Friday 22 Nov 2024
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

প্রবৃদ্ধি বনাম মূল্যস্ফীতি: প্রাসঙ্গিক ভাবনা

ড. মিহির কুমার রায়
২৭ সেপ্টেম্বর ২০২৪ ১৭:৪৮

চলতি অর্থবছরের জন্য বাংলাদেশের প্রবৃদ্ধির পূর্বাভাস কমিয়ে দিয়েছে এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক (এডিবি)। প্রবৃদ্ধি কমলেও মূল্যস্ফীতি বাড়তে পারে বলে তাদের পূর্বাভাস। ২০২৪-২৫ অর্থবছরের জন্য বাংলাদেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির পূর্বাভাস ৫ দশমিক ১ শতাংশে নামিয়ে এনেছে এডিবি। গত ২৫শে অক্টোবর বুধবার সংস্থাটি তাদের এশিয়ান ডেভেলপমেন্ট আউটলুক সেপ্টেম্বর সংস্করণ প্রকাশ করেছে। এর আগে গত এপ্রিলের পূর্বাভাসে তারা বলেছিল, প্রবৃদ্ধি ৬ দশমিক ৬ শতাংশ হবে। অর্থাৎ এক ধাপে প্রবৃদ্ধির পূর্বাভাস ১ দশমিক ৫ শতাংশীয় পয়েন্ট কমিয়েছে এডিবি। গত এপ্রিলে এডিবি বলেছিল, চলতি অর্থবছরে মূল্যস্ফীতি ৭ শতাংশে নেমে আসবে। কিন্তু এখন এডিবি বলছে, তা হবে না। বরং মূল্যস্ফীতি ১০ শতাংশে উন্নীত হবে। গত জুলাই ও আগস্ট মাসে দেশের রাজনৈতিক অস্থিরতার কারণে অর্থনৈতিক কার্যক্রম বিঘ্নিত হয়েছে। তার সঙ্গে সাম্প্রতিক বন্যার প্রভাবে বাংলাদেশের অর্থনীতি ক্ষতিগ্রস্ত হবে বলে মনে করছে এডিবি। এই দুই প্রভাবে বাংলাদেশের প্রবৃদ্ধির গতি কমতে পারে। রাজস্ব ও আর্থিক নীতিতে কঠোরতা আছে, তা অব্যাহত থাকবে বলে এডিবির ধারণা। এ ছাড়া ক্রয় ও বিনিয়োগ আরও কমবে। নেতিবাচক ঝুঁকি থাকায় সামষ্টিক অর্থনীতির পূর্বাভাস অনিশ্চিত। চলমান রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা, ভঙ্গুর আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি ও আর্থিক খাতের দুর্বলতা হলো এসব ঝুঁকির উৎস। এডিবির পর্যবেক্ষণে বলা হয়েছে, উচ্চমূল্যস্ফীতি, বৈশ্বিক অর্থনীতির ধীরগতি ও অন্যান্য সামষ্টিক অর্থনৈতিক চ্যালেঞ্জের কারণে চাহিদা কমবে। পণ্য ও জ্বালানির দাম বেড়ে যাওয়া এবং টাকার অবমূল্যায়ন হওয়ায় মূল্যস্ফীতির হার বাড়তি। তবে আমদানি-রপ্তানি কমে যাওয়ায় চলতি হিসাবের ঘাটতি কমেছে বলেও জানিয়েছে এডিবি। সংস্থাটির পূর্বাভাস, মূল্যস্ফীতির হার আবার দুই অঙ্কের ঘরে উঠতে পারে। ধারাবাহিক উচ্চমূল্যস্ফীতি, বৈদেশিক হিসাবের ওপর চাপ, আমদানি নিয়ন্ত্রণ ও বেসরকারি বিনিয়োগের ধীরগতির কারণে গত দুই অর্থবছরে বাংলাদেশের প্রবৃদ্ধি হয়েছে ৬ শতাংশের নিচে। ২০২২-২৩ অর্থবছরে প্রবৃদ্ধি হয়েছে ৫ দশমিক ৭৮ শতাংশ; ২০২৩-২৪ অর্থবছরে ছিল ৫ দশমিক ৮২ শতাংশ। প্রসঙ্গত, সদ্য ক্ষমতাচ্যুত শেখ হাসিনা সরকারের পূর্বাভাস ছিল, ২০২৪-২৫ অর্থবছরে জিডিপি প্রবৃদ্ধি হবে ৬ দশমিক ৭৫ শতাংশ। চলমান চ্যালেঞ্জের পরিপ্রেক্ষিতে অর্থনীতিবিদেরা একে ‘উচ্চাভিলাষী’ আখ্যা দিয়েছিলেন।

