পাহাড়ের কান্না শোনার কি কেউ আছে?
৩০ নভেম্বর ২০২৪ ১৩:৩৬
চট্টগ্রাম, বান্দরবান, কক্সবাজার, রাঙামাটি, খাগড়াছড়ি, সিলেট, মৌলভীবাজার, হবিগঞ্জ, শেরপুর, কুমিল্লাসহ পাহাড়বেষ্টিত জেলার প্রায় সব পাহাড় ও টিলা নির্বিচারে কাটা হচ্ছে। একই সঙ্গে কাটা হচ্ছে এসব পাহাড়ে থাকা গাছপালাও। এর সঙ্গে রয়েছে দখল ও বসতি স্থাপন। নানা কারণে পাহাড় কাঁদে, পাহাড়ের কোল ঘেঁষে দাঁড়িয়ে থাকা বৃক্ষরাজিও কাঁদে।
আবার কখনও কখনও পাহাড় ভয়ে জবুথবু হয়ে কাঁদে সন্ত্রাস ও সহিংসতায়। পাহাড় আর পাহাড়ের বৃক্ষরাজির এভাবে নীরবে নিভৃতে ক্রন্দনে প্রকৃতিও যেন এই কান্নার সমব্যথি হয়ে চরম প্রতিশোধ নেয় প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের মাধ্যমে। তবুও পাহাড় কাটা, বন উজাড়, বৃক্ষনিধন, পাহাড়ের কোলে অবৈধ বসতি থামছে না।
এই চিত্র বাংলাদেশের সর্বত্র বিশেষ করে পাহাড়ের টিলাবেষ্টিত সব অঞ্চলে। পাহাড় কাটা, টিলা কাটা, বন উজাড় করায় দেশের মানুষের, প্রকৃতির যে কী পরিমাণ ক্ষতি হচ্ছে তার নমুনা দেখতে খুব বেশি দূর যেতে হয় না। নিকট অতীতে পাহাড় ধস, ভূমিধস, পাহাড়ের কোলে বসবাস করা মানুষের মৃত্যু, সম্পদহানি পাহাড়ে অতিমাত্রায় বৃষ্টি, বন্যা প্রভৃতি।
এতকিছুর পরও থামে না পাহাড় কাটা, পাহাড়ের কোলে থাকা বৃক্ষরাজি নিধন। বিশেষ করে এ কারণে প্রতিবছর বর্ষা মৌসুমে পাহাড় ধস, মানুষের প্রাণহানি, সম্পদের ক্ষতি অব্যাহত থাকে। অবশ্য পাহাড় কাটা, পাহাড়ের বৃক্ষনিধন, পাহাড়ে অবৈধ বসতির বিরুদ্ধে বিভিন্ন সময়ে প্রসাশন লোক-দেখানো অভিযান পরিচালনা করলেও বন্ধ হয় না পাহাড় কাটা, বৃক্ষনিধন, পাহাড়ের অবৈধ বসিত।
বন্দর নগরীসহ বৃহত্তর চট্টগ্রামে থামছে না পাহাড় কাটা। শুধু স্বায়ত্তশাসিত সংস্থা চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (সিডিএ) একাই কাটছে ছোট-বড় ১৫টি পাহাড়। অন্যান্য সংস্থা, শিল্পগোষ্ঠীও প্রশাসনের চত্রছায়ায় বেপরোয়াভাবে পাহাড় কেটে দখল করে অবৈধ স্থাপনা গড়ে তোলে। গড়ে তোলা হয় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, মসজিদ, মক্তব, মাদ্রাসা, ক্লাব প্রভৃতি। তারা প্রকাশ্যে পাহাড় কেটে মাটি লুট করছে, মাটি বিক্রি করছে, পাহাড়ের জমি দখল করে গড়ে তুলছে অবৈধ বসতি।
