নারী স্বাধীনতার আসল লক্ষ্য কী?
২০ নভেম্বর ২০২৪ ১৫:৫৬
বিশ্বের যা-কিছু মহান সৃষ্টি চির কল্যাণকর, অর্ধেক তার করিয়াছে নারী, অর্ধেক তার নর। এই প্রবাদ বাক্যটি যেন নারী-পুরুষের পারস্পরিক সহযোগিতা ও সমতার ধারণাকে সামনে নিয়ে আসে। নারী স্বাধীনতা বলতে কেবল নারীদের প্রতি বিরূপ মনোভাব নয়; বরং এটি একটি সমতার সংগ্রাম, যেখানে নারী ও পুরুষ একসঙ্গে উন্নয়নের পথে এগিয়ে চলার প্রতিশ্রুতি রাখে।
বর্তমান সময়ের একটি প্রচলিত বাক্য নারী স্বাধীনতা। সমাজের কিছু মানুষ নারী স্বাধীনতা বলতে নারীদের আন্তঃপ্রকাশকে বোঝে। আবার কিছু মানুষ নারী স্বাধীনতাকে তাদের প্রতিদ্বন্দ্বী ভাবে। কিন্তু প্রকৃত অর্থে নারী স্বাধীনতা বলতে নারীর প্রতি বিরূপ মনোভাব বা পুরুষের বিরুদ্ধাচারণ বোঝানো হয় না। এটি আসলে একটি সমতা ও ন্যায়বিচারের দাবি, যা নারীকে তাদের সম্ভাবনা অনুযায়ী জীবনযাপন ও আত্মপ্রকাশের সুযোগ দেয়। সমাজে নারী ও পুরুষের ভূমিকা ও ক্ষমতাকে সমানভাবে মূল্যায়ন করাই নারী স্বাধীনতার প্রকৃত অর্থ।
আজকের বাংলাদেশে নারী স্বাধীনতা শুধু ব্যক্তিগত স্বাধীনতা বা ঘরোয়া ক্ষেত্রেই সীমাবদ্ধ নয়; বরং কর্মক্ষেত্রেসহ সমাজে এবং রাষ্ট্রীয় পর্যায়েও নারীদের অবাধ অংশগ্রহণ নিশ্চিত করার চেষ্টা চালানো হচ্ছে। তবে এটি কোনওভাবেই পুরুষের ওপর আধিপত্য বিস্তার বা পুরুষ বিদ্বেষ নয়। বরং নারী ও পুরুষ একসঙ্গে এগিয়ে গিয়ে একটি উন্নত সমাজ গঠনের লক্ষ্যে কাজ করবে, এটাই নারী স্বাধীনতার আসল লক্ষ্য।
ইতিহাস বলে, প্রতিটি পুরুষের সফলতার পিছনে একজন নারী থাকে। আদিমকালে নারীরা তাদের সাহস, ন্যায়বোধ, দেশের প্রতি ভালোবাসা সব কিছু পুরুষের মাধ্যমে প্রকাশ করেছে। কিন্তু তারা এখন নিজেদের মাধ্যমে নিজেকে প্রকাশ করতে চাই। আর এটা সম্ভব হয়েছে নারী স্বাধীনতা নামক বাক্যের মাধ্যমে।
বর্তমানে বাংলাদেশে নারী স্বাধীনতার প্রশ্নে নারীদের ভূমিকা আরও স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। সম্প্রতি ঘটে যাওয়া বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে নারীদের সাহসিক ভূমিকা, নেতৃত্ব এবং সম্মিলিত আন্দোলনের মাধ্যমে তাদের অধিকার রক্ষার চেষ্টা সমাজে একটি দৃষ্টান্ত হয়ে দাঁড়িয়েছে। এই আন্দোলনে নারীরা সামনে সারিতে থেকে তাদের অধিকার ও সমতার দাবিকে উচ্চকিত করেছেন, যা সমাজে নারীর জন্য সমমর্যাদার ক্ষেত্র তৈরিতে সহায়তা করছে।
আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ উদাহরণ হলো, কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ে বৈষম্য ও নিপীড়নবিরোধী আন্দোলনে নারীরা সক্রিয় অংশ নেয়। এই আন্দোলনের নেতৃত্বে নারী শিক্ষার্থীরা নির্ভয়ে কথা বলেন এবং সমান সুযোগের দাবি জানান। এছাড়া রাজশাহী ও চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাসেও নারীরা এই ধরনের আন্দোলনে শামিল হয়ে নিজেদের অধিকার রক্ষার জন্য সংগ্রাম করেছেন। বর্তমানে নারীরা শিক্ষা, স্বাস্থ্য, প্রযুক্তি, ব্যবসা ও প্রশাসনের মতো বিভিন্ন ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখছে।
সাবেক দুই প্রধানমন্ত্রী, স্পিকার, সংসদ সদস্যসহ বিভিন্ন শীর্ষস্থানে নারীদের অবস্থান প্রমাণ করে যে বাংলাদেশে নারী স্বাধীনতা কেবল ধারণায় নয়, বাস্তবে দৃশ্যমান। এমনকি বাংলাদেশ পুলিশের প্রথম নারী পুলিশ কমিশনার ডা. নাজমা বেগমের নিয়োগ, বা বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রথম নারী উপ-গভর্নর স্মৃতি পারভীন– এসব পদক্ষেপ বাংলাদেশের নারীদের জন্য অনুপ্রেরণাদায়ক উদাহরণ। কর্মক্ষেত্রে নারীদের স্বীকৃতি বৃদ্ধি, নারী উদ্যোক্তা তহবিলের মতো উদ্যোগ এবং নারীদের জন্য সুরক্ষিত পরিবেশ গঠনের প্রচেষ্টাও নারী স্বাধীনতার পথে গুরুত্বপূর্ণ অগ্রগতি হিসেবে দেখা যায়।
তবে সমাজে নারীদের স্বাধীনতার পথে এখনও অনেক চ্যালেঞ্জ বিদ্যমান। সমাজের কিছু অংশে পুরোনো মানসিকতা ও কুসংস্কার এখনও নারীদের উন্নতির পথে বাধা সৃষ্টি করে। এখনও অনেক পরিবার ছেলে ও মেয়ে সন্তানকে আালাদা নজরে দেখে থাকে। বিশেষ করে কর্মক্ষেত্রে নারীকে পুরুষের সমান মর্যাদা দেওয়া বা তাদের যোগ্যতা অনুযায়ী পারিশ্রমিক দেওয়া এখনও একটি চ্যালেঞ্জ। কিন্তু এই চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় কাজ করে যাচ্ছেন নারীবাদী সংগঠনগুলো এবং নারী অধিকার কর্মীরা। আমরা নারীরাও পুরুষের সাথে সমানভাবে এগিয়ে যাক।
নারী স্বাধীনতা মানে নারীদের প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবে দেখা নয় বরং সম-অধিকার ও সমান মর্যাদার ভিত্তিতে তাদের স্বীকৃতি দেওয়া। সমাজের সার্বিক উন্নতির জন্য নারী-পুরুষ উভয়ের সম্মিলিত প্রচেষ্টার প্রয়োজন। নারী স্বাধীনতা বাস্তবায়নের মাধ্যমে সমাজে একটি ভারসাম্যপূর্ণ ও উন্নত সংস্কৃতি গড়ে তোলাই প্রধান লক্ষ্য।
লেখক: শিক্ষার্থী, মনোবিজ্ঞান বিভাগ
সারাবাংলা/এসবিডিই