চীনা বিপ্লবের ৭৫ বছর
২৬ সেপ্টেম্বর ২০২৪ ১৪:৪৭
এক সময়কার খুবই দরিদ্র ও পশ্চাৎপদ দেশ চীন এখন বিশ্বের অন্যতম বৃহৎ এক অর্থনৈতিক শক্তিতে পরিণত হয়েছে।
১ অক্টোবর চীন তার বিপ্লবের ৭৫ বছর পালন করছে। ১৯৪৯ সালের ১ অক্টোবর চীনা বিপ্লবের মহান নেতা কমরেড মাও সে তুং পেইচিংয়ের ঐতিহাসিক তিয়ান আন মেন স্কয়ারে দাঁড়িয়ে সমাজতান্ত্রিক চীনা রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠার কথা ঘোষণা করেছিলেন।
তারপর থেকে বিগত ৭৫ বছরে দেশটিতে আর্থসামাজিক ব্যবস্থায় বড় ধরনের আমূল পরিবর্তন ঘটেছে। সমাজতান্ত্রিক বাজার অর্থনীতির দেশটি নজিরবিহীন সম্পদ অর্জন করেছে অত্যন্ত দ্রুতগতিতে। গণপ্রজাতন্ত্রী চীন আজ শুধু এশিয়া মহাদেশেই নয়, সারা বিশ্বেও পরাক্রমশালী এক সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্র।
(অক্টোবর ১৯৩৪-অক্টোরব ১৯৩৫) সময়কালে চীনা লংমার্চের পর প্রকৃত অর্থেই বিপ্লবের চূড়ান্ত প্রক্রিয়া শুরু হয়েছিল ১৯৪৬ সাল থেকে। বিশেষ করে দ্বিতীয় চীন-জাপান যুদ্ধের পর (১৯৩৭-৪৫)। ওই সময়টা ছিল চীনের গৃহযুদ্ধের সময় (১৯৪৫-৪৯)।
বিপ্লবের চূড়ান্ত মুহূর্তে চীনা কমিউনিস্ট পার্টির নেতৃত্বে লাল ফৌজবাহিনী চিয়াং কাই শেকের নেতৃত্বাধীন জাতীয়তাবাদী কুয়োমিনটাং দলকে পরাজিত করে রাষ্ট্রক্ষমতায় আসীন হয়েছিল। সেই থেকে চীনা কমিউনিস্ট পার্টি চীনের রাষ্ট্রক্ষমতা পরিচালনা করে আসছে। চীন আজ বিশ্ব রাজনীতিতে অন্যতম একটি শক্তি। একসময় বিশ্ব সমাজতান্ত্রিক আন্দোলন সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়ন ও চীনের মাঝে বিভক্ত হয়ে গিয়েছিল। ভারতীয় উপমহাদেশের মতো পৃথিবীর অনেক দেশের কমিউনিস্ট পার্টি ওই সময় প্রো-মস্কো ও প্রো-চীন এই দুই ভাগে ভাগ হয়ে গিয়েছিল। এ ক্ষেত্রে সোভিয়েত নেতা গরবাচেভ সোভিয়েত ইউনিয়নের কমিউনিস্ট পার্টিতে সংস্কার আনতে গিয়ে পুরো দেশটিই ভেঙে দিয়েছিলেন। তার সংস্কার (অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক) সোভিয়েত ইউনিয়নকে একত্র রাখতে পারেনি। চীনা কমিউনিস্ট পার্টিতেও সংস্কার এসেছে। চীনা নেতারা যথেষ্ট সতর্ক ছিলেন। তারা সংস্কার করেছেন। তারা গরবাচেভ মডেলের ‘পেরেস্ত্রোইকা’ অর্থাৎ পুনর্গঠনে নিয়োজিত হয়েছেন। কিন্তু গরবাচেভের ‘গ্লাসনস্ত’-এর ধারণা, অর্থাৎ সবকিছু উন্মুক্ত করে দেওয়া, এটা গ্রহণ করেননি। গরবাচেভ ‘পেরেস্ত্রোইকা’ ও ‘গ্লাসনস্ত’ একসঙ্গে বাস্তবায়ন করতে গিয়ে বিপত্তি বাধিয়েছিলেন। ফলে ভেঙে গিয়েছিল সোভিয়েত ইউনিয়ন। চীনে সংস্কার এসেছিল বিধায়, চীন আজ বিশ্বশক্তি। আজও চীনের ঐক্য টিকে আছে।
একজন গবেষক ও চীনা অর্থনীতিবিদ ক্রিস লিয়ং বলেছেন, “কমিউনিস্ট পার্টি যখন চীনের নিয়ন্ত্রণ গ্রহণ করে তখন দেশটি খুবই গরিব একটি দেশ ছিল। ব্যবসা করার জন্যে তাদের কোন অংশীদার ছিল না, কারো সাথে ছিল না কূটনৈতিক সম্পর্ক, তারা শুধু তাদের নিজেদের উপরেই নির্ভরশীল ছিল।”
গত ৪৫ বছরেরও বেশি সময় ধরে চীন সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থার মধ্যেই তাদের নিজস্ব ধাঁচের বাজার অর্থনীতিতে একের পর এক যুগান্তকারী সংস্কার ঘটিয়েছে, ব্যবসা বাণিজ্য ও বিনিয়োগের জন্যে নতুন নতুন রাস্তা খুলে দিয়েছে এবং শেষ পর্যন্ত কোটি কোটি মানুষকে দারিদ্রের কবল থেকে বের করে এনেছে।
শস্য উৎপাদন বেড়েছে ৫ গুণের বেশি
বিগত ৭৫ বছরে চীনের শস্য উৎপাদনে বড় অগ্রগতি অর্জিত হয়েছে এবং খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত হয়েছে। ২০২৩ সালে শস্য উৎপাদন ১.৩৯০৮ ট্রিলিয়ন চিন হয়েছে, যা ১৯৪৯ সালের তুলনায় এক ট্রিলিয়ন চিন বেশি বা ৫.১ গুণ বৃদ্ধি পেয়েছে। প্রতি ইউনিট এলাকায় শস্যের উত্পাদনও ব্যাপকভাবে বেড়েছে।
গণপ্রজাতন্ত্রী চীন প্রতিষ্ঠার পর থেকে চীনের কৃষি অর্থনীতির স্থিতিশীল উন্নতি হয়েছে এবং এর শিল্প কাঠামো অপ্টিমাইজ ও আপগ্রেড করা হয়েছে। ২০২৩ সালে চীনের কৃষি, বনজ, পশুপালন এবং মৎস্যের মোট আউটপুট মূল্য ছিল ১৫ হাজার ৮৫০.৭ বিলিয়ন ইউয়ান, যা ১৯৫২ সালের ৪৬.১ বিলিয়ন ইউয়ান থেকে ১৫ হাজার ৮০৪.৬ বিলিয়ন ইউয়ানে বেড়েছে।
কৃষি উৎপাদন পদ্ধতির রূপান্তরের সাথে সাথে চীনের কৃষি উৎপাদন চাষাবাদকে প্রধান শিল্প হিসেবে একটি উচ্চ একক কাঠামো থেকে ‘কৃষি, বনজ, পশুপালন ও মৎস্যের ব্যাপক, বহুমুখী ও সমন্বিত উন্নয়নে একটি ঐতিহাসিক রূপান্তর বাস্তবায়ন করেছে। খাদ্য সরবরাহের বৈচিত্র্যকরণ ব্যবস্থার নির্মাণ ত্বরান্বিত হয়েছে।
গণপ্রজাতন্ত্রী চীন প্রতিষ্ঠার ৭৫ বছরে অর্থনৈতিক ও সামাজিক উন্নয়নের সাফল্য সংক্রান্ত চীনের জাতীয় পরিসংখ্যান ব্যুরোর ২৪ সেপ্টেম্বর ২০২৪ (মঙ্গলবার) তারিখে প্রকাশিত ধারাবাহিক রিপোর্ট থেকে এসব তথ্য পাওয়া গেছে।
