চালের বাজার অস্থির কেন
২৯ অক্টোবর ২০২৪ ১৫:২৪
মানুষের মৌলিক চাহিদার অন্যতম হলো খাদ্য। এরপর বাকি সব চাহিদা। আর আমাদের প্রধান খাদ্য ভাত। যা তৈরি হয় চাল থেকে। আর চাল উৎপাদন হয় ধান থেকে। বাংলাদেশে চালের উৎপাদন বেড়েছে। কিন্তু দাম না কমায় মানুষের মাঝে শান্তি ফিরছে না। উৎপাদন বৃদ্ধির সুফল যদি প্রান্তিক মানুষ ভোগ না করতে পারে তাহলে কাজের কাজ কিছুই হবে না। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) বোরো উৎপাদনের তথ্যে দেখা গেছে, ২০২২-২৩ অর্থবছরে বোরো মৌসুমে দুই কোটি সাত লাখ টন ধান উৎপাদিত হয়েছে। এটি এর আগের অর্থবছরের তুলনায় তিন শতাংশ বেশি। ২০২২-২৩ অর্থবছরে দেশে মোট চাল উৎপাদন দুই দশমিক পাঁচ শতাংশ বেড়ে তিন কোটি ৯১ লাখ টনে দাঁড়িয়েছে। এটি সর্বোচ্চ রেকর্ড। ২০১৭-১৮ অর্থবছর থেকে ফসল উৎপাদন সামগ্রিকভাবে বেড়েছে। ধানি জমির পরিমাণ বেড়ে যাওয়ার পাশাপাশি আধুনিক জাতের ফসল ফলানোয় চাল আমদানি কমেছে। বিবিএসের তথ্যে দেখা গেছে, ২০২২-২৩ অর্থবছরে দেশের মোট ধানি জমির ৮১ শতাংশে উচ্চ ফলনশীল ধান চাষ হচ্ছে। ২০০৯-১০ অর্থবছরে তা ছিল ৭৩ শতাংশ। অন্যদিকে, উচ্চ ফলনশীল ও স্থানীয় জাতের তুলনায় বেশি ফলন দেওয়া হাইব্রিড ধানের চাষ ২০০৯-১০ অর্থবছরের ছয় শতাংশ থেকে বেড়ে ২০২২-২৩ অর্থবছরে ১০ শতাংশে উন্নীত হয়েছে। এই সময়ের মধ্যে, স্থানীয় জাতের ধান চাষ অর্ধেক কমেছে। গণমাধ্যম থেকে প্রাপ্ত সংবাদে জানা যায়, দেশের চালের বাজারে লাগামহীন দাম বৃদ্ধির নতুন চিত্র দেখা দিয়েছে, যদিও মোকাম ও গুদামে পর্যাপ্ত চাল মজুত রয়েছে। সম্প্রতি ধানের দাম বৃদ্ধির অজুহাতে ৫০ কেজির বস্তায় চালের দাম দেড়শ টাকা পর্যন্ত বেড়ে গেছে। এর আগের দুই মাসে বন্যা ও যানজটের কারণ দেখিয়ে দাম ৩০০ থেকে ৪০০ টাকা বাড়ানো হয়েছিল। বর্তমানে দেশে বড় কোনো প্রাকৃতিক দুর্যোগ নেই, এবং ধান-চালের সংকটও নেই।
দেশের বিভিন্ন মোকামে, বিশেষ করে রাজশাহী, দিনাজপুর, নওগাঁ, কুষ্টিয়া, পাবনা এবং বগুড়ায় চালের সরবরাহ স্বাভাবিক রয়েছে। আরও জানা যায়, বিশ্ববাজারে চালের দাম কমছে। শীর্ষ চাল রপ্তানিকারক দেশ ভারত রপ্তানিতে বিধিনিষেধ প্রত্যাহার করায় আন্তর্জাতিক বাজারে নিত্যপণ্যটির দাম কমছে; কিন্তু দেশের বাজারে উল্টো চিত্র দেখা যাচ্ছে। দুই সপ্তাহ ধরে দেশে প্রায় সব ধরনের চালের দাম বাড়ছে। রাজধানীর কয়েকটি বাজারে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, মোটা, মাঝারি ও সরু- প্রায় সব ধরনের চালের দাম খুচরা পর্যায়ে কেজিতে ৪ থেকে ৬ টাকা বেড়েছে। এখন স্থানীয় জাতের ধান চাষ হচ্ছে মোট ধানি জমির প্রায় নয় শতাংশ এলাকায়। কোনো যুক্তিসঙ্গত কারণ না থাকলেও তার দাম বৃদ্ধি পাচ্ছে। এমনিতেই দেশের মধ্যবিত্ত ও নিন্মবিত্তরা বছর শুরুই করেন নানা চাপ নিয়ে। বাসা ভাড়া বৃদ্ধি, এটার দাম বৃদ্ধি ওটার দাম বৃদ্ধি ইত্যাদি সমস্যা নিয়ে। বাজার থেকে কেবল চাল কিনলেই পেট ভরে না। এর সাথে ভোজ্য তেল এবং অন্যান্য দ্রব্যও কিনতে হয়। এরপর চিকিৎসা ও অন্যান্য