Friday 22 Nov 2024
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

নতুন ভিসির কাছে কেমন জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় চায় শিক্ষার্থীরা?

মো. রাকিব
২২ নভেম্বর ২০২৪ ২০:১০

জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের নতুন ভিসি অধ্যাপক আমানুল্লাহ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের লোগো। ছবি: সংগৃহীত

জুলাই ২৪ এর গণঅভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে আমরা পেয়েছি এক নতুন বাংলাদেশ। আর নতুন বাংলাদেশের প্রতিটি সেক্টরে লেগেছে পরিবর্তনের ছোঁয়া। এই পরিবর্তনের ছোঁয়া থেকে বাদ যাচ্ছে না আমাদের জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ও। শিক্ষার্থীদের তালিকাভুক্তি অনুযায়ী পৃথিবীর চতুর্থ বৃহত্তম বিশ্ববিদ্যালয় হয়েও বাংলাদেশে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় পরিচিত হয়েছে বেকার তৈরির কারখানায়। যারাই জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসনিক দায়িত্বে এসেছেন তারাই এটিকে প্রাইভেট কোচিং সেন্টারের মতো ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠান হিসেবে ব্যবহার করেছেন। এতে একদিকে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের ঝুলিতে জমা পড়েছে কিছু তিরস্কার আর শিক্ষার্থীদের ঝুলিতে জমা হয়েছে বেকারত্বের অভিশাপ। এদেশে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের সাথে সব দিক থেকেই বৈষম্য শিকার হতে হয়। এছাড়া দেশের সাধারণ মানুষ থেকে সুশীল সমাজ সবারই রয়েছে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় নিয়ে নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি। তারা মনে করেন জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করা মানেই মেধাবী শিক্ষার্থী নন ।

বিজ্ঞাপন

জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের ক্যাম্পাসে যে অভাবগুলো বেশি হতাশায় ভোগায় তা হলো প্রায় ক্যাম্পাসে নেই কোন হার্ড এবং সফট স্কিল ডেভলপ করার মতো ক্লাব। নেই কোনও প্রেজেন্টেশন প্রোগ্ৰাম কিংবা কমিউনিকেশন ডেভলপ করার ব্যবস্থা। নেই কোনও এক্সট্রাকারিকুলাম কোর্স বা শেখার ব্যবস্থা । যেখানে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা চার বছরে ১৬টি প্রেজেন্টেশন দিয়ে থাকে সেখানে আমাদের অনেক শিক্ষার্থী জানেই না প্রেজেন্টেশন নামের কোন প্রোগ্ৰাম আছে। যদিও বর্তমানে বছরে দুটি করে প্রেজেন্টেশন নেওয়ার কথা থাকলেও দৃশ্যমান হচ্ছে না কিছুই। এতে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা ভালো বিষয়ে পড়াশোনা করলেও পড়ালেখার বাইরে আর কিছুই শিখতে পারছে না। যেখানে আমাদের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলো ইতোমধ্যেই উপরে উল্লেখিত সমস্যাগুলোর সমাধান করে শিক্ষার্থীদের হাতেকলমে শিক্ষার বিষয়টি নিশ্চিত করার চেষ্টা করছে। সেখানে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় এখনও আমাদের একটু সুন্দর শিক্ষা পদ্ধতি দিতেই ব্যর্থ।

বিজ্ঞাপন

একটি গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ুয়া ৪৩ শতাংশ শিক্ষার্থীই দরিদ্র পরিবার থেকে আসা। তাদের পারিবারিক মাসিক আয় ১০ হাজার টাকার কম। আর ১০ থেকে ৪০ হাজার টাকা মাসিক আয় এমন পরিবারের শিক্ষার্থী সংখ্যা ৪৯ শতাংশ। সে হিসেবে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের ৯২ শতাংশ শিক্ষার্থীর পরিবারিক মাসিক আয়ের পরিমাণ ৪০ হাজার টাকার কম। ৬ শতাংশ শিক্ষার্থীর পরিবারের আয় ৪১ থেকে ৬০ হাজার টাকা পর্যন্ত। আর ৬০ হাজার টাকার বেশি আয় রয়েছে এমন পরিবারের শিক্ষার্থী রয়েছে মাত্র ২ শতাংশ। কিন্তু আমাদের বিশ্ববিদ্যালয় তার নিজের গতিতে চলছে । ইউজিসির দেওয়া তথ্য অনুযায়ী প্রতিটি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীর পেছনে যেখানে সরকার ব্যয় করে কয়েক লক্ষাধিক টাকা সেখানে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী প্রতি ব্যয় করা হয় মাত্র ১ হাজার ১৫১ টাকা । বাজেটেই নয়, জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় অবহেলিত চাকরির বাজারেও। কারণ সকলেই ভাবেন জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী মানেই হলো মেধাবী নয়। পরীক্ষকরা সিভিতে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় দেখে শুরুতেই ধারণা করেন, এই প্রার্থী ততটা অভিজ্ঞ নয়।

জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের এই ব্যর্থতার দায় এরিয়ে যেতে পারবেন না বিশ্ববিদ্যালয়ের দায়িত্বরত হর্তাকর্তারা। বিশ্ববিদ্যালয়ের নেই কেন শিক্ষার্থী বান্ধব নিয়ম-কানুন। যখন মন চায় ফর্ম ফিলাপের সময় সূচি দেয়, যেমন মন চায় তেমন সেশন ফী ধরা হয়, পরীক্ষার রুটিনগুলো পর্যন্ত বিষয় বিবেচনা করে তৈরি করা হয় না। এছাড়া সেশন জট, পরীক্ষার খাতা কাটায় অযত্ন, ভুতুড়ে রেজাল্ট, রেজাল্ট প্রকাশ করতে দীর্ঘ সময় নেওয়া, সমাবর্তন অনুষ্ঠান না করা, শিক্ষকদের আন্তরিকতার অভাবসহ এরকম শতাধিক অনিয়ম তো আছেই। মূলত যতদিন এসব সমস্যার সমাধান না হবে ততদিন আমি অন্তত জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের উন্নতি দেখছি না ।

