দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি: সংকটের কারণ ও সমাধান
২৭ অক্টোবর ২০২৪ ১৭:৪১
দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি ক্রমাগত বেড়ে চলেছে। এটি একটি সামাজিক ও অর্থনৈতিক সংকট যা সমাজের সর্বস্তরে প্রভাব ফেলে। বিশেষ করে নিম্ন আয়ের খেটে খাওয়া মানুষ জন। প্রতিটি মানুষের বেঁচে থাকার জন্য মৌলিক অধিকার অনস্বীকার্য। কিন্তু যখন খাদ্য, চিকিৎসা, শিক্ষা ও অন্যান্য দৈনন্দিন প্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের দাম বাড়তে থাকে, তখন সাধারণ মানুষের জীবনযাত্রা অনেক হুমকিস্বরূপ হয়ে যায়। সাধারণ মানুষের নুন আনতে পান্তা ফুরানোর মত অবস্থা সৃষ্টি হয়।বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল দেশে দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি মানুষের জীবনে প্রতিনিয়ত প্রভাব ফেলে। প্রতি মৌসুমে কিছু ব্যবসায়ী সিন্ডিকেট করে চোখের পলকে দ্রব্যমূল্যের দাম বৃদ্ধি করে। কিন্তু সেখানে কৃষক তার ন্যায্য মূল্য থেকে বঞ্চিত হয়। গণতান্ত্রিক দেশে পুঁজিবাদ সব কিছু নিয়ন্ত্রণ করে। আর এই পুঁজিবাদের কাছে একটি দেশের অসহায় ভূমিকা পালন করে। আইন কখনো সিন্ডিকেট হোতাদের মূল উদঘাটন করতে পারে না। আর খাদ্যদ্রব্য মানুষের বেঁচে থাকার জন্য অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ। তাই মানুষ বাধ্য হয়ে বেশি দাম দিয়ে দ্রব্যমূল্য কিনলেও চাহিদা অনুযায়ী কিনতে পারে না। বর্তমানে নিম্ন আয়ের মানুষ ডিম খাওয়া ছেড়ে দিয়েছে প্রায়। কিন্তু আমিষের মধ্যে ডিম সবচেয়ে সহজলভ্য ছিল।
দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির প্রধান কারণগুলোর মধ্যে অন্যতম হলো উৎপাদন ব্যয়ের বৃদ্ধি। জ্বালানি তেল, বিদ্যুৎ ও কাঁচামালের দাম বৃদ্ধির ফলে উৎপাদকদের খরচ বেড়ে যায় এবং পরবর্তীতে ভোক্তাদের উপর চাপিয়ে দেওয়া হয়। যেকোনো কারণে উৎপাদন ব্যয় বৃদ্ধি পেতে পারে। কিন্তু বাংলাদেশের সিন্ডিকেট ব্যবসায়ী এই সুযোগ কাজে লাগিয়ে কৃত্রিম সংকট তৈরি করে। তারা প্রকাশ করে বাজারে মালামালের উৎপাদন কম থাকায় দ্রব্যমূল্যের দাম বেড়ে গেছে। আর দ্রব্যমূল্যের ক্রমাগত উর্ধগতি তুলনা করলে আন্তর্জাতিক বাজার থেকে দেশে অনেক বেশি থাকে। ফলে সরকার প্রতি বছর বিদেশ থেকে পণ্য আমদানি করে কম দামে। এতে দেশের মুদ্রা বিদেশ চলে যায়। তাছাড়া আমদানি করার পরেও দ্রব্যমূল্যের দাম হ্রাস পায় না। তার কারণ আমদানিকৃত মালামাল সেই সিন্ডিকেট হোতাদের কাছেই যায়।আবার তারা রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ, সরবরাহ শৃঙ্খলের সমস্যার কথা জানায়। কিন্তু আমদানিকৃত মালামালের সাথে দ্রব্যমূল্যের ক্রমাগত উর্ধগতি জড়িত থাকতে পারে। সেখানে দেশীয় পণ্য কিভাবে আকাশচুম্বী দাম হয়?
