শৃংঙ্খলা ভঙ্গের দায়ে চাকরীচ্যুত: লঘু পাপে গুরুদণ্ড
২৭ অক্টোবর ২০২৪ ১৬:১২
চাকুরি নামক সোনার হরিণের পিছনে বাংলাদেশের বেশিরভাগই ২৫-৩০ বছর বয়সী উচ্চ শিক্ষিত তরুণরা ছুটে চলার অভিজ্ঞতা রয়েছে। এর মধ্যে অনেকেই সোনার হরিণের দেখা পায় নিজের মেধার জোরে কেউবা আবার মামা বা চাচার জোরে, কেউ আবার দলীয় ও রাজনৈতিক বিবেচনায়। মোটা দাগে বলতে গেলে স্বাধীনতা পরবর্তী থেকে বাংলাদেশের চাকুরির বাজারের অবস্থা মোটামোটি এমনই ছিলো। তবে এর মাঝেও বিভিন্ন সময় সরকারের কিছু স্বদিচ্ছার কারণে অনেক মেধাবীরা ও জায়গা করে নিয়েছে। সম্প্রতি একটি সংবাদ সবার দৃষ্টিগোচর হয়েছে, যেখানে ২৫২ জন পুলিশের প্রশিক্ষণরত উপ-পরিদর্শককে শৃঙ্খলা ভঙ্গের দায়ে ডিসচার্জ করা হয়েছে। তাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ নাস্তা গ্রহন না করে হৈচৈ করা ও ব্যারাকে অনুমতি ছাড়া প্রবেশ যা পুলিশের উর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের চোখে চরম অন্যায় ও চাকুরি হারানোর মত অপরাধ করে ফেলেছেন। তাই শাস্তিস্বরূপ তাদের চাকুরি কেড়ে নেয়া হয়েছে। প্রশিক্ষণার্থীদের মধ্য থেকে প্রায়ই প্রতি ব্যাচেই কয়েকজন প্রার্থী ছিটকে পড়েন। এর মধ্য শারীরিক অসুস্থতা, বিশৃঙ্খলা বা অন্যান্য কারণে তবে এ সংখ্যাটা কোন মতেই এবারের মত একযোগে এত বড় সংখ্যক নয়। এক যোগে এত জন প্রশিক্ষণার্থীকে ছুটিতে পাঠিয়ে পরে ডিসচার্জ হাতে ধরিয়ে দেয়ার পিছনেই কৌতূহলী মন অনেক কিছুই সন্দেহ করে বসে। গুঞ্জন আছে রাজনৈতিক কারণে তাদেরকে অব্যাহতি দেয়া হয়েছে, অব্যাহতি প্রাপ্ত বেশ কয়েকজনকে আবার কোন ধরনের বিশৃঙ্খলায় না জড়ানোর দাবি তুলতে ফেইসবুকে দেখা গেছে। এক বছর ব্যাপী এ প্রশিক্ষণের ৩৫২ তম দিনে এসে একযোগে ২৫২ জনকে ডিসচার্জ করা সত্যিই দুঃখজনক। তার আগে ঐ একই কারণে ৬২ জন সহকারী পুলিশ সুপারের প্যারেড ও আটকে গেলো, তাদের ভাগ্য কি আছে তা দেখার জন্য হয়তো আর কিছু দিন অপেক্ষা করতে হবে।
তার কিছু দিন পরেই ৫৯ জনকে প্রশিক্ষনরত এস আইকে নতুন করে শৃংঙ্খলা ভঙ্গের দায়ে কারণ দর্শানোর নোটিশ দেওয়া হয়। সম্প্রতি প্রকাশিত ৪৩ তম বিসিএস এর গেজেটে থেকে ৯০ জনরে অধিক বাদ পড়েছেন বলে গনমাধ্যমে খবর হয়েছে। যার মধ্যে কয়েকজন স্বাস্থ্য পরীক্ষা অংশগ্রহণ করেননি তবে কয়েকটি গণমাধ্যমের সংবাদে জানা যায় এর মধ্যে কমপক্ষে পঞ্চাশের অধিক কোন কারণ ছাড়াই বাদ পড়েছেন। ধারণা করা হয় এরা বেশিরভাগই আওয়ামী লীগ ও ছাত্রলীগের রাজনীতির সাথে জড়িত ছিলো।
