Friday 27 September 2024
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

নৈতিক সংস্কার বনাম শুদ্ধাচার পুরস্কার

এম এম উজ্জ্বল
২৪ সেপ্টেম্বর ২০২৪ ১৫:০০

প্রজাতন্ত্রের কর্মচারীদের পেশাগত দক্ষতা, সততা, নৈতিকতা ও কর্মক্ষেত্রে কাজের মান বৃদ্ধি করতে দেশের সরকারি দপ্তরগুলোতে মন্ত্রিসভা-বৈঠকে চূড়ান্তভাবে অনুমোদনের প্রেক্ষিতে ‘সোনার বাংলা গড়ার প্রত্যয়: জাতীয় শুদ্ধাচার কৌশল’ শিরোনামে ২০১৮ সালে জাতীয় শুদ্ধাচার কৌশল প্রবর্তন হয়। দেশের প্রচলিত আইনের সুষ্ঠু বাস্তবায়ন, দুর্নীতি দমন ও সর্বক্ষেত্রে শুদ্ধাচার চর্চার লক্ষ্যে জাতীয় শুদ্ধাচার কৌশল গ্রহণ করা হয়েছিল।

বিজ্ঞাপন

দৈনিক পত্রিকার তথ্যানুযায়ী দেশে শুদ্ধাচার পুরস্কার পেয়েছেন প্রায় দশ হাজার সরকারী কর্মকর্তা। সেই তালিকায় রয়েছেন দুর্নীতি মাধ্যমে সম্পদের পাহাড় গড়ে তোলা পুলিশ কর্মকর্তা, চারিত্রিক পদস্খলনের দায়ে অভিযুক্ত জেলা প্রশাসক, ছাগল কাণ্ডে আলোচিত এনবিআরের কর্মকর্তা থেকে শুরু নানা পর্যায়ের অনিয়ম করা কর্মকর্তাগণ। শুদ্ধাচার পুরস্কার প্রাপ্তিতে যে সকল গুণাবলি বিবেচনা করা হয় তার মধ্যে পেশাগত জ্ঞান ও দক্ষতা, সততার নিদর্শন, নির্ভরযোগ্যতা ও কর্তব্যনিষ্ঠা, শৃঙ্খলাবোধ ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য। তবে অভিযুক্ত কর্মকর্তাগণ কোন বিবেচনায় শুদ্ধাচার পুরস্কার পেয়েছেন তা সবার কাছেই সুস্পষ্ট।

বিজ্ঞাপন

নৈতিক স্খলন, দুর্নীতি, স্বজন-প্রীতি সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে প্রবেশ করেছে। বিগত সরকারের গৃহীত শুদ্ধাচার কৌশল কর্ম-পরিকল্পনা কর্মকর্তাগণের নৈতিক স্খলন, দুর্নীতি, স্বজন-প্রীতি প্রতিরোধ করতে ব্যর্থ হয়েছে। সম্প্রতি জন সম্মুখে প্রকাশিত রাঘব বোয়ালদের সম্পদের হিসাব তাই প্রমাণ করে। দুর্নীতির বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্স নীতি ঘোষণা করার পরে দেশে অনেক হৈচৈ শুরু হয়েছিল কিন্তু ঐ নীতি বাস্তবায়নকারী এবং সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিগণই যখন দুর্নীতিতে চ্যাম্পিয়ন হিসেবে আবির্ভূত হন তখন তা পরিষ্কার হয় যে আমাদের অস্থিমজ্জায় থেকেই দুর্নীতির উৎপত্তি। যা শুধু আইন কিংবা নীতি প্রণয়নের মাধ্যমে প্রতিরোধ করা সম্ভব নয়। প্রয়োজন আমাদের নৈতিক উন্নয়ন সাধন করা।

