যুক্তরাষ্ট্রের নির্বাচনে কি ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি
৪ নভেম্বর ২০২৪ ১৬:০৫
মার্কিন মুলুকের নির্বাচন মানেই বিশ্বের সব হিসাব নিকাশের ওলট পালট হওয়া। এখন শুধু শেষ মুহূর্তের অপেক্ষা মাত্র। এবার যেমন ট্রাম্প বনাম কমলা হ্যারিসের প্রতিদ্বন্দ্বিতায় ইতিমধ্যেই সেই আলোচনা শুরু হয়েছে। ইউক্রেন ও মধ্যপ্রাচ্য যুদ্ধের হিসাব নিকাশ রয়েছে সবচেয়ে আগে। এছাড়াও বিশ্বের অন্যান্য দেশের সাথে সম্পর্ক বিশেষত চীনের সাথে সম্পর্ক কেমন হবে সেটাও নির্ভর করছে কে ক্ষমতায় আসছে। যদিও এটা এখন আর অল্প কিছু সময়ের ব্যাপার মাত্র। জরিপের হিসাব নিকাশ যাই বলুক শেষ পর্যন্ত কি হবে অথবা কে হবে সেটাও সময় না হলে বলা যাবে না। এর কারণ হলো দোদূল্যমান অঙ্গরাজ্যের ভোট এবং শেষ মুহুর্তের ইলেক্টরাল ভোটের মারপ্যাঁচ। ভোটারের হিসাবে জয় লাভ করলেও শেষ মুহুর্তে ইলেক্টরাল ভোটেও যে কেউ প্রেসিডেন্ট হয়ে যেতে পারেন যেমনটা ট্রাম্প হয়েছিলেন হিলারি ক্লিনটনকে হারিয়ে। যুক্তরাষ্ট্রের ভোটাররা সরাসরি প্রেসিডেন্ট বা ভাইস প্রেসিডেন্ট নির্বাচন করতে পারেন না, ভোট হয় ‘ইলেক্টোরাল কলেজ’ নামের একটি পদ্ধতির মাধ্যমে। যুক্তরাষ্ট্রের ৫০টি প্রদেশ মিলিয়ে মোট ৫৩৮ জন ইলেক্টর রয়েছেন। ক্ষমতা দখল করতে প্রয়োজন ২৭০টি ভোট (পাশের সারণি)। কিন্তু অনেক সময়েই দেখা যায়, জনগণের ভোট বেশি পেয়েও শেষ পর্যন্ত হারতে হয়েছে কোনো প্রার্থীকে। সাম্প্রতিক ইতিহাসে এর দুটি উদাহরণ-২০০০ ও ২০১৬’র প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে এ ভাবেই হেরে যান দুই ডেমোক্র্যাট প্রার্থী, যথাক্রমে অ্যাল গোর এবং হিলারি ক্লিনটন। এত কিছুর মধ্যেই মানুষের মনে শঙ্কা ভর করছে বিগত নির্র্বাচনের দুঃস্বপ্ন। সেবার বাইডেন প্রেসিডেন্ট হলেও ফলাফল মানতে নারাজ ছিলেন ট্রাম্প। এরপর ক্যাপিটেল হিলে নজির বিহীন ঘটনা সারা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের গণতন্ত্রকেই প্রশ্নবিদ্ধ করেছে। এবারও কে সেরকম কিছু হতে পারে? মানুষ ইতিহাস থেকে শিক্ষা নেয় না। ইতিহাসই নানারুপে ফিরে আসে। অন্তত যদি ট্রাম্প নির্বাচনে বিজয়ী না হতে পারেন? সেই আশঙ্কা এখনও ফেলে দেবার মতো না। জনমত সমীক্ষা বলছে- ট্রাম্পের সঙ্গে হাড্ডাহাড্ডি লড়াই হতে চলেছে কমলা হ্যারিসের। কিন্তু নির্বাচন বিশ্লেষকদের মতে, ইলেক্টোরাল কলেজের ভোটে এগিয়ে ট্রাম্পই।
