৭ নভেম্বরের বিপ্লব: মওলানা ভাসানী ও জিয়াউর রহমান
৭ নভেম্বর ২০২৪ ১৫:৩০
১৬ ডিসেম্বর, ১৯৭১ দীর্ঘ নয়মাস রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে পৃথিবীর মানচিত্রে প্রতিষ্ঠিত হয় স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ। লাখো শহীদ আর মা বোনের ইজ্জ্বতের বিনিময়ে অর্জিত হয় লালসবুজের পতাকা। ৭২-এর ১০ জানুয়ারী স্বদেশ প্রত্যাবর্তন করেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, আর তারও ১২ দিন পর ২২ জানুয়ারী স্বদেশের মাটিতে ফিরে আসেন স্বাধীন বাংলাদেশের স্বপ্নদ্রষ্টা মজলুম জননেতা মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী। স্বাধীনতার পর যদিও সমগ্র জাতির প্রত্যাশা ছিল একটি জাতীয় সরকার, কিন্তু তা প্রতিষ্ঠিত না হয়ে হলো আওয়ামী লীগের দলীয় সরকার। সরকার প্রতিষ্ঠার পর থেকেই একের পর এক ভুল সিদ্ধান্তের ফলে সারা দেশে শুরু হয় অরাজক পরিস্থিতি, শুরু হয় সরকারের কঠোর সমালোচনা। তাতে করে সরকার এবং সমালোচকদের মধ্যে সম্পর্ক তিক্ততায় পর্যবসিত হয়। সমালোচকরা সরকারি দলের শত্রুতে পরিণত হয়, তাদের আখ্যায়িত করা হয় দেশদ্রোহী হিসাবে।
তৎকালীন সরকারে আবু সাঈদ চৌধুরী, জেনারেল ওসমানীর মত সৎ-ত্যাগী ব্যক্তি থাকলেও সরকারের মধ্যে একশ্রেণীর সরকারি দলের নেতাদের পৃষ্ঠপোষকতায় স্বাধীনতার অব্যাহতি পরপরই এমন সব সমাজ ও রাষ্ট্রবিরোধী কাজ ব্যাপকভাবে চলতে থাকে যা যে কোন বিবেকবান মানুষকে ব্যথিত ও বিচলিত করে। এই পরিপ্রেক্ষিতে মজলুম জননেতা মওলানা ভাসানীও সরকারের কঠোর সমালোচনা করতে থাকেন। এরই মধ্যে আবার সরকার স্বাধীন রাষ্ট্রের শাসনতন্ত্র প্রণীত হয়। এই শাসনতন্ত্র প্রণয়নে সরকার অন্যকোন দলের পরামর্শ গ্রহণের প্রয়োজন অনুভব করেনি, ফলে প্রত্যেক দলের মধ্যেই ক্ষোভ সৃষ্টি হয়। এমনকি যারা সরকারের সমর্থক ছিলেন তারাও ক্ষোভ প্রকাশ করে।
২৯ অক্টোবর ৭২-এ সরকার সমর্থক ন্যাপ মোজাফ্ফর‘এর শীর্ষ নেতারা যেমন পীর হাবিবুর রহমান, পঙ্কজ ভট্টাচার্য, মতিয়া চৌধুরী, আবদুল হালিম, সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত এক প্রচার পত্রে বলেন : “…. গভীর ক্ষোভ ও পরিতাপের বিষয় যে, শাসনতন্ত্রের মত জাতির একটি পবিত্র দলিল প্রণয়নের ক্ষেত্রে শাসক দল চরম একদলীয় সংকীর্ণ মনোভাব প্রদর্শন করিয়াছে। জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাপ্রদর্শন, জনমত যাচাই এবং স্বাধীনতা সংগ্রামে অংশগ্রহণকারী দেশপ্রেমিক রাজনৈতিক দলগুলোর মতামত ও পরামর্শ গ্রহণের তোয়াক্কা তাহারা করেন নাই।” ঐদিনই ন্যাপ (মো)-এর পল্টন ময়দানের সমাবেশে বজ্রকন্ঠে আওয়াজ তোলা হয়: ‘প্রধানমন্ত্রীর অযৌক্তিক ক্ষমতা কমাইয়া পরিষদকে সার্বভৌম করিতে হইবে।’ ১৯৭২ সালে ১৬ ডিসেম্বর শাসনতন্ত্র প্রণয়নের পরপরই ৭০-এর নির্বাচিত গণপরিষদ ভেঙ্গে দিয়ে ৭৩-এ ৭ মার্চ সাধারণ নির্বাচনের তারিখ ঘোষণা করেন সরকার। আওয়ামী লীগ ৩০০ আসনে ছাড়াও নির্বাচনে অংশ গ্রহণ করে ন্যাপ-ভাসানী ১৭০, ন্যাপ-মোজাফফর ২২৪, সদ্য প্রতিষ্ঠিত জাসদ-২৩৭, বাংলাদেশ জাতীয় লীগ (আতাউর রহমান খান), বাংলা জাতীয় লীগ (অলি আহাদ), শ্রমিক কৃষক সমাজবাদী দল, বাংলার কমিউনিস্ট পার্টি, বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি ৪টি আসনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে।
বিরোধী দলগুলোর ব্যাপক জনপ্রিয়তা ও মজলুম জননেতা মওলানা ভাসানীর সরকার বিরোধী বক্তব্যে সরকারি দল আতংকিত হয়ে পড়ে। নির্বাচনে শেখ মুজিবুর রহমান ২টি, সোহরাব হোসেন, তোফায়েল আহমেদ, মোতাহার উদ্দিন এবং কে.এম ওবায়দুর রহমান ৫টি আসনে মনোনয়নপত্র দাখিলের দিনই বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হন। মনোনয়ন পত্র প্রত্যাহারের শেষ দিন দেখা গেল সৈয়দ নজরুল ইসলাম, এ.এইচ.এম কামরুজ্জামান, মনোরঞ্জন ধর, জিল্লুর রহমান ও রফিকউদ্দিন ভূইয়াও বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হন। সকল দলের নেতাদের মত মওলানা ভাসানীও এই ধরনের কার্যক্রমের কঠোর সমালোচনা করেন। বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হওয়ার এই প্রবণতাকে ভারতীয় পত্র-পত্রিকাগুলোতেও কঠোর সমালোচনা করা হয়। একজন প্রার্থীর মৃত্যুর ফলে ২৯৯টি আসনে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হলে ৭টি আসন বাদে সকল আসনই আওয়ামী লীগ জয়লাভ করে ব্যাপক কারচুপির মাধ্যমে।
বিরোধী দলগুলো যখন কারচুপির অভিযোগ করছে তখন প্রধানমন্ত্রী সাংবাদিক সম্মেলনে বলেন, “বাংলাদেশে কোন বিরোধী দল নেই।” ৮ মার্চ সাংবাদিক সম্মেলনে ন্যাপ-ভাসানী সিনিয়র সহ-সভাপতি ডঃ আলীম আল রাজি বলেন, ‘নির্বাচন অবাধ ও নিরপেক্ষ হয়নি, সন্ত্রাস, ভয়ভীতির মধ্যে অনুষ্ঠিত হয়েছে।’ অধ্যাপক মোজাফ্ফর আহমেদ ও পঙ্কজ ভট্টাচার্য এক বিবৃতিতে বলেন, “অন্ততঃ ৭০টি আসনে বিরোধী দলের বিজয়ী হওয়ার সম্ভাবনা ছিল। এই নির্বাচনকে তারা ‘প্রহসন’ আখ্যায়িত করেন।” জাতীয় সংসদ প্রতিষ্ঠিত হয় বিরোধীদলবিহীন। ফলে সারা দেশে আওয়ামী লীগের একক শাসন প্রতিষ্ঠিত হয় এবং সমাজ ও রাষ্ট্রে দেখা দেয় চরম অস্থিতিশীলতা। শিল্পাঞ্চলগুলোতে আইন শৃংখলা পরিস্থিতির অবনতি ঘটতে থাকে। সরকারি দলের ক্ষমতার মোহে অন্ধ হয়ে বিরোধী দলকে শায়েস্তা করতে প্রতিষ্ঠিত হয় ‘লাল বাহিনী’, ‘রক্ষি বাহিনী’।
