বৈষম্যের সংজ্ঞা, পরিসর ও অগ্রাধিকার নির্ধারণ জরুরি
আনোয়ার হাকিম
৮ অক্টোবর ২০২৪ ১৭:৫৯
৮ অক্টোবর ২০২৪ ১৭:৫৯
যুগে যুগে, ছলকে ছলকে, একেক দিক থেকে একেক রকম হাওয়া আসে। তার সাথে ভেসে আসে কিছু শব্দ, কিছু সুর, কিছু ভাইব, কিছু টার্মিলজি। লোকেরা তার উপর হুমড়ি খেয়ে পড়ে। তা নিয়ে কিছুদিন আলোচনা-পর্যালোচনা হয়। যোগ-বিয়োগ-গুন-ভাগ শেষে মানুষ তার কিছু গ্রহণ করে; কিছু তাৎক্ষণিক বর্জন করে। আর কিছু কালের খাতায় স্বর্ণাক্ষরে লিখে রাখে। হালফিলের এরূপ এক টার্মিলজি হলো ‘বৈষম্য নিরসন’। দেশে-দেশে, জাতিতে-জাতিতে, সমাজে-রাষ্ট্রে ‘বৈষম্য’ আজ এক বাস্তব বিভীষিকা।
সভ্য সমাজেও বৈষম্য আছে। কম আর বেশি। কিন্তু তারা তা থেকে বেরিয়ে আসার জন্য ঐক্যবদ্ধভাবে উদ্যোগী হয়। সমস্যাকে চিহ্নিত করে সংস্কারের মাধ্যমে এর ব্যাপকতা কমিয়ে আনার চেষ্টা করে। আন্তরিক হলে আর উদ্দীষ্ট নির্দিষ্ট থাকলে সময়ের পরিসরে সমাজস্থিত বৈষম্য কমিয়ে আনা সম্ভব। উন্নত তথা পাশ্চাত্যের দেশসমূহে এর ব্যাপকতা অনেকটা কমে গেলেও একেবারে উৎপাটিত হয়ে গেছে এমনটিও বলা যায় না।
আমাদের দেশে সর্বক্ষেত্রে বৈষম্য বিরাজমান। এর কতক উত্তারাধিকার সূত্রে প্রাপ্ত, কতক শাসক দল কর্তৃক সময়ে সময়ে সৃষ্ট আর কতক স্বার্থজাত। বলাচলে বৈষম্য নিয়েই আমাদের নিত্য পথচলা। অনেক বৈষম্য আছে যা নিয়ে আমাদের কোন রা নেই। অনেকটা সামন্ত সমাজের মত। তাতেই আমরা ধাতস্থ হয়ে গেছি। আয়ের বৈষম্য, সম্পদের বৈষম্য, ক্ষমতার বৈষম্য, জাত-পাতের বৈষম্য আমাদের গা সহা হয়ে গেছে। এ নিয়ে এককালে বামদের রাজনীতি তুঙ্গে ছিলো, এখন তা ড্রয়িংরুমের আলাপচারিতায়, রেস্তোরাঁর চায়ের কাপে, সেমিনার-সিম্পোজিয়ামে আর চ্যানেলের টক শো-তে জাগরূক আছে। বৈষম্য নিয়ে বুদ্ধিজীবীদের মায়াকান্না আজ বক্তৃতা-বিবৃতিতে সীমাবদ্ধ, আর বিশেষ দিবসের ক্রোড়পত্রে দৃশ্যমান। সাংবাদিকদের কাছে বিষয় হিসেবে ‘বৈষম্য’ হলো নিউজ ফিলার স্বরূপ। পপুলার ক্যাটাগরিতে বিশেষ পুরষ্কার প্রাপ্তির সম্ভাবনার ক্ষেত্রও। রাজনীতিবিদদের কাছে বৈষম্য স্থায়ী টপিক হিসেবে আম পাবলিককে উজ্জীবিত করার জনপ্রিয় বিষয়। আর এসব কারণে, বৈষম্য যেখানে থাকার সেখানেই থেকে গেছে। হয়ত অনুপাতে সামান্য হেরফের হয়েছে। কিন্তু নতুন নতুন বৈষম্যের ক্ষেত্রও তৈরি হয়েছে। শ্রেণীর মধ্যে শ্রেণী সৃষ্টির মাধ্যমে উন্নত হাইব্রিড শ্রেণীরও সৃষ্টি হয়েছে।