রিপোর্টে দেখা যায় যে, বাসিন্দাদের জীবনযাত্রার মান এবং খাদ্যের কাঠামোর পরিবর্তনের ক্রমাগত উন্নতির সাথে সাথে অর্থকরী ফসলের উৎপাদন প্রাণবন্তভাবে বৃদ্ধি পাচ্ছে। চীনের কমিউনিস্ট পার্টির ১৮তম জাতীয় কংগ্রেসের পর থেকে চীনের পশুপালন শিল্পের আধুনিকীকরণ এবং স্কেল-আপ প্রক্রিয়াও দ্রুততর হয়েছে। ব্যাপক উৎপাদন ক্ষমতা আরও উন্নত হয়েছে এবং মাংস, ডিম ও দুধের উৎপাদন বহু বছর ধরে বিশ্বের শীর্ষে রয়েছে।
চীনের কমিউনিস্ট পার্টির ১৮তম জাতীয় কংগ্রেসের পর থেকে, দেশটি উচ্চমানের কৃষিজমি নির্মাণের প্রচার অব্যাহত রেখেছে, সেচের জলের উৎসের নিশ্চয়তার অগ্রগতি সমন্বিত করেছে। সেচের ক্ষেত্রের নির্মাণ ও রূপান্তর উল্লেখযোগ্যভাবে উন্নত হয়েছে এবং কৃষি ভিত্তি আরও মজবুত হয়েছে।
রিপোর্টে আরো বলা হয়, বিগত ৭৫ বছরে চীনের কৃষি বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির উন্নয়ন ছোট থেকে বড়, দুর্বল থেকে শক্তিশালী পর্যন্ত ব্যাপক অগ্রগতি করেছে। চীনের কমিউনিস্ট পার্টির ১৮তম জাতীয় কংগ্রেসের পর থেকে চীন উচ্চ-স্তরের বৈজ্ঞানিক ও প্রযুক্তিগত স্ব-নির্ভরতা ত্বরান্বিত করেছে, নতুন কৃষি উৎপাদনশীলতা লালন ও বিকাশ করেছে, কৃষি বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির উন্নয়নকে ত্বরান্বিত করেছে, ফলে উদ্ভাবন ব্যবস্থা আরও উন্নত হয়েছে এবং উদ্ভাবনের ক্ষমতা ব্যাপকভাবে জোরদারও হয়েছে। ২০২৩ সালে চীনের কৃষি বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি অগ্রগতি অবদানের হার ছিলো ৬৩.২ শতাংশ, যা ২০১২ সালের চেয়ে ৮.৭ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে এবং কৃষি বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির সামগ্রিক স্তর বিশ্বে প্রথম শ্রেণীতে প্রবেশ করেছে।
চীনের ৭৫ বছরের যে রাজনীতি, সেই রাজনীতিকে আমরা কয়েক পর্বে ভাগ করতে পারি। একজন চীনা বিশেষজ্ঞ এলিজাবেথ ইকোনমি (Elizabeth C. Econmy) চীনের ইতিহাস নিয়ে এই বই লিখেছেন ‘The third Revolution’। এ ক্ষেত্রে এই ৭৫ বছরের ইতিহাসকে তিনি তিন পর্ব হিসেবে দেখেছেন। প্রথম পর্বে কমরেড মাও সে তুংয়ের সময়কাল, দ্বিতীয় পর্বে দেং জিয়াও পিং ও অর্থনৈতিক সংস্কারের উদ্যোগ, আর তৃতীয় পর্বে শি জিন পিংয়ের উত্থান ও চীনকে বিশ্বশক্তিতে পরিণত করা।