সরকারের অপকর্মের বিরুদ্ধে বিরোধী দলগুলো কঠোর সমালোচনা করতে থাকে। ১৫ মে সকাল ৮টা থেকে ঢাকায় ন্যাপের কার্যালয়ে মজলুম জননেতা মওলানা ভাসানী সরকারের খাদ্য, বস্ত্র ও দ্রব্যমূল্য হ্রাস, দমননীতি বন্ধ করা এবং শিল্প-ব্যবসা-চাকরী ও জনজীবনের সর্বক্ষেত্রে অরাজকতার অবসান ও জানমালের নিরাপত্তা বিধানের দাবিতে আমরণ অনশন শুরু করেন। ১৮ মে মওলানা ভাসানীর অবস্থা অবনতি ঘটায় সকল বিরোধী দল তাকে অনশন ভাঙ্গার আহ্বান জানান।
১৯ মে মওলানা ভাসানীর অবস্থার আরো অবনতি ঘটলে হাজার হাজার জনতার ঢল নামে ঢাকায়। রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ থেকে সর্বস্তরের জনগণ তাকে হাসপাতালে নেবার চেষ্টা করে ব্যর্থ হন। মওলানা ভাসানীর জীবন রক্ষার্থে সকল রাজনৈতিক দলগুলোও ভাসানী ন্যাপের আন্দোলনের সাথে একাত্মতা ঘোষণা করেন। বিরোধী দলগুলোর মধ্যে ঐক্য সূচিত হতে থাকে। অন্যদিকে জোরদার হতে থাকে সরকারের দমননীতি। ২২ মে সার্বিক পরিস্থিতি বিবেচনা করে এবং অনুরাগীদের অনুরোধে মওলানা ভাসানী ৮ম দিন ২২ মে অনশন ভঙ্গ করেন। এভাবে সরকারের পক্ষে ও বিরুদ্ধে ব্যাপক পোলারাইজেশন হতে থাকে। এরই মধ্যে ১৯৭৪ সালে দেশে চরম দুর্ভিক্ষের পদধ্বনি শোনা যাচ্ছিল। মওলানা ভাসানী দেশব্যাপী সমাবেশ করে সরকারকে এ সম্পর্কে অবিরাম সতর্ক করে দিচ্ছিলেন। কিন্তু সরকার তাতে কর্ণপাত করেনি।
এরই মধ্যে দুর্ভিক্ষের কালো থাবায় মারা যায় হাজার হাজার মানুষ। সরকারের আভ্যন্তরীণ ব্যর্থতার পাশাপাশি আন্তর্জাতিক ভাবেও ব্যর্থ হতে থাকে। সীমান্তে শুরু হয় বন্ধু রাষ্ট্র ভারতের আগ্রাসন। দেশের অভ্যন্তরে বিরোধী দলকে শায়েস্তার নামে দেশপ্রেমিক সিরাজ শিকদারসহ ৩৬ হাজার দেশপ্রেমিক রাজনৈতিক নেতা-কর্মীকে হত্যা করা হয় সরকারের প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ মদদে। ইতিমধ্যে সরকার মজলুম জননেতা মওলানা ভাসানীকে সন্তোষে নজরবন্দী করা হয়। ৩০ জুন’৭৪ থেকে ১৫আগষ্ট‘৭৫ পর্যন্ত মওলানা ভাসানী সন্তোষে নজরবন্দী ছিলেন। মওলানা ভাসানী নজরবন্দী অবস্থায় বাংলাদেশের রাজনীতিতে ও রাষ্ট্রিয় জীবনে বহু গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা ঘটে যায়। ২৮ ডিসেম্বর রাষ্ট্রপতি এক অধ্যাদেশ দ্বারা দেশে জরুরী আইন জারি করে। ২৫ জানুয়ারী ৭৫-এ জাতীয় সংসদে মাত্র ১১ মিনিটে বহুদলীয় গণতন্ত্রকে হত্যা করে একদলীয় বাকশাল প্রতিষ্ঠা করা হয়। সরকারি দলের এই অগণতান্ত্রিক সিদ্ধান্তের প্রতিবাদে সেদিন জাতীয় সংসদ থেকে পদত্যাগ করেন সরকার দলীয় সংসদ সদস্য মুক্তিযুদ্ধের সর্বাধিনায়ক জেনারেল এম.