সাম্প্রতিক সময়ে, দ্বিতীয় স্বাধীনতা অর্জনের স্লোাগান থেকে উদ্ভুত বৈষম্য বিরোধী অজস্র প্লাটফর্ম চাঙ্গা হয়েছে, বৈষম্য নিরসনের অঙ্গীকার মূর্ত হয়েছে, সমাজস্থিত মানুষের মধ্যে প্রত্যাশা আকাশচুম্বী হয়েছে। সবাই রাস্তায় নেমেছে যার যার পুঞ্জীভূত খেদ নিয়ে। এখন বৈষম্য বিরোধী ক্ষোভ শুধু সরকারী ঘরানায় সীমাবদ্ধ থাকে নি। মানুষ যার যার পেশা ও গোষ্ঠীতে বিরাজিত বৈষম্য নিরসনেও সরকারের দুয়ারে এসে আসন গেঁড়ে বসেছে। এখন চলছে আল্টিমেটামের পর আল্টিমেটাম প্রক্ষেপণের পালা। অবস্থা এতটাই নাজুক যে, অন্তর্বতীকালীন সরকার এখন হুংকার আর আল্টিমেটাম সামাল দিতে অসহায় প্রায়। প্রত্যাশীদের দাবী যৌক্তিক নাকি অযৌক্তিক, হাস্যকর নাকি উদ্দেশ্যমূলক তা কারোর বিবেচনায় নেই। পা চালিত রিক্সাওয়ালারা হুংকার দিয়ে রাজপথ ছাড়ার আগেই যন্ত্রচালিত অটোযানের মালিক- শ্রমিক পালটা হুংকার নিয়ে মঞ্চে আবির্ভূত হয়েছে। ব্যাপারটা ক্রমে ক্রমে এতটাই হাস্যকর হয়ে উঠছে যে আমাদের অবিমৃষ্যকারিতায় আমরা নিজেরাই এখন লজ্জাবোধ করছি। তাতে করে আল্টিমেটাম আর বৈষম্যের নতুন নতুন আবদার থেমে নেই। গার্মেন্টস শ্রমিকরা হরহামেশাই বেরিয়ে আসছে। ছাত্ররা পরীক্ষা ছাড়াই অটো পাস চাচ্ছে। আনসাররা দাবী পূরণের পরেও অনুদঘাটিত কারণে সচিবালয় কাঁপিয়ে, কুপিয়ে লণ্ডভণ্ড করে দিয়ে গেছে। ডাক্তাররা রাজপথে নেমেছে, নার্সরা বঞ্চনার ফিরিস্তি সহ ফেটে পড়ছে। পেশাজীবিরা ট্রেড ইউনিয়ন সংঘঠনের মত রাস্তা কাঁপাচ্ছে। শিক্ষিত-অর্ধ শিক্ষিত সকলের মুখের ভাষা পারদের অংকে স্ফুটনাংক পর্যায়ে গিয়ে পৌছেছে। চাকরি জীবিরাও পিছিয়ে নেই। প্রথমে বিবৃতি, তারপর বক্তৃতা, এরপর মানব বন্ধন এরপর রাজপথ। এরপর সবার মত।
অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে দাবী পূরণই অন্তর্বতীকালীন সরকারের একমাত্র কাজ। অথচ আমরা চাই দেশের সার্বিক আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিরাপত্তামূলক ও নির্বিঘ্ন হোক। অফিস-আদালতে সেবাপ্রাপ্তি সহজ ও সুলভ হোক। সিণ্ডিকেটের মূলোৎপাটন হোক। চিহ্নিত কুখ্যাত সব ব্যাক্তিকে ধরে এনে আইনের পথে চালান করে