দিনে দিনে বাড়িতেছে গুজবের ডালপালা
আনোয়ার হাকিম
১২ অক্টোবর ২০২৪ ১৮:১৮
১২ অক্টোবর ২০২৪ ১৮:১৮
বাঙ্গালীদের নিয়ে দু’টি অনুমিতি মোটামুটি প্রতিষ্ঠিত – ১. বাঙ্গালী হুজুগ প্রিয় আর ২. বাঙ্গালী গুজবপ্রিয়। আবহমানকাল থেকে এর তৎপরতা ক্রমেই বেড়ে চলেছে, কমার কোন লক্ষ্মণ দৃশ্যমান হয়নি। বাঙ্গালী আবেগী জাতি। আপনি যদি তাদের আবেগে ঠিকমত হিট করতে পারেন তাহলে হুজুগে বাঙ্গালীর কায়কারবার দেখে আপনি নিজেও হতবিহ্বল হয়ে পড়বেন। দেখবেন, যা হবে বলে আশা করেছিলেন ফলাফল তারচেয়ে হয়েছে বহুগুণ আর এই আবেগজনিত হুজুগ ইতোমধ্যে অনেক অপ্রত্যাশিত বাইপ্রোডাক্টেরও জন্ম দিয়ে ফেলেছে। আমাদের মধ্যে আবেগ আর হুজুগের শক্তিশালী র্যাম, রোম ইনবিল্ট থাকায় গুজবের ভাইরাস বাসা বাধতে সময় নেয় না। গুজবহীন বাঙ্গালী সমাজ কল্পনাতীত। গুজব উদ্দীপক, তাই আটপৌরে। বাঙ্গালী এটাকে নেড়েঘেটে, জাবর কেটে, ছড়িয়ে-ছিটিয়ে বেশুমার আনন্দ পায়। বলাচলে, চায়ের সাথে গুজব যেন পারফেক্ট ম্যাচ। যাদের কোষ্ঠকাঠিন্য রোগ নেই তাদের কাছেও গুজবহীন দিন প্রাত্যহিক বাহ্যের মত বড়ই যাতনাময়।
গুজব কাকে বলে, কত প্রকার ও কি কি তা বোধকরি শিক্ষিত-অশিক্ষিত নির্বিশেষে বাঙ্গালী কাউকে ব্যাখ্যা করে বোঝাতে হবে না। তবু আলোচনা যখন উঠেছেই তখন একটু আলোকপাত করাই ভালো। সত্যতা যাচাই বিহীন যে ঘটনা বা খবর লোকমুখে প্রচারিত হয় সাদা বাংলায় তা-ই গুজব। গুজবের সবচেয়ে অনুকূল দিক হলো স্বল্প সময়ে এর সত্যতা যাচাই করা যায় না। কোন কোন গুজবের সত্যতা সম্মন্ধে দীর্ঘমেয়াদেও নিশ্চিত হওয়া সম্ভব হয় না। তাই, কোন কোন গুজব সন্দেহ নিয়ে গুজব হিসেবেই থেকে যায়।
গুজব দু’ধরণের হতে পারে। ভুল তথ্য সম্বলিত কোন বিষয় নিয়ে গুজব। মূলত মিথ্যা ও বানোয়াট তথ্য দিয়ে নিছক প্রচার- প্রচারণার উদ্দেশ্যে এ ধরণের গুজব জনারণ্যে ছেড়ে দেওয়া হয়। পাবলিক তা দেশে, শুনে, পারস্পরিক বলাবলি করে। অসমর্থিত সোর্সের কারণে হোক, কন্টেন্টের দুর্বলতার কারণে হোক বা প্রাথমিক বিশ্বাসযোগ্যতা না পাওয়ার কারণেই হোক এ ধরণের গুজব ডালপালা মেলে দীর্ঘকাল থাকতে পারে না। একটা সময়ের পর অসার বলে চাপা পড়ে যায়। আরেক প্রকার গুজব হলো অসৎ উদ্দেশ্যে ইচ্ছাকৃত ভাবে ভ্রান্ত তথ্য উপস্থাপন। এ ধরণের গুজবের গাঁথুনি অনেকটা মজবুত। কিছুটা সত্য ঘটনাকে উপজীব্য করে সিংহভাগ ভেজাল মিশিয়ে নিজেদের উদ্দেশ্য পূরণে বা কোন বিশিষ্ট ব্যাক্তি, দল, গোষ্ঠী, সম্প্র্রদায় বা জাতিকে হেয় বা অবমূল্যায়ন করার জন্যেই এই গুজবের সৃষ্টি। আর বিশেষ গোষ্ঠীর সক্রিয় সহযোগিতায় এ ধরণের গুজব বিদ্যুৎ গতিতে দেশ-কালের গণ্ডী পেরিয়ে উদ্দীষ্টকে বিদ্ধ করতে বড়ই পারঙ্গম। এ ধরণের গুজবের কারিগররা প্রযুক্তিতে মাস্টার, বুদ্ধিতে ইবলিশের উত্তম প্রতিভূ আর সম্প্রসারিত নেটওয়ার্কের সুফলভোগী অংশীজন।