ক্ষমতার জালের সুতা ছড়িয়ে আছে রাষ্ট্রযন্ত্রের শীর্ষ থেকে তলানি পর্যন্ত। দেশের জনগণ প্রত্যক্ষ করেছে একজন ড্রাইভার, পিয়ন কিংবা চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারী কীভাবে শত কোটি টাকার মালিক হয়। একটা স্কুল কীভাবে পারিবারিক কর্মসংস্থানের কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হয়। সংসদ সদস্য, আমলা কিংবা ব্যবসায়ী গোষ্ঠী কীভাবে দেশ থেকে হাজার কোটি টাকা পাচার করে। ক্ষমতার পালা বদলের সাথে সাথে সরকারের গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি, জাতীয় মসজিদের খতিব থেকে শুরু করে ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যানকে পর্যন্ত পালিয়ে বেড়াতে হচ্ছে। কেউ কেউ ধরা পড়ছে প্রতিবেশী দেশে পলায়নের সময়। জনগণ প্রশ্ন করছে, তারা কি এমন কাজ করেছে যার জন্য ক্ষমতার রদবদলের সাথে সাথে পালাতে বাধ্য হচ্ছে? তারা কি অপমার জনতা কিংবা দেশের জন্য কিছুই করেনি? তা হয়ত করেছে কিন্তু নীতি নৈতিকতার প্রশ্নে তারা উত্তীর্ণ হতে পারেনি।

সরকার পতনের পর বেশ কিছুদিন দেশের অস্থিতিশীল অবস্থা বিরাজ করে। গণধোলাই, ডাকাতি, লুটপাট চলে কয়েক সপ্তাহ। নিপীড়নকারীরা ভয়ে পালাতে থাকে দেশে কিংবা দেশের বাইরে। ছাত্র-ছাত্রীরা ক্ষেত্র বিশেষে অছাত্ররাও বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে শিক্ষকদের পদত্যাগ করতে বাধ্য করেছে; অনেক শিক্ষক নিপীড়নকারী হলেও কোনো কোনো ক্ষেত্রে তা ব্যক্তিগত আক্রোশে সংগঠিত হয়েছে। অনেক শিক্ষকও নৈতিকতার প্রশ্নে আপস করেছেন রাজনৈতিক সংশ্লিষ্টতার স্বার্থে। কারণ পদ পদবির জন্য রাজনৈতিক প্রভুদের খুশি রাখতে হয়; নৈতিকতা সেখানে বিবেচ্য বিষয় নয়।

জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বলেছিলেন, ‘এ-দেশের নাড়িতে-নাড়িতে অস্থিমজ্জায় যে পচন ধরেছে, তাতে এর একেবারে ধ্বংস না হলে নতুন জাত গড়ে উঠবে না। যার ভিত্তি পচে গেছে তাকে একদম উপড়ে ফেলে নতুন করে ভিত্তি না গাঁথলে তার ওপর ইমারত যতবার খাড়া করা যাবে, ততবারই তা পড়ে যাবে’। দীর্ঘ সময় ক্ষমতায় থাকার ফলে ক্ষমতাসীন দলের ক্ষমতা চর্চা যেন জাতীয় কবির সেই বক্তব্যেরই প্রতিফলন। রাষ্ট্রের প্রতিটি ক্ষেত্রে ঘুণ পোকায় ছিদ্র করেছে। এই কাঠামোর উপরে যত প্রলেপ দেওয়া হোক না কেন তাতে ইমারত গড়ে তোলা যথেষ্ট সময় ও শ্রমসাধ্য।

অন্তর্বর্তী সরকার দেশ সংস্কারের মাধ্যমে ছাত্র জনতার স্বপ্নের বাংলাদেশ গড়ে তুলার প্রত্যয় ব্যক্ত করেছে। ঘোষণা করেছে কয়েকটি সংস্কার কমিশনও। কমিশনের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে সংশ্লিষ্ট বিষয়ে অভিজ্ঞ ব্যক্তিগণকে। দেশে প্রকৃত সংস্কার নিয়ে আসতে হলে ব্যক্তিক নৈতিকতার প্রশ্নে হতে হবে আপসহীন। রাষ্ট্র ব্যবস্থাকে গড়ে তুলতে হবে ন্যায় বিচার, ন্যায্যতা, নৈতিকতার ভিত্তিতে যেখানে পুরস্কৃত করা হবে শুধু নৈতিকতা বিবেচনায় অন্য কোনো বিবেচনায় নয়। সংস্কারের চূড়ান্ত সুফল পেতে আমাদের প্রত্যেকের জায়গায় নিজেদের নৈতিকতায় সংস্কার নিয়ে আসতে হবে যা কোনো আইন কিংবা কৌশল দিয়ে বাস্তবায়ন করা সম্ভব নয়।

লেখক: গল্পকার ও প্রাবন্ধিক, সাবেক শিক্ষার্থী, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

এম এম উজ্জ্বল নৈতিক সংস্কার বনাম শুদ্ধাচার পুরস্কার মুক্তমত

বিজ্ঞাপন
সর্বশেষ
সম্পর্কিত খবর