দেওয়া হোক। আর্থিক খাতে শৃঙ্খলা ফিরে আসুক। বিদেশে শ্রম বাজার রকেট গতিতে সম্প্রসারিত হোক ইত্যাদি ইত্যাদি। বহু দিনের অনিয়মের ও দুর্বৃত্তায়নের শিকার দেশবাসী এ সরকারের কাছে তাই পরিত্রাণ প্রত্যাশা করে। এটা স্বাভাবিক কিন্তু এর জন্য সময় দিতে তারা নারাজ। নিজেরটুকু পেলেই আমরা খুশিতে জিন্দাবাদ দেই আর না পেলেই মুর্দাবাদ শ্লোগানে কর্তৃপক্ষকে কাঁপিয়ে-কুপিয়ে ভয়ার্ত রূপ দেখাতে এতটুকু সময় নেই না। একবারও ভেবে দেখিনা আমাদের দাবী যৌক্তিক নাকি কারো উদ্দেশ্যপূরণে ঘি ঢালার মত? স্বার্থপরতার রক্ত আমাদের শিরায় শিরায়। আমরা ব্যস্টিকতায় বিশ্বাসী, সামষ্টিকতায় আমাদের আগ্রহ নেই বললেই চলে।
কথা ঘুরপথে অনেক দূর চলে গেছে। টু দি পয়েন্টে আসি। ওই যে সবাই বৈষম্য বৈষম্য করছে এর সংজ্ঞা ও পরিধি কি? গেলো রেজিমে বিভিন্ন অনিয়মের মাধ্যমে যারা গাছের প্রায় মগডালে গিয়ে আয়েসি আসন পেতে বসে হাওয়া খাচ্ছে তারা কি গাছের ত্রিসীমানায় আসতে না পারাদের সমপর্যায়ভুক্ত? যারা কমিটি করে, সিণ্ডিকেট করে জনগণের সর্বস্ব লুটে নিয়েছে তাদের মানবিক আবেদন আর সর্বস্ব খোয়ানো জনতার মানবিক আবেদন কি এক? পরীক্ষা ছাড়া অটো পাশের আবদার আর পরীক্ষা দিয়ে পাস করতে ইচ্ছুকদের মধ্যে বৈষম্য নিরোধ কি নৈতিক? গত দেড় যুগে যা নিয়ে টু শব্দটুকু করা হয়নি আজ সরকারের নাজুক সময়ে তা নিয়ে মরণ কামড় দেওয়া কি বৈষম্য নিরসনের তরিকা? দাবি থাকতেই পারে, অন্যায়-অবিচারের ফিরিস্তি লম্বা হওয়াটাও অস্বাভাবিক না কিন্তু দীর্ঘ জটিলতার চটজলদি নিরসন কি শুধুমাত্র বৈষম্য বিরোধী শ্লোগান তুলে আর আল্টিমেটাম দিয়ে নিষ্পত্তিযোগ্য? আমরা সবাই ক্রমে ক্রমে খুব অসহিষ্ণু হয়ে পড়ছি। এটা যতটা বঞ্চনার তার চেয়ে বেশি ফায়দা হাসিলের কুমতলবে ঠাসা।
আমরা আমাদেরটা নিয়েই মারমুখী, অন্যেরটা নিয়ে বিন্দুমাত্র সহানুভূতি আমাদের নেই। এক্ষুনি আমাদের মত করে দাবী পূরণ করে দিতে হবে, নইলে আগের জমানাই ভালো ছিলো এই পাল্লা যেন ক্রমশঃ ভারি হচ্ছে। অথচ আগেরটাই যদি এত ভালো হত তাহলে দেড় যুগের চেপে রাখা এত এত দাবী উত্থাপনের প্রশ্নই বা উঠছে কেন? আজ সবার আগে এ প্রশ্নেরই মীমাংসা হওয়া জরুরি। আর এত এত বৈষম্যই বা এলো কোত্থেকে? বিগত রেজিমে তাহলে কাজের কাজ কি হয়েছে?
