সামাজিক অস্থিরতা ও গণপিটুনির সংস্কৃতি
২৩ সেপ্টেম্বর ২০২৪ ১৭:১৯
বাংলাদেশে সামাজিক অস্থিরতা ও গণপিটুনি সাম্প্রতিক সময়ে একটি গুরুতর সমস্যায় পরিণত হয়েছে, যা দেশের রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক প্রেক্ষাপটের সঙ্গে জড়িত। এই সমস্যা মূলত সামাজিক ও প্রাতিষ্ঠানিক দুর্বলতার প্রতিফলন। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর ব্যর্থতা, বিচার বিভাগের দীর্ঘসূত্রিতা, রাজনৈতিক বিভাজন এবং সাধারণ মানুষের মধ্যে প্রাতিষ্ঠানিক আস্থার অভাব এই সমস্যার মূল কারণ হিসেবে কাজ করছে। গণপিটুনির মতো ঘটনা সমাজের হতাশা ও অবিশ্বাসের প্রতিফলন, যেখানে মানুষ প্রাতিষ্ঠানিক বিচার ব্যবস্থার ওপর আস্থা না রেখে নিজেদের মতো করে বিচার করতে বাধ্য হচ্ছে।
বাংলাদেশে সামাজিক অস্থিরতার প্রধান কারণগুলোর একটি হলো কার্যকর শাসনের অভাব। অর্থনৈতিক উন্নতি সত্ত্বেও ধনী ও দরিদ্রের মধ্যে ব্যবধান দিন দিন বাড়ছে, যা সাধারণ মানুষের মধ্যে গভীর ক্ষোভের সৃষ্টি করছে। বিশেষ করে সমাজের প্রান্তিক মানুষরা উন্নয়নের মূলধারার বাইরে থেকে যাচ্ছে, ফলে তারা নিজেদেরকে উপেক্ষিত ও বঞ্চিত মনে করছে। সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোর বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ এবং সম্পদের অসম বণ্টনও এই ক্ষোভকে বাড়িয়ে তুলছে। এই কারণে বাংলাদেশে বিক্ষোভ, প্রতিবাদ ও সংঘর্ষ ক্রমাগত বেড়ে চলেছে, যা দেশের সামাজিক স্থিতিশীলতাকে হুমকির মুখে ফেলছে।
বাংলাদেশের বিচার ব্যবস্থা প্রায়শই দ্রুত ও সঠিক বিচার দিতে ব্যর্থ হয়। মামলাগুলো বছরের পর বছর ধরে চলতে থাকে, ফলে ভুক্তভোগীরা এবং তাদের পরিবারবর্গ এক অনিশ্চয়তার মধ্যে দিন কাটায়। পুলিশের কার্যকারিতা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে বারবার, তাদের বিরুদ্ধে দুর্নীতি ও অপরাধীদের সঙ্গে সখ্যতার অভিযোগ রয়েছে। এই পরিস্থিতিতে, মানুষ তাদের সমস্যার সমাধানে আইনগত পথে না গিয়ে গণপিটুনির মতো নৃশংস পদ্ধতির আশ্রয় নিচ্ছে। জনগণ যখন বুঝতে পারে যে বিচার ব্যবস্থা তাদের সুরক্ষা দিতে পারছে না, তখন তারা বিকল্প উপায়ে বিচার প্রক্রিয়া পরিচালনার চেষ্টা করে, যার ফলাফল হচ্ছে সমাজে গণপিটুনির ঘটনা বৃদ্ধি।
গণপিটুনির ঘটনা মূলত তখনই ঘটে যখন একটি সমাজ নিজেকে ক্ষতিগ্রস্ত বা অবহেলিত মনে করে এবং আনুষ্ঠানিক বিচার ব্যবস্থার ওপর আস্থা হারায়। সাধারণত চুরির অভিযোগ, অপবাদ বা অন্য কোনো ছোটখাটো ঘটনার প্রতিক্রিয়া হিসেবে জনতা জড়ো হয় এবং অভিযুক্ত ব্যক্তিকে শাস্তি দেয়ার জন্য তৎক্ষণাৎ আক্রমণ শুরু করে। এমনকি অনেক সময় নিরীহ ব্যক্তিদেরও কোনো প্রমাণ ছাড়াই গণপিটুনির শিকার হতে হয়। এই ধরনের সহিংসতা দ্রুত বৃদ্ধি পায় এবং জনতা নিজেরাই আইন ও বিচার প্রতিষ্ঠার দায়িত্ব তুলে নেয়, যা সামাজিক শৃঙ্খলাকে সম্পূর্ণরূপে বিপন্ন করে।
গণপিটুনির ঘটনাগুলোতে গুজব এবং ভুল তথ্য বড় ভূমিকা পালন করে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম এবং মেসেজিং প্ল্যাটফর্মের দ্রুত বিস্তারের কারণে, ভুল তথ্য মুহূর্তের মধ্যে হাজারো মানুষের কাছে পৌঁছে যায়। একটি সামান্য পোস্ট বা ভিডিও, যেখানে কাউকে অপরাধী হিসেবে দেখানো হয়, তা কয়েক মিনিটের মধ্যে জনতাকে উত্তেজিত করে তুলতে পারে। এসব প্ল্যাটফর্ম গুজব ছড়ানোর প্রধান মাধ্যম হয়ে দাঁড়িয়েছে এবং এর ফলে গণপিটুনির ঘটনা খুব দ্রুত ঘটে থাকে। অনেক সময় নির্দোষ মানুষও এ ধরনের ভুয়া অভিযোগের শিকার হয়ে প্রাণ হারাচ্ছে।