এ.জি ওসমানী ও ব্যারিষ্টার মঈনুল হোসেন। আর অন্যদিকে জাতীয় লীগ নেতা আতাউর রহমান খানসহ কয়েকজন সদস্য বাকশালে যোগ দেন। ২৩ শে জুন ৪টি সংবাদপত্র বাদে সকল সংবাদপত্র বন্ধ করে দেয়া হয়।
বাকশাল প্রতিষ্ঠা ও সংবাদপত্র বন্ধ হয়ে যাওয়ার পর সারা দেশে এক শ্বাসরুদ্ধকর পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়। বাকশাল প্রতিষ্ঠার ৬ মাস ২০ দিনের মাথায় ১৯৭৫-এর ১৪-১৫ আগষ্ট মধ্যরাতে সামরিক বাহিনীর কয়েকজন জুনিয়র অফিসার সংঘটিত করে ইতিহাসের নৃশংস ঘটনা, বাংলাদেশের রাষ্ট্রপ্রধান বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে হত্যা করা হয়। এই নৃশংস হত্যাকান্ডের মাত্র অল্প সময়ের পর তৎকালীন সেনাপ্রধান মেজর জেনারেল কে.এম শফিউল্লাহ, বিমানবাহিনী প্রধান এ.কে. খন্দকার ও নৌবাহিনী প্রধান কমোডর এম.এইচ.খান পৃথক পৃথক বেতার ভাষণে শেখ মুজিবুর রহমানের মন্ত্রীসভার মন্ত্রী খন্দকার মোশতাক আহমেদের নতুন সরকারের প্রতি আনুগত্য জানিয়ে শ্রদ্ধা নিবেদন করেন। ১৩ আগষ্ট থেকে মওলানা ভাসানী সন্তোষে তার ইবাদত গৃহে ধ্যানমগ্ন ছিলেন। ১৫ আগষ্ট ফজরের নামাজের পর তিনি ইবাদতগৃহ থেকে বেরিয়ে আসেন। এরই মধ্যে বেতারে তিনি ঢাকার অভ্যুত্থানের ঘটনা ও শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে হত্যার ঘটনা শুনে স্তম্ভিত হয়ে পড়েন।
পরদিন ১৬আগষ্ট জেনারেল ওসমানী প্রেসিডেন্ট খন্দকার মোশতাক আহমেদের নির্দেশে সন্তোষে মওলানা ভাসানীর কাছে গিয়ে দেশের সর্বশেষ পরিস্থিতি ব্যাখ্যা করে তার বিবৃতি প্রত্যাশা করলে তিনি বলেন, ‘সবই যখন শেষ তখন আর এই বুড়োর বিবৃতির প্রয়োজন কি?’ ২১ আগষ্ট খন্দকার মোশতাক আহমেদ নিজে মওলানা ভাসানীর সাথে দেখা করলেও তিনি কোন বিবৃতি দেননি। ২৪আগষ্ট কয়েকজন রাজনীতিবিদ মওলানা ভাসানীর সাথে দেখা করে অনুরোধ করলে তিনি বিবৃতি প্রদান করেন যাতে তিনি “মেহনতি মানুষ, বুদ্ধিজীবী, সরকারি ও আধাসরকারি কর্মচারী, সামরিক ও আধাসামরিক বাহিনী, বেসামরিক নাগরিক ও মুসলমান, হিন্দু, বৌদ্ধ, খৃষ্টান নির্বিশেষে সমস্ত মানুষের প্রতি শুধু রাজনৈতিক স্বাধীনতাই নয় সকলের জন্য অর্থনৈতিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও ধর্মীয় স্বাধীনতা পুরোপুরি অর্জনের জন্যে নিরলসভাবে কঠোর পরিশ্রম করার আহ্বান জানান।” (দৈনিক বাংলা ২৫ আগষ্ট‘৭৫)