বলাবাহুল্য এ ধরণের গুজবই আজকাল সামাজিক, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে খুব ক্ষতিকর ভূমিকা রেখে চলেছে। গুজব উৎপাদকরা বিভ্রান্তি ছড়িয়ে, কারো মু-ুুপাত ঘটিয়ে বা কোন ঘটনাকে বিকৃত করে সত্যের মত উপস্থাপনের মাধ্যমে ব্যাক্তির সাথে ব্যাক্তির, সমাজস্থিত শ্রেণীর মধ্যে, বিভিন্ন দল, গোষ্ঠী, জাত, সম্প্রদায়ের মধ্যে বিভেদের, অনৈক্যের পথ প্রশস্থ করে ও জিইয়ে রাখে। সন্দেহ, হিংসা-দ্বেস, জিঘাংসা-ক্রোধ উসকে দিয়ে ফায়দা হাসিল করে থাকে। এ ধরণের গুজবের উর্বর ক্ষেত্র হলো ধর্মীয়, জাতিগত ও রাজনৈতিক ক্ষেত্র। পাবলিক খুব সহজেই আবেগে উথলে উঠে, প্রতিহিংসা চরিতার্থে বিকল্প কোন পথ খুঁজে না দেখে ‘চিলে কান নিয়ে গেছে’ বলে চিলের পিছু পিছু ছুটতে থাকে। ফলত: যা হবার তা-ই হয়। ততক্ষণে ক্ষয়ক্ষতি যা হওয়ার তা হয়ে যায়। জিঘাংসা, সন্দেহ, আক্রোশ দীর্ঘস্থায়ী রূপ নেয়। সমাজ, দেশ, জাতি অতি ছোটখাটো সব বিষয়েই বড় বেশি স্পর্শকাতর ও সংবেদনশীল হয়ে পড়ে।
গুজব কেন ডালপালা মেলে? যখন সমাজে তথ্যের অবাধ প্রবাহ বাধাগ্রস্ত হয়; তখন। যখন গুজবের সোর্স যাচাই করার উপায় থাকেনা তখনই এ ধরণের গুজব ডালপালা বিস্তার করে থাকে। পাবলিক বিকল্প হিসেবে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের উপর নির্ভরশীল হয়ে পড়ে। আর এরই সুযোগ নিয়ে থাকে এক শ্রেণীর অসাধু কারিগর। বর্তমান প্রযুুক্তির যুগে এদের উৎকর্ষতা এতই উচ্চাঙ্গে গিয়ে পৌছেছে যে, অসৎ উদ্দেশ্য সাধনে বদ্ধপরিকর বিবদমান দল, গোষ্ঠী, সম্প্রদায়সমূহ এদের উপর অতিমাত্রায় নির্ভরশীল হয়ে পড়েছে। এসব দল, গোষ্ঠী, সম্প্রদায় তাদের ক্যাডারদেরকে সার্বক্ষণিকভাবে এ কাজে নিয়োজিত করে বা একাজে পারদর্শী ব্যাক্ত বা গোষ্ঠীকে অর্থের বিনিময়ে চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ প্রদান করে থাকে। ফলতঃ গুজবের ফ্যাক্টরি আজ জেঁকে বসেছে।
