্রণীত পাঠ্যক্রম বাংলাদেশ প্রশ্নে অনুপযুক্ত বলে প্রমাণিত হয়েছে। তাদের ব্যর্থতার বেশ কিছু কারণ রয়েছে যেখান থেকে আমাদের শিক্ষা নিতে হবে।
শিক্ষাব্যবস্থা আসলে কি? এবং আদর্শ শিক্ষাব্যবস্থা কি? একটি আদর্শ শিক্ষাব্যবস্থার ভিত্তিস্তম্ভগুলোই বা কি? যার উপর একটি শিক্ষাব্যবস্থা দাঁড়িয়ে থাকে। যেগুলোকে শক্তিশালী না করলে শিক্ষাব্যবস্থা শক্তিশালী হয়না। উত্তর খোঁজ করা যাক।
বলে রাখা ভালো অনেকে শিক্ষাব্যবস্থা, শিক্ষাক্রম এবং পাঠ্যক্রমের ধারণার মধ্যে গুলিয়ে ফেলি। এগুলোর মধ্যে পার্থক্য রয়েছে। একটি দেশের জনগণকে শিক্ষিত করতে যে সামগ্রিক বৃহত্তর কাঠামো তৈরি করা হয় সেটাই মূলত শিক্ষাব্যবস্থা। শিক্ষাব্যবস্থায় বিদ্যালয়, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়, শিক্ষাক্রম, শিক্ষক, এবং প্রশাসনিক নীতি সবকিছুর সমন্বয়ে গঠিত। এর মধ্যে প্রাথমিক শিক্ষা থেকে শুরু করে উচ্চশিক্ষা পর্যন্ত পরিচালিত হয়।
অন্যদিকে পাঠ্যক্রম বা কারিকুলাম হলো এমন একটি পরিকল্পনা, যা শিক্ষার্থীদের কী শেখানো হবে এবং কীভাবে শেখানো হবে, তা নির্ধারণ করে। এটি মূলত নির্দিষ্ট একটি শিক্ষাস্তরের পাঠ্য বিষয়ের রূপরেখা, যেখানে পাঠ্যবই, পাঠদান পদ্ধতি, শিক্ষার উদ্দেশ্য এবং শিক্ষার্থীদের মূল্যায়নের উপায়গুলো উল্লেখ করা থাকে। উদাহরণস্বরূপ, স্কুলে যেসব বিষয় পড়ানো হয়, যেমন- গণিত, বিজ্ঞান, বাংলা, এগুলো পাঠ্যক্রমের অংশ। পাঠ্যক্রম শিক্ষার্থীদের শেখানোর জন্য নির্দিষ্ট একটি দিকনির্দেশনা দেয়।
আর শিক্ষাক্রম বা সিলেবাস হলো কোনো নির্দিষ্ট বিষয়ের জন্য নির্ধারিত পাঠ্যসূচি, যেটা অনুসরণ করে শিক্ষক শ্রেণিকক্ষে কোনোবিষয় পাঠদান করেন।
আমরা যখন আদর্শ শিক্ষাব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার কথা তুলছি তখন তার স্বরূপটা বুঝতে হবে। আদর্শ শিক্ষাব্যবস্থার কয়েকটি মৌলিক ও অপরিহার্য উপাদান রয়েছে যেগুলোকে বোঝা প্রয়োজন এবং আমাদের দেশের ধর্মীয়, সাংস্কৃতিক, ও অর্থসামাজিক অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে উপাদানগুলোর নিশ্চিতকরণ বিবেচনায় আনতে হবে।
একীভূত পাঠ্যক্রম ও সেতুবন্ধন: আমাদের দেশে বর্তমানে সাধারণ, মাদ্রাসা, কারিগরি, এবং ইংলিশ মিডিয়াম নামে একাধিক শিক্ষাধারা প্রচলিত। এই ধারাগুলোর মধ্যে পার্থক্য অনেক বেশি। এর ফলে শিক্ষার্থীরা এক ধারা থেকে অন্য ধারায় যেতে চাইলে নানা সমস্যার সম্মুখীন হয়।