এমনি অবস্থায় বাধ্য হয়ে পাহাড়া, টিলা কাটা বন্ধ ও সংরক্ষণে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে সংশ্লিষ্টদের নির্দেশ দেন হাইকোর্ট। ২০১৭ সালে পাহাড় কাটা নিয়ে প্রকাশিত সংবাদের পরিপ্রেক্ষিতে এ নির্দেশ দেওয়া হয়। তবে উচ্চ আদালতের নির্দেশনা উপেক্ষা করে সিলেট জেলার চুনারুঘাট, নবীগঞ্জ, বাহুবল ও মাধবপুর উপজেলার বিভিন্ন স্থানে পাহাড় কেটে উচ্চ দামে লাল মাটি বিক্রি করছে স্থানীয় প্রভাবশালীরা। প্রশাসনের হস্তক্ষেপ চেয়ে দেওয়া হয়েছে একাধিক লিখিত অভিযোগ।
তবে থানা পুলিশ ও প্রশাসনের সংশ্লিষ্ট কার্যক্রমে শিথিলতা বিরাজ করায় কোনও কার্যকর ব্যবস্থা নেওয়া যাচ্ছে না। কিছু পাহাড়ের ওপরের অংশ ন্যাড়া করে উজাড় করা হয়েছে গাছপালা। কয়েকটি পাহাড় কাটা হয়েছে খাড়াভাবে। আর কিছু কাটা হচ্ছে উঁচু চূড়া থেকে। এভাবে নানা রকম কায়দায় কাটা হচ্ছে পর্যটন শহর কক্সবাজারের পাহাড়। প্রতিনিয়ত পরিবেশের ওপর এই আগ্রাসন চললেও কারও যেন মাথাব্যথা নেই। যেসব পাহাড়ের ওপরের অংশ পরিকল্পিতভাবে উজাড় করা হয়, বৃষ্টি হলে এসব পাহাড়ের মাটি পানির তোড়ে নিচের দিকে নেমে পড়ে।
অনুরূপ শুধু হবিগঞ্জ নয় চট্টগ্রাম, রাঙামাটি, কক্সবাজার, খাগড়াছড়ি, বান্দরবান, সিলেট, ময়মনসিংহ, শেরপুর, কুমিল্লাসহ দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে পাহাড় কাটার প্রতিযোগিতা চলছে। প্রশাসন মাঝেমধ্যে মামলা ও জরিমানা করে পাহাড় কাটা রোধে চেষ্টা চালালেও তা ফলপ্রসূ হয় না।
পরিবেশের মামলায় বেশির ভাগই অর্থদণ্ডে নিষ্পত্তি হয়। এটিও পাহাড় কাটা বন্ধ না হওয়ার অন্যতম কারণ। শত-সহস্র বছর ধরে সিলেট জেলার যেসবটিলা মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়েছিল, নগর সভ্যতার চাপে গত দুই দশকের মধ্যেই সেগুলো বিলীন হতে বসেছে। নির্বিচারে পাহাড়, টিলা কাটার ফলে সিলেটের প্রকৃতি-পরিবেশে বিরূপ প্রভাব পড়ছে।
পরিবেশবাদীদের দাবি, গত দুই দশকে টিলা কাটার ফলে সিলেট অঞ্চলের সবচেয়ে বড় মানবসৃষ্ট প্রাকৃতিক বিপর্যয় দেখা দিয়েছে। স্থানীয় প্রভাবশালীদের পরোক্ষ সহযোগিতায় টিলা কাটা হচ্ছে। সরকারি প্রকল্পের জন্য টিলা কাটার কারণে প্রভাবশালীদের আরও সাহস পায় টিলা ধ্বংসে।
১৯৫৬ সালের ভূমি জরিপের আলোকে বাংলাদেশ পরিবেশ আইনবিদ সমিতির (বেলা) প্রস্তুত করা তথ্য অনুযায়ী, সিলেট জেলায় ১ হাজার ২৫টি টিলা ছিল, যার মধ্যে ১৯৯টি টিলা সিলেট নগরী ও এর আশপাশের এলাকায় অবস্থিত। পাহাড় কাটা রোধে পরিবেশ আইনবিদ সমিতিসহ বেলাসহ বিভিন্ন সংগঠন দীর্ঘদিন ধরে আইনি লড়াইয়ের পাশাপাশি মাঠপর্যায়ে সচেতনতা সৃষ্টির লক্ষ্যে কাজ করছে।
