Thursday 21 Nov 2024
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

আবহাওয়ার ও জলবায়ুর পরিবর্তন নির্ণয়ে তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তির গুরুত্ব

মো. জাহিদুল ইসলাম
২৯ সেপ্টেম্বর ২০২৪ ১৯:২৭

বিশ্বজুড়ে জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব পড়েছে । বৃদ্ধি পেয়েছে বৃষ্টিপাত, ভূমিকম্প, সুনামি সহ বন্যার মতো নানা নানান ধরনের প্রাকৃতিক দুর্যোগগুলো। তাই বর্তমান আধুনিক তথ্য প্রযুক্তির এই যুগে আগাম সতর্কতা হিসেবে প্রয়োজন হয়ে পড়েছে আবহাওয়ার নির্ভুল পূর্বাভাসের। ব্যারোমিটার (বায়ুমণ্ডলীয় চাপ পরিমাপ করতে), হাইগ্রোমিটার (আর্দ্রতা পরিমাপ করতে), থার্মোমিটার (তাপমাত্রা পরিমাপ করতে) ইত্যাদি আধুনিক প্রযুক্তির যন্ত্র ব্যবহার করে ভৌগোলিক অবস্থান, পূর্ব আবহাওয়ার ইতিহাস, তাপমাত্রা, বায়ুচাপ, বায়ুর আর্দ্রতা, জলবায়ু, প্রাকৃতিক পরিবেশ, বনাঞ্চলের পরিমাণ ইত্যাদি পর্যবেক্ষণ ও প্রাপ্ত উপাত্ত বিশ্লেষণ করে বিদ্যমান আবহাওয়া ও অদূর ভবিষ্যতের আবহাওয়ার পূর্বাভাস দেওয়া হয়ে থাকে। বর্তমানে আধুনিক বৈজ্ঞানিক প্রযুক্তি ব্যবহারের মাধ্যমে আবহাওয়া ও জলবায়ু সংক্রান্ত সেবা দ্রুততার সঙ্গে জনগণের দোরগোড়ায় পৌঁছে দেওয়া সম্ভব হচ্ছে। প্রাকৃতিক দুর্যোগে মানুষের জানমালের ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়। তাই দুর্যোগ ক্ষয়ক্ষতি ঘটানোর আগের প্রতিটি মুহূর্তই খুবই মূল্যবান। যদি প্রাকৃতিক দুর্যোগ আসার আগেই সঠিক সতর্কবার্তা পাওয়া যেত তাহলে ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ অনেক হ্রাস পেতো।

বিজ্ঞাপন

ঘূর্ণিঝড়, খরা, সুনামি, ভূমিকম্প সহ বন্যার মতো বিভিন্ন প্রাকৃতিক দুর্যোগের আগাম তথ্য জানিয়ে জনগণের সম্পদের রক্ষা সহ প্রাণহানি কমানোর পাশাপাশি কৃষি উৎপাদনে ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ কমিয়ে আনা সম্ভব। প্রকৃতপক্ষে সামগ্রিকভাবে দেশে আবহাওয়া ও জলবায়ুর পূর্বাভাস সেবার মান বাড়িয়ে প্রাকৃতিক দুর্যোগের হাত থেকে দেশ ও দেশের মানুষকে রক্ষা করার জন্য প্রয়োজনে ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। গবেষকেরা প্রাকৃতিক দুর্যোগের ক্ষেত্রে আগাম সংকেত পাওয়ার পদ্ধতি নিয়ে বিভিন্ন ধরনের গবেষণা চালাচ্ছেন । তারা প্রাকৃতিক দুর্যোগের সংকেত পেতে জিপিএস প্রযুক্তির পাশাপাশি প্রাকৃতিক দুর্যোগের ঝুঁকি নির্ণয়ে উপযোগী প্রযুক্তির সেন্সরও ব্যবহার করেছেন তাদের গবেষণা এবং পরীক্ষা নিরীক্ষার ক্ষেত্রে। এছাড়াও প্রযুক্তিবিদরা ফ্ল্যাশ ফ্লাড বা আকস্মিক বন্যার মতো ভয়াবহ প্রাকৃতিক দুর্যোগের জরুরি সংকেত পেতেও এই ধরনের বিভিন্ন অত্যাধুনিক প্রযুক্তির ব্যবহার করেছেন। এক্ষেত্রে গবেষকরা রিয়েল টাইম বা ঘটনা ঘটার সঙ্গে সঙ্গে যেন তথ্য পাওয়া যায় এ ধরনের প্রযুক্তি নিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা চালাচ্ছেন। যেহেতু প্রাকৃতিক দুর্যোগের আগেই প্রতিটি মুহূর্ত সময় সবচেয়ে বেশি মূল্যবান। তাই ঘটনা ঘটার সঙ্গে সঙ্গে তথ্য পাওয়া গেলে জরুরি সেবাদাতা সংস্থাগুলোর জন্য প্রস্তুত থাকা সহজ হবে। এর ফলে এ ধরনের সতর্কবার্তা স্মার্টফোনে পাঠানো সহজ হবে। জননিরাপত্তায় এ ধরনের প্রযুক্তি ব্যাপকভাবে কাজে লাগবে।