মাদ্রাসার শিক্ষার্থীরা ধর্মীয় জ্ঞান অর্জন করে, কিন্তু সাধারণ শিক্ষার মূল বিষয়গুলোতে তাদের ঘাটতি থেকে যায়। আবার, ইংলিশ মিডিয়াম শিক্ষার্থীরা আন্তর্জাতিক মানের শিক্ষা পেলেও অনেক সময় তাদের বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতির সঙ্গে দূরত্ব তৈরি হয়। কারিগরি শিক্ষার ক্ষেত্রে, শিক্ষার্থীরা দক্ষতামূলক প্রশিক্ষণ পেলেও জীবনের অন্যান্য মৌলিক বিষয়ে তাদের জ্ঞান সীমিত থাকতে পারে। এই ভিন্ন শিক্ষার ধারা শিক্ষার্থীদের মধ্যে একটি অসামঞ্জস্যতা তৈরি করে।
একটি আদর্শ শিক্ষা ব্যবস্থায় শিক্ষার প্রতিটি ধারার মধ্যে ইন্টিগ্রেটেড পাঠ্যক্রম বা একীভূত পাঠ্যক্রম থাকা উচিত, যেখানে শিক্ষার্থীদের জন্য একটি ভিত্তিগত কাঠামো নির্ধারণ করা হবে। এর মানে হলো, মাদ্রাসা, কারিগরি বা ইংলিশ মিডিয়াম- যে ধারা থেকেই আসুক না কেন, সবাইকে কিছু মৌলিক বিষয় শিখতে হবে, যেমন বিজ্ঞান, গণিত, তথ্যপ্রযুক্তি, নৈতিক শিক্ষা ইত্যাদি।
এভাবে, যদি কোনো শিক্ষার্থী মাদ্রাসা থেকে সাধারণ শিক্ষা বা কারিগরি শিক্ষা থেকে সাধারণ শিক্ষায় যেতে চায়, তাহলে তার জন্য শিক্ষার ভিত্তি একই থাকবে। এতে শিক্ষার্থীদের শিক্ষাজীবনের মাঝে পরিবর্তন আনতে কোনো সমস্যায় পড়তে হবে না এবং তাদের শেখার ধারাবাহিকতা বজায় থাকবে।
গুণগত মানসম্পন্ন শিক্ষক: একটি কার্যকর ও টেকসই শিক্ষা ব্যবস্থার জন্য গুণগত মানসম্পন্ন শিক্ষক খুবই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। বাংলাদেশের মতো একটি উন্নয়নশীল দেশে, যেখানে শিক্ষার বিভিন্ন ধারা রয়েছে, সেখানে একজন দক্ষ ও প্রশিক্ষিত শিক্ষকই পারেন শিক্ষার্থীদের মধ্যে প্রকৃত পরিবর্তন আনতে।
শিক্ষকরা শুধুমাত্র তথ্য বা জ্ঞান প্রদান করেন না, তারা শিক্ষার্থীদের চিন্তাশক্তি ও মানসিক বিকাশের অন্যতম চালিকা শক্তি। বাংলাদেশে শিক্ষকদের মধ্যে অনেকেই পেশাগত দক্ষতার ক্ষেত্রে চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হন, কারণ তারা প্রায়ই পর্যাপ্ত প্রশিক্ষণের অভাবে বা সময়োপযোগী শিক্ষাদান পদ্ধতির সাথে তাল মিলিয়ে চলতে পারেন না। শিক্ষার্থীদের উন্নয়নের জন্য শিক্ষকদের নিজস্ব দক্ষতা ও যোগ্যতা থাকা অত্যাবশ্যক।
শিক্ষকরা যাতে সময়োপযোগী শিক্ষাদান পদ্ধতি ও নতুন প্রযুক্তির সাথে মানিয়ে নিতে পারেন, সেজন্য নিয়মিত শিক্ষক প্রশিক্ষণ কর্মসূচি প্রয়োজন। এই প্রশিক্ষণ শুধুমাত্র পাঠদানের দক্ষতা উন্নয়নের জন্য নয়, বরং শিক্ষার্থীদের চিন্তাশক্তি, বিশ্লেষণ ক্ষমতা ও সৃজনশীলতাকে জাগিয়ে তোলার জন্যও অপরিহার্য।
