Tuesday 29 Oct 2024
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

ত্যাগ স্বীকার সাফল্যের মূল চাবিকাঠি

মিজানুর রহমান
২৯ অক্টোবর ২০২৪ ১৩:৫৫

আমেরিকার নাগরিক অধিকার আন্দোলনের অন্যতম প্রধান নেতা মার্টিন লুথার কিং জুনিয়র এর একটি উক্তি দিয়ে শুরু করতে চাই। তিনি বলেন ‘মানব অগ্রগতি স্বয়ংক্রিয় বা অবশ্যম্ভাবী কোন বিষয় নয়… ন্যায়বিচারের লক্ষ্য অর্জনের প্রতিটি পদক্ষেপেই ত্যাগ, কষ্ট এবং সংগ্রামের প্রয়োজন; নিবেদিত ব্যক্তিদের অক্লান্ত পরিশ্রম এবং আন্তরিক প্রচেষ্টা প্রয়োজন।’

আমরা যদি ইতিহাসের দিকে তাকাই, দেখব ব্যক্তিগত জীবন থেকে শুরু করে রাষ্ট্রীয় পর্যায়ের সাফল্য, প্রতিটি ক্ষেত্রে আত্মত্যাগই হলো মূল উপাদান।

বিজ্ঞাপন

ব্যক্তিগত ত্যাগ: নিজের সফলতার জন্য নিজের ত্যাগ

বাঙালি সমাজের একটি প্রবাদ আছে, ‘অতিরিক্ত ঘুমালে ঘুমেই জীবন যাবে।’ জীবনকে বদলে দিতে হলে প্রথমেই নিজের উপর নিয়ন্ত্রণ আনা একান্ত প্রয়োজন। এর জন্য চাই দৃঢ় সংকল্প ও ইস্পাত কঠিন মনোবল। মানুষের মধ্যে রয়েছে দুইটি বৃত্তি- জীববৃত্তি ও বুদ্ধিবৃত্তি। কোন ব্যক্তি যদি জীববৃত্তির গোলাম হয়ে যায় তাহলে সে অন্য প্রাণীর থেকে নিজেকে আলাদা করতে পারবে না। জীববৃত্তির টানে পড়ে মানুষ খারাপ কামনা-বাসনা, অতিরিক্ত ভোগবিলাসিতা, অতিরিক্ত ঘুম ইত্যাদিতে আসক্ত হয়ে পরে। ফলে মানুষের মধ্যে যে উচ্চ বৃত্তি তথা বুদ্ধিবৃত্তি রয়েছে তা বিকশিত হয় না। তাই সফলতার জন্য প্রথমেই এই জীববৃত্তির মোহ ছাড়তে হবে।

আত্মনিয়ন্ত্রণের দ্বিতীয় ধাপে রয়েছে বুদ্ধিবৃত্তিক ত্যাগ

এই যুগে আমরা প্রায় সবাই সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের দিকে এতটাই ঝুঁকে পড়েছি যে সময়ের মূল্য হারিয়ে ফেলছি। আপনি যদি সফল হতে চান তবে প্রথমেই আপনার মোবাইলের ব্যবহারটাকে নিয়ন্ত্রণের মধ্যে নিয়ে আসতে হবে। এক্ষেত্রে ব্যর্থ হলে আপনি কখনই সফল হতে পারবেন না। আপনি যদি মোবাইলের ব্যবহার নিয়ন্ত্রণ করতে না পারেন, মোবাইলই আপনাকে নিয়ন্ত্রণ করবে, মোবাইল আপনাকে নিয়ে খেলবে।