কৃষি ও খাদ্য উৎপাদনে বিভিন্ন সমস্যার কারণে কৃষি পণ্য সরবরাহ কমে যায়, যার ফলে খাদ্য দ্রব্যের দাম বাড়তে থাকে। অনেক এলাকায় প্রাকৃতিক দূর্যোগের ফলে ফসল উৎপাদন কমে যায়। ফলে সেখানে দাম বেড়ে যায়। কিন্তু ব্যবসায়ীর আড়তে আসার সাথে সাথে কেমনে দাম বেড়ে যায় তা অনেকের কাছে অজানা। দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি সরাসরি মানুষের জীবনযাত্রার মান কমিয়ে দেয়। বিশেষ করে নিম্নবিত্ত শ্রেণির মানুষদের জীবনধারণে একাধিক সমস্যার সম্মুখীন হতে হয়। তারা তাদের মাসিক উপার্জনে বিভিন্ন প্রয়োজনীয় জিনিসের পরিমাণ কমিয়ে দিতে বাধ্য হন। এমনকি অনেক ক্ষেত্রে পুষ্টিকর খাবারের পরিমাণ কমে যায়, যা ভবিষ্যতে স্বাস্থ্যগত সমস্যা সৃষ্টি করতে পারে। মধ্যবিত্ত শ্রেণির লোকজনও এই পরিস্থিতিতে তাদের জীবনযাত্রার মান বজায় রাখতে হিমশিম খাচ্ছেন। উৎপাদন খরচ কমানোর জন্য জ্বালানি ও কাঁচামালের দাম সহনীয় রাখতে প্রয়োজনীয় উদ্যোগ নেওয়া উচিত। বাজার মনিটরিং জোরদার করতে হবে এবং অসাধু ব্যবসায়ীদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নিতে হবে। উল্লেখ্য ভোক্তা অধিকার প্রতিনিয়ত বাজার মনিটরিং করে জরিমানা আদায় করছে। কিন্তু এতে কোনো ফল পাওয়া যাচ্ছে না। কারণ পরবর্তীতে আবার দাম বাড়িয়ে জরিমানার টাকা উশুল করে নিচ্ছে।
এক সময় বাংলালিংক বিজ্ঞাপন দিত যে কৃষকের কাছে সরাসরি আলু কিনে সাধারণ মানুষের কাছে পৌঁছে দিত। এতে সিন্ডিকেট ব্যবসায়ী কারসাজি করতে পারত না। এছাড়া কৃষক ন্যায্য মূল্য পেত। তাই কৃষকদের জন্য সরাসরি বিক্রির সুযোগ তৈরি করতে হবে, যাতে তারা মধ্যস্থতা ছাড়াই ন্যায্য মূল্যে পণ্য বিক্রি করতে পারেন। সরকার ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোকে কৃষকদের জন্য কৃষক বাজার (ফার্মার্স মার্কেট) বা সংগ্রহ কেন্দ্র তৈরি করতে সহায়তা দিতে হবে। অনলাইন প্ল্যাটফর্মের মাধ্যমে কৃষক, ক্ষুদ্র উদ্যোক্তা ও ভোক্তাদের সরাসরি সংযুক্ত করা যেতে পারে। এর ফলে পণ্যের সরাসরি লেনদেন হবে, মধ্যস্থতা এড়ানো সম্ভব হবে। বাংলাদেশে এরকম প্ল্যাটফর্ম তৈরি করতে সরকারি-বেসরকারি উদ্যোগ গ্রহণ করা যেতে পারে। কৃষি পণ্য সংরক্ষণ, পরিবহন, এবং বাজারজাতকরণের জন্য সঠিক অবকাঠামো ও প্রযুক্তির অভাব থাকায় কৃষকরা পণ্য সংরক্ষণ করতে পারেন না। হিমাগার ও পরিবহন ব্যবস্থা উন্নত করলে কৃষকরা মধ্যস্থ ব্যবসায়ীদের উপর নির্ভর না করেই বাজারে সরাসরি বিক্রি করতে পারবেন। উৎপাদকদের জন্য স্বল্প সুদের ঋণ ও ভর্তুকির ব্যবস্থা করলে তারা অর্থের সংকটে পড়ে পণ্য বিক্রি করতে বাধ্য হবেন না। এতে মধ্যস্থ ব্যবসায়ীদের প্রতি তাদের নির্ভরশীলতা কমবে। বাজার মনিটরিং এবং কঠোর আইন প্রণয়ন করতে হবে। দ্রব্যমূল্যের দাম বৃদ্ধিতে যারা জড়িত তাদের শুধু জরিমানা নয়, কারাগারে পাঠানোর সিদ্ধান্ত নিতে হবে। তাহলে মালামাল একেবারে বিক্রি করতে না পেরে তাদের শুভবুদ্ধির উদয় হবে।
লেখক: শিক্ষার্থী, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়
সারাবাংলা/এসবিডিই