৪ অক্টোবর এক বেতার ভাষণে খন্দকার মোশতাক আহমেদ ১৯৭৭ সালের ফেব্রুয়ারীতে সাধারণ নির্বাচনের ঘোষণা দেন। এ ব্যাপারে সাংবাদিকরা মওলানা ভাসানীর প্রতিক্রিয়া জানতে চাইলে তিনি ‘সকল রাজবন্দীর মুক্তি, প্রাপ্ত বয়স্কদের সার্বজনীন ভোটাধিকারের ভিত্তিতে সাধারণ নির্বাচন ও সংবাদপত্রের স্বাধীনতার প্রতিশ্রুতি দিয়ে (প্রেসিডেন্টের) যে ভাষণ দেন (তার জন্য তাকে) ধন্যবাদ জানান। ৯ অক্টোবর তিনি এক বিবৃতিতে ৭ ডিসেম্বর টাঙ্গাইলের সন্তোষে এক কৃষক সম্মেলনের ঘোষণা দেন। খন্দকার মোশতাক আহমেদের ৮২ দিনের শাসনকালে মওলানা ভাসানী কোন রাজনৈতিক কর্মকান্ডে জড়িত হননি, এসময় তিনি সন্তোষে অবস্থান করেন। মাঝে মাঝে ঢাকা থেকে বিভিন্ন রাজনৈতিক নেতারা সন্তোষে যেতেন তার সাথে সাক্ষাত করতে।
এর মধ্যে ৩ নভেম্বর রাতে ব্রিগেডিয়ার খালেদ মোশারফের নেতৃত্বে আরেকটি সামরিক অভ্যুত্থান ঘটে। সেনাপ্রধান জিয়াউর রহমানকে গৃহবন্দী করা হয়। ৩ নভেম্বর ঘটে যায় ইতিহাসের আরেকটি নৃশংস ঘটনা। ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে নির্মমভাবে হত্যা করা হয় ৪ জাতীয় নেতা সৈয়দ নজরুল ইসলাম, তাজউদ্দিন আহমেদ, এম. মনসুর আলী ও এ.এইচ.এম কামরুজ্জামানকে। খন্দকার মোশতাক আহমেদ সে সময় গণভবনে থাকলেও কার্যত তিনি ছিলেন ক্ষমতাচ্যুত। খালেদ মোশারফকে ‘১৯৭৫ সালের ৩ নভেম্বর পূর্বাহ্নে মেজর জেনারেল পদে উন্নীত করিয়া চীফ অফ আর্মি স্টাফ নিয়োগ করা হয়।’
এক সরকারি বিজ্ঞপ্তিতে আরো বলা হয় যে, ‘একই দিনে মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমান বীরউত্তম পিএসসি পদত্যাগ করায় তিনি (খালেদ মোশারফ) তাহার স্থলাভিষিক্ত হইয়াছেন।’ ৬ নভেম্বর সুপ্রিম কোর্টের প্রধান বিচারপতি আবু সাদাত মোহাম্মদ সায়েমের কাছে রাষ্ট্রপতির দায়িত্ব অর্পণ করা হয়। এখানেই শেষ নয় ৭ নভেম্বর আরেক অভ্যুত্থানের রাষ্ট্রক্ষমতায় নতুন বাক সৃষ্টি হয়। যাকে ‘সিপাহী জনতার অভ্যুত্থান’ বা ‘জাতীয় বিপ্লব ও সংহতি দিবস’ বলে অভিহিত করা হয়। বন্দিদশা থেকে জিয়াউর রহমান মুক্তি পান। এ প্রসঙ্গে প্রখ্যাত বাম নেতা হায়দার আকবর খান রনো মাসিক অনুসরণ পত্রিকায় লিখেছেন, “অভ্যুত্থান হিসাবে ৭ নভেম্বর সিপাহী অভ্যুত্থান সফল হয়েছিল। … মধ্যরাত থেকে দলে দলে সিপাহীরা আর্মি গাড়ি করে স্লোগান দিতে দিতে শহরে প্রবেশ করলো। ট্যাংক বাহিনী ট্যাংকসহ শহরে ঢোকেন। সিপাহীদের স্লোগান ছিলো ‘সিপাহী বিপ্লব-জিন্দাবাদ’, ‘সিপাহী