Monday 25 Nov 2024
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

ডব্লিউএফপি প্রতিবেদন: খাদ্যনিরাপত্তা আতঙ্কে প্রান্তিক জনগন

ড. মিহির কুমার রায়
১৫ অক্টোবর ২০২৪ ১৪:২৮

জাতিসংঘের বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচি (ডব্লিউএফপি) প্রকাশিত এক নিয়মিত প্রতিবেদনে দেখা যায় যে বাংলাদেশে খাদ্যনিরাপত্তাহীনতায় ভুগছে ২০ শতাংশ মানুষ। সিলেট ও বরিশাল অঞ্চলে এ হার সবচেয়ে বেশি, ২৪ শতাংশ। আর নিত্যপণ্যের মূল্যবৃদ্ধির প্রভাবে প্রয়োজনের চেয়ে কম খাদ্য গ্রহণ করছে দেশের ৩০ শতাংশ মানুষ। দেশের আট বিভাগের ১ হাজার ২০০ মানুষের ওপর পরিচালিত জরিপের ভিত্তিতে নিয়মিত প্রতিবেদনটি তৈরি করেছে ডব্লিউএফপি। এতে বলা হয়েছে বিভাগ ভিত্তিক খাদ্য নিরাপত্তার চিত্র যেমন ঢাকা ১৭%, খুলনা ১৮%, ময়মনসিংহ ১৯%, রংপুর ২০%, রাজশাহী ২০%, চট্টগ্রাম ২১%, সিলেট ২৪% ও বরিশাল ২৪%।

বিজ্ঞাপন

সেপ্টেম্বর শেষে দেশে খাদ্যনিরাপত্তা পরিস্থিতি নিয়ে গত সপ্তাহেই এটি প্রকাশ করা হয়। এতে দেখা যায়, দেশের সাম্প্রতিক বন্যায় কৃষি ও সামগ্রিক অর্থনীতির ওপর চাপ তৈরি হয়েছে। এর প্রভাবে প্রয়োজনীয় খাদ্য সংস্থান করতে পারছে না প্রতি ১০ জনের মধ্যে তিনজন বা ৩০ শতাংশ। নিম্ন আয়ের মানুষের ক্ষেত্রে এ হার প্রায় ৩৬ শতাংশ। খাদ্য ব্যয় সংকোচনমূলক ব্যবস্থার মাধ্যমে বর্তমান পরিস্থিতির সঙ্গে খাপ খাইয়ে নেয়ার চেষ্টা করছে ২৯ শতাংশ মানুষ। আর সার্বিক জীবন-জীবিকায় ব্যয় সমন্বয়ের মাধ্যমে পরিস্থিতি মোকাবেলা করছে ৭১ শতাংশ মানুষ।

বিজ্ঞাপন

খাদ্যনিরাপত্তাহীনতার ধারাবাহিকতায় দেশে অপুষ্টি ও রোগব্যাধির প্রকোপ বেড়ে যাওয়ার আশঙ্কা করছেন জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা। এ বিষয়ে তাদের বক্তব্য হলো কম খাবার গ্রহণের ফলে শিশুর শারীরিক ও মানসিক বিকাশ বাধাগ্রস্ত হয়। পুষ্টিহীনতা বেড়ে যায়। এমনকি প্রাপ্তবয়স্কদের ক্ষেত্রেও কমে যায় রোগ প্রতিরোধের ক্ষমতা। ফলে নানাবিধ রোগ-ব্যাধির প্রকোপও বাড়ে। জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ডা. লেনিন চৌধুরী বলেন, ‘খাদ্য কম গ্রহণ করলে মানুষের ওজন কমে যায়। তখন রোগ-ব্যাধি তীব্রতর হয়। গর্ভবতী নারীদের স্বাস্থ্য খারাপ হয়। জন্ম নেয়া শিশুও খর্বকায় হয়। রুগ্‌ণ শিশুর সংখ্যা বেড়ে যাওয়ার পাশাপাশি ব্যাহত হয় তাদের শারীরিক ও মানসিক বিকাশ।’