বিজ্ঞাপন

বাংলাদেশের মোট দেশজ উৎপাদনে (জিডিপি) প্রবৃদ্ধির হার কমে যাওয়ার কারণ হিসাবে মানুষের আয় ও ক্রয়ক্ষমতা হ্রাস এবং ডলার সংকটকে দায়ী করেছেন অর্থনীতিবিদরা।তাদের মতে, বৈশ্বিক ও দেশীয় অর্থনৈতিক মন্দায় সৃষ্টি হয়েছে এমন পরিস্থিতি। ডলার সংকটের কারণে আমদানি বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। গ্যাস ও বিদ্যুতের সংকট প্রকট আকার ধারণ করেছে। এতে শিল্প উৎপাদন সচল রাখা যাচ্ছে না। যেটুকু সচল আছে সেগুলো খরচ পড়ছে বেশি। ডলারের দাম বাড়ায় টাকার মান কমেছে।একই সঙ্গে পণ্যের দাম বাড়ায় মানুষের ক্রয়ক্ষমতা কমেছে। এতে টাকার হাতবদল কমে যাচ্ছে। যে কারণে প্রবৃদ্ধির হারও কমেছে ।এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক (এডিবি) বাংলাদেশের মোট দেশজ উৎপাদনে (জিডিপি) প্রবৃদ্ধির পূর্বাভাস আরও এক দফা কমিয়েছে। এডিবির হিসাবে গত অর্থবছরে বাংলাদেশে জিডিপি প্রবৃদ্ধি ৫ দশমিক ৩ শতাংশ হতে পারে বলেছিল।এর আগে গত বছরের সেপ্টেম্বরে প্রতিষ্ঠানটি ৬ দশমিক ৬ শতাংশ প্রবৃদ্ধির পূর্বাভাস দিয়েছিল। ৬ মাসের মধ্যে তারা জিডিপি প্রবৃদ্ধির পূর্বাভাস কমিয়েছে ১ দশমিক ৩ শতাংশ। বিশ্বব্যাংক প্রবৃদ্ধির পূর্বাভাস কমিয়ে বলেছে, গত অর্থবছরে ৫ দশমিক ২ শতাংশ প্রবৃদ্ধি হতে পারে। এর আগে গত বছরের অক্টোবরে তারা বলেছিল প্রবৃদ্ধি ৬ দশমিক ১ শতাংশ হতে পারে।এদিকে আন্তর্জাতিক অর্থ তহবিল (আইএমএফ) বাংলাদেশের প্রবৃদ্ধির পূর্বাভাস কমিয়ে গত অক্টোবরে বলেছে, ৫ দশমিক ৫ শতাংশ হতে পারে। তবে এপ্রিলে তারা প্রবৃদ্ধির পূর্বাভাস কমাতে পারে।এদিকে সরকার থেকে চলতি অর্থবছরের শুরুতে জিডিপি প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছিল সাড়ে ৭ শতাংশ। ইতোমধ্যে সরকার এ হার ১ শতাংশ কমিয়ে সাড়ে ৬ শতাংশ করেছে।সব সংস্থা থেকেই মূল্যস্ফীতির হার বাড়তে পারে বলে পূর্বাভাস দেওয়া হয়েছে। সরকার থেকেও এ হার বাড়ানো হয়েছে। গত বছরের জুনে সরকার মূল্যস্ফীতির হার ধরেছিল ৫ দশমিক ৬ শতাংশ। এখন তা বাড়িয়ে সাড়ে ৭ শতাংশ করেছে। মার্চে মূল্যস্ফীতি হয়েছে ৯ দশমিক ৩৩ শতাংশ। এতে এডিবি ও বিশ্বব্যাংক মনে করে চলতি অর্থবছরে গড় মূল্যস্ফীতি ৮ দশমিক ৭ শতাংশের মধ্যে থাকতে পারে।জিডিপি প্রবৃদ্ধি কমে যাওয়ার বিষয়ে এডিবি ও বিশ্বব্যাংকের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে সৃষ্ট বৈশ্বিক মন্দার নেতিবাচক প্রভাব বাংলাদেশের অর্থনীতিতে অনেকটা জোরালোভাবে আঘাত হেনেছে। এর প্রভাবে মানুষের ক্রয়ক্ষমতা কমে গেছে। সঙ্গতকারণে কমেছে চাহিদাও।এতে পণ্য বিক্রি কমেছে। একই কারণে বৈশ্বিক মন্দায় বিদেশের বাজারে পণ্যের চাহিদা কমে গেছে। ফলে রপ্তানির অর্ডার যেমন কমেছে, তেমনি আয়ও কমছে। প্রবাসীদের রেমিট্যান্স পাঠানো ও রপ্তানি আয় কমে যাওয়ায় এক দিকে রিজার্ভ কমছে। অন্যদিকে ডলারের দাম বেড়েছে। ফলে টাকার মান কমে গেছে। এতে মূল্যস্ফীতির হার বাড়ছে। এ কারণে প্রবৃদ্ধির হার কমে যাচ্ছে।জ্বালানি তেল, গ্যাস-বিদ্যুতের সংকট ও দাম বৃদ্ধি শিল্প খাতে নেতিবাচক প্রভাব ফেলেছে। উৎপাদন কমার পাশাপাশি খরচ বেড়েছে। এতে বেড়েছে পণ্যের দাম। একদিকে পণ্যমূল্য বৃদ্ধি, অপরদিকে ক্রয় ক্ষমতা কমে যাওয়া-এ দুইয়ে মিলে মানুষ চাপে পড়ে পণ্য কেনা কমিয়ে দিয়েছে। ফলে জিডিপিকে নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে। রপ্তানি, রেমিট্যান্স ও বেসরকারি খাতকে এগিয়ে নিতে হবে-, বিশ্বব্যাংক ও এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক জিডিপির প্রবৃদ্ধির যে হিসাব দিয়েছে তা ঠিকই আছে। তাদের হিসাব বাস্তবতার কাছাকাছি রয়েছে। প্রবৃদ্ধি কোনো ক্রমেই ৫ দশমিক ২ শতাংশ বা ৫ দশমিক ৩ শতাংশের বেশি হবে না। সরকার প্রবৃদ্ধি সাড়ে ৬ শতাংশ অর্জিত হবে বলে যে হিসাব দিয়েছে এটি অর্জন করা কঠিন।