উদাহরণস্বরূপ, বাংলাদেশের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে অনেক সময় শিক্ষার্থীদের পাঠ্যসূচিতে প্রযুক্তিগত বিষয় যুক্ত করা হলেও, শিক্ষকদের এই প্রযুক্তিগত জ্ঞান সম্পর্কে সচেতনতা বা দক্ষতা থাকে না। ফলে শিক্ষার্থীরা তা থেকে পূর্ণাঙ্গ সুবিধা নিতে পারে না। যদি শিক্ষকরা সঠিক প্রশিক্ষণের মাধ্যমে এসব প্রযুক্তিগত বিষয় সম্পর্কে দক্ষতা অর্জন করতে পারেন, তাহলে তারা শিক্ষার্থীদের আরও উন্নতভাবে দিকনির্দেশনা দিতে পারবেন এবং শিক্ষাকে যুগোপযোগী করতে পারবেন।
সময়োপযোগী শিক্ষাদান পদ্ধতি: নতুন শিক্ষা ব্যবস্থায় সময়োপযোগী শিক্ষাদান পদ্ধতি নিশ্চিত করা খুবই প্রয়োজন, কারণ বিশ্ব যেভাবে দ্রুত পরিবর্তিত হচ্ছে, তার সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলতে শিক্ষার্থীদের দক্ষতা বাড়ানো অপরিহার্য। আমাদের দেশে এখনও শিক্ষার বড় অংশটাই মুখস্থনির্ভর এবং তাত্ত্বিক, যা শিক্ষার্থীদের বাস্তব জীবনের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলার জন্য পুরোপুরি প্রস্তুত করতে পারে না। শিক্ষার্থীদের শুধু পরীক্ষা পাস করার জন্য তৈরি না করে, তাদের হাতে-কলমে শেখানোর ব্যবস্থা করতে হবে। আধুনিক প্রযুক্তির ব্যবহার, ইন্টার্যাকটিভ ক্লাসরুম এবং বাস্তব জীবনের প্রকল্পভিত্তিক শিক্ষা যুক্ত করলে শিক্ষার্থীরা শেখার পাশাপাশি চিন্তাশক্তি এবং সমস্যার সমাধান করার ক্ষমতা বাড়াবে। এতে তারা শুধু পরীক্ষায় ভালো করবে না, ভবিষ্যতের চাকরি বা জীবনের অন্যান্য ক্ষেত্রেও সফল হতে পারবে।
প্রযুক্তি ও ডিজিটাল শিক্ষার অন্তর্ভুক্তি: বাংলাদেশের শিক্ষাব্যবস্থায় প্রযুক্তি ও ডিজিটাল শিক্ষার অন্তর্ভুক্তি এখন সময়ের দাবি। কেবল বইয়ের ওপর নির্ভরশীল শিক্ষায় শিক্ষার্থীরা আধুনিক বিশ্বের চাহিদা মেটাতে পারছে না। আমাদের শিক্ষার্থীদের কম্পিউটার, স্মার্টবোর্ড, ইন্টারনেট ইত্যাদি ব্যবহার করে শেখার সুযোগ দিতে হবে, যাতে তারা বাস্তবমুখী ও ইন্টার্যাকটিভভাবে শিখতে পারে। এর ফলে তারা শুধু বইয়ের জ্ঞানেই সীমাবদ্ধ থাকবে না, বরং সৃজনশীল চিন্তাভাবনা ও সমস্যা সমাধানের দক্ষতা বাড়বে।
শিক্ষার্থীদের প্রযুক্তি-নির্ভর শিক্ষায় গাইড করতে হলে শিক্ষকদেরও ডিজিটাল দক্ষতা প্রয়োজন। আমাদের দেশে অনেক শিক্ষক এখনও এই প্রযুক্তি ব্যবহারে দক্ষ নন, তাই তাদের জন্য প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা জরুরি। আধুনিক মাল্টিমিডিয়া টুলস ব্যবহার করে শিক্ষার্থীদের আরও ভালোভাবে শেখানো সম্ভব।
বাংলাদেশের গ্রামীণ এলাকাগুলোতে এখনো ইন্টারনেট সংযোগের অভাব এবং বিদ্যুতের সমস্যা বড় চ্যালেঞ্জ। এসব সমস্যা সমাধানে সরকারের উচিত সুলভ মূল্যে ইন্টারনেট সেবা নিশ্চিত করা এবং প্রত্যন্ত অঞ্চলে ডিজিটাল অবকাঠামো তৈরি করা। প্রযুক্তি ও ডিজিটাল শিক্ষার সঠিক অন্তর্ভুক্তি আমাদের শিক্ষার্থীদের আন্তর্জাতিক মানের দক্ষতা অর্জনে সাহায্য করবে, যা তাদের ভবিষ্যতের কর্মজীবনে সফল হতে সহায়ক হবে এবং দেশের উন্নয়নেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে।
