‘মাকে হত্যা করে ডিপফ্রিজে’ ও আমাদের মিডিয়া ট্রায়াল সংস্কৃতি
১৭ নভেম্বর ২০২৪ ১৪:১৬
সম্প্রতি বগুড়ার দুপচাঁচিয়ায় ঘটে যাওয়া একটি ঘটনা সারাদেশে আলোড়ন সৃষ্টি করেছিল। একটি ছেলে তার মাকে হত্যার অভিযোগে গ্রেফতার হয় এবং সেই অভিযোগের পরপরই দেশের গণমাধ্যমে এবং সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে একের পর এক খবর প্রকাশ হতে থাকে। বলা হয়, কলেজপড়ুয়া ছেলেটি তার মাকে হত্যা করে ডিপফ্রিজে রেখে দিয়েছে। সেসময় র্যাবও জানিয়েছিল, হাতখরচের টাকার জন্য মাকে হত্যা করেছিল ছেলেটি। পরে মরদেহ ডিপ ফ্রিজে রেখে দেন।
এর কিছুদিন পর উম্মে সালমা (৫০) নামে গৃহবধূর হত্যাকাণ্ডের ঘটনাটি নতুন মোড় নেয়। পুলিশ জানায়, নিহতের ছেলে নয়, বাড়ির ভাড়াটিয়াই এই হত্যাকাণ্ড ঘটিয়েছেন। এ ঘটনায় তিনজনকে গ্রেফতার করা হয়েছে। দুপচাঁচিয়া থানার পুলিশ জানায়, হত্যাকাণ্ডের সময় ওই বাসা থেকে খোয়া যাওয়া মোবাইল ও ওয়াইফাই রাউটারের সূত্র ধরে বাসার ভাড়াটিয়া মাবিয়া আক্তারকে গ্রেফতার করা হয়। পুলিশের সূত্রে সংবাদমাধ্যমগুলো খবর প্রকাশ করে, জিজ্ঞাসাবাদে ভাড়াটিয়া স্বীকার করেছেন, চার মাস আগে বাসা ভাড়া নিয়ে মাদক ও অনৈতিক কাজ চালিয়ে যাচ্ছিলেন তিনি। বিষয়টি টের পেলে বাসা ছাড়ার নির্দেশ দেন উম্মে সালমা। ভাড়ার পাওনা টাকাসহ বিভিন্ন ইস্যুতে ক্ষুব্ধ হন মাবিয়া। এর জেরে দুই সহযোগীকে নিয়ে উম্মে সালমাকে নিয়ে হত্যার পর মরদেহ ফ্রিজে রেখে বেরিয়ে যান তারা।
এই যে কোনওকিছুর বিস্তারিত না জেনে র্যাবের প্রাথমিক সন্দেহের ওপর ভিত্তি করে কলেজপড়ুয়া ছেলেটিকে যে সর্বত্র দোষী সাব্যস্ত করা- এই প্রক্রিয়াকে ‘মিডিয়া ট্রায়াল’ বলে অভিহিত করা হয়। মিডিয়া ট্রায়াল মূলত গণমাধ্যমে কোনও ঘটনা নিয়ে বিচারিক প্রক্রিয়া শুরু হওয়ার আগেই কোনও ব্যক্তিকে দোষী বা নির্দোষ প্রমাণ করার প্রবণতা। এটি সমাজে আইন, নৈতিকতা এবং ব্যক্তিগত স্বাধীনতার ওপর একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রভাব ফেলে।
মিডিয়া ট্রায়ালের ক্ষতিকর দিক
আসামির অধিকার ক্ষুণ্ন হওয়া
বাংলাদেশের সংবিধান অনুযায়ী, প্রত্যেক ব্যক্তির ‘ন্যায়বিচার পাওয়ার অধিকার’ রয়েছে। কোনও মামলার আসামিকে আদালতে বিচার শুরু হওয়ার আগেই দোষী হিসেবে তুলে ধরলে তার ন্যায্য বিচার পাওয়ার সুযোগ ব্যাহত হয়। গণমাধ্যমে আলোচিত ছেলেটির ঘটনা নিয়ে যদি আমরা গভীরভাবে চিন্তা করি, দেখা যাবে যে তার ছবি, নাম, এবং ব্যক্তিগত তথ্য প্রকাশিত হওয়ায় সমাজে সে ও তার পরিবারের প্রতি নেতিবাচক মনোভাব তৈরি হয়েছে। এর ফলে যদি সে আদালতে নির্দোষ প্রমাণিত হয়, তবুও সমাজে তার ‘দোষী’ তকমা মুছে ফেলা কঠিন হবে।
আইনের শাসন ব্যাহত হওয়া
আইন অনুযায়ী, বিচার প্রক্রিয়ার প্রতিটি ধাপ একটি নির্দিষ্ট নিয়মে পরিচালিত হয়। কিন্তু মিডিয়া যখন নিজস্ব উপায়ে বিচার করতে শুরু করে, তখন তা বিচার বিভাগকে প্রভাবিত করতে পারে। বিচারকের মনোভাব, মামলার সাক্ষীদের নিরাপত্তা এবং মামলার ফলাফল প্রভাবিত হতে পারে। অনেক সময় মিডিয়ার প্রচার-প্রচারণা বিচারকদের ওপর জনমতের চাপ সৃষ্টি করে, যা সুবিচারের পথে বড় বাধা হতে পারে।
ব্যক্তিগত স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ
মিডিয়া ট্রায়ালে অভিযুক্ত ব্যক্তির ব্যক্তিগত জীবন নিয়ে অতিরিক্ত তথ্য প্রকাশিত হয়। এ ধরনের তথ্য তার ও তার পরিবারের জন্য সামাজিক এবং মানসিকভাবে কষ্টকর হতে পারে। গণমাধ্যমে যদি সত্য ঘটনা প্রকাশের চেয়ে মনোরঞ্জনের জন্য কল্পনাপ্রসূত তথ্য দেওয়া হয়, তবে তা শুধু ব্যক্তির ক্ষতিই করে না, পুরো সমাজে ভুল বার্তা পাঠায়।