শহরের চেয়ে গ্রামাঞ্চলে খাদ্যনিরাপত্তাহীনতার হার তুলনামূলক বেশি বলে বিভিন্ন সময় সরকারি-বেসরকারি প্রতিবেদনে উঠে এসেছে। সর্বশেষ সরকারি তথ্য অনুযায়ী দেশে ১৮ শতাংশ মানুষ দারিদ্র্যসীমার নিচে। তাদের ওপরই মূল্যস্ফীতির চাপ ও খাদ্যনিরাপত্তাহীনতার সংকট সবচেয়ে মারাত্মক আকারে জেঁকে বসেছে। আবার দারিদ্র্যসীমার নিচে অবস্থানকারীদের হারের চেয়ে খাদ্যনিরাপত্তাহীনতায় ভুক্তভোগীর হার বেশি। এর অর্থ হলো দারিদ্র্যসীমার ওপর অবস্থানরতরাও উচ্চ মূল্যস্ফীতির চাপে ভুগছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, খাদ্যের জোগান থাকার পরও প্রয়োজনীয় খাদ্য গ্রহণ করতে না পারার পরিস্থিতিকেই বলা হয় খাদ্যনিরাপত্তাহীনতা। মূল্যস্ফীতির চাপ বাড়তে থাকায় চাপে পড়েছে সাধারণ মানুষের ক্রয়ক্ষমতাও। আয় করার পরও বাড়তি দামের কারণে প্রয়োজনীয় পণ্য ক্রয় করতে পারছেন না অনেকেই।

ডব্লিউএফপির প্রতিবেদন বলছে, সিন্ডিকেটের কারণে বাজারে নিত্যপণ্যের দাম বাড়ছে। ফলে নিম্ন আয়ের প্রায় ৩৬ শতাংশ মানুষ খাদ্যনিরাপত্তাহীনতায় ভুগছে। ৫৪ শতাংশ পরিবার খাদ্যপণ্যের দাম বাড়ার কথা বলছে। যার প্রভাবে ৫৯ শতাংশ পরিবারের ব্যয় বেড়ে গেছে। এমন পরিস্থিতিতে আবার ৩৭ শতাংশ পরিবারের আয় কমে গেছে। বন্যা ও বন্যা-পরবর্তী পরিস্থিতিতে অনেকে কর্মহীন হয়ে পড়েছে, যার প্রভাব সবচেয়ে বেশি পড়েছে শ্রমজীবী মানুষের ওপর। বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচি জানিয়েছে, গত ফেব্রুয়ারি মাসে বিশ্বে খাদ্যপণ্যের দাম তিন বছরের মধ্যে সর্বনিম্ন স্তরে ছিল। যদিও একই সময়ে নিত্যপণ্যের দাম নিয়ে প্রায় দিশেহারা ছিল বাংলাদেশের মানুষ। কারণ, এখানে গত তিন বছরে চাল, ডাল, ভোজ্যতেল, আলু, চিনিসহ কয়েকটি পণ্যের দাম ন্যূনতম ১৪ থেকে সর্বোচ্চ ১৪০ শতাংশ পর্যন্ত বেড়েছে। এই বাড়ার চিত্র খোদ সরকারি হিসাবে। বাস্তবে তা আরও বেশি।সম্প্রতি এফএও তাদের মাসিক ‘ফুড প্রাইস ইনডেক্স’ বা খাদ্যপণ্যের মূল্যসূচক প্রকাশ করেছে। সেই সূচকে দেখা যায়, গত ফেব্রুয়ারিতে তিন বছরের মধ্যে সর্বনিম্ন স্তরে থাকা খাদ্যপণ্যের মূল্য মার্চ মাসে এসে সামান্য বৃদ্ধি পেয়েছে।ফেব্রুয়ারি মাসে খাদ্য মূল্যসূচক ছিল১১৭পয়েন্ট(১০০ পয়েন্ট হচ্ছেভিত্তি)। আর মার্চ মাসেতা সামান্য বেড়ে হয়েছে ১১৮ পয়েন্ট। ফেব্রুয়ারির খাদ্য মূল্যসূচক ১১৭ পয়েন্টে পৌঁছানোর আগে ২০২১ সালে ফেব্রুয়ারিতে খাদ্য মূল্যসূচক এই স্তরে ছিল। এফএও বলছে, মার্চ মাসে যে বিশ্ববাজারে খাদ্য মূল্যসূচক সামান্য বৃদ্ধি পেয়েছে, এটা মূলত ভোজ্যতেলের বাড়তি চাহিদার কারণেই হয়েছে। তবে এখনো বিশ্ববাজারে বেশির ভাগ পণ্যের দাম কমতির দিকে বলে জানিয়েছে সংস্থাটি।