টেকসই অর্থায়ন ও ব্যাবস্থাপনা: একটি দেশের শিক্ষাব্যবস্থা কতটা কার্যকর হবে, তা নির্ভর করে কতটা টেকসইভাবে অর্থায়ন ও ব্যবস্থাপনা করা হচ্ছে তার ওপর। শিক্ষার মান উন্নত করতে শুধু ভালো নীতিমালা থাকলেই হবে না, তা বাস্তবায়নের জন্য পর্যাপ্ত বাজেট বরাদ্দও অত্যন্ত জরুরি।
বাংলাদেশ সাধারণত প্রতি বছর শিক্ষাখাতে জিডিপির প্রায় ২.৫% বরাদ্দ করে। এই বরাদ্দের মাধ্যমে স্কুল-কলেজ থেকে শুরু করে বিশ্ববিদ্যালয়ের অবকাঠামো উন্নয়ন, বই বিতরণ, এবং শিক্ষার্থীদের জন্য বিভিন্ন সেবার মান উন্নত করার চেষ্টা করা হয়। কিন্তু বাস্তবতা হলো, এই বরাদ্দ প্রায়ই পর্যাপ্ত হয় না, বিশেষ করে গ্রামাঞ্চল এবং নিম্নআয়ের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোর জন্য। গ্রামীণ এলাকায় শিক্ষার উন্নতির জন্য যে প্রযুক্তি, আধুনিক সরঞ্জাম বা প্রশিক্ষিত শিক্ষক প্রয়োজন, সেগুলো প্রায়ই অপ্রতুল থাকে। ফলে শিক্ষার্থীরা পিছিয়ে পড়ে, এবং শিক্ষার গুণগত মান উন্নয়নে বাঁধা সৃষ্টি হয়।
অনেক দেশ শিক্ষাখাতে বড় বাজেট বরাদ্দ করে, যার ফলে তাদের শিক্ষাব্যবস্থা বিশ্বব্যাপী প্রশংসিত হয়। উদাহরণস্বরূপ, কিউবা শিক্ষার জন্য মোট বাজেটের প্রায় ১৩% বরাদ্দ করে। সেখানে শিক্ষার্থীরা বিনামূল্যে শিক্ষা পায় এবং এর মানও অসাধারণ। এটি সম্ভব হয়েছে কেবল টেকসই অর্থায়নের কারণে। এছাড়া, ফিনল্যান্ড শিক্ষাখাতে মোট বাজেটের ১২% বরাদ্দ করে এবং শিক্ষকদের প্রশিক্ষণ ও শিক্ষার মান উন্নয়নের দিকে বিশেষ নজর দেয়। জাপান তাদের শিক্ষা খাতে মোট বাজেটের ১০% ব্যয় করে, যা প্রযুক্তি ও আধুনিক সরঞ্জাম ব্যবহারে সাহায্য করে। সুইডেন শিক্ষার জন্য ৯% বাজেট বরাদ্দ করে, যা শিক্ষার্থীদের জন্য উন্নত সুযোগ তৈরি করে এবং শিক্ষার গুণগত মান নিশ্চিত করে।
বাংলাদেশের মতো দেশের জন্য শিক্ষায় বিনিয়োগ বৃদ্ধি করা অত্যন্ত প্রয়োজন। বাংলাদেশের শিক্ষাখাতে জিডিপির ২.৫% বরাদ্দ অনেক ক্ষেত্রেই যথেষ্ট নয়। কিউবা, ফিনল্যান্ড, জাপান এবং সুইডেনের মতো দেশগুলো শিক্ষায় উচ্চমাত্রার বরাদ্দ রেখে নিজেদের শিক্ষাব্যবস্থাকে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছে।
যদি বাংলাদেশ শিক্ষায় আরও বেশি অর্থ বরাদ্দ করতে পারে এবং সঠিকভাবে ব্যবস্থাপনা করতে পারে, তাহলে শিক্ষার মান অনেক উন্নত হবে। আধুনিক শিক্ষাসামগ্রী, প্রযুক্তির ব্যবহার, এবং শিক্ষকদের উন্নত প্রশিক্ষণ নিশ্চিত হলে শিক্ষার্থীরা আরও ভালোভাবে শিখতে পারবে এবং ভবিষ্যতে সফলতার সুযোগও বৃদ্ধি পাবে।
