Thursday 21 Nov 2024
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

ছাত্র রাজনীতি: নিষিদ্ধ না কি সংশোধনে সমাধান

জাফর হোসেন জাকির
২৭ অক্টোবর ২০২৪ ১৭:৫৩

জুলাই’২৪ ছাত্র-শ্রমিক-জনতার গণ-অভ্যুত্থানের পর বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন এবং জাতীয় নাগরিক কমিটি এক সংবাদ সম্মেলন থেকে আওয়ামী লীগের ছাত্রসংগঠন ছাত্রলীগকে নিষিদ্ধ করতে সময় বেঁধে দিলে ২৩ অক্টোবর হত্যা, নির্যাতন, গণরুমকেন্দ্রিক নিপীড়ন, ছাত্রাবাসে সিট বাণিজ্য, টেন্ডারবাজি, ধর্ষণ, যৌন নিপীড়নসহ নানাবিধ জননিরাপত্তা বিঘ্নকারী কর্মকাণ্ডে জড়িত থাকার কারণে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার ছাত্রলীগকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করে প্রজ্ঞাপন জারি করে। এখন জনমনে প্রশ্ন জেগেছে, নিষিদ্ধ না-কি সংশোধনে সমাধান?

বিজ্ঞাপন

ছাত্র রাজনীতি মূলত ছাত্রদের স্বার্থ নিয়ে, ছাত্রদের অধিকার নিয়ে, ছাত্রদের সংকট নিয়ে এবং এসব করতে গিয়ে সেই ছাত্রের মাঝে জন্ম নেয় দেশপ্রেম, ভেতরে বিস্তার ঘটে মানবতার, ঘাড়ে এসে পড়ে সমাজ তথা দেশ তথা গণমানুষের দায়িত্ব। অতীতের ইতিহাস খুললে আমরা তাই দেখি। কিন্তু ফ্যাসিস্ট হাসিনার শাসন আমলে ছাত্রলীগের কর্মকান্ডে আমরা কি দেখেছি ছাত্র রাজনীতির নামে? কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে ছাত্রলীগ ভর্তি আর সিট বাণিজ্য থেকে শুরু করে শারীরিক নির্যাতন, ছাত্রদের ন্যায়সঙ্গত অধিকার আদায়ের আন্দোলনে হামলা, হেলমেট আর লাঠিয়াল বাহিনী হয়ে অসুরের বেশে রাজপথে নেমে দমন-পীড়ন-হত্যা কোনটাতে পিছিয়ে ছিলো তারা? নিজ দলের দুই গ্রুপের মারামারি কাটাকাটি তো ছিলো নিত্য দিনের সংবাদপত্রের প্রধান শিরোনাম। কেন্দ্রীয় নেতা থেকে শুরু করে ওয়ার্ড নেতা কার বিরুদ্ধে অপরাধের অভিযোগ ওঠার বাকি ছিলো? এসব কি হুট করে একদিনে তৈরি হয়েছে? নিশ্চয়ই না। তৈরি হয়েছে এযাবৎকালে ক্ষমতায় আসা রাজনৈতিক দলগুলোর ব্যক্তিস্বার্থ বাস্তবায়ন আর লেজুড়বৃত্তিক অপ-রাজনীতির মধ্য দিয়ে।

বিজ্ঞাপন

বাংলাদেশে গত ১৫ বছরে বিভিন্ন জায়গায় ছাত্রলীগ নেতা-কর্মীদের বিরুদ্ধে আর্থিক অনিয়ম, হত্যা, সন্ত্রাস, দুর্নীতি, টেন্ডারবাজি, চাঁদাবাজি, অর্থের বিনিময়ে কমিটি গঠন, ধর্ষণের মতো গুরুতর অপরাধের অভিযোগ ওঠে। ২০১৯ সালে দুর্নীতি ও চাঁদাবাজিসহ বিভিন্ন বিতর্কিত কর্মকাণ্ডের অভিযোগে দলটির তৎকালীন কমিটির সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদককে অব্যাহতি দেয়া হয়েছিল। ধর্ষণবিরোধী আন্দোলন, বুয়েটের আবরার হত্যাকান্ড বিরোধী আন্দোলন, নিরাপদ সড়ক আন্দোলন, ২০১৮ সালের কোটা সংস্কার আন্দোলন এবং ২০২৪ সালের গণ অভ্যুত্থান ঘিরে আওয়ামী লীগ সরকারের হয়ে মাঠে বিতর্কিত ভূমিকায় দেখা গেছে ছাত্রলীগকে। গণ অভ্যুত্থানে আন্দোলনকারী ছাত্র-শ্রমিক-জনতার ওপর হামলা, গুলি চালানোর মতো ঘটনায় প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছে এ সংগঠনটির কার্যক্রম। ফলে এই আন্দোলনের শুরু থেকেই ছাত্র রাজনীতি বন্ধের সুর ওঠে। ক্যাম্পাসগুলোতেও ছাত্র রাজনীতি বন্ধের আওয়াজ তোলে আন্দোলনকারীরা। ক্যাম্পাসগুলোতে লেজুড়বৃত্তিক ছাত্র রাজনীতি বন্ধ করা যুক্তিসঙ্গত। কেননা ক্ষমতায় থাকা রাজনৈতিক দলের ছাত্র সংগঠনগুলো ছাত্রদের অধিকার আদায়ের সংগ্রামের বিপরীতে ক্ষমতার অপব্যবহা করে ছাত্রদের উপর দমন-পীড়ন চালিয়ে ক্ষমতায় থাকা দলকে টিকে রেখে জনকল্যাণবিরোধী এজেন্ডা বাস্তবায়ন করতে চায়। তবে লেজুড়বৃত্তিক ছাত্র রাজনীতির বিপরীতে ছাত্রকল্যাণমুখী ছাত্র রাজনীতি না থাকলে ছাত্রদের অধিকার আদায়ের লড়াই, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের সংকট নিরসনে আন্দোলন, দুর্নীতি-ভূলনীতি আর চাঁদাবাজের বিরুদ্ধে ভ্যানগার্ড হবে কারা? ন্যায়কে ন্যায় আর অন্যায়কে অন্যায় বলার সাহস ও মানসিকতা তৈরি না হলে ক্যাম্পাসগুলোতে ছাত্র সংসদ নির্বাচনে অংশগ্রহণ করে নেতৃত্ব দিবে কেমন করে? অবশ্যই দেশে এবং ক্যাম্পাসগুলোতে আদর্শ ধারার ছাত্রমুখী ছাত্র রাজনীতি প্রাসঙ্গিক।