বিজ্ঞাপন

দেশের বর্তমান প্রেক্ষাপটে এটি হবে না। বৈশ্বিক মন্দা ও দেশের সার্বিক অর্থনৈতিক পরিস্থিতিতে প্রবৃদ্ধি যে কমবে এটি সবাই স্বীকার করে নিয়েছেন। তবে কত কমবে সেটি নিয়ে বিতর্ক আছে। অনেকেই মনে কর বৃদ্ধির হার ৫ শতাংশের সামান্য বেশি হতে পারে। এর চেয়ে বেশি হবে না। প্রবৃদ্ধির হার বাড়ানোর প্রসঙ্গে বেলা হয়, প্রবৃদ্ধির হার বাড়ানোর অন্যতম প্রধান উপকরণ রপ্তানি আয়, প্রবাসীদের পাঠানো রেমিট্যান্স নিম্নমুখী।বেসরকারি খাতে ঋণ প্রবাহ খুব বেশি বাড়ছে না। ডলারের হিসাবে এটি কমছে। গ্যাস, বিদ্যুৎ সংকটের কারণে শিল্প উৎপাদন কমে গেছে। এখন শুধু কৃষি খাত উৎপাদনের ধারাবাহিকতা ধরে রেখেছে। কিন্তু কৃষির ওপর ভর করে প্রবৃদ্ধি বাড়বে না। জিডিপির প্রবৃদ্ধি বাড়াতে হলে রপ্তানি, রেমিট্যান্স ও বেসরকারি খাতকে সমানভাবে সামনে এগিয়ে নিতে হবে। এই তিনটি খাতই এখন এগোচ্ছে না।ছোট উদ্যোক্তাদের অবস্থা আরও খারাপ। বিদ্যমান প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশের জন্য প্রবৃদ্ধির যে পূর্বাভাস দেওয়া হয়েছে, সেটি অর্জিত হলেই সন্তোষজনক বলা যায়। ভারতে হয়তো কিছু বেশি প্রবৃদ্ধি হবে।, এই মুহূর্তে সরকারকে প্রবৃদ্ধি বাড়ানোর দিকে নজর না দিয়ে মূল্যস্ফীতির হার নিয়ন্ত্রণের ওপর বেশি গুরুত্ব দেওয়া উচিত। কারণ প্রবৃদ্ধি কিছুটা কম হলেও তেমন কোনো সমস্যা নেই। প্রবৃদ্ধির সুফল সবাই পায় না। শুধু উচ্চ আয়ের মানুষ প্রবৃদ্ধির সুফল বেশি পায়। স্বল্প আয়ের মানুষের কাছে এর সুফল যাচ্ছে না। ফলে তারা উচ্চ প্রবৃদ্ধি অর্জনের সুফল থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। এখন চড়া মূল্যস্ফীতির কারণে বিশেষ করে স্বল্প আয়ের মানুষ বেশি কষ্ট ভোগ করছে। তাদের মূল্যস্ফীতির চাপ থেকে সহনীয় রাখতে এ হার কমাতে হবে। এটি কমানোর জন্য দরিদ্র মানুষের মধ্যে কম মূল্যে খাদ্যের জোগান নিশ্চিত করতে হবে। তাদের আয় বাড়ানোর পাশাপাশি পণ্যমূল্য নিয়ন্ত্রণ করাটা জরুরি। শিল্পে গ্যাস ও বিদ্যুতের জোগান নিশ্চিত করতে হবে ।চলতি অর্থবছরে জিডিপির প্রবৃদ্ধির হার ঘুরেফিরে ৫ শতাংশের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকবে।