আমাদের দেশে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের ব্যাপক প্রসার হয়েছে। যার হাতেই স্মার্টফোন আছে সে-ই যেন নায়ক। ম্যাজিক বুক তার নিয়ন্ত্রণে। একশ্রেণীর তরুণ আছে তথ্য পেলেই ছড়িয়ে দেয়। এর মাধ্যমে সে সবার মাঝে আলোচিত-সমালোচিত হয়ে বেঁচে থাকাকেই বেশি গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে করে থাকে। আরেকদল আছে, ইউটিউব, চ্যানেল, রীল, পেইজ, ভøগ খুলে বারোয়ারি মাল পোস্ট করে লাইক, ভিউ, কমেন্টের বিনিময়ে ডলার প্রাপ্তিকেই নেশা হিসেবে শিরোধার্য করে নিয়েছে। এদের কাছে নীতি-নৈতিকতা প্রণিধানযোগ্য না। বরং পরিচিতি, সাময়িক উত্তাপ আর প্রাপ্তিই মুখ্য। আরেক দল আছে, যারা প্রযুক্তিতে দক্ষ, নেটওয়ার্কে সমৃদ্ধ, গোষ্ঠীপ্রীতিতে মুগ্ধ, পেশাজীবি হিসেবে উজ্জীবিত। অল্প বিনিয়োগে বিস্তর অর্থ প্রাপ্তিই তাদের ধ্যান-জ্ঞান।
গত রেজিমে সাইবার নিরাপত্তা আইন ২০২৩ তৈরির মাধ্যমে তথ্য সন্ত্রাস নিয়ন্ত্রণের নামে বিরুদ্ধ মতবাদ জব্দকরণের কাজটি অতি নিপুণতা ও নৃশংসতার সাথে করা হয়েছিলো। যারা এর ভুক্তভোগী তারা ভালো করেই জানেন, “তাহাদের সহিত কি করা হইয়াছে”? পাবলিকও তার প্রত্যক্ষদর্শী। তাই, বিরোধী কন্ঠ বাঁকাপথ অনুসরণ করেছে। এভাবেই সুযোগে গুজবের বীজ অংকুরিত হয়ে থাকে। অতি সম্প্রতি সাইবার আইনের প্রয়োগ এতটাই শিথিল যে, পাবলিক ধরেই নিয়েছে এখন গুজব তৈরি ও বিপণনে নেট দুনিয়া অপার সম্ভাবনার দ্বার খুলে দিয়েছে। তাই, দেশে-বিদেশের বাঙ্গালী সমাজের অনেকেই পেশা ও নেশা হিসেবে চমৎকার এই শিল্পের বিকাশে ও তা থেকে নানাবিধ ফায়দা লুটার অভিপ্রায়ে গুজব তৈরির কাজে নেমে পড়েছে। ফলতঃ প্রতি মুহুর্তে চটকদার গুজব গোডাউন থেকে বের হয়ে নেটের মাধ্যমে বিপণন হচ্ছে। পাবলিক দেখছে, শুনছে। কেউ কেউ বিশ্বাস করছে, কেউ কেউ অতি উৎসাহী হয়ে তা ছড়িয়েও দিচ্ছে। দলীয় গোষ্ঠী প্রচারণায় উজ্জীবিত হয়ে বেশি বেশি করে শেয়ার করছে, পাল্লা ভারি করতে কমেন্ট বক্স ভরে তুলছে।
ইদানীং এমন এমন গুজব ছড়ানো হচ্ছে যা, জনমনে আশংকার সৃষ্টি করছে। শ্রেণী, দল ও সম্প্রদায়ের মধ্যে সংঘর্ষ অনিবার্য করে তুলছে। দেশে রাজনৈতিক অস্থিরতা সৃষ্টিই যে এর উদ্দেশ্য তা গুজবের ধরণ দেখলেই বুঝা যায়। প্রযুক্তির সাহায্যে চলতি স্পর্শকাতর ইস্যুগুলো নিয়ে লাগাতার নাড়াচাড়া করছে বেশ কিছু লোক। এদের করা কন্টেন্টসমূহ ফ্যাক্ট চেকিংয়ে ভুয়া বলে প্রমানিত হলেও তারা এ থেকে নিবৃত্ত হচ্ছে না। ভিডিও এডিটিং ও আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স প্রযুক্তির সুবিধা ব্যবহার করে নির্মিত এ ধরণের গুজব রুচিতে নিম্ন, নৈতিকতায় অতীব জঘন্য। রাষ্ট্রের নিরাপত্তা, সংঘাত, বিদ্বেস যাতে সর্বক্ষণ যুদ্ধংদেহী অবস্থায় ক্ষত-বিক্ষত হতে থাকে- সেটা নিশ্চিত