পাহাড় কাটা বন্ধ চেয়ে জনস্বার্থে বেশ কয়েকটি মামলা করেছে হিউম্যান রাইটস অ্যান্ড পিস ফর বাংলাদেশ (এইচআরপিবি)। সংগঠনটির প্রেসিডেন্ট মনজিল মোরশেদ বলেন, চট্টগ্রাম, কক্সবাজার ও সিলেট জেলায় পাহাড় কাটা বন্ধে হিউম্যান রাইটস অ্যান্ড পিস ফর বাংলাদেশের পক্ষে হাইকোর্টে একাধিক আবেদন করা হয়। আদালত পাহাড় কাটা বন্ধের নির্দেশ দেন। দেখা যাচ্ছে, রায় অমান্য করে পাহাড়গুলো কেটে মাটি বিক্রি করছে স্থানীয় এক শ্রেণির লোকজন।
পরিবেশ অধিদপ্তরসহ স্থানীয় প্রশাসনের তরফ থেকে কার্যকর প্রদক্ষেপ না নেওয়ায় পাহাড় রক্ষা করা সম্ভব হচ্ছে না। পাহাড় কাটার কারণে প্রাকৃতিক ভারসাম্য ও পরিবেশ নষ্ট হচ্ছে। কিন্তু এ বিষয়ে গণমাধ্যমে রিপোর্ট প্রকাশ হলেও তাদের বিরুদ্ধে কোনও ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়নি।
এরি মধ্যে চলতি বছরের ২ এপ্রিল রাঙামাটির বাঘাইছড়ি উপজেলার সাজেকে পাহাড় কাটা বন্ধের নির্দেশ দেন হাইকোর্ট। এক রিট আবেদনের শুনানি শেষে বিচারপতি জে বি এম হাসান ও বিচারপতি রাজিক-আল-জলিলের হাইকোর্ট বেঞ্চ রুলসহ পাহাড় কাটা বন্ধের আদেশ দেন। সাজেকে পাহাড়ের মাটি কাটা সম্পর্কে ২৯ মার্চ গণমাধ্যমে খবর প্রকাশ হলে জনস্বার্থে হিউম্যান রাইটস অ্যান্ড পিস ফর বাংলাদেশের পক্ষে একটি রিট পিটিশন করা হয়।
আদালত এক অন্তর্বর্তীকালীন আদেশে প্রশাসনকে মনিটরিং টিম গঠন করার নির্দেশ দেন যাতে কেউ পরিবেশ অধিদপ্তরের অনুমতি ব্যতীত পাহাড় কাটতে না পারে। চলতি বছরের ১১ ফেব্রুয়ারি চট্টগ্রামের লোহাগাড়ায় পাহাড় ও কৃষিজমির মাটি কাটা ৭ দিনের মধ্যে বন্ধের নির্দেশ দেন হাইকোর্ট। পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয়ের সচিবসহ, সংশ্লিষ্ট সংস্থার দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা বিবাদীদের এ নির্দেশ দেওয়া হয়।
সেই সঙ্গে পাহাড় কাটায় জড়িতদের বিরুদ্ধে আইন অনুযায়ী ব্যবস্থা নিতে পরিবেশ অধিদপ্তরের চট্টগ্রাম জেলা কার্যালয়ের পরিচালককে নির্দেশ দেন আদালত। সংশ্লিষ্ট আইনজীবী জানান, হাইকোর্টের রায়ের পর প্রশাসনের পক্ষ থেকে পাহাড়ে অভিযান পরিচালনা করা হয়। কিন্তু কিছুদিন পর ফের পাহাড় কাটা শুরু হয়। বিষয়টি আদালতের নজরে আনা হয়েছে।