সবার মধ্যেই রাজনৈতিক একটি সত্তা থাকে। তাইতো এরিস্টটল বলে গেছেন মানুষ মাত্রই রাজনৈতিক জীব। রাজনীতি থেকে কেউ বাইরে নয়। বিগত শাসনামলে যেমনি বিরোধী রাজনীতির কারণে বহু মেধাবী শিক্ষার্থীকে বাদ দেয়া হয়েছে ঠিক একই কারণে এখনো চাকুরি থেকে বাদ দেওয়া মোটেও উচিত নয়। এর মধ্যে যদি কেউ অপরাজনীতি অথবা কোন ফৌজদারি অপরাধের সাথে জড়িত থাকে তাহলে অবশ্যই তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া উচিত। তবে কেবল রাজনীতির জন্য একজন শিক্ষার্থীকে তার প্রাপ্য অধিকার থেকে বঞ্চিত করা উচিত নয়। যদি এইরকম প্রক্রিয়া চলতে থাকে, তাহলে নতুন কোন সরকার এসে তার নিজস্ব দলীয় লোক নিয়োগ দেয়ার ব্যাপারে তৎপর হয়ে উঠবে।ক্ষতিগ্রস্ত হবে শিক্ষার্থীরা। কারণ বিশ্ববিদ্যালয়ে অনেক শিক্ষার্থী, না জেনে বুঝে অথবা সামান্য সুযোগ সুবিধার লোভে ক্ষমতাসীন ছাত্র সংগঠনে যোগ দিয়ে থাকে। তবে এদের মধ্যে গুটি কয়েক দলীয় ক্যাডার হিসেবে কাজ করে থাকে।
এবার একটু পিছনে ফিরে যাই, অন্তর্র্বতীকালীন সরকার ক্ষমতা গ্রহনের পর যে কাজটায় সবচেয়ে বেশি বাহবাহ পেয়েছে তা হলো বি সি এসে গত ১৫ বছরে যাদের গেজেট রাজনৈতিক কারণে আটকে ছিলো তাদের গেজেট প্রকাশ করা। যাদের সাথে শুধু রাজনৈতিক কারণে বৈষম্য করা হয়েছে তাদের চাকুরি ফিরিয়ে দিয়ে তরুণদের মাঝে আশার সঞ্চার করেছে। ঠিক একযোগে নিছক কারণে এত সদস্যর চাকুরি হারানোয় আশাহত ও হতে হয়।
আমরা ডিবি হারুনের কথা সবাই জানি। সর্বপ্রথম ২০১২ সালে বি এন পি নেতা জয়নুল আবেদীন ফারুকে বেদম প্রহার করে আলোচনায় আসেন, যা ছিলো পুরোপুরি অপেশাদার সুলভ, কোন রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দকে এরকম বেদম প্রহার কোনভাবেই যুক্তিযুক্ত না। এ ঘটনায় সাবেক ডিবি প্রধান হারুনের শাস্তি হওয়া উচিত ছিলো, কিন্তু আমরা দেখলাম ভিন্ন চিত্র বরং তাকে রাষ্ট্র পুরুস্কৃত করেছে। এত কথা বলার পিছনে মূল কারণ হলো এই ডিবি হারুনকে এরকম অপেশাদার করে তুলেছে কে? রাজনৈতিক দলগুলোই। হারুনের এক সাক্ষাৎকার থেকে জানা যায় তাদের প্রশিক্ষন