জ্ঞানের আলোকবর্তিকা মহীয়সী জেনি মার্কস
১ নভেম্বর ২০২৪ ১৭:০৫
পৃথিবীতে শোষণমুক্ত সমাজ প্রতিষ্ঠার বিজ্ঞানসম্মত স্বপ্ন দেখেছিলেন কিছু মানুষ। তারা স্বপ্ন দেখেছিলেন মেয়েদের ভাবা হবে মানুষ হিসেবে। রান্নাঘর এবং আঁতুড় ঘর থেকে তাদের মুক্ত করা হবে। পরমযত্নে তার ভিতরকার সুপ্ত সম্ভাবনাকে উপযুক্ত পরিবেশ দিয়ে বিকশিত করা হবে – তারা বাধাহীনভাবে জ্ঞান জগতের বহুবিস্তৃত ক্ষেত্রে বিচরণ করবে। তারা উন্নত হবে, সুন্দর হবে। যুগ যুগ ধরে নারীকে শেখানো হয়েছে সন্তানধারণেই তোমার জীবনের সার্থকতা। এই দৃষ্টিভঙ্গি ও মানসিকতার ফলে পৃথিবীর অনেক দেশে মেয়েদের বিদ্যা বুদ্ধি ও মেধা প্রায় কাজে লাগেনি বললেই চলে। মানব শক্তি ও সম্পদের এ বড় অপচয়। কিন্তু এর কারণ কি? এক কথায় বলা যায়: পুঁজিবাদী শাসন-শোষণ মানবজাতিকে এই পুঁজিবাদী শাসন শোষণ থেকে মুক্ত করার সংগ্রাম করতে গিয়ে সমগ্র মানব জাতির সামনে যারা জ্ঞানের আলোকবর্তিকা জ্বালিয়ে দিয়েছিলেন মহীয়সী কমরেড জেনি মার্কস তাদের অন্যতম। এই সংগ্রামকেই তিনি জীবনের ধ্রুবতারা হিসাবে গ্রহণ করেছিলেন। তার জীবন সংগ্রাম আমাদের প্রেরণা দেয়, শিক্ষা দেয়।
জার্মানির এক অভিজাত পরিবারে জেনি মার্কসের জন্ম। বাবা ছিলেন প্রি: ভি: কাউন্সিলর, মা ছিলেন স্কটল্যান্ডের ডিউক অব আর্গলের পরিবারের উত্তরসূরী। কিন্তু জেনির বাবা মায়ের আভিজাত্য বংশ নিয়ে কোন অহমিকা ছিল না। জেনির ভাই ছিলেন কাল মার্কসের সহপাঠী। মূলত: তাদের পিতা-মাতার সাংস্কৃতিক ও নৈতিক শিক্ষা পারিবারিক আবহাওয়া জেনি এবং অধিকারের মধ্যে অভিজাত বংশ নিয়ে কোন সংস্কার গড়ে উঠতে দেয় নি। এই কারণে মধ্যবিত্ত ঘরের সন্তান কার্ল মার্কসের সাথে এদের সখ্যতা গড়ে উঠতে কোন বাধা হয়নি। জেনির বাবা এবং কার্ল মার্কসের পিতা বন্ধু ছিলেন।
অত্যন্ত ছোটবেলা থেকেই মার্কস এবং জেনির বন্ধুত্ব ছিল। যা কালক্রমে গভীর ভালবাসায় পরিণত হয়। কার্ল মার্কসের প্রতিভা তাকে আকৃষ্ট করেছিল। তার বাবার ফরাসি উদারনীতিবাদ ও সমাজতান্ত্রিক মতবাদের প্রতি যে আগ্রহ ছিল তা জেনির মানসিকতা, মূল্যবোধ ও নৈতিকতা তৈরিতে সহায়ক হয়েছিল। এই কারণেই অভিজাত বংশের সুখ-স্বাচ্ছন্দ্যের কথা না ভেবে সাধারণ মধ্যবিত্ত ঘরের মানুষ যার কোন বংশ কৌলিন্য নেই তাকে বিয়ে করতে তিনি অনড় ছিলেন। মেরি গ্যাব্রিয়েল তার লাভ এন্ড ক্যাপিটাল: কার্ল অ্যান্ড জেনি মার্কস এন্ড দি ব্রিটিশ অফ এ রেভোলিউশান বইতে লিখেছেন – ”তার চোখে (জেনির) মার্কস যেন শেলীর প্রমিথিউস – একটি খাড়া ও উঁচু গিরি চূড়ায় শৃঙ্খলিত কারণ তিনি অত্যাচারী দেবতাকে চ্যালেঞ্জ করার সাহস করেছিলেন। ১৮৪৩ সালের জুনে তাদের বিয়ে হয়।