রপ্তানি আয় কমায় রিজার্ভে চাপ বেড়েছে, একই সঙ্গে রপ্তানিকারকদের কাছে তারল্যের প্রবাহ কমে যাবে। ফলে তারা উৎপাদন স্বাভাবিক রাখতে পারবে না। এ খাতের শ্রমিক কর্মীদের মধ্যেও টাকার প্রবাহ কমবে। সব মিলে টাকার প্রবাহে নিম্নমুখিতা রয়েছে। বেসরকারি খাতের কর্মকাণ্ডও বলতে গেলে স্থবির। ডলার সংকটে এলসি খোলা যাচ্ছে না। আমদানি কমে যাচ্ছে। আন্তর্জাতিক বাজারে কাঁচামালের দাম বেশি হওয়ায় কম পণ্য আসছে। এতে অনেক প্রতিষ্ঠানে উৎপাদন কমে গেছে। কাঁচামালের অভাবে অনেক শিল্পপ্রতিষ্ঠান বন্ধও হয়ে যাচ্ছে।প্রবৃদ্ধির হার কমার পেছনের নেপথ্য কারণগুলো হচ্ছে, বৈশ্বিক ও দেশীয় অর্থনৈতিক মন্দায় মানুষের ক্রয়ক্ষমতা কমে গেছে। এতে পণ্যের চাহিদা কমে গেছে। ফলে উৎপাদনের পাশাপাশি সরবরাহও কমেছে। ফলে টাকার হাতবদলও কমে গেছে। টাকার হাতবদল যত কমবে প্রবৃদ্ধিও তত কমবে। কারণ অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড স্থবির থাকলে টাকার হাতবদল কমে যায়। মানুষের মধ্যে এক ধরনের আস্থাহীনতা তৈরি হয়। এতে টাকা সবাই ধরে রাখতে চায়। কেউ বিনিয়োগ করতে চায় না বা চাহিদা অনুযায়ী পণ্য কিনতে চায় না। একই সঙ্গে ডলার সংকটের কারণে আমদানি কমে গেছে। এতে শিল্পের উৎপাদন বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। একই সঙ্গে বাণিজ্যিক পণ্যের বাজারেও স্থবিরতা দেখা দিয়েছে। কাঁচামাল আমদানির অভাবে বিদ্যুৎ-গ্যাস সংকট তো আছেই। চাহিদা অনুযায়ী গ্যাস পাওয়া যাচ্ছে না। ফলে শিল্প খাতেও টাকা ঘুরছে না। ব্যাংক থেকে টাকা বের হয়ে শিল্প খাত ঘুরে মানুষের হাতে পৌঁছে। এখন শিল্প খাতে স্থবিরতার কারণে টাকার হাতবদল কম হচ্ছে। এতে প্রবৃদ্ধির চাকাও ধীরগতিতে ঘুরছে। যে কারণে প্রবৃদ্ধি কম হবে। মানুষের ক্রয়ক্ষমতা কমায় পণ্য কেনার পরিমাণ কমিয়ে দিয়েছে। খেয়াল করলে দেখবেন, ইফতারির বাজারেও বিক্রি কম। মানুষ পোশাক কেনা কমিয়ে দিয়েছে। সংকটের কারণে মানুষের চাহিদায় পবির্তন এসেছে। চাহিদা কাটছাঁট করা হয়েছে। একেবারে অপরিহার্য ছাড়া অন্য কোনো কেনাকাটা করছে না। আর কেনাকাটা করার সক্ষমতাও অনেকে হারিয়ে ফেলেছে। এতে প্রবৃদ্ধি কমবে।

