চারিদিকে ষড়যন্ত্র, স্বৈরাচারের দোসররা আজও সক্রিয়
২৬ নভেম্বর ২০২৪ ১৮:২৪
ঢাকায় অরাজক পরিস্থিতি সৃষ্টির চেষ্টা চলছে অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নেয়ার পর থেকেই। সরকারের সাড়ে তিন মাস অতিক্রান্ত হয়েছে ইতোমধ্যেই। এই গোটা সময়টাতে বিভিন্ন দাবি-দাওয়া ও আন্দোলনের নামে সরকারকে বেকায়দায় ফেলার এবং গণদুর্ভোগ চরমে নেয়ার অপপ্রয়াস চলেছে পূর্বাপর। এখনও এর অবসান ঘটেনি। গত ক’দিন ধরে ব্যাটারিচালিত রিকশাচালকদের বেপরোয়া তাণ্ডব প্রত্যক্ষ করছে নগরবাসী। তারা সড়ক দখল ও অবরোধ করে রাখছে ঘণ্টার পর ঘণ্টা। গাড়ি ভাংচুর করছে। কোথাও কোথাও বাসাবাড়িতে ইটপাটকেল নিক্ষেপ ও হামলা করছে। পুলিশ, এমনকি সেনাসদস্যদের ওপর হামলা করতেও তারা পিছপা হচ্ছে না। পরিকল্পিত এই বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি ও নাশক তৎপরতা প্রকৃতপক্ষে কারা চালাচ্ছে তা নিয়ে জনমনে বিরাট প্রশ্ন রয়েছে।
ইতোপূর্বে সংখ্যালঘু নির্যাতনের অভিযোগে শাহবাগে সমাবেশ, আনসারদের আন্দোলন ও সচিবালয়ে অনুপ্রবেশ, গার্মেন্টস শ্রমিকদের নামে আন্দোলন ও সড়ক অবরোধ ইত্যাদি ঘটনায় পতিত স্বৈরাচারের বিভিন্ন সংগঠনের নেতাকর্মীদের প্ররোচণা ও অংশগ্রহণের বিষয়টি স্পষ্ট হয়েছে। পত্রপত্রিকায় এ সম্পর্কে খবরও প্রকাশিত হয়েছে। ব্যাটারিচালিত রিকশাচালকদের রাস্তা অবরোধ ও তাণ্ডবের পেছনেও পতিত স্বৈরাচারের অনুসারী-অনুগামীরাই যুক্ত বলে তথ্য আছে। বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত খবরে স্পষ্টতই বলা হয়েছে, শ্রমিকলীগের নেতাকর্মীরা রিকশা শ্রমিক লীগের হয়ে ব্যাটারিচালিত রিকশাচালকদের নামে ঢাকায় কয়েকদিন যাবত সড়ক ও রেলপথ অবরোধ করে তাণ্ডব করছে। তারা প্রতিদিন বিভিন্ন সড়ক ও রেলপথ অবরোধ করে বিক্ষোভ করছে। পথচারীদের হয়রানি করছে। কোথাও কোথাও লাঠি হাতে, কোথাও কোথাও দেশি অস্ত্র হাতে তারা ত্রাস সৃষ্টি করছে। বলাবাহুল্য, ঢাকার মতো জনবহুল ও ব্যস্ত নগরীতে এভাবে সড়ক অবরোধ ও সন্ত্রাসের কারণে জনমনে ভীতি-আতংক সৃষ্টি ছাড়াও যাতায়াতে দারুণ বিঘ্ন ঘটছে। সড়ক যানজটে ঘণ্টার পর ঘণ্টা অচল হয়ে থাকছে। সড়কযান ও জনচলাচলের জন্য নির্মিত ও উন্মুক্ত। অবরোধ ও বাধা সৃষ্টি করে তাকে অচল করে দেওয়ার অধিকার কারও নেই। অথচ, কারণে অকারণে সড়ক অবরোধ, ভাংচুর ও নাশকতা চলছে। দুঃখজনক হলেও লক্ষ করা যাচ্ছে, জননিরাপত্তা ও আইনশৃঙ্খলার দায়িত্বে নিয়োজিত পুলিশ তেমন কোনও ভূমিকাই রাখছে