বিজ্ঞাপন

পৃথিবীতে আঘাত হানা প্রাকৃতিক দুর্যোগ গুলোর মধ্যে প্রচণ্ডতার দিক থেকে ঘূর্ণিঝড় অন্যতম। ঘূর্ণিঝড়ের তীব্রতা ও গতিপথ পূর্বাভাসের জন্য বিভিন্ন পদ্ধতি রয়েছে। উদাহরণস্বরূপ অধিক রেঞ্জবিশিষ্ট অত্যাধুনিক কম্পিউটারযুক্ত রাডারের সাহায্যে ঘূর্ণিঝড়ের মেঘরাশি কেমন করে আবর্তিত হচ্ছে, মেঘরাশির উচ্চতা ও এর গতি কোনদিকে তা সুস্পষ্টভাবে দেখা যায়। রাডারের চিত্র থেকে ঘূর্ণিঝড়ের সর্বোচ্চ বাতাসের গতি ও ঘূর্ণিঝড়ের গতি নির্ণয় করা সম্ভব। অর্থাৎ এই রাডারের সাহায্যে ঘূর্ণিঝড়ের ত্রিমাত্রিক ধারণা পাওয়া সম্ভব। এছাড়া ঘূর্ণিঝড়ের চিত্র স্যাটেলাইটের মাধ্যমেও পাওয়া যায়। মূলত প্রযুক্তির সাহায্যে রাডার থেকে মেঘ লক্ষ্য করে পাঠানো বিদ্যুৎ-চুম্বকীয় তরঙ্গ মেঘের কণায় আঘাত করে প্রতিফলিত তরঙ্গ হিসাবে আবারও রাডারের অ্যানটেনায় অবস্থিত প্রাপক যন্ত্রে ফিরে আসে। এর মাধ্যমে ওই মেঘের গতি-প্রকৃতি বোঝা যায়। সাধারণত রাডার থেকে একটি নির্দিষ্ট সময় ব্যবধানের পরপর বিদ্যুৎ-চুম্বকীয় তরঙ্গ পাঠানো হয়ে থাকে। এতে করে হঠাৎ সৃষ্টি হওয়া ঝড় বা কালবৈশাখী কখন কোথায় হবে সেটি বলা যায়। প্রাকৃতিক দুর্যোগের পূর্বাভাসে জরুরী টেলিযোগাযোগ ব্যবস্থার অনেকটাই এখন দখল করে নিয়েছে ইন্টারনেট ও নিউ মিডিয়া। আবহাওয়াজনিত দুর্যোগের পূর্বাভাস দিতে সদা তৎপর বিশ্বজুড়ে পরিবেশ ও আবহাওয়া বিজ্ঞানীরা। পূর্বাভাসের মাধ্যমে জনসাধারণকে অগ্রিম সতর্ক করায় জীবন ও সম্পদহানির পরিমাণ বহুলাংশে কম হয়ে থাকে। জনসাধারণকে সচেতন করার কাজে পরিবেশ ও আবহাওয়া বিজ্ঞানীরা অত্যাধুনিক নতুন নতুন ডিজিটাল প্রযুক্তি ব্যবহার করে সঠিক ও সময়োচিত পূর্বাভাসদানে সচেষ্ট রয়েছেন। এদিকে ভূমিকম্প হচ্ছে ভূমির কম্পন অর্থাৎ পৃথিবীর কেঁপে ওঠাই ভূমিকম্প।ভূ-অভ্যন্তরে যখন একটি শিলা অন্য একটি শিলার উপরে উঠে আসে তখন ভূমি কম্পন হয়। পৃথিবীপৃষ্ঠের অংশবিশেষের হঠাৎ অবস্থান পরিবর্তন বা আন্দোলনই ভূমিকম্পন।