করাই এ ধরণের গুজব সম্প্রচারের উদ্দেশ্য। অতি সাম্প্রতিক সম্প্রচারিত সিরিজ গুজবে জনমনে এমন শংকা সৃষ্টি হচ্ছে, সংশয় দানা বাঁধছে। এর ফায়দা নিচ্ছে বিভিন্ন শ্রেণী, গ্রুপ। অবিলম্বে এর নিরসন হওয়া প্রয়োজন। না হলে গুজবের ডালপালা বেড়ে প্রকৃত খবরকেই অবিশ্বাস্য করে তুলবে। তখন দেশবাসী বিভ্রান্ত হয়ে পড়তে বাধ্য হবে। যার ফায়দা যে কোন পক্ষই তুলে নিতে পারে। অতএব সাধু সাবধান।
প্রশ্ন উঠা সঙ্গত, এ থেকে পরিত্রাণের পথ কি? গুজব সম্মন্ধে জনগণকে সচেতন করতে হবে। গুজব সৃষ্টিকারীকে আইনের আওতায় আনতে হবে। দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির বিধান করে তা জনগণের সামনে দৃশ্যমান করতে হবে। গুজবের বিপরীতে মূল প্রকৃৃত তথ্য তুলে ধরতে হবে। এসব দায়িত্ব সরকারের। তাই বলে আইনের অপপ্রয়োগ বা উদ্দেশ্যপ্রণোদিত প্রয়োগ কোনটাই কাম্য নয়। প্রয়োজনে বাস্তবতার নিরীখে বিদ্যমান সাইবার নিরাপত্তা আইনের সংশোধন করতে হবে। নিবর্তনমূলক ধারাসমূহ বাদ দিতে হবে। জনগণেরও কর্তব্য আছে। কোন তথ্য গুজব কিনা তা নিজের জ্ঞান ও বিবেক দিয়ে প্রাথমিকভাবে উপলব্ধি করার চেষ্টা করতে হবে। সোর্স যাচাই করতে হবে। যাচাই-বাছাই ব্যাতিরেকে কোন তথ্য অন্য কারো সাথে শেয়ার করা অনভিপ্রেত। কোন গুজব নিছক গুজব বা উদ্দেশ্যমূলক বলে অকাট্য প্রমাণ কারো কাছে থাকলে বা কোন যুক্তি থাকলে তা সাহসের সাথে শালীন ভাষায় তুলে ধরতে হবে। এর মাধ্যমে গুজবের বিপক্ষে জনমত গঠিত হবে।
মনে রাখতে হবে শ্রেণীতে শ্রেণীতে, জাতিতে জাতিতে, দল-গোষ্ঠী-সম্প্রদায় নির্বিশেষে হিংসা-দ্বেস জিইয়ে রেখে দেশের উন্নয়ন নিশ্চিত করা সম্ভব না। আমাদের দুর্ভাগ্য আমরা আমাদের নিজ নিজ মতামতকে চূড়ান্ত ও শ্রেষ্ঠ বলে সবার উপর চাপিয়ে দিয়ে কর্তৃত্ববাদিতাকেই পোক্ত করার চেষ্টা করি। কাউকে অন্যায়ভাবে অবদমন করে, নির্যাতন-নিপীড়নের মাধ্যমে স্থায়ী শান্তি যেমন বজায় রাখা যায় না তেমনি উন্নয়ন-রাজনীতি আখেরে কোন কাজও দেয় না। আসুন সর্বপ্রকার গুজবকে না বলি, গুজবের পৃষ্ঠপোষকতা না করি, এর সম্প্র্রচারে শামিল না হই। সকল ধর্মমতে মিথ্যা বলা মহা পাপ। মিথ্যারোপ করা আরো জঘন্য পাপ। মিথ্যার বেসাতি আত্মবিনাশী খেলা। গুজব সৃষ্টি ও ছড়ানো নিজের মানব মর্যাদাকে দানব পর্যায়ে নামিয়ে আনে। এটা বোধের মধ্যে নিতে পারলে গুজবের ক্রমবর্ধমান ডালপালা সময়েই শুকিয়ে যাবে। দেশ-জাতির শান্তি ও প্রগতির জন্য এর কোন বিকল্প নেই। সবার সুবোধ জাগ্রত হোক।
লেখক: কলামিস্ট
সারাবাংলা/এসবিডিই