শিক্ষকতা শুধু পেশা নয়, একটি ব্রত, একটি আদর্শ
১৫ অক্টোবর ২০২৪ ১৭:১৭
শিক্ষা জাতির মেরুদন্ড এবং শিক্ষক হলেন জাতির স্নায়ুতন্ত্র যার মধ্য দিয়ে সবসময় জ্ঞানের নতুন ধারা প্রবাহিত হয়ে সৃষ্টি করে বিশ্ব সভ্যতা। শিক্ষক শব্দটির মূল অর্থ শেখানো বা শিখানো। একজন শিক্ষকের স্বপ্ন থাকে তার শিক্ষার্থীরা জ্ঞান, বিজ্ঞান এবং শিক্ষায় তাকে একদিন অতিত্রম করবে এবং মানবিক মূল্যবোধ সমন্বিত আদর্শ মানবে পরিণত হবে। মায়ের সেবা অর্থমূল্যে যেমন বিবেচনা করার সুযোগ নাই তেমনি শিক্ষকের শিক্ষাদানও অর্থমূল্যে পরিশোধের অবকাশ নাই। তবে এ মহৎ কর্মের জন্য শিক্ষার্থী ও সমাজের নিকট শিক্ষকের প্রাপ্য সম্মান প্রত্যাশিত। ১৯৬৬ সালের ৫ অক্টোবর ফ্রান্সের প্যারিসে শিক্ষকদের অবস্থা নিয়ে আন্ত:সরকার সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। ১৯৯৪ সালে জাতিসংঘের অঙ্গ সংস্থা ইউনেস্কোর ২৬তম অধিবেশনে গৃহীত সিদ্ধান্তের ভিত্তিতে ৫ অক্টোবর ‘বিশ্ব শিক্ষক দিবস’ হিসেবে পালনের ঘোষণা দেওয়া হয়। ১৯৯৫ সাল থেকে বাংলাদেশসহ পৃথিবীর অনেক দেশেই প্রতি বছরের ৫ অক্টোবর যথাযোগ্য মর্যাদায় বিশ্ব শিক্ষক দিবস পালিত হয়ে আসছে।
শিক্ষকতা শুধুমাত্র একটি পেশা নয়, একটি ব্রত, একটি আদর্শ, একটি নৈতিকতার মানদন্ড। প্রাণিত্বকে মনুষ্যত্বে পরিণত করার কাজটি সহজ না সত্ত্বেও শিক্ষককেই সেই কঠিন কাজটিকে সহজ ভেবে করতে হয়। বাট্রান্ড রাসেলের মতে ‘শিক্ষকের কাজ দুইটি- ১. শিক্ষার্থীদের পাঠের প্রতি আগ্রহী করে তোলা। ২. সেই আগ্রহ নিবৃত করা। শিক্ষা মানুষকে চক্ষুষ্মান করে, শিক্ষায় মানুষের মধ্যে ঘুমিয়ে থাকা শক্তি সুপ্ত অবস্থা থেকে জেগে ওঠে। শিক্ষা মানুষের দায়িত্ববোধ জাগ্রত করে, তার অধিকার ও কর্তব্য সম্পর্কে সজাগ, সবাক, সকর্ম করে তোলে। মানবসম্পদ উন্নয়নে শিক্ষার যেমন বিকল্প নেই, জাতীয় জীবনমানের সার্বিক উন্নয়নে শিক্ষায় বিনিয়োগেরও তাই কোনো বিকল্প নেই। কৃষির উন্নয়ন যেমন কৃষকের সার্বিক প্রচেষ্টার ফল তেমনি শিক্ষার উন্নয়ন থেকে বিনিয়োগ সবকিছুরই সাফল্য শিক্ষকের মানসম্মত শিক্ষাদান ও পরিশ্রমের ফল। একটি লাটিম যেমন মাটির উপরে বিন্দুমাত্র চিহ্ন রচনা করিয়া সুচ্যগ্র পরিমাণ ভূমির মধ্যেই তীব্র বেগে ঘুরে তেমন আর্থিক দৈন্যে যদি শিক্ষকের জীবন যাত্রা ঘুরপাক খায় তাহলে শিক্ষায় বিনিয়োগ ফলপ্রসু হবে না। সেজন্য শিক্ষকদের প্রতিও সমাজ ও রাষ্ট্রের দায়িত্ব রয়েছে।
শিক্ষকের মর্যাদা সম্পর্কে মহান আল্লাহ্তায়ালা সুরা আহজাবের ভেতরে বর্ণনা করেছেন যে, সব মানবজাতির জন্য তিনি তার প্রত্যেক নবী ও রাসুলকে শিক্ষক হিসেবে প্রেরণ করেছেন এবং তাদের ভেতরেই উত্তম আদর্শ রেখে দিয়েছেন। প্রথম নবী হজরত আদম (আ.) থেকে শুরু করে হজরত মুহাম্মদ (সা.) পর্যন্ত সব নবীই ছিলেন শিক্ষার আলোয় আলোকিত এবং সু-শিক্ষার ধারক বাহক ও মহান শিক্ষক। মুহাম্মদ (সা.) ছিলেন সে ধারার সর্বশেষ ও সর্বোত্তম শিক্ষক।তার অনুসারীদের শিক্ষাদানের ক্ষেত্রে তিনি কখনো কঠোরতা করেননি, কখনো প্রহার করেননি, কখনো গালমন্দ করেননি। কোলাহলপূর্ণ বিশৃঙ্খল পরিবেশ শিক্ষার বিষয় ও শিক্ষক উভয়ের গুরুত্ব কমিয়ে দেয়। রাসূলুল্লাহ (সা.) শিক্ষাদানের জন্য উপযুক্ত পরিবেশের অপেক্ষা করতেন।