পৃথিবীতে বছরে গড়ে ছয় হাজার ভূমিকম্প হয়। এগুলোর বেশিরভাগই মৃদু, যেগুলো আমরা টের পাই না। সাধারণত তিন ধরনের ভূমিকম্প হয়ে থাকে- প্রচণ্ড, মাঝারি ও মৃদু। পৃথিবী জুড়ে অনেক ভূকম্পমিটার আছে যারা কোথাও একটা ভূমিকম্প ঘটলেই কমবেশী কাঁপন রেকর্ড করে। মিটারগুলো স্বয়ংক্রিয় হওয়ায় ও নেটওয়ার্কে সংযুক্ত থাকায় কয়েক সেকেন্ডের মধ্যেই প্রাথমিক বিশ্লেষন রিপোর্ট কম্প্যুটার থেকে বেরিয়ে আসে। এই কম্পন-তীব্রতার তথ্য-উপাত্ত ভূতত্ত্ববিদদেরকে ভূগর্ভের মানচিত্র বানাতে, ভূমিকম্পের উৎস এবং তীব্রতা বিশ্লেষণে সাহায্য করে। আবহাওয়ার পূর্বাভাস যেমন বহু বিপদ থেকে প্রান বাঁচানোর সুযোগ করে দিতে পারে একই ভাবে সঠিক পূর্বাভাস দেশের অর্থনৈতিক ব্যবস্থাকেও পরিচালনা করতে পারে। প্রযুক্তি অনেক উন্নত হয়েছে। বর্তমান আধুনিক প্রযুক্তির মাধ্যমে মহাকাশের নানা ধরনের উপগ্রহের (স্যাটেলাইট) সাহায্যে পৃথিবীর নানা প্রান্তের আবহাওয়ার খবর এখন অনেক সহজেই জানা যাচ্ছে। উন্নত বিশ্বে স্যাটেলাইটসহ বিভিন্ন উৎস থেকে তাপমাত্রা, চাপ, আর্দ্রতা এবং বাতাসের গতির মতো পর্যবেক্ষণগুলো সারা বিশ্ব থেকে সংগ্রহ করা হয়। ‘রিমোট সেন্সিং’ যতই উন্নত হচ্ছে ততই নিখুঁত তথ্য মিলছে এ সব উপগ্রহ থেকে। আকাশের ছবি তুলছে, সমুদ্রের নীচের ছবিও তুলে আনছে। কম্পন বুঝে বলে দিচ্ছে বিপদ আসছে কি না। আবহাওয়ার পূর্বাভাসের কাজে যুক্ত উপগ্রহ যেমন খবর পাঠায় কোথায় কবে ঝড় আসতে পারে ঠিক তেমনই জানান দেয় তাপমাত্রা ওঠা-নামার কথাও। এখন সে সবের উপর নির্ভর করে নানা ধরনের কাজ করা হয়।