অন্যদিকে মৌলভীবাজার এবং হবিগঞ্জে পাহাড় ও টিলা কাটার সঙ্গে জড়িতদের বিরুদ্ধে পরিবেশ সংরক্ষণ আইনের ১৫ ধারা অনুসারে চার সপ্তাহের মধ্যে ব্যবস্থা নিতে নির্দেশ দেন হাইকোর্ট। হিউম্যান রাইটস অ্যান্ড পিস ফর বাংলাদেশের পক্ষে করা এক সম্পূরক আবেদনের শুনানি শেষে ২০২৩ সালের ৮ ফেব্রুয়ারি বিচারপতি ফারাহ মাহবুব ও বিচারপতি আহমেদ সোহেলের হাইকোর্ট বেঞ্চ এ আদেশ দেন। উচ্চ আদালতের রায়ের পর প্রশাসনের পক্ষ থেকে কোনও ধরনের তৎপরতা দেখা যায়নি।
ফলে পাহাড় কাটা অব্যাহত আছে। এ প্রসঙ্গে আইনজীবীর অভিমত, প্রাকৃতিক পরিবেশের ভারসাম্য বজায় রাখতে পাহাড়ের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা আছে। কিন্তু নির্বিচারে পাহাড় নিধন চলছে। এতে পরিবেশের যেমন ক্ষতি হয়, তেমনি পাহাড় ধসে প্রাণ হারায় এর পাদদেশে বসবাসরত মানুষ। এ জন্য পাহাড়া রক্ষা করা সবার দায়িত্ব। বাস্তবতা হচ্ছে প্রভাবশালীদের দৌরাত্ম্য ও মানুষের অসচেতনতায় নির্বিচারে পাহাড় কাটা বন্ধ হচ্ছে না। পরিবেশের ওপর যার ভয়াবহ প্রভাব পড়ছে। শুধু অর্থদণ্ড নয়, অপরাধীদের আইনের আওতায় এনে শাস্তি নিশ্চিত না করলে পাহাড় কাটা কিছুতেই থামবে না।
প্রসঙ্গত, চট্টগ্রামে ২০১১ থেকে ২০২৩ সাল পর্যন্ত ৫৬০টি পাহাড় কাটার অভিযান পরিচালনা করেছে পরিবেশ অধিদপ্তর। এসব অভিযানে ৮৫ কোটি ২ লাখ টাকা জরিমানা করা হয়। এ ছাড়া চট্টগ্রাম মহানগরে চলতি বছরে পাহাড় কাটার অভিযোগে পরিবেশ অধিদপ্তর পাঁচটি মামলা করেছে। আগের বছর মামলা হয় ১০টি। ২০২২ সালে মামলা হয়েছিল ২২টি। বৃহত্তর চট্টগ্রামে সবচেয়ে বেশি পাহাড় কাটা হয়েছে কক্সবাজার এলাকায়। এ পর্যন্ত এখানে পাহাড় কাটার জন্য ১৮১টি মামলা হয়েছে।
এর মধ্যে ১১৫টিতে অভিযোগপত্র দেওয়া হয়। ৬৬টি মামলার তদন্ত চলছে। চট্টগ্রাম জেলা, রাঙামাটি ও খাগড়াছড়িতে মোট মামলা হয়েছে ৬০টি। এর মধ্যে ৫২টির অভিযোগপত্র দাখিল করা হয়েছে। এ ছাড়া বান্দরবানে ২১টি ও কুমিল্লায় পাহাড় কাটার অপরাধে ৯টি মামলা হয়েছে। গত চার মাসেও এসব এলাকায় পাহাড় কাটার অভিযোগ পাওয়া গেছে। পাহাড় কাটা, পাহাড়ের বৃক্ষনিধন বন্ধে কঠোর হস্তে আইনের কার্যকর প্রয়োগ করা জরুরি। তা না হলে পাহাড়ের নীরব কান্না, পাহাড় ধস, ভূমিধস, বৃক্ষনিধন, পাহাড়ে অবৈধভাবে বসতি স্থাপন করা মানুষে মৃত্যু, সম্পদের ক্ষতি বন্ধ করা যাবে না।
লেখক: সাংবাদিক
সারাবাংলা/এসবিডিই