কানাডার কুইন্স বিশ্ববিদ্যালয়ের এক গবেষকের গবেষণায় ষোড়শ শতকে জন্ম নেয়া এবং একবিংশ শতকে টিকে থাকা ৩৩টি প্রতিষ্ঠানের মধ্যে ২৯টিই হচ্ছে বিশ্ববিদ্যালয়, ২টি চার্চ, ১টি পার্লামেন্ট আর শুধু ১টি বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান। ব্যাখ্যার অপেক্ষা রাখে না, কেন জ্ঞান বিতরণকারী প্রতিষ্ঠানগুলো শতাব্দী পরম্পরায় টিকে থাকে, কেন মুনাফাধর্মী প্রতিষ্ঠানগুলো নয়। কারণটা হয়তো বিতরণে জ্ঞান বাড়ে, অর্থ কমে। নিরবচ্ছিন্ন জ্ঞানচর্চা জ্ঞানের পরিধিকে সম্প্রসারণ করে; মানবতাকে, সভ্যতাকে এগিয়ে নিয়ে যায়। শিক্ষক সমাজে জ্ঞান ও মহৎ চিন্তার বীজ বপন করেন। শিক্ষা’ হচ্ছে এমন একটি সম্পদ যার মালিকানা, মালিকের শরীর থেকে বিচ্ছিন্ন করা যায় না। কিন্তু শিক্ষক এটি নি:শর্তে শিক্ষার্থীদের মগজে ও মননে প্রবেশ করানোর শত কৌশল প্রয়োগ করেন।
ভারকি ফাউন্ডেশনের ‘গ্লোবাল টিসার্চ স্ট্যাটাস ইনডেক্সে-২০১৮’ শীর্ষক ওই প্রতিবেদনে বলা হয় বিশ্বে গড়ে ৩৬ শতাংশ ছাত্রছাত্রী তাদের গুরুজনকে সম্মান করেন। বিশ্বের মধ্যে এশিয়ার দেশগুলোতে শিক্ষকতা পেশা সামাজিক অবস্থান ও মর্যাদার দিক থেকে শীর্ষে রয়েছে। চীনে এই পেশা সবচেয়ে বেশি মর্যাদার। চীনের শিক্ষক-শিক্ষার্থীর এই সম্পর্ক জ্ঞান, বিজ্ঞান ও অর্থনৈতিক সমৃদ্ধিতে সহায়তা করেছে।
রবীন্দ্রনাথের মতে, ‘বিদ্যা যে দেবে এবং বিদ্যা যে নেবে তাদের উভয়ের মাঝখানে যে সেতু, সেই সেতুটি হচ্ছে ভক্তিস্নেহের সমন্ধ। সেই সম্বন্ধ না থেকে যদি কেবল শুস্ক কর্তব্য বা ব্যবসায়ের সম্বন্ধই থাকে তা হলে যারা পায় তারা হতভাগ্য, যারা দেয় তারা ও হতভাগ্য। আনন্দের সাথে শেখাতে পারলে শিখন শক্তিও বেড়ে যায়। ফলে গ্রহণ শক্তি, ধারণা শক্তি ও চিন্তা শক্তি সহজ ও স্বাভাবিক নিয়মেই বৃদ্ধিপ্রাপ্ত হয়। ঈশ্বর চন্দ্র বিদ্যাসাগরের মাতা বলেছেন অনাহারীকে অন্নদান পূজা অপেক্ষা শ্রেয়। তেমনি জ্ঞানহীন মানুষকে শিক্ষকের জ্ঞানদান সর্বোত্তম প্রার্থনা। শিক্ষক সম্প্রদায়ের মহান প্রচেষ্টায় বিভেদের মাঝে ঐক্য, নানা পথের একটি মিলন স্থল এবং বহুমতের সমন্বয়ে একটি পথের সৃষ্টি হয়। এভাবে শিক্ষক মানব সমাজের সকল সদস্যকে এক সুতোয় গেথে বিশ্ব ভ্রাতৃত্ব, সাম্য ও মৌত্রীর বন্ধন সৃষ্টি করে।