বিজ্ঞাপন

প্রযুক্তির যুগে যারা সফল উদ্যোক্তা হয়েছেন তাদের কেউই আরাম আয়েশে দিন কাটাননি। নিজের আরাম-আয়েশ ত্যাগ না করলে, সফলতা পাওয়া প্রায় অসম্ভব। একজন সফল উদ্যোক্তা নিজের বিনোদন, আড্ডাবাজি, এবং বিলাসিতা থেকে নিজেকে দূরে রাখেন। সাফল্যের পথে এগিয়ে যাওয়ার জন্য তাকে ঘুমের সময় কমিয়ে, বিনোদনের সময় কমিয়ে কঠোর পরিশ্রম করতে হয়। আমরা দেখি স্টিভ জবস বা এলন মাস্কের মতো সফল ব্যক্তিরা কখনোই সাধারণ মানুষের মতো আরামে ঘুমিয়ে, আনন্দে সময় কাটিয়ে সফল হননি। তাদেরকে দিনের পর দিন কষ্ট করতে হয়েছে, ঘুম হারাম করে রাত জেগে পরিশ্রম করতে হয়েছে। একটি চীনা প্রবাদ আছে, ‘পাহাড়ে উঠতে হলে প্রথমে ছোট পাথরগুলোতে পা রাখতে হয়।’ সাফল্য সেই পাহাড়, আর আমাদের প্রতিটি ক্ষুদ্র ত্যাগ হলো সেই পাথরগুলো।

পারিবারিক ত্যাগ: সন্তানের সফলতার জন্য পরিবারের ত্যাগ

‘বাবা-মায়ের মুখে হাসি ফোটাতে চাইলে, তাদের চোখের জল দেখো’—এই উক্তির মাধ্যমে বোঝা যায়, একজন সন্তান যখন সফলতার শীর্ষে পৌঁছায়, তখন তার পেছনে বাবা-মা এবং পরিবারের আত্মত্যাগ থাকে অমূল্য। সন্তানের জন্মের পর থেকেই বাবা-মার আত্মত্যগ ও সংগ্রামের জীবন শুরু হয়। তাদের শত রাতের ঘুম, কত আরাম আয়েশের জীবন সন্তানের সফলতার জন্য উতসর্গ করেন। সন্তানের চেয়ে পিতা-মাতাই বেশি উৎকণ্ঠায় থাকেন। নিজে ভাল কাপড় না পরিধান করে, নিজে ভাল না খেয়ে সন্তানের জন্য ব্যয় করেন। এমনকি আমাদের সমাজে অনেক পরিবারেই দেখা যায়, বাবা-মা নিজের চিকিৎসা করানো থেকে বিরত থাকেন, যেন সন্তান ভালোভাবে পড়াশোনা করতে পারে। ‘একটি মাটির পাত্র যতবার ভাঙবে, ততবারই মাটি দিয়ে গড়ে নিতে হয়’-পরিবারের ত্যাগ সেই মাটির মতো, যা একজন সন্তানকে নতুন করে গড়ে তোলে।

আবার ভাই-বোনের ত্যাগও অনেক মূল্যবান। বাংলাদেশের অনেক পরিবারেই দেখা যায়, বড় ভাই নিজের পড়াশোনা বাদ দিয়ে ছোট ভাইকে লেখাপড়া করানোর জন্য উপার্জন করেন। এমন অনেক গল্প আমরা শুনেছি, যেখানে একজন ভাই বা বোন নিজে ভালো জামা কাপড় না কিনে সেই টাকা ভাই-বোনের ভবিষ্যতের জন্য ব্যয় করে। অন্যদিকে বিবাহিত জীবনে স্বামী তার স্ত্রীর জন্য বা স্ত্রী তার স্বামীর জন্য অনেক ত্যাগ স্বীকার করেন যেন সে ভালভাবে পড়ালেখা করে একটি ভাল চাকরি করেতে পারে। অনেক উদাহরণ দেয়া যেতে পারে যেখানে স্ত্রীর অসামান্য ত্যাগের মাধ্যমে তার স্বামীকে সাপোর্ট দিয়েছেন সারা জীবন ধরে। একজন স্ত্রীর ত্যাগের মাধ্যমেই তার স্বামী অথবা একজন স্বামীর ত্যাগের মাধ্যমে তার স্ত্রী আরোহণ করতে পারে উন্নতির চরম শিখরে। Personal Sacrifice for your family is an investment in their future—এই ভাবনা থেকেই আসে সাফল্যের গল্প।