গণঅভ্যুত্থানে শেখ হাসিনার পতনের পর বাজারে সব ধরনের সবজির দর তিন ভাগের এক ভাগে নেমে এসেছিল। স্বস্তিদায়ক সেই পরিস্থিতি মাসখানেকের মতো ছিল। এর পর থেকেই পুরোনো চেহারায় ফিরেছে সবজির বাজার। সরকারের সংশ্লিষ্টদের দাবি, দাম বাড়ার মূল কারণ টানা বৃষ্টি। তবে প্রতিদিনই বাজার তদারকি হচ্ছে। আমদানির অনুমতি, শুল্ক কমানোসহ কিছু ইতিবাচক উদ্যোগে ইতোমধ্যে কয়েকটি পণ্যের দর কমতে শুরু করেছে। ঢাকায় অনেক সবজির সেঞ্চুরি । বাংলাদেশ পাইকারি কাঁচামাল আড়ত মালিক সমিতির সভাপতি বলেন, এ বছর ঘন ঘন বৃষ্টি হচ্ছে। কোথাও বৃষ্টির পরিমাণ অস্বাভাবিক। তাতে সবজি ক্ষেত ডুবে গেছে। উঁচু এলাকায় না ডুবলেও গাছের গোড়ায় পানি জমে গাছ পচে যাচ্ছে। তিনি বলেন, বছরের এ সময় শীতের কিছু সবজি আগাম বাজারে আসে। যেমন– ফুলকপি, বাঁধাকপি ও শিম। এসব সবজি উত্তরবঙ্গ, নোয়াখালী, কুমিল্লা, কুষ্টিয়া ও খুলনা অঞ্চলে বেশি হয়। কিন্তু সেসব এলাকায় পানির কারণে বীজ লাগানো যাচ্ছে না। সার্বিকভাবে সবজির সরবরাহ কমছে। তাছাড়া এ সময় শ্রমিকদের মজুরিও বেশি দিতে হয়। সেজন্য উৎপাদন এলাকায় কৃষকরাও এখন তুলনামূলক দাম বেশি নিচ্ছেন। বগুড়ার মহাস্থানহাটের পাইকাররা ঢাকাসহ বিভিন্ন জেলায় প্রতিদিন ২৫-৩০ ট্রাক সবজি নিয়ে গেলেও উৎপাদন কম থাকায় এখন পাঁচ-ছয় ট্রাকের বেশি নিতে পারেন না। এখানকার পাইকারি ব্যবসায়ী বলেন, প্রতিদিন কমপক্ষে তিন ট্রাক সবজি নিয়ে যান ঢাকা কারওয়ান বাজারে। এখন মাত্র এক ট্রাক নিচ্ছেন। বগুড়া সদরের শেখেরকোলা এলাকার সবজি চাষি বলেন, তিনি পটোল ও বেগুন চাষাবাদ করেন দুই বিঘা জমিতে। লাগাতার বৃষ্টিতে সবজি গাছের ফুল পচে গেছে, তাতে উৎপাদন কমে গেছে। এখন যা উৎপাদন হচ্ছে, তা দিয়ে খরচ উঠছে না।তবে আমদানির উদ্যোগ ও শুল্ক কমানোর খবরে গত তিন দিনে ডিমের ডজনে ২০ টাকার মতো কমে বিক্রি হচ্ছে ১৫৫ থেকে ১৬০ টাকায়। যদিও পাড়া-মহল্লায় কোনো কোনো ব্যবসায়ী এর চেয়েও বেশি দর নিচ্ছেন। ব্রয়লার মুরগির দর কমেনি। এখনও ব্রয়লারের কেজি বিক্রি হচ্ছে ১৮০-২০০ টাকা দরে। তবে অপরিবর্তিত সোনালি জাতের মুরগি। প্রতি কেজি বিক্রি হচ্ছে ২৬০ থেকে ২৭০ টাকায়। মাস দেড়েক আগে ডিমের ডজন ১৪০ থেকে ১৪৫ এবং ব্রয়লারের কেজি ছিল ১৫০ থেকে ১৬০ টাকা। তবে স্বস্তির খবর আছে গরুর মাংসের বাজারে। প্রতি কেজি বিক্রি হচ্ছে ৭০০ থেকে ৭৩০ টাকা দরে। দুই মাস আগে মাংসের কেজি ৭৫০ টাকার বেশি ছিল। দুই মাসের বেশি সময় ধরে চালের বাজার বাড়তি। বিআর-২৮ ও পায়জাম জাতের বা মাঝারি আকারের চালের কেজি খুচরায় বিক্রি হচ্ছে ৫৮ থেকে ৬৪ টাকায়। মোটা চালের (গুটি স্বর্ণা ও চায়না ইরি) কেজি বিক্রি হচ্ছে ৫০ থেকে ৫৫ টাকায়। এ ছাড়া চিকন চাল (মিনিকেট) বিক্রি হচ্ছে কেজি ৭০ থেকে ৭৫ টাকা দরে। দুই মাস আগে প্রতি কেজি মোটা চাল ৪৮ থেকে ৫০, মাঝারি চাল ৫৪ থেকে ৫৮ এবং চিকন চাল ৬৮ থেকে ৭০ টাকায় বিক্রি হয়েছে।