বর্তমানে বাংলাদেশের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানসমূহে প্রায় পাঁচ কোটি শিক্ষার্থী অধ্যয়ন করছে এবং সব মিলিয়ে শিক্ষকের সংখ্যা প্রায় ১৪ লাখ। এই ১৪ লাখ শিক্ষকের মধ্যে সিংহভাগ শিক্ষক বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের। শিক্ষক-শিক্ষার্থী ভক্তি স্নেহের সম্পর্ক চিরজাগ্রত রাখতে এই সিংহভাগ শিক্ষকের বেতন ভাতা সহ অন্যান্য সুযোগ সুবিধা অন্যান্য সরকারি কর্মচারিদের সাখে সমতা আনয়ন জরুরী। The Transformation of Education Begins with Teachers’ শিক্ষকদের পরিবর্তনের সঙ্গেই শিক্ষার পরিবর্তন হয়। অত্রএব শিক্ষকদের জীবনযাত্রার মান উন্নত হলে শিক্ষার মান যে আরো উন্নত হবে তাতে কোন সন্দেহ নেই। অর্থাৎ শিক্ষকের পরিবর্তন হলেই শিক্ষার্থীর পরিবর্তন হয় আর তখনই শিক্ষার পরিবর্তন ঘটে। শিক্ষক-শিক্ষার্থীর পারস্পরিক শ্রদ্ধা, বিশ্বাস, সমর্থন এবং যোগাযোগ একটি সহায়ক এবং উদ্দীপক শিক্ষার পরিবেশ প্রদান করে। তাদের পারস্পরিক ইতিবাচক সম্পর্ক, শ্রদ্ধা, বিশ্বাস এবং নিবিড় যোগাযোগ, মাতৃ পরিচর্যা শিক্ষার উচ্চ প্রত্যাশার সৃষ্টি করে যা টেকসই সম্পর্ক ও শিক্ষার পরিবেশ সৃষ্টিতে সহায়ক। এ ধরণের সম্পর্ক শিক্ষা বিস্তারের যে কোন চ্যালেজ্ঞ অতিক্রম করে সূষ্ঠু একাডেমিক পরিবেশ সৃষ্টি করে।
হঠাৎ স্ফুলিঙ্গ অন্ধকার রাতের অন্ধকার দূরীভূত করতে পারে না। বরং অতিরিক্ত আলোর ঝলকানিতে পথচারীর দৃষ্টি ক্ষীণ হবার সম্ভাবনা দেখা দেয়। অন্ধকার দূর করতে প্রয়োজন প্রদীপ আর সেই প্রদীপ জ্বালাতে সলতে পাকাতে হয় এবং জ্বালানী তেল ব্যবহার করতে হয়। তেমনি সমাজকে আলোকিত করতে প্রয়োজন হয় শিক্ষক নামক প্রদীপের। এই প্রদীপকে আলোময় রাখতে সমাজের অন্যান্য মানুষের যেমন মৌলিক চাহিদাগুলো পূরণের সুযোগ রয়েছে তেমনি শিক্ষক সমাজেরও ব্যক্তি, পারিবারিক ও সামজিক চাহিদা পূরণের প্রয়োজন রয়েছে। সমাজে বসবাসরত অন্যান্য নাগরিকের জীবন যাত্রা যখন উন্নত হয়, চাকরিজীবি অন্য প্রতিবেশির সন্তান যখন ভালো স্কুলে পড়াশোনা করে, তার পরিবারের আপন ভাই যখন অন্য সরকারি চাকুরি করে উন্নত জীবন যাপন করে তখন একজন শিক্ষককেও তার স্ত্রী, সন্তান কিংবা পিতা-মাতার জন্য অনুরুপ সুযোগ সুবিধা নিশ্চিত করতে হয়। কিন্তু তিনি যখন সেটি পারেন না তখন তাকে পারিবারিকভাবে, সামাজিকভাবে এবং ব্যক্তিগতভাবে ছোট হতে হয়। এ অবস্থা থেকে পরিত্রাণের জন্য শিক্ষক সমাজ দীর্ঘদিন ধরে সমাজ ও সরকারের নিকট আবেদন ও দাবি জানিয়ে আসছে।
এ মহান পেশায় স্কুল, কলেজ, ইউনিভার্সিটি কিংবা মাদরাসার শিক্ষক, সরকারি-বেসরকারি এরুপ সাইকোলজিক্যাল বিভাজন কাম্য নয়। গরজে পড়ে কাউকে ভাই হিসেবে ডাকার চেয়ে দরদে কাউকে ভাই হিসেবে ডাকলে অভূতপূর্ব সাড়া পাওয়া যাবে সার্বক্ষনিক। প্রয়োজন সার্বক্ষনিক ভ্রাতৃত্বপুর্ণ আচরণ বা সম্পর্ক। যে কোনো বিভক্তির বিষ শুধু শিক্ষক সমাজকে নয় সমগ্র জাতিকে ধ্বংস করে দেয়। যে চেতনা বা বুদ্ধি সকলকে সংযুক্ত করে সেটাই হলো শুভ বুদ্ধি। আমাদের সকল শিক্ষকের মাঝে সেই শুভ বুদ্ধির উদয় হোক।
লেখক: অধ্যক্ষ, কুড়িগ্রাম সরকারি কলেজ
সারাবাংলা/এসবিডিই
প্রফেসর মীর্জা মো. নাসির উদ্দিন মুক্তমত শিক্ষকতা শুধুমাত্র একটি পেশা নয় একটি ব্রত একটি আদর্শ