রাষ্ট্রের সফলতা: ব্যক্তির আত্মত্যাগে দেশের উন্নতি

পৃথিবীর ইতিহাসে অনেক মানুষকে খুঁজে পাওয়া যায়, যারা আজীবন সংগ্রাম ও ত্যাগ স্বীকার করেছেন তার দেশের জন্য, দেশের নাগরিকের উন্নত জীবন মানের জন্য, মানবতার জন্য। স্বাধীনতার জন্য যুদ্ধে অংশগ্রহণ করা, কিংবা দেশকে উন্নতির শিখরে নিয়ে যেতে বছরের পর বছর সংগ্রাম করা—সবই আত্মত্যাগের উদাহরণ। একটি দেশের উন্নতির জন্য ব্যক্তির আত্মত্যাগ অপরিহার্য। মহাত্মা গান্ধী এবং নেলসন ম্যান্ডেলা দু’জনেই ত্যাগের প্রতীক। গান্ধী তার জীবনের আরাম-আয়েশ ত্যাগ করে ভারতের স্বাধীনতা অর্জনের জন্য আন্দোলন করেছেন। তিনি শিখিয়েছিলেন, ‘যত বেশি ত্যাগ করবে, ততই বেশি পাবে।’ নেলসন ম্যান্ডেলা তার জীবনের ২৭ বছর কারাগারে কাটিয়ে, শারীরিক কষ্ট সহ্য করে দক্ষিণ আফ্রিকাকে বর্ণবাদের শৃঙ্খল থেকে মুক্ত করেছিলেন। তার একটি বিখ্যাত উক্তি, ‘অসীম আত্মত্যাগ ছাড়া কোনো অর্জন হয় না।’এই আত্মত্যাগ ছাড়া একটি রাষ্ট্রের উন্নতি কল্পনাও করা যায় না।

আবার বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সময় আমরা দেখি, অনেক মানুষ প্রাণ বিসর্জন দিয়েছিলেন দেশের স্বাধীনতার জন্য। একাত্তরের সেই সব মুক্তিযোদ্ধারা জীবন দিয়ে প্রমাণ করেছেন, দেশের উন্নতি ও স্বাধীনতা শুধু সাহস নয়, ত্যাগেরও ফল। বর্তমানে দেশে আত্মত্যাগের চরম দৃষ্টান্ত হলো বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের আবু সাইদের আত্মত্যাগ। এই আন্দোলনে অনেকেই অনেক ত্যাগ স্বীকার করেছেন কিন্তু আবু সাইদের আত্মত্যাগ ছিল ভিন্ন মাত্রার। তিনি নিজের জীবন উতসর্গ করে বাংলাদেশের ইতিহাস পরিবর্তন করে দিয়েছেন। এভাবে রাষ্টীয় সফলতার ইতিহাস সৃষ্টি হয় ব্যক্তিগত আত্মত্যাগের মাধ্যমেই।

আত্মত্যাগের গুরুত্ব: সাফল্যের পথে অপরিহার্য

যত বেশি ত্যাগ স্বীকার করা যায়, তত বেশি সাফল্য অর্জিত হয়। কোনো কিছু অর্জন করতে হলে ত্যাগ স্বীকারই একমাত্র উপায়। যে ব্যক্তি নিজের আরাম-আয়েশ ত্যাগ করতে প্রস্তুত, সে সফলতার চূড়ায় পৌঁছাতে বাধ্য। আবার, যে পরিবার নিজের সন্তানের জন্য ত্যাগ স্বীকার করতে পারে, সেই পরিবারে একজন সফল মানুষের জন্ম হয়। দেশের উন্নতির জন্যও এক বা একাধিক ব্যক্তির ত্যাগ অপরিহার্য। শেষ পর্যন্ত বলা যায়, সফলতা আর আত্মত্যাগ একে অপরের সঙ্গে অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িত। ‘যত বড় ত্যাগ, তত বড় সফলতা’ জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে এই সত্য প্রযোজ্য।

লেখক: প্রভাষক, দর্শন বিভাগ, গাইবান্ধা সরকারি কলেজ

সারাবাংলা/এসবিডিই

ত্যাগ স্বীকার সাফল্যের মূল চাবিকাঠি মিজানুর রহমান মুক্তমত

বিজ্ঞাপন
সর্বশেষ

সুনামগঞ্জে মা-ছেলে খুন
২৯ অক্টোবর ২০২৪ ১২:২৯

সম্পর্কিত খবর