ক্যাম্পাসে ছাত্র রাজনীতি: সুযোগ না সংকট
১৯ অক্টোবর ২০২৪ ১৬:০৩
ছাত্র রাজনীতি দেশের উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোর পুরোনো এক ঐতিহ্য। এটি ছাত্রদের মধ্যে রাজনৈতিক সচেতনতা এবং সামাজিক উন্নয়নে ভূমিকা রাখার সুযোগ তৈরি করতে পারে। আজকের এই যুগে, বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে ছাত্র রাজনীতির প্রাসঙ্গিকতা নিয়ে বিতর্ক তুঙ্গে। একদিকে একে শিক্ষার্থীদের নেতৃত্ব গুণাবলি বিকশিত করার মঞ্চ হিসেবে দেখা হয়, অন্যদিকে সহিংসতা ও বিশৃঙ্খলার কারণ হিসেবেও দায়ী করা হয়। তাহলে ক্যাম্পাসে ছাত্র রাজনীতির প্রকৃত চিত্র কী? এতে লাভবান কারা, ক্ষতিগ্রস্ত কারা?
ছাত্র রাজনীতির মূল উদ্দেশ্য হলো তরুণদের মধ্যে নেতৃত্বের গুণাবলী তৈরি করা, সমাজ সচেতনতা বৃদ্ধি করা এবং জাতীয় সমস্যাগুলোর সমাধানে ভূমিকা রাখা। কিন্তু বর্তমানে দেখা যাচ্ছে, ক্যাম্পাসে ছাত্র রাজনীতি সেই উদ্দেশ্য থেকে সরে গিয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে। ছাত্ররা ক্ষমতার অপব্যবহার করছে, যা প্রকৃত রাজনীতি চর্চার ধারণার বিপরীত। ক্যাম্পাসে ছাত্র রাজনীতির মাধ্যমে সবচেয়ে বেশি লাভবান হচ্ছে রাজনৈতিক দলগুলো। তারা ছাত্রদের ব্যবহার করে নিজেদের স্বার্থ সিদ্ধি করছে। অনেক সময় দেখা যায়, ছাত্ররা নৈতিক ও অনৈতিক কাজের সঙ্গে জড়িয়ে পড়ছে, যেগুলো রাজনৈতিক দলগুলোর নির্দেশে হচ্ছে। অথবা তারা রাজনৈতিক দলের ট্যাগ ব্যবহার করে ক্ষমতার বড়াই দেখাচ্ছে।এতে ছাত্রদের মধ্যে প্রকৃত রাজনীতি চর্চার কোনো সুযোগ থাকছে না। বরং তারা রাজনৈতিক দলের নির্দেশ পালনেই ব্যস্ত থাকে, যা ছাত্রদের ভবিষ্যৎ এবং তাদের নৈতিক মূল্যবোধের ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলে। ছাত্র রাজনীতি এখন ক্ষমতার অপব্যবহারে রূপান্তরিত হয়েছে। ছাত্ররা নিজেদের রাজনৈতিক শক্তি প্রদর্শন করে অন্যদের চুপ করিয়ে দিতে বেশি আগ্রহী। তারা অন্য দলের সমালোচনাও সঠিকভাবে করতে পারে না, কারণ তারা দলীয় আনুগত্যের কারণে স্বাধীন মত প্রকাশের সাহস পায় না। ফলে প্রকৃত রাজনৈতিক আলোচনা বা মত বিনিময় সঠিকভাবে হতে পারে না।