জনতা ভাই ভাই’, ‘জেনারেল জিয়া জিন্দাবাদ’, ‘রুশ ভারতের দালালরা হুঁশিয়ার’। শেষ রাতের দিকে রেডিও স্টেশন থেকে আবেগজড়িত কন্ঠে ঘোষণা করা হলো যে, মেহনতি মানুষের সন্তান সিপাহীরা বিপ্লব করেছে। … ঢাকা শহর সিপাহী-জনতার উৎসবমুখর মিছিল আর মিছিলে ভরে গেল। এ যেন জনতার এক মহাবিজয় উল্লাস। এমন অভুতপূর্ব দৃশ্য আমরা আর কোন দিন দেখিনি।
…৭ নভেম্বর ভোরে মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমান রেডিওতে সংক্ষিপ্ত ভাষণ দেন। …৭ নভেম্বর থেকে জিয়া ব্যস্ত হয়ে উঠলেন সেনাবাহিনীতে পুরাতন শৃংখলা ফিরিয়ে আনতে। সিপাহীদের ক্যান্টনম্যান্টে ফিরে আসার জন্য তিনি আহ্বান জানালেন। সিপাহীদের মাঝে একাধিক বক্তৃতা করলেন।” ৭ নভেম্বর দুপুরে বঙ্গভবন থেকে সন্তোষে মওলানা ভাসানীর সাথে যোগাযোগ করা হলে ঐদিনই জেনারেল জিয়ার কাছে তিনি এক তার বার্তা প্রেরণ করেন যাতে তিনি বলেন, “May Allah bless you and your government. Let Army and the people be united to work for independence and sovereignty. Let there be rule of Rabubiat for the emacipation of mankind irrespective of creed and caste.”
পরদিন মওলানা ভাসানী জিয়াউর রহমানের কাছে এক পত্র প্রেরণ করেন যাতে লিখেছিলেন, “আল্লাহ পাকের দরবারে প্রার্থনা, তুমি বিরাট দায়িত্ব গ্রহণ করিয়াছ, তাহা পালন করিতে সক্ষম হও।” ১২ নভেম্বর প্রেসিডেন্ট সায়েম ও জিয়াউর রহমানের অনুরোধে আতাউর রহমান খান ও ব্যারিষ্টার মঈনুল হোসেন সন্তোষে মওলানা ভাসানীর নিকট যান একটি বিবৃতি দেয়ার প্রস্তাব নিয়ে। তারা মওলানা ভাসানীর বক্তব্য রেকর্ড করে নিয়ে আসেন যা ১৩ নভেম্বর ১৯৭৫-এ দৈনিক বাংলা ও হক কথায় প্রকাশ করা হয়। যেখানে মওলানা ভাসানী বলেন, “বাংলাদেশের স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ব নস্যাৎ করিবার সাম্প্রতিক এক গভীর ষড়যন্ত্র ব্যর্থ করা হইয়াছে। তাহাতে বীর মোজাহেদ প্রতিরক্ষা বাহিনী, বিডিআর, পুলিশ, আনসার ও দেশপ্রেমিক জনসাধারণ যে ভূমিকা পালন করিয়াছেন তজ্জন্য অন্তরের অন্তঃস্থল হইতে সকলকে মোবারকবাদ জানাইতেছি। কিন্তু, পরিতাপের বিষয়, বাংলাদেশের নগণ্য সংখ্যক মীরজাফরকে অবলম্বন করিয়া এখনো দেশী-বিদেশী শক্তি আমাদের স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্বকে বানচাল করিতে উঠিয়া পড়িয়া লাগিয়াছে। … যে কোন ত্যাগের বিনিময়ে সেনাবাহিনী, নৌবাহিনী, বিমানবাহিনী, বিডিআর, পুলিশ ও আনসারদের শৃংখলা বজায় রাখিতে হইবে। দেশরক্ষায় আমাদের তিন বাহিনীর