১৯৪৯ থেকে ১৯৭৬ সাল পর্যন্ত যে সময়সীমা, তাতে আমরা দেখেছি, ‘চার কুচক্রীর’ (মাওয়ের স্ত্রী জিয়াও কুইয়ংয়ের নেতৃত্বে) উত্থান ও মাও সে তুংকে রেখে ক্ষমতা কুক্ষিগত করার চেষ্টা, অতি বাম রাজনীতি,খুব দ্রুত চীনের কৃষি অর্থনীতিকে একটি শিল্প হিসেবে গড়ে তুলতে উদ্যোগ নিয়েছিলেন। ‘যা গ্রেট লিপ ফরোয়ার্ড নামে পরিচিত’ (১৯৫৮), যৌথ খামার ব্যবস্থা ও সাংস্কৃতিক বিপ্লব। ওই সাংস্কৃতিক বিপ্লব চীনে প্রাসঙ্গিক হলেও পরে বিতর্কিত হয়েছিল। ওই সময়সীমায় প্রচুর বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষককে গ্রামে যৌথখামারে কাজ করতে ও উৎপাদন প্রক্রিয়ায় অংশ নিতে বাধ্য হয়েছিলেন। পরে তা নিয়ে সাম্রাজ্যবাদী অপপ্রচার ও পশ্চিমা মিডিয়ায় জানা গিয়েছিল, সাংস্কৃতিক বিপ্লবের কারণে প্রায় ৩০ মিলিয়ন মানুষ মারা গিয়েছিলেন (১৯৫৮-৬১)। এটা ছিল অতি বামবাদের লক্ষণ (পাঠক, কম্বোডিয়ার পলপটের নেতৃত্বাধীন সময় কিংবা আলবেনিয়ার এনভার হোজার সময়কার কথা স্মরণ করতে পারেন)।
কমরেড মাও সে তুং চীনা ইতিহাসের এক অবিস্মরণীয় নাম। কিন্তু সাংস্কৃতিক বিপ্লবের সময় তার ভূমিকার কারণে তিনি সমালোচিত। চীনা নেতারা এখন স্বীকার করেন মাও ভুল করেছিলেন। দ্বিতীয় পর্বটা শুরু হয়েছিল দেং জিয়াও পিংয়ের উত্থানের মধ্য দিয়ে। দেং চীনকে বদলে দিয়েছিলেন। আধুনিক ‘চীনের সংস্কারের জনক’ হিসেবে যদি কাউকে চিহ্নিত করা যায়, তাহলে তিনি হচ্ছেন দেং জিয়াও পিং। দেং অর্থনৈতিক সংস্কারের ওপর গুরুত্ব আরোপ করেছিলেন। তিনি মনে করতেন উন্নয়নটা প্রয়োজন। পাঠক স্মরণ করতে পারেন তার একটি বিখ্যাত উক্তি ‘বিড়াল সাদা কী কালো, এটা বড় কথা নয়। বড় কথা হলো বিড়াল ইঁদুর মারে কি না।’ এর ব্যাখ্যা পরিষ্কার উন্নয়ন চাই, সাধারণ মানুষের জীবনযাত্রার উন্নতি চাই, তা যেকোনো সমাজব্যবস্থাতেই হোক না কেন। দেং তার এই ধরনের বক্তব্যের জন্য সমালোচিত হয়েছিলেন। পার্টি থেকে বহিষ্কার হয়েছিলেন। ওই সময়টা (১৯৭৬-৮৯) ছিল অর্থনৈতিক সংস্কারের যুগ, যার ভিত্তি দেং করে দিয়ে গিয়েছিলেন। তবে মনে রাখতে হবে দেং কোনো দিন পার্টির চেয়ারম্যান ছিলেন না। রাষ্ট্রের কোনো পদ তিনি গ্রহণ করেননি। শুধু পার্টির মিলিটারি কমিশনের চেয়ারম্যানের দায়িত্ব পালন করে গেছেন। তিনি ১৯৮২ সালে অবসরেও গিয়েছিলেন। ১৯৮৯ থেকে ২০১২ সাল পর্যন্ত, অর্থাৎ বর্তমান নেতা শি জিন পিংয়ের দায়িত্ব গ্রহণের আগ পর্যন্ত চীন একটি অন্তরীণ সময়সীমা পার করেছে, যেখানে চীনা বিপ্লবের তৃতীয় জেনারেশনের নেতারা নেতৃত্বের সারিতে আসেন এবং অর্থনৈতিক সংস্কারকে আর