২০২৪-২৫ সালে বাংলাদেশের উচ্চ গড় অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি অর্জন করতে হলে মানসম্পন্ন অবকাঠামোতে সরকারকে আরও বেশি বিনিয়োগ করতে হবে। অর্থনৈতিক উন্নয়নকে গতিশীল করতে অবকাঠামো বিনিয়োগ করে দেশের রাস্তা, সেতু, বাঁধ এবং অন্যান্য অবকাঠামো মেরামত বা নির্মাণ করতে হবে, যেমন-নৌবন্দর ও বিমানবন্দর। বিনিয়োগের জন্য বিদ্যমান এবং সম্ভাব্য আর্থিক সম্ভাবনা গুলোকে আরও ভালোভাবে কাজে লাগাতে হবে। ডিজিটাল এবং পরিবেশ পরিকাঠামোতে অগ্রাধিকার দিতে হবে এবং সব ধরনের পাবলিক বিনিয়োগ ভালো ব্যবস্থাাপনার মাধ্যমে আরও স্মার্টভাবে করতে হবে। শহর এবং গ্রামের রক্ষণাবেক্ষণ, কম কার্বন বিল্ডিং, শক্তি দক্ষতা, বর্জ্য এবং দূষণ ব্যবস্থাপনা ব্যবহার এবং পরিবেশবান্ধব গণপরিবহণে নতুন বিনিয়োগ প্রয়োজন। ভালো সমন্বয়, সংকট ব্যবস্থাাপনা ব্যর্থতার ঝুঁকি কমিয়ে দেয়। সরকারের সব ¯ মন্ত্রণালয়গুলোর সমন্বিত প্রচেষ্টা সংকট-ব্যবস্থপনা ব্যর্থতা হ্রাস করতে পারে। সরকারের মন্ত্রণালয়গুলোর একতরফা সিদ্ধান্ত নেওয়ার ফলে উন্নয়ন প্রক্রিয়া ব্যহত হবে। মন্ত্রণালয়গুলোর মধ্যে সমন্বয় ও সহযোগিতা সরকারের অর্থনীতি এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার উদ্দেশ্যগুলো এবং পরিকল্পনার ব্যবস্থাগুলো শনাক্ত করতে হবে ।অর্থনীতির উন্নয়নের গতিধারাকে এগিয়ে নিতে সব ব্যবসার মালিক, পরিষেবা প্রদানকারী, শিক্ষক ও অভিভাবক এবং সুশীলসমাজসহ অন্যান্য স্টেকহোল্ডারের সঙ্গে সরকারের পর্যাপ্ত ও সময়োপযোগী পরামর্শ নিশ্চিত করাও গুরত্বপূর্ণ। অর্থনীতি অঞ্চলগুলো দেশের সর্বত্র বিকেন্দ্রীকরণ করতে হবে। দেশকে একটি অর্থনৈতিক অঞ্চলে পরিণত করতে হবে। শহর, ছোট শহর, গ্রাম-এ বিভাজন কমিয়ে আনতে হবে। কৌশলগত শিল্প পুনঃস্থাপনের সঙ্গে যুক্ত সুযোগগুলো বিবেচনা করা যেতে পারে। অর্থনৈতিক গতিধারাকে এগিয়ে নিতে হলে ন্যায়বিচার ও শক্তিশালী রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক প্রতিষ্ঠান গঠন করতে হবে। দেশের অর্থনৈতিক প্রবৃ.দ্ধির সুফল কাজে লাগাতে হলে দুর্নীতি নিয়ন্ত্রণ, আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা, স্ব”ছতা, জবাবদিহিতা এবং অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক স্বাধীনতাকে অধিক গুরুত্ব দিতে হবে।