শেষে প্যারেডে সে সহ বেশ কয়েকজনকে আটকে দেয় তৎকালীন বি এন পি জামায়াত জোট সরকার। যার ফলশ্রুতিতে সে আওয়ামীলীগ প্রধান শেখ হাসিনার পরামর্শে হাইকোর্টে মামলা করে ও আওয়ামীলীগ ক্ষমতায় আসলে ক্ষতিপূরণসহ চাকুরিতে পূনর্বহাল করা হয়। যার ফলে জনগনের ট্যাক্সের টাকায় বেতন পাওয়া একজন পুলিশ সদস্য হয়ে উঠেন দলীয় লাঠিয়াল। এই পরিস্থিতির যদি পুনরাবৃত্তি হয় তাহলে আমরা নিঃসন্দেহ ২৫২ জন হারুনকে আবার ফিরে পাবো।
যে সরকারই যখন ক্ষমতায় যায় তাদের প্রথম ও প্রধান টার্গেট হয় দলীয় লোকদের রাষ্ট্রের বিভিন্ন জায়গায় নিয়োগ প্রদান করা। বিশেষ করে নিরাপওায় নিয়োজিত বাহীনিগুলোতে এ প্রবণতা বেশি। রাষ্ট্রীয় বাহিনীকে দলীয় বাহিনীতে রুপান্তর করার ফলাফল কখনোই ভালো হয় না। ক্ষমতা গ্রহনের পর সকল সরকারই মনে করে বাহিনীগুলোকে হাতে রাখতে পারলে বোধহয় আর ক্ষমতা হারাতে হবে না। তবে ইতিহাস বলে, রাষ্ট্রীয় বাহিনীকে দলীয় কাজে ব্যবহার করে কখনই ক্ষমতা পাকাপোক্ত করা যায় নি। হয়তো একটি রাজনৈতিক দল পাঁচ বছর বা দশ বছর শাসন করে চলে যায় কিন্তু একজন অযোগ্য লোক নিয়োগ দিলে এর বোঝা রাষ্ট্রকে ৩০-৩৫ বছর বহন করতে হয়।
তাহলে চূড়ান্ত ভাবে কি দাড়ালো? মেধাবীরা চাকুরি না পেয়ে দেশ ছাড়ছে আর অযোগ্যরা দখল করে আছে গুরুত্বপূর্ণ পদ, যারা জনগনকেও ভালোভাবে সেবা দিতে পারছে না আবার রাজনৈতিক দলগুলোর তোষামোদি করলেও তাদেরকে টিকিয়ে রাখতে পারছে না। মাঝে থেকে রাষ্ট্রের বড় ক্ষতি।
বড় রাজনৈতিক দলগুলোর যদি এই বোধদয় হয় যে, রাষ্ট্রকে যতই দলীয়করণ করা হউক ক্ষমতায় থাকতে হলে জনগনের ভোটেই ক্ষমতায় টিকে থাকা যায়, কোন দলীয় কর্মকর্তারা ক্ষমতায় টিকিয়ে রাখবে না। যদি রাজনৈতিক সরকার যোগ্য ও মেধাবীদের নিয়োগ করে তাহলে রাজনৈতিক দল যেমনি লাভবান হতো তেমনি জনগনও সঠিক সেবা পেতো। বৈষম্যহীন সমাজ গড়ে তুলতে হলে এই বৈষম্য গুলো দূর করতে হবে। দলীয় বিবেচনা উর্ধ্বে উঠে মেধা কে সর্বোচ্চ বিবেচনা করতে হবে। যা ২৪ এর আন্দোলনের অন্যতম দাবি ছিলো মেধার ভিত্তিতে নিয়োগ।
লেখক: প্রভাষক, লোকপ্রশাসন বিভাগ, বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়, রংপুর
সারাবাংলা/এসবিডিই
মুক্তমত শৃংঙ্খলা ভঙ্গের দায়ে চাকরীচ্যুত: লঘু পাপে গুরুদণ্ড সাইফুল ইসলাম