বিশেষ দায়িত্ব রহিয়াছে। … এতদসঙ্গে জনগণ কেউ নীরব দর্শকের ভূমিকা পালন করিলে চলিবে না। … বাংলাদেশ পৃথিবীতে মর্যাদার সহিতই বাঁচিয়া থাকিবে। জাতি-ধর্ম-গোত্র-বর্ণ নির্বিশেষে অসাম্প্রদায়িক জাতি হিসাবে যাহাতে আমরা বিশ্বের দরবারে নিজেদের সুপ্রতিষ্ঠিত করিতে পারি-আল্লাহ পাকের দরবারে এই মোনাজাত করিতেছি। আল্লাহ আমাদের সহায় হউন। নাসরুম মিনাল্লাহা ওয়া ফাতহুন কারীব।”
৭৫-এর ১৫ আগষ্ট দুঃখজনক ঘটনার পর থেকে বাংলাদেশের স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ব নিয়ে অব্যাহত চক্রান্ত ষড়যন্ত্রের বিরুদ্ধে ৭৫-এর ৭ নভেম্বরের ঐতিহাসিক সিপাহী জনতার বিপ্লবের মাধ্যমে যে প্রতিরোধ সংগ্রামের সূচনা হয়েছিল মওলানা ভাসানী যদি সেদিন জিয়াউর রহমানকে সমর্থন না জানাতেন তবে এ সংগ্রাম পথের মধ্যেই নিঃশেষ হয়ে যেত। আধিপত্যবাদ-সাম্রাজ্যবাদ, ব্রাম্ম্যণ্যবাদ-আগ্রাসনবাদের কালো থাবা থেকে বাংলাদেশের স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ব, পতাকা-মানচিত্র রক্ষায় এদেশের দেশপ্রেমিক সিপাহী-জনতার সংগ্রামের পাশে মওলানা ভাসানীর সমর্থন সংগ্রামকে করেছিল বেগবান। ৭ নভেম্বরের সফলতার সাথে যে মানুষটিকে শ্রদ্ধার সাথে স্মরণ করতে হবে তিনিই হচ্ছেন ইতিহাসের মহানায়ক স্বাধীন বাংলাদেশের স্বপ্নদ্রষ্টা মজলুম জননেতা মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী।
৭ নভেম্বর পরবর্তী শুধু জিয়াউর রহমানকে সমর্থন দিয়েই তিনি ক্ষান্ত হননি। বরং জিয়াউর রহমান ও তার সরকার এবং দেশের স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ব রক্ষায় মওলানা ভাসানী তার বৃদ্ধ বয়সে ঘুরে বেড়িয়েছেন সারা বাংলাদেশের সীমান্ত এলাকাগুলোতে। জনসভায় বক্তব্যের মাধ্যমে ভারতীয় আগ্রাসনের বিরুদ্ধে জনগণকে সোচ্চার করেছেন। ভারতীয় পানি আগ্রাসনের বিরুদ্ধে করেছেন ঐতিহাসিক ফারাক্কা লংমার্চ। এই সকল বিবেচনাই মওলানা ভাসানীকে যদি আমরা জাতিয়তাবাদী ও দেশপ্রেমিক শক্তি যথাযোগ্য মর্যাদা প্রদান করতে ব্যর্থ হই তাহলে নিজেদেরকে কিভাবে দেশপ্রেমিক ও জাতিয়তাবাদী বলি? ৭ নভেম্বরের চেতনার সাথে মজলুম জননেতা মওলানা ভাসানী ও শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িত।
লেখক: মহাসচিব, বাংলাদেশ ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি-বাংলাদেশ ন্যাপ; আহ্বায়ক-জাতীয় কৃষক-শ্রমিক মুক্তি আন্দোলন
সারাবাংলা/এসবিডিই
৭ নভেম্বরের বিপ্লব: মওলানা ভাসানী ও জিয়াউর রহমান এম. গোলাম মোস্তফা ভুইয়া মুক্তমত