উচ্চতায় নিয়ে যান। ওই সময় ১৯৮৯ সালে চীন প্রত্যক্ষ করেছিল ‘তিয়ান আন মেনের’ ঘটনা। ছাত্ররা অতি গণতন্ত্রের দাবিতে ছয় সপ্তাহ পেইচিংয়ের বিখ্যাত ‘তিয়ান আন মেন’ স্কয়ারে অবস্থান নিয়েছিল। ওই সময় পার্টির নেতা ছিলেন জিয়াও জে মিন। অভিযোগ আছে, তিনি ছাত্রদের দাবি-দাওয়া মেনে নিতে রাজি ছিলেন। কিন্তু দেং জিয়াও পিং ছিলেন এর বিরুদ্ধে। ফলে সেখানে সেনাবাহিনী পাঠিয়ে ছাত্রদের হটিয়ে দেওয়া হয়। একপর্যায়ে অপসারিত হন জিয়াও জে মিন। ‘তিয়ান আন মেন’-এর ঘটনা নিঃসন্দেহে চীনের সমসাময়িক রাজনীতির জন্য একটি বড় ঘটনা। একটি সমাজতান্ত্রিক সমাজে বহুদলীয় গণতন্ত্র কতটুকু গ্রহণযোগ্য কিংবা তা আদৌ কাজ করবে কি না (সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট বিল ক্লিনটন বলেছিলেন, তিনি জীবদ্দশায় চীনে গণতন্ত্র দেখে যাবেন), এটা নিয়ে বিতর্ক আছে। সংস্কারের প্রয়োজন আছে। কিন্তু বহুদলীয় গণতন্ত্র সমাজতন্ত্রের পতন ঘটাবে, যেমনটি ঘটেছিল সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নে। সুতরাং দেং জিয়াও পিংয়ের সিদ্ধান্ত ছিল সঠিক। ছাত্রদের চাপের মুখে গণতন্ত্র নয়। চীন একটি বড় দেশ। বিপুল জনগোষ্ঠীর বাস ওই দেশে। ৫৫টি ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র জাতি রয়েছে এ দেশে। এ দেশে পশ্চিমা গণতন্ত্র কাজ করবে না। আজকের যে চীন, দেশটিকে এ পর্যায়ে নিয়ে আসার মূল কৃতিত্ব শি জিন পিংয়ের।
চীনের ৭৫ বছরের রাজনীতিতে যে তিনজন দূরদর্শী নেতার কথা বলা হয়, তার একজন হচ্ছেন শি জিন পিং (বাকি দুজন কমরেড মাও সে তুং ও দেং জিয়াও পিং)। কোনো কোনো ক্ষেত্রে তিনি মাওকেও ছাড়িয়ে গেছেন। ২০১৭ সালে বিখ্যাত নিউজ ম্যাগাজিন ইকোনমিস্ট তাকে বিশ্বের শ্রেষ্ঠ ক্ষমতাশালী ব্যক্তি হিসেবে চিহ্নিত করেছিল (১৪ অক্টোবর)। আর ২০১৮ সালে ফোর্বস (Forbes) তাকে শুধু বিশ্বের শ্রেষ্ঠ ক্ষমতাশালী ব্যক্তি হিসেবেই চিহ্নিত করেনি, বরং প্রভাববিস্তারকারী নেতা হিসেবে আখ্যায়িত করেছিল (৭ সেপ্টেম্বর ২০১৯)। ফোর্বস তাকে রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের চেয়েও ওপরে স্থান দিয়েছিল। ২০১২ সালের পর থেকেই তিনি কমিউনিস্ট পার্টির সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করে আসছেন (প্রেসিডেন্ট ২০১৩ থেকে)। পার্টির দায়িত্ব নিয়ে তিনি অর্থনীতিতে আরও সংস্কার আনেন। একসময় ‘aogai’ প্রদ্ধতি, অর্থাৎ ‘re-education through labour’ এটা তিনি বদলে ফেলেন। এক সন্তানের যে চীনানীতি, তাও তিনি বদলে ফেলেন। পার্টির নেতাদের বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযান পরিচালনা করে তিনি ব্যাপক প্রশংসিত হন। বৈদেশিক নীতিতে বড় পরিবর্তন আনার লক্ষ্যেই তিনি ২০১৩ সালে কাজাখস্তান সফরের সময় তার উচ্চাভিলাষী পরিকল্পনা ‘বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভ’ (বিআরআই) উপস্থাপন করেন। বিআরআই (যাতে ব্যয় ধরা হয়েছে ১ থেকে ৮ ট্রিলিয়ন ডলার) প্রেসিডেন্ট শি জিন পিংয়ের একটি দর্শন। এর মাধ্যমে চীনকে বিশ্বের ৬৫টি দেশকে চীনের সঙ্গে সংযুক্ত করবে। বিআরআই দুভাবে কাজ করবে। প্রথমত, সড়ক ও রেলপথে মধ্য এশিয়া, পাকিস্তান ও দক্ষিণ পূর্ব এশিয়াসহ ইউরোপ পর্যন্ত সংযুক্ত হবে। দ্বিতীয়ত, সমুদ্রপথে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া, আফ্রিকা হয়ে সুদূর ইউরোপ পর্যন্ত তা সংযুক্ত হবে। এর মধ্য দিয়ে চীনাপণ্য অতিদ্রুততার সঙ্গে ও সহজলভ্যে পৃথিবীর সর্বত্র ছড়িয়ে যাবে। চীন বিআরআইয়ের আওতায় দেশগুলোকে অবকাঠামো খাতে ঋণ দেবে। তবে এই চীনা ঋণ নিয়ে ইতিমধ্যে বিতর্ক সৃষ্টি হয়েছে। বলা হচ্ছে, ঋণ দিয়ে চীন ‘ঋণের ফাঁদে’ ফেলছে দেশগুলোকে। তবে বিআরআই নিয়ে যত বিতর্কই থাকুক না কেন, বিআরআই যে চীনকে বিশ্বের অন্যতম শক্তিধর দেশ হিসেবে পরিচিত করবে, তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না। এটা সফল হলে পৃথিবীর জনসংখ্যার তিন ভাগের দুভাগ মানুষ চীনের প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ নিয়ন্ত্রণে থাকবে। বাংলাদেশও বিআরআইয়ের আওতায় চীন থেকে ঋণ নিচ্ছে। একজন গবেষক এলিজাবেথ ইকোনমি লিখেছেন, ‘Under xi, china now activel seeks to shape international norms and institutions and Forcefully asserts it presence on the global stage’। মিথ্যা বলেননি এলিজাবেথ ইকোনমি। চীনের আর্থিক ভিত্তি চীনকে যথেষ্ট শক্তিশালী করেছে এবং চীনকে বিশ্বশক্তিতে পরিণত করেছে। বিআরআই পরিকল্পনা প্রণয়ন ও বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে আরও একটি উদ্দেশ্য কাজ করছে তা হচ্ছে ভারত মহাসাগরভুক্ত অঞ্চলে ক্রমবর্ধমান মার্কিনি আগ্রাসনের মুখে এক ধরনের চ্যালেঞ্জ। যুক্তরাষ্ট্র তার ‘Pivot to Asia’ পরিকল্পনায় ইন্দোপ্যাসিফিক অঞ্চলে তার সামরিক প্রভাব বাড়াচ্ছে। এর বিপরীতে মার্কিনি প্রভাব কমাতে চীন তার বিআরআই পরিকল্পনা এগিয়ে আছে। বলা হচ্ছে, ভারত মহাসাগরভুক্ত অঞ্চলে প্রভাব-প্রতিপত্তি নিয়ে আগামী দিনে চীন ও যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে দ্বন্দ্ব এই অঞ্চলের স্নায়ুযুদ্ধ-২-এর জন্ম দিতে পারে।