রাজনৈতিক নেতা যে হারে বাড়ছে, সে হারে রাজনীতি চর্চা হয় না। রাজনীতি বলতে তারা বোঝে পাওয়ার যা বলায় বাহুল্য বাংলা অনুবাদ করলে এর আক্ষরিক অর্থ হয় ক্ষমতা। মিশেল ফুকোর একটা দর্শন আছে যেটা মিশেল ফুকোর ক্ষমতা তত্ত্ব নামে পরিচিত।এই দর্শনটা আমাকে এখনো ভাবায়। আমি প্রথম মিশেল ফুকো সম্পর্কে জানতে পারি প্রফেসর মানস চৌধুরী এক বক্তব্যে। সেখানে তিনি খুব সুন্দর করে ব্যাখ্যা করেছিলেন তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না। আর যখন আমি এটা নিয়ে পড়তে বসলাম ফুকোর বক্তব্য অনুযায়ী, ‘সবকিছু থেকে ক্ষমতা আসে, এবং সবকিছুর ওপর ক্ষমতা প্রয়োগ করা হয়।’ ‘ক্ষমতা অস্ত্রের মতো, একে কেবল ধারণ করা যায় এবং প্রয়োগ করা যায়’- এই মতের বিরোধিতাও করেছেন তিনি। তার মতে, এটি ক্ষমতা নয়, বরং ক্ষমতা চর্চা করার সক্ষমতা। কোনো পদক্ষেপ না নেওয়া পর্যন্ত তা ক্ষমতা হিসেবে গণ্য হবে না। অর্থাৎ, ক্ষমতা হচ্ছে এমন এক জিনিস যা কেউ ধারণ করতে পারে না, বরং ক্ষমতা হচ্ছে এমন কিছু যার সাহায্যে ভিন্ন ব্যক্তির ওপর কোনো কিছু করা হয়, এমন কিছু যা অন্যের কাজকে প্রভাবিত করতে সক্ষম। কিন্তু ক্ষমতার এই তলদেশে আর একটা শব্দ লুকিয়ে আছে তা হচ্ছে জ্ঞান এই প্রসঙ্গে আরো স্পষ্ট ভাবে বলতে গেলে ম্যাক্স ওয়েবারও ‘সমাজে আমলাতান্ত্রিকতা যত বাড়বে, জ্ঞানও তত ক্ষমতা হিসেবে ব্যবহৃত হবে’ বলে মত দিয়েছেন। বর্তমানে রাজনীতি অবস্থা বলে ক্ষমতা তত্ত্ব অনুযায়ী আমাদের উপর কোন আমলা কিন্তু বল প্রয়োগের মাধ্যমে কোন কিছু চাপিয়ে দিচ্ছে না কেবল তার ক্ষমতা বলে সে যা নির্ধারণ করে দিচ্ছে তা আমরা মেনে নিচ্ছি এবং মেনে নিতে বাধ্য এছাড়া না মেনেও উপায় নেই। শুধু তাই নয় আমরা আমাদের সমাজ পরিবার সব ক্ষেত্রেই ক্ষমতা প্রভাব দ্বারা আবদ্ধ এবং একটা শৃঙ্খলায় বাধা।
যাইহোক ক্ষমতা প্রসঙ্গ রেখে এখন আবার ফিরে আসি ছাত্র রাজনীতিতে।ছাত্র রাজনীতির নামে ক্যাম্পাসে যে কার্যক্রম চলছে, তা কতটুকু প্রকৃত রাজনীতি চর্চা তা নিয়ে সন্দেহ থেকেই যায়। অধিকাংশ ছাত্রই মূলত নিজেদের রাজনৈতিক দলীয় পরিচয়ের পরিচর্যা এবং ক্ষমতা প্রদর্শনের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকে। এতে সমাজ এবং দেশের কল্যাণে সত্যিকার অর্থে কোনো অবদান রাখতে পারছে না তারা।
ক্যাম্পাসে ছাত্র রাজনীতির প্রয়োজনীয়তা এবং তা কতটুকু ফলপ্রসূত, এ প্রশ্নগুলো আজ সময়োপযোগী। ছাত্র রাজনীতি তখনই অর্থবহ হয়, যখন এটি তরুণদের মধ্যে স্বাধীন চিন্তা ও নেতৃত্বের বিকাশ ঘটায়। তবে বর্তমান প্রেক্ষাপটে দেখা যাচ্ছে, ছাত্র রাজনীতি মূলত রাজনৈতিক দলগুলোর হাতিয়ার হয়ে পড়েছে, যেখানে প্রকৃত রাজনীতি চর্চা পিছিয়ে পড়ছে। তাই ক্যাম্পাসে ছাত্র রাজনীতির ভূমিকা নিয়ে নতুন করে ভাবার সময় এসেছে।