না। পুলিশের এই ‘ধরি মাছ না ছুঁই পানি’ আচরণ প্রশ্নবিদ্ধ হচ্ছে। স্বৈরাচারের দোসর হিসাবে পুলিশ গত সাড়ে ১৫ বছর যে বেপরোয়া ত্রাস প্রদর্শন করেছে এবং সর্বশেষ জুলাই-আগস্ট আন্দোলনে ছাত্র-জনতার ওপর নির্বিচারে গুলি করে গণহত্যা করেছে, তার নজির বিশ্বের ইতিহাসে বিরল। বিপ্লবোত্তরকালে পুলিশের অনেক সদস্যই পালিয়ে গেছে। বাহিনী হিসাবে পুলিশ বিশৃঙ্খল, ট্রমাক্রান্ত ও দুর্বল হয়ে পড়েছে। একইসঙ্গে পুলিশের মধ্যে এখনও স্বৈরাচারের বশংবদদের থাকা অসম্ভব নয়, যারা দায়িত্ব পালনে গড়িমসি বা অবহেলা প্রদর্শন করছে। পুলিশ সক্রিয় ও তৎপর হলে সড়কে বিশৃঙ্খলা, সন্ত্রাস ও অচলাবস্থা এতটা উদ্বেগজনক হতে পারত না।
গত রোববার ও সোমবার পুরান ঢাকায় চরম অরাজকতা প্রত্যক্ষ করা গেছে। বিক্ষোভ, হামলা, ভাংচুর, সড়ক অবরোধ অবস্থান কর্মসূচি কী হয়নি? একজন কলেজ শিক্ষার্থী ন্যাশনাল মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে ভুল চিকিৎসায় মারা গেছে, এমন অভিযোগের সূত্র ধরে এই তুলকালাম কাণ্ড হয়েছে। শিক্ষার্থীটি ছিল যাত্রাবাড়ীর ড. মাহবুবুর রহমান মোল্লা কলেজের (ডিএমআরসি)। তার মৃত্যুর ঘটনায় কলেজের ছাত্ররা হাসপাতাল চত্বরে বিক্ষোভ প্রদর্শন করে। হাসপাতালের অভ্যন্তরে প্রবেশ করে হামলা ও ভাংচুর করে। শহীদ সোহরাওয়ার্দী কলেজ ও কবি নজরুল কলেজের কিছু শিক্ষার্থী এতে ক্ষুব্ধ হয়ে ডিএমআরসি কলেজের বিক্ষোভরত ছাত্রদের ওপর হামলা চালায়। এরই পরিপ্রেক্ষিতে আশপাশের কয়েকটি কলেজের শিক্ষার্থীরা একজোট হয়ে সোহরাওয়ার্দী ও নজরুল কলেজে হামলা, ভাংচুর, অগ্নিসংযোগের চেষ্টা চালায়। এতে পুরান ঢাকার একটা বড় এলাকায় ভীতি-ত্রাস ছড়িয়ে পড়ে। কলেজ দুটির ব্যাপক ক্ষতি হয় এবং ওইদিনের পরীক্ষা কলেজ কর্তৃপক্ষকে বাতিল করে দিতে হয়। পরদিন সোমবার সোহরাওয়ার্দী ও নজরুল কলেজসহ অন্যান্য কলেজের শিক্ষার্থীরা ডিএমআরসি কলেজে চড়াও হয় ও ভাংচুর করে। রোববার ও সোমবারের হামলায় শতাধিক শিক্ষার্থী আহত হযেছে। ভুল চিকিৎসায় মৃত্যু আমাদের দেশে নতুন কোনও ঘটনা নয়। ভুল চিকিৎসা যেমন অকাম্য, তেমনি তাতে মৃত্যুও অত্যন্ত দুঃখজনক। কিন্তু এ ধরনের অভিযোগ তুলে চিকিৎসক অথবা হাসপাতালের ওপর হামলা চালানো মোটেই সমীচীন নয়, যদিও এমন ঘটনা প্রায়ই ঘটতে দেখা যায়। ন্যাশনাল মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে যে শিক্ষার্থী মারা গেছে সে ভুল চিকিৎসায় মারা গেছে, তা কি প্রমাণিত? প্রমাণিত হলেও চিকিৎসক বা হাসপাতালের