ছাত্রলীগকে নিষিদ্ধ করার মধ্য দিয়ে তাদের তৎপরতা আর রাজনৈতিক কর্মকান্ড কি বন্ধ হয়ে যাবে? আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর যে সংগঠনগুলোকে নিষিদ্ধ করেছিল তাদের সাংগঠনিক কর্মকান্ড কি বন্ধ বা একেবারে শেষ হয়ে গিয়েছিলো? ইতিহাস তো স্বাক্ষী দেয় নিষিদ্ধ করে কোনো সংগঠনের এ্যাক্টিভিটি জনকল্যাণবিমুখী বিপরীতে মানবকল্যাণ করা যায়নি। বরং তারা নতুন নামে, নতুন রূপে, নতুন সাজে রাজনৈতিক মাঠে ফিরে এসেছে। নিষিদ্ধ নয় বরং অপরাধীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির ব্যবস্থা করতে হবে। স্বজনপ্রীতি আর বিচারহীনতা সংস্কৃতি পরিহার করে বিচার বিভাগ স্বাধীন করে দিয়ে সুশাসন প্রতিষ্ঠা করতে হবে। তবে যদি তাই করা না হয় ‘যেই লাউ সেই কোদু’। সামনে যে রাজনৈতিক দল ক্ষমতায় আসবে তাদের লেজুড়বৃত্তিক ছাত্র সংগঠন ঠিক ছাত্রলীগের মতো চরিত্র ধারন করে নিজেদের পবিত্র মনে করবে। আবার যে ক্ষমতায় আসবে সেই সংগঠনকে নিষিদ্ধ করবে। নিষিদ্ধের প্রশ্ন তুললে দেশে বৃহত্তর রাজনৈতিক দলগুলোর ছাত্র সংগঠনের অতীতের ইতিহাস কি তাদের নিষিদ্ধ করার ক্ষমতা রাখে না? তাহলে কি নিষিদ্ধের মধ্য দিয়ে সমাধান আসবে? না, সমাধান আসবে না। সমাধান আসবে যেই সংগঠন অপরাধ করবে তাদের সুনির্দিষ্ট অপরাধের শাস্তির ব্যবস্থা করতে হবে। বিচারের মধ্য দিয়ে তাদের সংশোধনের সুযোগ করে দিতে হবে এবং অন্য সংগঠনগুলোকে সতর্ক করে দিতে হবে।

ছাত্র রাজনীতি নেতৃত্ব গুণ তৈরি করে, ছাত্র রাজনীতি সাধারণ মানুষের চাওয়া পাওয়াকে কাছে থেকে দেখতে সাহায্য করে, ছাত্র রাজনীতি শোষকের হাত থেকে শোষিতদের বাঁচানোর তাগিদ দেয়, ছাত্র রাজনীতি অধিকার সচেতনতা শেখায়, ছাত্র রাজনীতি দেশের প্রকৃত চাহিদার ব্যাপারে স্পষ্ট ধারণা দেয়, ছাত্র রাজনীতি নেতাদের মধ্যে নৈতিকতা তৈরি করে। সর্বশেষ জুলাই’২৪ গণ-অভ্যুত্থানে জ্বলন্ত উদাহরণ। ফলে ছাত্র রাজনীতি নিষিদ্ধ নয় বরং সংশোধন, সংস্কার ও পরিবর্তনের মধ্যদিয়ে প্রগতি ধারায় ছাত্র রাজনীতি প্রাসঙ্গিক।

লেখক: সংবাদকর্মী ও কলামিস্ট

সারাবাংলা/এসবিডিই

ছাত্র রাজনীতি: নিষিদ্ধ না কি সংশোধনে সমাধান জাফর হোসেন জাকির মুক্তমত

বিজ্ঞাপন

আরো

সম্পর্কিত খবর