বাংলাদেশে মূল্যস্ফীতি অনেকটা লাগাম ছাড়া, বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ কমতির দিকে, ডলার–সংকট এবং ডলারের বিপরীতে টাকার ধারাবাহিক দরপতন ঘটছে। এসব পরিস্থিতি অর্থনীতিকে জটিল করে তুলেছে। বিশ্লেষকেরা বলছেন, মূল্যস্ফীতি কমানো, মুদ্রার বিনিময় হারে স্থিতিশীলতা আনা এবং খেলাপি ঋণ কমানো—এই তিন বিষয় ব্যাংকিং খাত ও দেশের অর্থনীতির জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ। অথচ এসব ক্ষেত্রেই আমাদের কেন্দ্রীয় ব্যাংক অদক্ষতা কিংবা ব্যর্থতার পরিচয় দিয়েছে। এ পরিস্থিতির জন্য ‘রাজনৈতিক চাপ ও সরকারের নিয়ন্ত্রণ’ বড় ভূমিকা পালন করেছে বলেও তাঁদের অনেকেই মনে করেন। অনেক দিন ধরেই আমাদের বাজারে ডলারের তীব্র সংকট তৈরি হয়ে আছে এবং কোনোভাবেই বৈদেশিক মুদ্রার ক্ষেত্রে বাজারে স্থিতিশীলতা আনা যাচ্ছে না। আবার ডলারের ক্ষেত্রে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের এখনকার যে নীতি তা রপ্তানি আয়ের ক্ষেত্রে সমস্যা তৈরি করছে বলেও মনে করেন অনেকে। অর্থনীতিবিদদের অনেকেই বলেছেন, বিনিময় হার নিয়ে বাংলাদেশ ব্যাংক একটানা ১০-১২ বছর প্রায় বসেই ছিল এবং এটাকে বাজারভিত্তিক করার ক্ষেত্রে কোনো পরিবর্তন না আনায় একটা সংকট তৈরি হয়েছে। আবার ইচ্ছেমতো টাকা ছাপিয়ে সরকারকে ধার দেওয়ার কারণেও বড় ধরনের চাপ তৈরি হয়েছে। ব্যাংকিং খাতে রেকর্ড পরিমাণ মন্দ ঋণের পরিমাণ বেড়েছে। রাজনৈতিক বিবেচনায় ঋণ ও ব্যাংকের অনুমোদন কেন্দ্রীয় ব্যাংক ম্যানেজ করতে আগে পারেনি ও এখনো পারছে না। বিশ্লেষকেরা বলছেন, মূল্যস্ফীতি কমিয়ে আনা ও বৈদেশিক মুদ্রার সংকট মোকাবিলায় কেন্দ্রীয় ব্যাংক যেমন সফলতা পায়নি, তেমনি নিজেদের ঘোষিত মুদ্রানীতি বাস্তবায়নেও তারা সাফল্য পায়নি। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের চিন্তা করা উচিত, যেন তাদের নীতিটা বাজার ব্যবস্থার সঙ্গে সংগতিপূর্ণ হয়। মূল্যস্ফীতির ক্ষেত্রে ও যে মুদ্রানীতি কেন্দ্রীয় ব্যাংক ঘোষণা করেছে, সেগুলো বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে যেসব সমস্যা আছে, তা দূর করার ক্ষেত্রে প্রচুর অদক্ষতা এমনকি সীমাবদ্ধতাও আছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সেদিকে নজর দেওয়া উচিত। বৈদেশিক মুদ্রার সংকট ও রিজার্ভ ক্রমাগত সংকুচিত হচ্ছে, এসব বিষয়ে যে নীতিগুলো এখন তারা অনুসরণ করছেন সেগুলোতেও দৃষ্টি দেওয়া প্রয়োজন।

লেখক: গবেষক ও অর্থনীতিবিদ

সারাবাংলা/এজেডএস

ড. মিহির কুমার রায় প্রবৃদ্ধি বনাম মূল্যস্ফীতি: প্রাসঙ্গিক ভাবনা

বিজ্ঞাপন

আরো

সম্পর্কিত খবর