তাহলে কিভাবে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় এসব সমস্যা থেকে মুক্তি পাবে? আমাদের জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষকে প্রথমেই সেশন জট নিরসনে ব্যবস্থা গ্ৰহণ করতে হবে। একজন শিক্ষার্থীকে যদি চার বছরের অনার্স শেষ করতে ছয় বছর অপেক্ষা করতে হয় তখন দেখা যায় চাকরির জন্য নির্ধারিত বয়স থেকে তার দুটো বছর কমে যায়। এতে ভেঙে পড়েন শিক্ষার্থীরা। দ্বিতীয়ত, গতানুগতিক শিক্ষার বাইরে গিয়ে প্রতিটি ডিপার্টমেন্টের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ কোর্স চালু করা। যেমন ইংরেজি বিভাগের শিক্ষার্থীদের শুধুমাত্র গতানুগতিক সাহিত্য পড়ানো হলেও নেই কোনও গ্ৰামার কোর্স, নেই কোনও ভাষা উন্নয়ন কোর্স। এতে দেখা যাবে একজন শিক্ষার্থী ইংরেজি বিষয়ে অনার্স শেষ করে ৫-১০ লাইন ইংরেজি বলতে পারেন না। তৃতীয়ত, প্রতিটি ক্যাম্পাসে শিক্ষার্থীদের স্কিল ডেভেলপমেন্টের জন্য বিভিন্ন ধরনের ক্লাব প্রতিষ্ঠিত করা। এর মধ্যে অন্যতম- ইংলিশ ল্যাঙ্গুয়েজ ক্লাব, ডিবেট ক্লাব, কালচারাল ক্লাব, ম্যাথ ক্লাব এবং রিসার্চ ক্লাব ইত্যাদি। এছাড়া আরও যে বিষয়গুলো এই তৃতীয় পার্টে রাখা যায় তা হচ্ছে শিক্ষার্থীদের পাবলিক স্পিকিং দক্ষতা উন্নয়ন, লিডারশিপ , প্রেজেন্টেশন স্কিল বৃদ্ধি, কেইস স্টাডি শেখানোর ব্যবস্থা করা।

চতুর্থত, যেসব বিষয়ে গুরুত্ব দেওয়া উচিত সেগুলো হচ্ছে- অভিজ্ঞ শিক্ষক নিয়োগ, আধুনিক সেমিনার হল তৈরি করা, বড় ক্যাম্পাসগুলোতে বাস সার্ভিস চালু করা, মাল্টিমিডিয়া ক্লাসরুম চালু করা, উপস্থিতির হার বাড়ানোর ব্যবস্থা করা, ল্যাব ফ্যাসিলিটিজ বাড়ানো এবং রিসার্চের উপর গুরুত্ব দেওয়া। সর্বশেষ একটি বিষয়কে আলাদাভাবে বলতেই হয় সেটি হচ্ছে ভুতুড়ে রেজাল্ট প্রকাশ বন্ধ করা। নিজের অভিজ্ঞতা শেয়ার করি। আমাদের ইংরেজি বিভাগের দ্বিতীয় বর্ষের খুব সহজ একটি কোর্স হচ্ছে এডভান্স রিডিং এন্ড রাইটিং। যেটি মোটামুটি সহজেই পাশ করা যায়। কিন্তু দুঃখের বিষয় হচ্ছে, আমাদের এক রুম থেকে একই সাবজেক্টে ৩০ জনের বেশি শিক্ষার্থী ফেইল করেছেন। এছাড়া এবারের অনার্স চতুর্থ বর্ষের রেজাল্ট আমাকে আরও বেশি ভাবিয়েছে, চতুর্থ বর্ষে এসেও ৩০ শতাংশ শিক্ষার্থী ফেইল করা। অনেক শিক্ষার্থীকে দেখা যাচ্ছে ব্যক্তিগত ক্ষোভ প্রকাশ করতে।

বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষকে মাথায় রাখা উচিত চতুর্থবর্ষের একজন শিক্ষার্থী ফেইল করা মানে তার একটি বছর বরবাদ হওয়া। আমি বলছি না যে ফেইল করা শিক্ষার্থীকেও পাশ করিয়ে দেওয়া হোক; আমি বলছি অন্তত খাতাগুলোর যথাযথ মূল্যায়ন করা হোক। নিজের চোখেই দেখেছি অনেক শিক্ষক ফাইনাল পরীক্ষার খাতা শিক্ষার্থীদের হাতে কাটিয়েছেন। এতে খাতার সঠিক মূল্যায়ন নিশ্চিত করা হয় না। এছাড়া বিভিন্ন পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় যেখানে তাদের শিক্ষার্থীদের নিয়ে নিয়মিত সমাবর্তন অনুষ্ঠানের আয়োজন করে সেখানে আমাদের জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের এসব বিষয়ে কোনও চিন্তা নেই বললেই চলে। তাই আমরা চাইব জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ এবার অন্তত কোচিং সেন্টারের মতো ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানের চিন্তা থেকে বেরিয়ে শিক্ষার্থীদের মেধা উন্নয়নে এবং তাদের স্কিল ডেভেলপমেন্টের দিকে নজর দিবেন। এতে ইতিবাচক পরিবর্তন হবে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের এবং পরিবর্তন হবে দেশ।

লেখক: শিক্ষার্থী

সারাবাংলা/এসবিডিই

জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়

বিজ্ঞাপন

আরো

সম্পর্কিত খবর