খরচ মিলিয়ে একজন সাধারণ আয়ের মানুষকে জীবন যাপন করতে হয়। এরপর যদি চালের দাম বৃদ্ধি পায় তাহলে দাড়ানোর জায়গা থাকে না। আমরা যারা ভোক্তা তাদের একটাই দৃষ্টিকোণ। তা হলো বাজার থেকে কেনা। এ দেশে দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির গতি যতটা দ্রুত হয় মূল্য কমার গতি তার থেকে বহুগুণে কম হয়। ভোক্তারা অপেক্ষা করছে কবে ক্রয়ক্ষমতার মধ্যে আসবে চালের দাম। অন্তত মোটা চাল যা সাধারণত নিন্মবিত্ত আয়ের মানুষ ক্রয় করে।
মোট চালের উৎপাদনে চীন ও ভারতের পর তৃতীয় অবস্থান ধরে রেখেছে বাংলাদেশ। গত বৃহস্পতিবার জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থা (এফএও) থেকে প্রকাশ করা গ্লোবাল ফুড আউটলুক প্রতিবেদনে এসব তথ্য উঠে এসেছে। তথ্যমতে, চীন চাল উৎপাদনে এখনো শীর্ষে রয়েছে। আয়ের সাথে মানানসই ব্যয় হলে তখন অস্থিরতা কমে। ক্রমবৃদ্ধিপ্রাপ্ত এ চালের বাজারের আগুনের আচ লাগছে সাধারণ মানুষের উপর। এ জ্বালা কেবল যারা নিন্মবিত্ত আর মধ্যবিত্ত শ্রেণির তাদেরই বেশি। দাম বাড়ার কারণ হিসেবে একজন অন্যের দিকে দোষারপ করছে। তবে মূল কাজটা এখনও হচ্ছে না। সাধারণ খেটে খাওয়া মানুষ এই আশাতেই পথ চেয়ে থাকে যে চালের দাম কমবে। পাঁচ জনের একটি পরিবারে যদি একজন উপার্জন ক্ষম ব্যাক্তি থাকে তাহলে চাল কিনতেই প্রতিদিনের আয়ের একটি বড় অংশ চলে যাচ্ছে।
ক্ষুধামুক্ত দেশ গড়ার লক্ষে আমরা এগিয়ে চলেছি। কৃষি খাত এখন অনেক ভালো অবস্থানে। খাদ্য উৎপাদনেও বাংলাদেশ সফল। যদি কোনো প্রাকৃতিক দুর্যোগ থাকে এবং সেই কারণে দাম বৃদ্ধি হয়, যদি সরবরাহে বাধা থাকে, সেটাও সাময়িক হওয়ার কথা তাহলেও দাম বৃদ্ধির এই প্রবণতা খাদ্য নিরাপত্তাকেই চ্যালেঞ্জের মুখে ফেলবে। নতুন ভাবে একটি দেশকে গড়ে তুলতে চালের মূল্যের এই বৃদ্ধির গতি চেপে ধরতে হবে। অসাধু ব্যক্তির হাত থেকে দাম বৃদ্ধির লাগাম কেড়ে নিতে হবে। সেই চ্যালেঞ্জ সামনে রেখেই কাজ করতে হবে। পেট ভরলেই তো সুষ্ঠু চিন্তা সম্ভব। ক্ষুধার জন্য করে না এমন কাজ আর নেই। তাই ক্ষুধা মুক্ত দেশ গঠনের এটা একটা গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ। গরীবের ক্ষুধা নিয়ে ব্যবসার ফল যে শুভ হয় না তা মনে হয় এসব অর্থলোভীরা জানে না। অনেক মহৎ উদ্দেশ্যই বাস্তাবায়নের অভাবে ব্যর্থতায় পর্যবেসিত হয়। চালের মূল্য এমন একটি বিষয় যা মূলত সব শ্রেণি পেশার মানুষের ওপরই প্রভাব ফেলে। এর মধ্যে যাদের আয় সীমিত তাদের ওপরই প্রভাব বেশি পরে। মাথায় নিত্যদিনের চিন্তা নিয়ে বের হতে হয়। ফলে মূল্য বৃদ্ধি একটি বাড়তি চাপ হিসেবে দেখা দেয়। আমরা আশা করি দাম নাগালের মধ্যেই থাকবে। দাম বৃদ্ধির লাগাম টেনে ধরতে হবে। আয়ের সাথে ব্যয়ের সঙ্গতি রাখতে হলে অবশ্যই চালের দাম হাতের নাগালে রাখতে হবে। বাজার সিন্ডিকেটমুক্ত করতে হবে। সবার স্বার্থেই মূল্য বৃদ্ধির লাগাম টেনে ধরতে হবে। সাধারণ মানুষের হাতের মঙ্গলার্থে চালের দাম হাতের নাগালেই রাখতে হবে।
লেখক: প্রাবন্ধিক ও কলামিস্ট
সারাবাংলা/এসবিডিই