ওপর হামলা বৈধ নয়। এজন্য আইন-আদালত আছে। আলোচ্য ক্ষেত্রে তিল তালে পরিণত হয়েছে। অনেকেরই এতে ক্ষতি হয়েছে। শিক্ষার্থীদের এই হামলা-পাল্টা হামলার ঘটনা অত্যন্ত অনভিপ্রেত বলে গণ্য। শিক্ষার্থীরা সম্প্রতি জনতার সঙ্গে মিলে যে অভূতপূর্ব অভ্যুত্থান ঘটিয়ে স্বৈরাচার বিতাড়িত করে অনন্য ইতিহাস রচনা করেছে। তাদের একাংশের এমন আচরণ অপ্রত্যাশিত। প্রসঙ্গত আবারও পুলিশের ভূমিকার কথা ওঠে। পুরান ঢাকার অনাকাঙ্খিত ঘটনাবলী রোধে পুলিশ নিষ্ক্রিয় থেকেছে। এমূর্হূতে পুলিশকে সক্রিয় ও উজ্জীবিত করা জরুরি। এ ব্যাপারে নতুন আইজিপি দ্রুত কার্যকর পদক্ষেপ নেবেন বলে আশা করি।
আমরা উদ্বেগের সঙ্গে লক্ষ করছি, পতিত স্বৈরাচারের সঙ্গী-সাথী, অনুসারী, দলীয় ও সহযোগী সংগঠনসমূহের পলাতক ও আত্মগোপনে থাকা নেতাকর্মীরা মুখ বের করতে শুরু করেছে। সরকার সন্ত্রাসী সংগঠন হিসেবে ছাত্রলীগকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করেছে। অথচ, ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা দেশের বিভিন্ন স্থানে ঝটিকা মিছিল, এমন কি লাঠিমিছিল পর্যন্ত করেছে। ছাত্রলীগই নয়, যুবলীগ, শ্রমিকলীগ, রিকশালীগ ইত্যাদিও নানাভাবে তাদের অস্তিত্ব জানান দিচ্ছে। এসব লীগ গত সাড়ে ১৫ বছরে এমন কোনও অপকর্ম নেই, যা করেনি। মানুষকে মানুষ বলে মনে করেনি। এসব অপরাধী ও জুলুমবাজ ‘লীগে’র নাম নিশানা দেশের মানুষ দেখতে চায় না। ভারতে বসে শেখ হাসিনা টেলিফোনের মাধ্যমে তার ফেলে যাওয়া নেতাকর্মীদের প্ররোচণা ও উসকানি দিচ্ছেন মাঠে নামতে, অরাজকতা ও নাশকতা করতে। ভারতের প্রত্যক্ষ মদদে ও পরিকল্পনা মোতাবেক তিনি এ কাজ করছেন। তাতে সন্দেহ নেই। প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস শুরুতেই শেখ হাসিনার কথা বলার ব্যাপারে সর্তক করে দিয়েছিলেন। শেখ হাসিনা তার কথায় গুরুত্ব দেননি। ভারতও তাতে কর্ণপাত করেনি। বিষয়টি সরকারকে বিবেচনায় নিতে হবে। পতিত স্বৈরাচারের কথাবার্তা, মোদি সরকারের ভূমিকা, মোদির মিডিয়ার অপপ্রচার ইত্যাদি থেকে যা বুঝার, সেটা বুঝতে হবে। সরকারকে অজনপ্রিয় ও ফেলে দেওয়ার জন্যই যে এই যৌথপ্রয়াস তাতে সংশয় নেই। এ ব্যাপারে সতর্ক ও সাবধান যেমন হতে হবে, তেমন পতিত স্বৈরাচারের দোসররা, যারা বিভিন্ন ক্ষেত্রে ঘাপটি মেরে আছে কিংবা একটু একটু করে মাথা তুলছে, তাদের খুঁজে বের করতে হবে। তাদের প্রতি কঠোর হওয়ার এবং তাদের অপকর্মের উপযুক্ত শাস্তি বিধানের বিকল্প নেই।
লেখক: আইনজীবী
সারাবাংলা/এসবিডিই