বিবাহের পর জেনি এবং মার্কস প্যারিসে আসেন। শুরু হল আর্থিক কষ্ট। ১৮৪৪-এ এখানেই মার্কস এবং এঙ্গেলসের প্রথম সাক্ষাৎ। যদিও চিঠিপত্রে এর আগেই দুজনের পরিচয় হয়েছে। ১৮৪৫ সালের ফেব্রুয়ারির তিন তারিখে কোনরকম পূর্ব প্রস্তুতি ছাড়া প্যারিস ছাড়তে বাধ্য হন তারা। এরপর তারা আসেন ব্রাসেলসে। ১৮৪৬-এ মার্কস এবং এঙ্গেলস কমিউনিস্ট অর্গানাইজিং কমিটি গড়ে জার্মান ওয়ার্কার্স ইউনিয়ন প্রতিষ্ঠা করেন। এই কমিটির প্রথম সদস্য ছিলেন জেনি। এই সময়েই জেনি মার্কসের ‘জার্মান ইডিওলজি’ প্রকাশনার দায়িত্ব নেন।
জেনি মার্কস ছিলেন সুশিক্ষিত, বহু ইউরোপীয় ভাষার উৎপত্তির অধিকারী, অত্যন্ত বিদুষী এই মহিলা কমিউনিস্ট আন্দোলনের প্রথম যুগ থেকেই আন্দোলনের সাথে যুক্ত ছিলেন। অনেক সময়েই কমিউনিস্ট বিপ্লবীদের সভা তিনি পরিচালনা করেছেন। সেখানে কমিউনিস্ট আন্দোলনের প্রথম যুগের অগ্রণী চিন্তা নায়করা আলোচনায় অংশ নিতেন। মার্কসের পান্ডুলিপি পড়ে মন্তব্য করা, ভিন্ন ভাষা থেকে প্রয়োজনীয় তথ্য অনুবাদ করে দেওয়া ইত্যাদি কাজেও সহায়তা করেছেন জেনি। মার্কস জেনিকে অত্যন্ত গুরুত্ব দিতেন।
১৮৪৮ সালের বিদ্রোহের সময় জেনি জার্মান বিপ্লবীদের জন্য অর্থ সংগ্রহ করেছেন এবং মার্কস শ্রমিকশ্রেণিকে সশস্ত্র করে তুলতে সরাসরি বিপ্লবের কাজে জড়িয়ে পড়েন। স্বাভাবিকভাবেই মার্কস এবং তার সাথে জেনিকেও পুলিশ গ্রেপ্তার করে এবং ২৪ ঘন্টার মধ্যে দেশছাড়ার হুকুম জারি হয়। থানা থেকে তাদের আর বাড়ি আসতে দেওয়া হয়নি। সেখান থেকেই জোর করে তাদের বেলজিয়ামের সীমান্ত পার করে দেওয়া হয়। তারা এরপর জার্মানির কোলনে আসেন। কোলনে এসে মার্কস এঙ্গেলস ‘নিউ রাইনিসে জাইতুং’ পত্রিকা প্রকাশের সিদ্ধান্ত নেন। জেনিও এই কর্মকাণ্ডে সক্রিয়ভাবে যুক্ত ছিলেন।
১৮৫১ সালের মার্চ মাসে মেয়ে ফ্রানসিসকার জন্ম হল। কিন্তু তিনখানা ছোট ঘরে অন্যদের সঙ্গে ওকে মানুষ করা সম্ভব হচ্ছিল না। তাই বাচ্চাটিকে নার্সের হাতে তুলে দেওয়া হোল। ১৮৫২-তে ব্রঙ্কাইটিসে মারা যায় মেয়েটি।