গণপিটুনির পরিণাম খুবই ভয়াবহ। যারা অভিযুক্ত হয়, তাদের জীবন প্রায়শই শেষ হয়ে যায়, এবং সমাজে আতঙ্ক ও অবিশ্বাসের পরিবেশ সৃষ্টি হয়। গণপিটুনি সমাজের আইনি ও নৈতিক ভিত্তিকে দুর্বল করে দেয়। এর ফলে, সামাজিক সুস্থিতি নষ্ট হয় এবং একটি সমাজে শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠার জন্য অপরিহার্য ভিত্তি দুর্বল হয়ে পড়ে। যখন গণতান্ত্রিক এবং বিচারব্যবস্থা দুর্বল হয়ে যায়, তখন মানুষ নিজেদের প্রতিক্রিয়া সহিংস পদ্ধতিতে প্রকাশ করে, যা দীর্ঘমেয়াদী অস্থিতিশীলতা সৃষ্টি করে।
বাংলাদেশে সামাজিক অস্থিরতার আরেকটি প্রধান কারণ হলো অর্থনৈতিক বৈষম্য। দেশের উন্নয়নের সত্ত্বেও, একটি বড় অংশের মানুষ এখনও দারিদ্র্য ও বেকারত্বের শিকার। গ্রামীণ এলাকায় ভূমি বিরোধ, অবকাঠামোর অভাব এবং কর্মসংস্থানের অভাবে সামাজিক অস্থিরতা বাড়ছে। যখন মানুষ তাদের অর্থনৈতিক অবস্থা নিয়ে হতাশ এবং উন্নতির কোনো পথ দেখতে পায় না, তখন তারা সহজেই সহিংস প্রতিবাদের দিকে ঝুঁকে পড়ে। এই অর্থনৈতিক সমস্যা, সামাজিক অবিচারের সঙ্গে মিলিত হয়ে সমাজকে অস্থিতিশীল করে তোলে।
এই সামাজিক অস্থিরতা এবং গণপিটুনি মোকাবিলায় একটি সমন্বিত প্রচেষ্টা প্রয়োজন। বিচার ব্যবস্থার শক্তিশালীকরণ অপরিহার্য। দ্রুত এবং ন্যায়বিচারের নিশ্চয়তা প্রদান করে জনগণের আস্থা ফিরিয়ে আনতে হবে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে আরও দক্ষ করে তুলতে হবে, যাতে তারা সমাজের সমস্যাগুলো দ্রুত ও কার্যকরভাবে সমাধান করতে পারে। একইসঙ্গে, মামলার দীর্ঘসূত্রিতা রোধ করে দ্রুত বিচার নিশ্চিত করতে হবে, যাতে মানুষ আদালতের প্রতি আস্থা রাখতে পারে।
গণসচেতনতা বৃদ্ধির মাধ্যমে জনগণকে গণপিটুনির বিপদ সম্পর্কে জানানোও অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। মানুষকে আইন ও শৃঙ্খলার প্রয়োজনীয়তা এবং বিকল্প পথে বিচারের ক্ষতিকর প্রভাব সম্পর্কে শিক্ষা দিতে হবে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম এবং অন্যান্য ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মগুলোর মাধ্যমে সহনশীলতা ও শান্তির বার্তা ছড়িয়ে দেয়া যেতে পারে। একইসঙ্গে, গুজব নিয়ন্ত্রণে সরকারকে শক্তিশালী নীতি গ্রহণ করতে হবে।
অর্থনৈতিক বৈষম্য দূর করার জন্যও দীর্ঘমেয়াদী পদক্ষেপ নিতে হবে। দরিদ্রদের জন্য কর্মসংস্থান এবং শিক্ষা ব্যবস্থা নিশ্চিত করে তাদের মধ্যে আশার সঞ্চার করতে হবে। সরকারকে আরও অন্তর্ভুক্তিমূলক অর্থনৈতিক নীতি গ্রহণ করতে হবে, যা সম্পদের ন্যায্য বণ্টন নিশ্চিত করবে এবং সমাজে সাম্য প্রতিষ্ঠা করবে। রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক সংস্কার আনতে হবে, যাতে দুর্নীতির লাগাম টানা যায় এবং জনগণের মাঝে আস্থা ফিরিয়ে আনা যায়। জনগণের আস্থা ফিরিয়ে এনে এবং সামগ্রিকভাবে সমাজের সমস্যাগুলো সমাধান করে বাংলাদেশ একটি শান্তিপূর্ণ এবং শৃঙ্খলাপূর্ণ সমাজ গড়ে তুলতে পারে, যেখানে গণপিটুনি ও সামাজিক অস্থিরতার কোনো স্থান থাকবে না।
সামাজিক অস্থিরতা এবং গণপিটুনির ঘটনা বাংলাদেশে ক্রমশ একটি গুরুতর সমস্যায় পরিণত হয়েছে, যা দেশের প্রাতিষ্ঠানিক দুর্বলতা, অর্থনৈতিক বৈষম্য, এবং আইনি ব্যবস্থার ব্যর্থতার সঙ্গে জড়িত।
লেখক: বিভাগীয় প্রধান, সমাজবিজ্ঞান বিভাগ, তেজগাঁও কালেজ, ঢাকা
মুক্তমত মো. বজলুর রশিদ সামাজিক অস্থিরতা ও গণপিটুনির সংস্কৃতি