সামাজিক বিভাজন ও মতামতের মেরুকরণ
মিডিয়া ট্রায়াল সমাজে বিভিন্ন গোষ্ঠীর মধ্যে মতবিরোধ বাড়িয়ে তুলতে পারে। এ ক্ষেত্রে ছেলেটির ঘটনা সমাজে দুই ভাগে বিভক্তির সৃষ্টি করেছে- এক পক্ষ তাকে দোষী মনে করছে, আরেক পক্ষ মনে করছে তার দোষ প্রমাণিত না হওয়া পর্যন্ত তাকে নির্দোষ ধরে নেওয়া উচিত। এই মতবিরোধ সামাজিক অস্থিরতার জন্ম দিতে পারে।
আইনের দৃষ্টিকোণ থেকে মিডিয়া ট্রায়াল
বাংলাদেশের আইনি কাঠামো অনুযায়ী, কারও বিরুদ্ধে অভিযোগ উঠলে তা তদন্তের মাধ্যমে প্রমাণ করতে হবে। ফৌজদারি কার্যবিধি (সিআরপিসি) অনুযায়ী, পুলিশ তদন্ত করবে এবং সাক্ষ্য-প্রমাণ সংগ্রহ করে আদালতে উপস্থাপন করবে। বিচারক তখন আইনি নিয়মে তা মূল্যায়ন করবেন। মিডিয়া ট্রায়ালের কারণে এই প্রক্রিয়া ব্যাহত হতে পারে। বিচার প্রক্রিয়া শুরু হওয়ার আগেই মিডিয়া যদি কোনও ব্যক্তিকে দোষী সাব্যস্ত করে, তবে তা আইনের শাসনের জন্য বড় বাধা হয়ে দাঁড়ায়। বাংলাদেশের তথ্য প্রযুক্তি আইন এবং মানহানির আইন অনুযায়ী, কারও ব্যক্তিগত তথ্য বা মানহানিকর বক্তব্য প্রকাশ করলে আইনি পদক্ষেপ নেওয়া যেতে পারে। কিন্তু মিডিয়া সংস্থাগুলো প্রায়শই নিজেদের ক্ষমতা বা প্রভাবের কারণে এসব আইন উপেক্ষা করে।
মিডিয়া ট্রায়ালের প্রতিকার কীভাবে
গণমাধ্যমের দায়িত্বশীল ভূমিকা
গণমাধ্যমকে দায়িত্বশীল হতে হবে। অভিযুক্ত ব্যক্তির নাম, ছবি বা ব্যক্তিগত তথ্য প্রকাশ না করে তারা ঘটনা নিয়ে নিরপেক্ষ প্রতিবেদন করতে পারে। গণমাধ্যমের উচিত জনমত তৈরির বদলে সত্য ও নিরপেক্ষ তথ্য প্রদান করা।
আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর প্রভাবমুক্ত তদন্ত
পুলিশ এবং অন্যান্য আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী সংস্থাগুলোকে মিডিয়ার চাপ উপেক্ষা করে তদন্ত করতে হবে। প্রমাণের ভিত্তিতে কাজ করতে হবে। যা মিডিয়ায় প্রচার হয় তার ভিত্তিতে নয়। তদন্ত হতে হবে স্বচ্ছ ও নিরপেক্ষ।
আইন সংস্কার ও প্রয়োগ
বাংলাদেশে মিডিয়া সংক্রান্ত আইনগুলো শক্তিশালী করে প্রয়োগ করতে হবে। কোনও গণমাধ্যম যদি বিচার প্রক্রিয়ায় হস্তক্ষেপ করে বা ব্যক্তির অধিকার লঙ্ঘন করে, তবে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে হবে।
সচেতনতা বৃদ্ধি
সাধারণ মানুষের মধ্যে মিডিয়া ট্রায়ালের নেতিবাচক প্রভাব সম্পর্কে সচেতনতা সৃষ্টি করা জরুরি। অনেক সময় মিডিয়ার মনগড়া তথ্য জনগণের মাঝে বিশৃঙ্খলার সৃষ্টি করে। তাই মিডিয়াতে প্রচারিত প্রতিটি তথ্য যাচাই না করে বিশ্বাস করা উচিত নয়।
মিডিয়া সমাজে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। কিন্তু এর সীমা অতিক্রম করলে তা ব্যক্তির অধিকার ও আইনের শাসনের ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলে। সম্প্রতি ঘটে যাওয়া এই ছেলেটির ঘটনায় আমরা দেখতে পেয়েছি, কীভাবে একটি মিডিয়া ট্রায়াল একজন অভিযুক্তের জীবনকে প্রভাবিত করতে পারে। তাই ন্যায়বিচার নিশ্চিত করতে হলে মিডিয়াকে আরো দায়িত্বশীল হতে হবে এবং আইনকে তার নিজের গতিতে কাজ করতে দিতে হবে। গণমাধ্যমের ভূমিকা হওয়া উচিত সত্য প্রকাশ করা, কিন্তু সেটা এমনভাবে যাতে আইনি প্রক্রিয়া বা কোনও ব্যক্তির অধিকার ক্ষুণ্ন না হয়।
লেখক: শিক্ষার্থী, আইন বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়
সারাবাংলা/এসবিডিই