নেভাডা, অ্যারিজ়োনা, মিনেসোটা, পেনসিলভেনিয়া, জর্জিয়া, নর্থ ক্যারোলাইনা, উইসকনসিন- এই ‘অনিশ্চিত’ প্রদেশগুলিই ঠিক করবে হোয়াইট হাউসে ট্রাম্প ফিরছেন কি না। এখনও ভোট শেষ হয় নি এবং নাটকের অনেক কিছুই বাকি রয়েছে। কারণ দোদূল্যমান অঙ্গরাজ্য যেসব রাজ্য মূলত প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের ভাগ্য নির্ধারণ করে দেয় সেসব অঙ্গরাজ্যগুলিতে এখনও ভোট বাকি রয়েছে। সুতরাং হিসাবের এখনও অনেকটা বাকি আছে। ট্রাম্পের সময়ে নীতি ছিল আমেরিকা ফার্ষ্ট আর বাইডেনের যুক্তরাষ্ট্রের স্বমূর্তিতে ফিরে আসার নীতি। বিশ্লেষকরা বলছেন, যুক্তরাষ্ট্রের আগামী প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক ও ব্যক্তিগত ইস্যু বড় ইস্যু হয়ে দাঁড়াবে। এখন দেখা যাক, আগামী নির্বাচনে প্রার্থীতার ক্ষেত্রে কোন বিষয়গুলো প্রভাব বিস্তার করবে। নিঃসন্দেহে গত কয়েক দশক থেকে বর্তমানের পরিস্থিতি ভিন্ন। চীন ও রাশিয়ার সাথে প্রতিযোগীতা, নিজেদের আধিপত্য বজায় রাখা, করোনা ও যুদ্ধের কারণে বৈশি^ক অর্থনীতিও দুঃসময়ে,বেকারত্ব প্রভৃতি নানা প্রতিকূলতার মুখোমুখি হতে হচ্ছে আমেরিকার। তবে আমেরিকার আভ্যন্তরীণ নীতিতে খুব বেশি পরিবর্তন আসে না সে প্রেসিডেন্ট যেই হোক না কেন। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ চলছে পুরোদমে। যা থামার কোনো লক্ষণ নেই। এই যুদ্ধ ইউক্রেন করলেও প্রচ্ছন্নভাবে রয়েছে যুক্তরাষ্ট্র। অর্থাৎ এটা যুক্তরাষ্ট্রের জন্য একটি প্র্যাষ্টিজ ইস্যু হয়ে দাড়িয়েছে। আসন্ন মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে যদি রিপাবলিকান প্রার্থী ডোনাল্ড ট্রাম্প জয়ী হন, তাহলে যুক্তরাষ্ট্র বিদেশে কোনো যুদ্ধ করবে না। কোনো মার্কিন সেনাকেও আর যুদ্ধের জন্য বিদেশে পাঠানো হবে না।
এমন প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন প্রেসিডেন্ট প্রার্থী ডোনাল্ড ট্রাম্প। তিনি বলেছেন, বর্তমান প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের শাসনামলে যতগুলো আন্তর্জাতিক সংকটে জড়িয়েছে যুক্তরাষ্ট্র, সেসবের প্রত্যেকটির সমাধান করবেন তিনি এবং এক্ষেত্রে অগ্রাধিকার দেবেন ইউক্রেন ও গাজা সংঘাতকে। এবারের নির্বাচনের আগে দেশটিতে রেকর্ড সংখ্যক আগাম ভোট পড়েছে। এরই মধ্যে আগাম ভোট দিয়েছেন প্রায় ৭ কোটি ভোটার। যুক্তরাষ্ট্রে ভোট দেওয়ার বয়স হয়েছে এমন মোট জনসংখ্যা ২৩ কোটির বেশি। তবে নিবন্ধিত ভোটার প্রায় ১৬ কোটি। প্রতিদ্বন্দ্বী পরাশক্তিগুলোর সাথে কূটনৈতিক দক্ষতায় এগিয়ে