১৮৫২ সালের ৮ই সেপ্টেম্বর তারিখে একটি চিঠিতে মার্কস লিখেছেন, ‘স্ত্রী অসুস্থ। জেনি সোনারও অসুখ। হেলেনের একপ্রকার স্নায়বিক জ্বর হয়েছে। অথচ ওষুধ কেনার পয়সা নেই বলে এখনও পর্যন্ত আমি ডাক্তার ডাকতে পারছি না। গত এক সপ্তাহ ধরে গোটা পরিবারকে শুধু রুটি আর আলু খাইয়ে রেখেছি।’ জেনি এই সময় তার বন্ধুকে লিখছেন- ‘মনে করবেন না এই সব তুচ্ছ ছোটখাটো দুঃখ দুর্দশা ভাবনা চিন্তা আমার মনোবল নষ্ট করে দিয়েছে। আমি খুব ভাল করেই জানি যে আমাদের সংগ্রাম বিচ্ছিন্ন কোন ব্যাপার না।’
১৮৫৫ সালের বসন্তকালে জেনির জীবনে নেমে এলো আর এক দুর্যোগ। জেনির ৮ বছরের পুত্র সন্তান কর্নেল মুশ ঘুমন্ত অবস্থায় মার্কসের কোলেই মারা যায়। জেনি লিখেছেন – ‘ওর মৃত্যুর দিনটা আমার জীবনের এক ভয়াবহ দিন। এর আগে যত দুঃখ কষ্ট পেয়েছি সেগুলো একত্রিত করলে যা হয় এটা যেন তার চেয়েও বেশী।’
আমরা জানি ১৮৭১ সালের ১৮ই মার্চ থেকে মে মাসের ২৮ তারিখ এই ৭২ দিন স্থায়ী হয়েছিল প্যারি কমিউন- সর্বহারাদের প্রথম রাষ্ট্র। এই প্যারি কমিউনের পতনের পর রাষ্ট্রের দমন-পীড়ন নেমে আসে বিপ্লবীদের উপর। আত্মরক্ষার্থে তারা ইংল্যান্ডসহ নানা জায়গায় ছড়িয়ে পড়ে। মার্কস এঙ্গেলসের গৃহ হয়ে উঠেছিল এই সমস্ত মানুষদের সাহায্য করার মূল কেন্দ্র। এদের অর্থ সাহায্য করা, আশ্রয়ের ব্যবস্থা করা, পরিবারের শিশুদের স্কুলে ভর্তি করা এবং শরণার্থীদের খাবার দাবারের ব্যাবস্থা করার জন্য জীবিকার ব্যবস্থা করা। এসবই সামলেছেন জেনি। পল লাফার্গ মন্তব্য করেছিলেন যে জেনির কাছে “এদের সাথে কোন সামাজিক পার্থক্য ছিল না; তিনি নিজের বাড়িতে এবং তাদের খাবার টেবিলে শ্রমজীবী লোকেদের এমনভাবে আপ্যায়ন করবেন যেন তারা কোন দেশের ডিউক বা রাজকুমার।” বস্তুতঃ প্যারি কমিউনের পতনের পর মার্কস এঙ্গেলসের ইংল্যান্ডের অ্যাপার্টমেন্ট হয়ে উঠেছিল পরাজিত বিধ্বস্ত পালিয়ে আসা বিপ্লবীদের এবং প্রথম আন্তর্জাতিকের কেন্দ্রীয় পরিচালনা কেন্দ্র এবং তার অন্যতম মুখ্য পরিচালকের দায়িত্ব পালন করেছেন জেনি মার্কস।
আমরা সহজেই অনুমান করতে পারি কমিউনিস্ট মতধারা উন্মেষের কালে দর্শন, অর্থনীতি, রাজনীতি, সাহিত্য, বিজ্ঞান ইত্যাদি নানা বিষয়ে গভীর অধ্যায়ন ও অক্লান্ত গবেষণার প্রয়োজন হয়েছে। নতুন মতবাদ সম্পর্কে বই প্রবন্ধ ইত্যাদি লেখা ও প্রচারের ব্যবস্থা করা, বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তের