চীন এখন পরিপূর্ণভাবে বদলে গেছে। চীন-ভিয়েতনাম যুদ্ধের সময় (১৯৭৮) সংবাদপত্রে খবর বেরিয়েছিল, চীনা সৈন্যরা কোথাও কোথাও খালি পায়ে (বুট ছাড়া) যুদ্ধে অংশ নিয়েছে। সেই চীন এখন বদলে গেছে। যে চীনের নাগরিকরা তাদের ঘরে একটি সেলাই মেশিন থাকলে, তা নিয়ে গর্ব করত, সেই চীন এখন বিশ্বের ধনী দেশগুলোর একটি। ২০১৯ সালের অভিক্ষণ অনুযায়ী বিশ্বের জিডিপিতে শীর্ষে থাকবে যুক্তরাষ্ট্র (২১৪৮২.৪১ বিলিয়ন ডলার)। এর পরের অবস্থান চীনের, ১৪১৭২.২০ বিলিয়ন ডলার (STATICS TIMES, IMF, April-2018), কিন্তু ক্রয়ক্ষমতার ভিত্তিতে শীর্ষে থাকবে চীন (২৭৪৪৯.০৫ বিলিয়ন ডলার), যুক্তরাষ্ট্র নিচে নেমে দ্বিতীয় অবস্থানে থাকবে (২১৪৮২.৪১ বিলিয়ন ডলার)। পরিসংখ্যানই বলে দেয় বিশ্ব রাজনীতির নিয়ন্ত্রণ এখন চীনের হাতে। আন্তর্জাতিক সম্পর্কের ছাত্ররা জানেন ঊনবিংশ শতাব্দী ছিল ব্রিটেনের হাতে (Pax Britanica), বিংশ শতাব্দী ছিল যুক্তরাষ্ট্রের হাতে (American Century))। আর একুশ শতক হবে চীনের, চীনা ভাষায় বলা হয় চরহুরহ, যার আভিধানিক অর্থ The Chinese century ওই Chinese Century বিশ্বকে নিয়ন্ত্রণ করবে একুশ শতকে।
সুপ্রিয় পাঠক, চীনা বিপ্লবের ৭৫তম বার্ষিকী উপলক্ষ করে এই নিবন্ধটি লেখা হলেও মহান ও কীর্তিমান বিপ্লবীদের নিয়ে সব সময়ই লেখা যায়। পরিশেষে, সমাজতন্ত্র অভিমুখী অসাম্প্রদায়িক জনগণতান্ত্রিক ও বৈষম্যহীন ব্যবস্থা গড়ে তোলার প্রত্যয়ে সমতা-ন্যায্যতার প্রশ্নে বাংলাদেশকে এগিয়ে নেওয়ার প্রয়োজনেই জনগণের নতুন ধারার এক আর্থসামাজিক বৈপ্লবিক ব্যবস্থা প্রবর্তনে বিশ্বজনীন মহান ও কীর্তিমান বিপ্লবীদের রাজনীতি, আত্মোৎসর্গ, জীবন সংগ্রাম, কীর্তি, ইতিহাস, তত্ত্ব ও অনুশীলন সম্পর্কে পাঠ প্রাসঙ্গিক ও জরুরী। কিংবদন্তী মহানায়ক কমরেড মাও সে তুং, চীনা কমিউনিস্ট পার্টির সকল বিপ্লবীসহ ইতিহাসের নির্মাতা ও চালিকাশক্তি জনগণের প্রতি আমাদের বিনম্র শ্রদ্ধা ও অভিবাদন!
লেখক: মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক গবেষক, সাংবাদিক ও কলামিস্ট