থাকা এবং মধ্যপ্রাচ্যসহ বৈশ্বিক নিয়ন্ত্রণে আমেরিকার ভূমিকা শক্তিশালী করার নীতিও আগামী নির্বাচনে ফ্যাক্ট হয়ে কাজ করবে। বিশেষত মধ্যপ্রাচ্যে সম্প্রতি যুক্তরাষ্ট্রের বিপরীতে চীন গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে। সেক্ষেত্রে এ অঞ্চলে যুক্তরাষ্ট্রের একাধীপত্য প্রশ্নের মুখে। বিশ্ব খুব দ্রুত বদলে যাচ্ছে। এখন বিশ্ব বহুমুখী ব্যবস্থায় অগ্রসর হচ্ছে। কোনো দেশ একক কোনো দেশের কতৃত্বের বদলে একাধিক দেশের সাথে সম্পর্ক গড়ে তুলছে। সেক্ষেত্রে একসময় দ্বন্দ্ব থাকলেও তারা এখন পারস্পরিক সহযোগীতার সম্পর্ক গড়ে তুলছে। একদিকে রয়েছে মৌলিক কিছু বিষয়ে দ্বন্দ্ব আবার অন্যদিকে রয়েছে পারস্পরিক স্বার্থ সংশ্লিষ্ট বিষয়ে ঐক্যমত। এভাবেই এগিয়ে চলেছে বিশ্ব। সেই বিশ্বে যুক্তরাষ্ট্রকে কৌশলগতভাবে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকার রাখতে হবে। আগাম ভোটের বুথ-ফেরত জরিপ বলছে, আনুষ্ঠানিক ভোটগ্রহণের আগে আগাম ভোটে রিপাবলিকান প্রার্থী ডোনাল্ড ট্রাম্পের চেয়ে বড় ব্যবধানে এগিয়ে আছেন ডেমোক্র্যাট প্রার্থী কমলা হ্যারিস। এমনকি সাত দোদুল্যমান রাজ্যের আগাম ভোটে ছয়টিতেই এগিয়ে রয়েছেন কমলা। শুধুমাত্র নেভাদায় কমলার থেকে এগিয়ে আছেন ট্রাম্প।
যদিও বুথ ফেরত জরিপকে এখনি চুড়ান্ত ধরার কোনো কারণই নেই। কারণ ইতিহাস বলছে, এরপরেও ফলাফলে পরিবর্তন হয়েছে। আমরা ভারতের নির্বাচনেও সেটাই দেখেছি। প্রশ্ন যদি ট্রাম্প প্রেসিডেন্ট না হন এবং বিগত বারের মতোই ফলাফল মেনে না নেন সেক্ষেত্রে কি হবে? যুক্তরাষ্ট্র কি আবারও একই চিত্র দেখতে পারে? ফলাফল উলটো হলে অর্থাৎ নির্বাচনে ট্রাম্প হেরে গেলে ২০২১ সালে ঘটে যাওয়া সহিংস ঘটনার পুনরাবৃত্তি হতে পারে বলে আশঙ্কা করছেন অনেকেই। ট্রাম্প বলেছেন, সৃষ্টিকর্তা নিজে ভোটের ফলাফল গণনা করলে তিনি ভূমিধস জয় পেতেন। ট্রাম্পের এ মন্তব্যে বোঝা যায়, তার মিথ্যা নির্বাচনি জালিয়াতির দাবি কীভাবে অযৌক্তিক মাত্রায় পৌঁছেছে। তবে এটা নতুন কিছু নয়। চার বছর আগেও তিনি দাবি করেছিলেন, ভোট কারচুপির কারণে তিনি পরাজিত হয়েছেন। এরপর তিনি দেশটির রাজধানীতে দাঙ্গা বাধিয়ে ছাড়েন। যদিও নিরাপত্তা ব্যবস্থা আগেই জোরদার করা হয়েছে। তাছাড়া পরিস্থিতি এড়াতে ডেমোক্র্যাট শিবির পরিকল্পনা করেছেন। কিন্তু যদি সেটাই হয় তবে তা হবে যুক্তরাষ্ট্র এবং গণতান্ত্রিক বিশ্ব ব্যবস্থার জন্য একটি খারাপ উদাহরণ।
লেখক: কলামিষ্ট
সারাবাংলা/এসবিডিই