কমরেডদের সাথে যোগাযোগ রক্ষা করতে দীর্ঘ পত্রলেখা, বিভিন্ন মতবাদ কান্তির বিরুদ্ধে লড়াই চালানো, কমিউনিস্ট আন্তর্জাতিকের সংগঠন গড়ে তোলা, সেই সংগঠনের সভা, কংগ্রেস ইত্যাদির জন্য প্রস্তুত হওয়া, উপস্থিত থাকা আলোচনায় অংশ নিয়ে তীব্র মতবাদিক লড়াই করা ইত্যাদি বিপুল পরিমাণ কাজে ব্যস্ত থাকতে হয়েছে মার্কস এঙ্গেলসকে। জেনি মার্কস ছিলেন মার্কস এঙ্গেলসের এই সমগ্র কর্মোদ্যোগে অন্যতম সহযোগী।
রোগভোগ আর কঠোর দারিদ্রের সাথে লড়াই করতে করতে জেনি তার চার সন্তানকে হারিয়েছিলেন। ১৮৮১ সালে জেনির লিভার ক্যান্সার ধরা পরে। ক্রমাগত তার শরীর দুর্বল হতে থাকে। কার্ল মার্কসের জীবনে এই মহীয়সী নারীর অবদান মার্কস নিজেও অনুধাবন করতেন। তিনি ছিলেন প্রকৃত অর্থে তার সহযোগী, সহকর্মী এবং শ্রমিক আন্দোলনে সহযোদ্ধা। ১৮৮১ সালের ২রা ডিসেম্বর তার মৃত্যু হয়। তার অন্ত্যেষ্টির সময় মার্কস এতই অসুস্থ ছিলেন যে উপস্থিত থাকতে পারেন নি। এঙ্গেলস তার দায়িত্ব নেন। তার সমাধি পাশে দাঁড়িয়ে এঙ্গেলস বলেছিলেন – ‘তার বলিষ্ঠ এবং জ্ঞানগর্ভ উপদেশ থেকে বঞ্চিত হব। তার মধ্যে ছিল বলিষ্ঠতা কিন্তু আত্মম্ভরিতা নয়, প্রকাশ পেত প্রাজ্ঞতা, কিন্তু সর্বদা মর্যাদা রক্ষা করে।’ এই কথা প্রমাণ করে বিশ্ব সাম্যবাদী আন্দোলন গড়ে তোলার সুকঠিন কাজে জেনির অবদানের স্বরূপ কেমন ছিল। জেনি মার্কসের মৃত্যুর মধ্য দিয়ে কার্ল মার্কসের এক মহান সহযোদ্ধা, বিশ্ব সাম্যবাদী আন্দোলনের এক অনন্য চরিত্রের পরিসমাপ্তি ঘটে।
জেনি মার্কসের কথা দিয়েই এই আলোচনা শেষ করি – ‘আমরা নারীরা ঘরে বসে থাকি, সোজা বুঝি। এতে কিন্তু আমাদের দুঃশ্চিন্তা বা দুঃখ কষ্টের লাঘব হয়না – দৃঢ়তার সাথে একজনকে জীবন সংগ্রামের সম্মুখীন হতে হবে। আমার ত্রিশ বছরের অভিজ্ঞতা থেকে আমি একথা বলছি।’
আজকের সময়ে দাঁড়িয়ে যারা মজুরি দাসত্ব থেকে শ্রমিকের মুক্তির কথা ভাবেন – পুঁজিবাদ এবং পুরুষতন্ত্রের দ্বিবিধ শোষণ থেকে নারীমুক্তির স্বপ্ন দেখেন জেনি মার্কসের জীবন তাদের অবশ্যই অনুপ্রাণিত করবে।
শোষনহীন বিশ্ব সৃষ্টি করার জন্য আজও যে সংগ্রাম চলছে তার মধ্যেই জেনির সংগ্রামী চরিত্র বেঁচে থাকবে।
লেখক: মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক গবেষক, সাংবাদিক ও কলামিস্ট
সারাবাংলা/এসবিডিই
জ্ঞানের আলোকবর্তিকা মহীয়সী জেনি মার্কস মুক্তমত সৈয়দ আমিরুজ্জামান