আমরা ফায়দা নিতে ওত পেতে থাকি। ডাণ্ডার কাছে সভ্য বিড়াল সেজে থাকি; যেন ভাজা মাছটাও আমরা উলটে খেতে জানি না। ছাত্র-জনতার বিপ্লবের মূল উদ্দেশ্যই ছিলো যাবতীয় বৈষম্যের প্রতিকার বিধান করা ও সর্বত্র শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনা। সে ক্ষেত্রে এত্ত জঞ্জাল নিমিষেই জুয়েল আইচ ম্যাজিকে নিরসন করা যাবে এ ম্যাসেজ আমরা কোত্থেকে পেলাম? আজ যারা পুরোনো মাল মশলা দিয়ে নতুন সুরে আগের জমানার গীত রচনা করার চেষ্টা করছেন তাদের কাছে স্মৃতিকাতরতা আছে, আবেগ আছে, হতাশাবোধ আছে, কথার জারিজুরিতে মানুষকে অতীতমুখী করে তোলার ছল আছে; আর যাই হোক বাস্তব পরীবিক্ষণ নেই। ছেলে ভুলানো গীত যে ‘জেন জি’ যৌবনে আলোড়ন তুলবে না তা মূল্য দিয়ে প্রতিষ্ঠিত হয়ে গেছে। তাই, কথায় নয় কাজের মাধ্যমেই বৈষম্য নিরসনে উদ্যোগী হতে হবে।
অন্তর্বতীকালীন সরকারেরও করণীয় আছে। প্রত্যাশার তালিকা ব্যাপক হতে পারে, জন আকাঙ্ক্ষা বিভিন্নমুখী হতে পারে কিন্তু সরকারকে তার সামর্থ্য ও সময়কাল বিবেচনায় নিয়ে করণীয় সম্মন্ধে সংক্ষিপ্ত অথচ অগ্রাধিকার তালিকা প্রস্তুত করে অগ্রসর হতে হবে। এতে করে জনগণের কাছে সঠিক বার্তা পৌছে যাবে, ফায়দা-লুটেরারা প্রথাগত নোংরা পথে হাঁটা বন্ধ করতে বাধ্য হবে। বিপ্লবের স্পিরিটকে শিথিল করে দিয়ে এই অন্তর্বতীকালীন কঠিন দায়িত্ব, যা কিনা বৈষম্য নিরসনের অঙ্গীকার নিয়ে জন্ম নিয়েছে, তা অর্জন করা দুরূহ হয়ে পড়বে। মনে রাখা দরকার, দেড় যুগের ‘আলাদীনের আশ্চর্য চেরাগে’ ভর্তি দৈত্যরা মরে যায় নি বা প্রভু-বিমুক্ত হয়নি। ঘষা দেওয়া মাত্র তারা মুহুর্তেই আগের মত ‘প্রভু হাজির’ রবে কুর্নিশ করতে করতে হাজির হয়ে যাবে। এটা তাদের অস্তিত্বের জন্য জান-মাল-ইজ্জত কা সাওয়াল। তাদের আছে বিদেশে ব্যাংক ভর্তি ডলার, দেশে বস্তা ভর্তি টাকা। প্রবাদে আছে, ভাত ছিটালে কাকের অভাব হয়না। এখানে কাকের চেয়ে বশংবদ ভৃত্যের সংখ্যা বেশি, প্রভুভক্তিতে তারা ‘হাজির হুজুর’ এর মতই করিৎকর্মা।
দেড় যুগের তরল-গরল অর্থনীতির সুফলভোগীরা তাদের যাপিত জীবনাচারের এই হঠাৎ পরিবর্তনে আজ মানসিক ট্রমাক্রান্ত। এরা বিনা যুদ্ধে দিবে না সূচাগ্র্র মেদিনী। এটাই চরম সত্য। এরিমধ্যে তাদের স্বরূপ উদঘাটিত হতে শুরু করেছে। তাই, সরকারের আশু করণীয় নির্দিষ্ট করে জনগণের সামনে তা স্পষ্ট করা প্রয়োজন হয়ে পড়েছে। সব কিছুকে সমাধান করতে গেলে অগ্রাধিকার খাতে সরকারের সাফল্যে ঘাটতি দেখা দেবে। তখন জনগণের হতাশা বিতৃষ্ণায় পর্যবসিত হতে সময় নেবে না। অভীষ্ট অর্জনে সরকারের তরফ থেকে মাত্রাবোধ ও মানবিকতা যেমন থাকবে তেমনি অতি উদারতা প্রদর্শন ও যে কোন প্রকার শৈথিল্য বুমেরাং হয়ে দেখা দিতেও সময় নেবে না। মনে রাখা দরকার, আমরা জোয়ার ভাটার দেশের অধিবাসী। এখন এই জল থৈ থৈ তো কিছু পরেই মাটি শক্ত খট খট। সরকারের চলার পথে কারা দেশি প্রতিবন্ধক কারা আর কারা বিদেশী ঘি সরবরাহকারী তা সবার জানা। তাই, যথোপযুক্ত কৌশল গ্রহণ করাই অপিরহার্য হয়ে পড়েছে। অতএব সাধু সাবধান। সবার সুবোধ জাগ্রত হোক।
লেখক: কলামিস্ট
সারাবাংলা/এসবিডিই