আবহাওয়া ও জলবায়ুর এমন দ্রুত পরিবর্তনের কারণে পূর্বাভাস ব্যবস্থাকে আধুনিকায়ন করা অত্যাবশ্যকীয় এবং গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে। বর্তমানে আবহাওয়ার নির্ভুল পূর্বাভাস নির্ধারণে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা প্রযুক্তির উপর জোর দিয়েছে বিশ্বের অনেক দেশ। এই প্রযুক্তি ব্যবহারের জন্য আরও নির্ভুল আবহাওয়ার পূর্বাভাস দেওয়া সম্ভব হবে। এ নিয়ে গ্রহন করা হয়েছে বিভিন্ন ধরনের নতুন নতুন প্রযুক্তিগত পরিকল্পনাও। আগামী দিনে আবহাওয়ার ক্ষেত্রে এই প্রযুক্তি বিশ্ববাসীর জন্য নিয়ে আসবে নতুন বিপ্লব। এদিকে ভৌগোলিক অবস্থানের কারণে বাংলাদেশের আবহাওয়া ও জলবায়ু নাতিশীতোষ্ণ হলেও তা দিনে দিনে চরম ভাবাপন্ন হয়ে উঠছে। ফলে দেশের কৃষি, জনস্বাস্থ্য, মৎস্য, জীববৈচিত্র্যসহ সামগ্রিক ক্ষেত্রে এর বিরূপ প্রভাব পরিলক্ষিত হচ্ছে। জলবায়ু পরিবর্তনের বিরূপ প্রভাবে বাংলাদেশে দুর্যোগের সংখ্যা ও তীব্রতা ক্রমাগত বৃদ্ধি পাচ্ছে। জলবায়ু ও আবহাওয়ার পরিবর্তনজনিত প্রভাব মোকাবিলার জন্য বিশ্বের অন্যান্য দেশের ন্যায় বাংলাদেশও বিভিন্ন গবেষণা কার্যক্রম ও উন্নত প্রযুক্তির ব্যবহার করা খুবই জরুরী।

আবহাওয়া পর্যবেক্ষণ ও তথ্য-উপাত্ত বিশ্লেষণের জন্য বিদ্যমান প্রযুক্তির সঙ্গে উন্নত বায়ু পরিমাপক ও রেকর্ডিং সিস্টেম, ডিজিটাল ব্যারোমিটার, জিপিএস রেডিও স্টেশন স্থাপনসহ বিভিন্ন প্রযুক্তি ব্যবহার করতে হবে। এ সকল আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহারের মাধ্যমে প্রাকৃতিক দুর্যোগের অধিকতর সঠিক ও আগাম পূর্বাভাস পাওয়া সম্ভব হবে। অত্যাধুনিক এসব প্রযুক্তির ব্যবহার দুর্যোগের ক্ষয়ক্ষতি কমাতে সহায়ক ভূমিকা পালন করবে। বিজ্ঞানের উৎকর্ষের কল্যাণে দুর্যোগপ্রবণ দেশগুলোর ক্ষতি মোকাবেলায় যেসব প্রযুক্তির উদ্যোগ নেয়া হয় সেসবের জনপ্রিয়তা যেমন বাড়ছে তেমনি গ্রহণযোগ্যতাও বেড়েছে অনেক। বিশেষ করে বন্যা ও সাইক্লোনের পূর্বাভাসে এক সময় প্রচুর অসঙ্গতি ছিল। যার কারণে মানুষের কাছে এসব পূর্বাভাসের কোন গুরুত্ব ছিল না। কিন্তু গত প্রায় দুই দশক ধরে তথ্য-প্রযুক্তির গবেষণায় এসব সীমাবদ্ধতা কাটিয়ে ওঠা গেছে। বর্তমানে পূর্বাভাসের প্রতি মানুষের আস্থা বাড়ার পাশাপাশি সচেতনতাও বেড়েছে অনেক।ফলে ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ আগের তুলনায় এখন অনেক কম হয়। বিশেষ করে প্রাণহানির সংখ্যা অনেক সীমিত হয়ে এসেছে।

লেখক: নেটওয়ার্ক টেকনিশিয়ান (আইসিটি সেল), জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা

সারাবাংলা/এজেডএস

মো. জাহিদুল ইসলাম

বিজ্ঞাপন

আরো

সম্পর্কিত খবর