ছাত্র রাজনীতি কেনো দরকার এই প্রসঙ্গে কিছু যুক্তি দেওয়া যেতে পারে যেমন ছাত্র রাজনীতি ছাত্রদের নেতৃত্ব গুণাবলি বিকাশে এবং শিক্ষার্থীদের নেতৃত্ব, সংগঠন ও যোগাযোগের দক্ষতা বিকাশ করতে সাহায্য করে। এছাড়া, সামাজিক সমস্যা সমাধান ছাত্ররা ক্যাম্পাসের বিভিন্ন সমস্যা সমাধানে সক্রিয় ভূমিকা রাখতে পারে। সচেতনতা সৃষ্টি বিভিন্ন সামাজিক ও রাজনৈতিক ইস্যুতে শিক্ষার্থীদের মধ্যে সচেতনতা সৃষ্টি করতে সাহায্য করে।
কিন্তু ছাত্র রাজনীতির সংকট শিক্ষার ব্যাঘাত অনেক সময় ছাত্র রাজনীতি শিক্ষার পরিবেশকে প্রভাবিত করে এবং শিক্ষার্থীদের পড়াশোনা ব্যাহত হয়। সহিংসতা ও বিশৃঙ্খলা ছাত্র রাজনীতির নামে অনেক সময় সহিংসতা ও বিশৃঙ্খলা দেখা যায়। এছাড়া রাজনৈতিক দলের হাতিয়ার হিসেবে ছাত্র রাজনীতিকে অনেক সময় রাজনৈতিক দলগুলি তাদের স্বার্থ হাসিলের জন্য ব্যবহার করে থাকে।
এখন যদি আমরা প্রশ্নপাতে দৃষ্টি রাখি লাভবান কারা? ছাত্র রাজনীতির মাধ্যমে রাজনৈতিক দলগুলি তাদের ভোটার ব্যাঙ্ক বাড়াবে এবং তরুণদের মধ্যে তাদের প্রভাব বিস্তার করতে পারে। কিছু ছাত্র ক্ষমতার লোভে কিছু ছাত্র রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়ে এবং ব্যক্তিগত স্বার্থ হাসিল করে।
ক্ষতিগ্রস্ত কারা? সাধারণ শিক্ষার্থীরা ।কারন ছাত্র রাজনীতির সহিংসতা ও বিশৃঙ্খলার শিকার হয়ে থাকে। শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ছাত্র রাজনীতির কারণে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের পরিবেশ নষ্ট হয় এবং শিক্ষার মান ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এর বাইরে দেশ ছাত্র রাজনীতির নেতিবাচক দিকগুলি দেশের উন্নয়নে বাধা সৃষ্টি করে।এর সমাধান কি? ছাত্র সংসদকে সুশাসনের মাধ্যমে পরিচালনা করতে হবে। ছাত্র সংসদ নির্বাচন নিরপেক্ষভাবে পরিচালনা করতে হবে। শিক্ষার্থীদের মধ্যে সচেতনতা সৃষ্টি করতে হবে যাতে তারা রাজনীতির নামে সহিংসতা ও বিশৃঙ্খলা না সৃষ্টি করে। রাজনৈতিক দলগুলিকে ছাত্র রাজনীতিকে ব্যক্তিগত স্বার্থ হাসিলের জন্য ব্যবহার করা বন্ধ করতে হবে।
ছাত্র রাজনীতি একটি শক্তিশালী হাতিয়ার হতে পারে। কিন্তু তা যদি সঠিকভাবে পরিচালিত না হয় তাহলে তা বিপর্যয় ডেকে আনতে পারে। তাই ছাত্র রাজনীতিকে সুশাসনের মাধ্যমে পরিচালনা করা এবং শিক্ষার্থীদের সচেতনতা সৃষ্টি করা জরুরি।
লেখক: শিক্ষার্থী, সরকারি ব্রজলাল কলেজ, খুলনা
সারাবাংলা/এসবিডিই