তবে বিগত দেড় দশকে বাংলাদেশের শিক্ষাখাতে অনিয়ম, দুর্নীতি, এবং অর্থ লুটপাট ধীরে ধীরে এক বড় সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে, যা শিক্ষার মান উন্নয়নের পথে বড় বাধা তৈরি করছে। স্কুলের অবকাঠামো উন্নয়নের নামে যে অর্থ বরাদ্দ করা হয়, তা সঠিকভাবে ব্যবহার না হওয়ায় অনেক স্থানে নিম্নমানের ভবন তৈরি হয়েছে, যা শিক্ষার্থীদের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ। শিক্ষাসামগ্রী ও বই বিতরণেও অনিয়মের কারণে শিক্ষার্থীরা প্রয়োজনীয় জিনিসগুলো পাচ্ছে না। শিক্ষক নিয়োগেও ঘুষ ও রাজনৈতিক প্রভাবের কারণে যোগ্যতাসম্পন্ন শিক্ষক প্রায়শই পিছিয়ে পড়ছেন, ফলে শিক্ষার মান কমে গিয়েছে। তথ্যপ্রযুক্তি প্রকল্পে বরাদ্দকৃত অর্থ সঠিকভাবে ব্যবহার না হওয়ায় শিক্ষার্থীরা আধুনিক শিক্ষা থেকে বঞ্চিত হয়েছে। গত দেড় দশকে এসব সমস্যা আরও প্রকট হয়েছে। যেখানে উন্নত দেশগুলো, যেমন ফিনল্যান্ড ও জাপান, শিক্ষাখাতে বরাদ্দকৃত অর্থের সঠিক ব্যবহার করে শিক্ষার মান উন্নত করেছে, সেখানে বাংলাদেশে বরাদ্দ থাকলেও কার্যকর ফলাফল দেখা যাচ্ছে না। দুর্নীতি রোধে কঠোর ব্যবস্থা এবং স্বচ্ছতা নিশ্চিত না করা গেলে শিক্ষাখাতের প্রকৃত উন্নয়ন সম্ভব হবে না।
আমাদের জন্য একটি আদর্শ শিক্ষাব্যবস্থা এমন হতে হবে যা শুধু বইয়ের অক্ষরের সীমাবদ্ধতায় নয়, বরং আমাদের শিক্ষার্থীরা সৃজনশীলতা, চিন্তাশক্তি এবং বাস্তব জীবনের দক্ষতাকে মূল্য দেয়। আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থাকে এমনভাবে সাজাতে হবে যাতে সব ধরনের শিক্ষার ধারাগুলো একত্রিত হয়ে, সবাইকে মৌলিক শিক্ষা দেওয়া হয়। এতে করে আমাদের শিক্ষার্থীরা শুধু পরীক্ষায় ভালো করবে না, বরং জীবনের সকল ক্ষেত্রে সাফল্য অর্জন করতে পারবে।
প্রযুক্তি এবং ডিজিটাল শিক্ষার অন্তর্ভুক্তি নিশ্চিত করতে হবে, যাতে তারা আধুনিক বিশ্বের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলতে পারে। গুণগত মানসম্পন্ন শিক্ষকদের প্রশিক্ষণও অপরিহার্য, যাতে তারা শিক্ষার্থীদের সঠিকভাবে গাইড করতে পারে। তবে, সবকিছুর আগে আমাদের প্রয়োজন টেকসই অর্থায়ন এবং সঠিক ব্যবস্থাপনা। এই অর্থায়ন আমাদের শিক্ষার মান উন্নয়নের ক্ষেত্রে বড় ভূমিকা রাখতে পারে।
যদি আমরা এগুলো নিশ্চিত করতে পারি, তাহলে আমরা একটি সুন্দর, শক্তিশালী এবং সামঞ্জস্যপূর্ণ শিক্ষাব্যবস্থা গড়তে পারব, যা আমাদের আগামী প্রজন্মকে সাফল্যের পথে এগিয়ে নিয়ে যাবে।
লেখক: শিক্ষার্থী, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়