তবে এর মধ্যেও আশাবাদী অর্থনীতিবিদদের অনেকে। তাদের ভাষ্যমতে, সাম্প্রতিক বন্যার প্রকোপ কমে আসার পাশাপাশি বাজার নিয়ন্ত্রণে এলে খাদ্যনিরাপত্তাহীনতা কমে আসবে বলে প্রত্যাশা তাদের। অর্থনীতিবিদ ও ইকোনমিক রিসার্চ গ্রুপের (ইআরজি) পরিচালক বলেন, ‘খাদ্যনিরাপত্তাহীনতা বেড়ে যাওয়ার কারণ হলো সাম্প্রতিক বন্যা ও নিত্যপণ্যের মূল্যবৃদ্ধি। তবে আশা করছি আগামী মাস থেকে হয়তো তা কমে আসবে। কারণ নভেম্বরে আমাদের দেশে ধান কাটা হয়। নতুন ধান বাজারে এলে পরিস্থিতির হয়তো উন্নতি ঘটবে।’ জরিপে দেখা যায়, খাদ্য কেনার জন্য ঋণ করতে হচ্ছে ৪২ শতাংশ মানুষকে। আর খাদ্য ব্যয় মেটাতে গিয়ে স্বাস্থ্য ব্যয় কাটছাঁট করছে ২৬ শতাংশ। ১৭ শতাংশ বাধ্য হচ্ছে সঞ্চয় ভাঙতে। আর নানা ধরনের সহায়তার ওপর নির্ভর করতে হচ্ছে ১৫ শতাংশ মানুষকে। সার্বিক বিষয়ে খাদ্য মন্ত্রণালয়ের নতুন সচিব বলেন, ‘নিত্যপণ্যের দাম নিয়ন্ত্রণে টিসিবির মাধ্যমে ১ কোটি পরিবার এবং ওএমএসের মাধ্যমে ৫০ হাজার পরিবারের মধ্যে সুলভ মূল্যে চাল ও আটা বিক্রি করা হচ্ছে। জেলায় জেলায় নতুন নীতিমালার আলোকে ওএমএস ডিলার নিয়োগ করা হচ্ছে। নতুনভাবে ডিলার নিয়োগ দিয়ে প্রান্তিক পর্যায়ে জনগণের চাল ও আটার প্রাপ্তি নিশ্চিত করার জোর প্রচেষ্টা চালানো হচ্ছে।’ দাম নাগালে রাখতে বাণিজ্য মন্ত্রণালয় ও ভোক্তা অধিদপ্তরের একাধিক টিম বাজার তদারকি করেছ। বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের উপসচিব ব্যবসায়ীদের উদ্দেশে বলেন, পণ্যের ক্রয় রসিদ রাখতে হবে। অযৌক্তিক দরে বিক্রি করলে জরিমানা করা হবে। এ সময় তিনি বলেন, গত কয়েক দিনের তুলনায় ডিম, পেঁয়াজ ও আলুর দাম কিছুটা কমেছে। আরও কমে আসবে।সারাদেশে নিত্যপণ্যের বাজারে অভিযান চালিয়ে ভোক্তা অধিদপ্তর ৩৯টি প্রতিষ্ঠানকে বিভিন্ন অপরাধের দায়ে ৩ লাখ ১৩ হাজার টাকা জরিমানা করেছে।এখন দেখা যাক পরিস্থিতি উন্নতি হলে সাধারন ভোক্তার মনে কিছুটা হলেও স্বর্তি ফিরে আসবে এই প্রত্যাশা রইল।

লেখক: গবেষক ও অধ্যাপক

সারাবাংলা/এসবিডিই

ড. মিহির কুমার রায় ডব্লিউএফপি প্রতিবেদন: খাদ্যনিরাপত্তা আতঙ্কে প্রান্তিক জনগন মুক্তমত

বিজ্ঞাপন

আরো

সম্পর্কিত খবর