মেগা প্রকল্পগুলো যেন মেগা অর্থনৈতিক বোঝা না হয়
৪ ডিসেম্বর ২০২৪ ১২:২০ | আপডেট: ৪ ডিসেম্বর ২০২৪ ১৫:৫৪
সাম্প্রতিক বছরগুলোয় যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়নে বেশ কয়েকটি মেগা প্রকল্প বাস্তবায়ন হয়েছে। বাস্তবায়িত যোগাযোগ অবকাঠামোগুলোর মধ্যে অন্যতম কক্সবাজারে নতুন রেলপথ, ঢাকায় মেট্রোরেল, চট্টগ্রামে টানেল ও পদ্মা সেতু সংযোগ রেলপথ। এসব প্রকল্প যোগাযোগের ক্ষেত্রে কিছুটা গতিশীলতা আনলেও অর্থনৈতিকভাবে তেমন কোনওও প্রভাব রাখতে পারেনি। উল্টো প্রকল্পগুলোর আয় দিয়ে পরিচালন ও রক্ষণাবেক্ষণ ব্যয়ের সংস্থান করা যাচ্ছে না। ওপরন্তু উন্নয়নসহযোগীদের ঋণের টাকায় বাস্তবায়িত এসব প্রকল্পের ঋণ পরিশোধ করতে সরকারকে দিতে হচ্ছে ভর্তুকি। সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনার অভাবে মূলত প্রকল্পগুলো আর্থিক লোকসানের কারণ হয়ে উঠেছে। বলা বাহুল্য, উচ্চাভিলাষী, বিবেচনাহীন এসব প্রকল্প দেশের বর্তমান অর্থনৈতিক দুর্দশার প্রধানতম কারণ। এসব প্রকল্প দেশের অর্থনীতিতে চাপ তৈরি করছে।
যোগাযোগ অবকাঠামো নির্মাণের আগে পরিপূর্ণ সমীক্ষা প্রয়োজন। বাস্তবে একটি প্রকল্প কতটা কার্যকর ভূমিকা রাখবে লক্ষ্য পূরণে সেটি যাচাই করতে হবে। তাছাড়া যোগাযোগের ক্ষেত্রে গতিশীলতা আনতে প্রয়োজন সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনা। কেবল অবকাঠামোগত উন্নয়ন দিয়ে যে যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়ন সম্ভব নয় তার প্রকৃষ্ট উদাহরণ রাজধানী ঢাকা। সিপিডির এক গবেষণা অনুযায়ী, প্রতিদিন ঢাকার নাগরিকদের সড়কে প্রতি ২ ঘণ্টায় ৪৬ মিনিট যানজটে আটকে থাকতে হয়। বছরে জনপ্রতি নষ্ট হয় ১২৬ ঘণ্টা। পৃথিবীর অন্যতম জনবহুল ঢাকা শহরের জনজীবনে গতি আনতে যেখানে বিকেন্দ্রিকরণ ও পরিকল্পিত নগরায়ণের ওপর জোর দেওয়া প্রয়োজন ছিল সেখানে কেবল অবকাঠামো বাড়ানো হয়েছে। প্রশ্ন হচ্ছে, লাখ লাখ মানুষের শহরে উড়াল সড়ক, এক্সপ্রেসওয়ে, মেট্রোরেল কি এ শহরের তীব্র যানজটকে বাগে আনতে পেরেছে? পারেনি। অথচ যানজট নিরসন করে শহরকে গতিময় করতে ২০১২ সালের পর থেকে নানা প্রকল্পের মাধ্যমে প্রায় ১ লাখ ৩৫ হাজার কোটি টাকা ব্যয় হয়েছে। সেসব প্রকল্প থেকে সরকারকে লোকসান গুনতে হচ্ছে। বিগত সরকারের আমলে বাস্তবায়ন করা দেশের যোগাযোগ অবকাঠামোখাতের বড় প্রকল্প উত্তরা-মতিঝিল মেট্রোরেলের (লাইন-৬) আয় দিয়ে এখনও ঋণের কিস্তি পরিশোধ করা সম্ভব হচ্ছে না। জাপান আন্তর্জাতিকসহযোগীতা সংস্থার (জাইকা) কাছ থেকে নেওয়া ঋণ পরিশোধ শুরু হয়েছে ২০২৩ সালে। প্রথম বছর পরিশোধ হয়েছে ৬৫ কোটি টাকা, যার পুরোটাই দেওয়া হয়েছে প্রকল্প বাস্তবায়নের জন্য বরাদ্দকৃত অর্থ থেকে।
এদিকে ২০২২ সাল থেকে শুরু হয়েছে দোহাজারী-কক্সবাজার রেলপথের ঋণের কিস্তি পরিশোধ। প্রকল্পটির জন্য এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক (এডিবি) ঋণ দিয়েছে ৯ হাজার ৯৩ কোটি টাকা। বিপুল পরিমাণ ঋণের বিপরীতে দোহাজারী-কক্সবাজার রেলপথে তিনটি ট্রেন পরিচালনা করে ২০২৩ সালের ১ ডিসেম্বর থেকে গত সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ৭১ কোটি টাকার মতো আয় করেছে বাংলাদেশ রেলওয়ে। এ আয় দিয়ে রেলের পরিচালন ব্যয় মেটানো সম্ভব হচ্ছে না। ফলে ঋণ পরিশোধ করতে গিয়ে ভর্তুকি দিতে হচ্ছে সরকারকে। বিশেষজ্ঞদের মতে, দোহাজারী-কক্সবাজারের এ রেলপথ লাভজনক হওয়ার সম্ভাবনাও একেবারেই কম এবং এরই মধ্যে প্রকল্পের জন্য গৃহীত ঋণ দেশের জন্য বোঝা হয়ে দাঁড়িয়েছে। রেল কর্তৃপক্ষ থেকে জানা যায়, প্রকল্পটি বাস্তবায়নের আগে প্রাথমিক সমীক্ষাও যথাযথভাবে হয়নি। অনিয়ম-দুর্নীতির অভিযোগও রয়েছে।
একই দশা কর্ণফুলী টানেল প্রকল্পের। বাংলাদেশ সেতু কর্তৃপক্ষের হিসাবে চালুর পর এক বছরে (অক্টোবর ২০২৩ থেকে অক্টোবর ২০২৪) টানেল থেকে আয় হয়েছে প্রায় ৩৭ কোটি টাকা। বিপরীতে অবকাঠামোটি পরিচালনা ও রক্ষণাবেক্ষণ বাবদ ব্যয় হচ্ছে বছরে ১৩৬ কোটি টাকার বেশি। অর্থাৎ সরকারকে প্রকল্পটিতে প্রতিবছর বিপুল অংকের লোকসান গুনতে হচ্ছে। বলা যায়, সঠিক সমীক্ষা ছাড়া আরেকটি অবাস্তব প্রকল্প কর্ণফুলী টানেল। বিশেষজ্ঞদের মতে, মাটির তলদেশে নির্মিত যে কোনওও প্রকল্পের পরিচালন ব্যয় সময়ের পরিক্রমায় অনেক বাড়তে থাকে। সুতরাং আশঙ্কা রয়েছে সামনের দিনগুলোয় এ প্রকল্পের ব্যয় আরও বাড়বে। এ থেকে উত্তরণের উপায় নিয়েও সন্দিহান সংশ্লিষ্টরা।
আবার পদ্মা সেতু রেল সংযোগ রেলপথের ঋণ চুক্তি অনুযায়ী, গ্রেস পিরিয়ড শেষ করে চলতি বছরের এপ্রিল থেকে এ প্রকল্পের ঋণ পরিশোধ শুরু হয়েছে। আয় দিয়ে প্রয়োজনীয় অর্থের সংস্থান না হওয়ায় এ ঋণ পরিশোধেও ভর্তুকি দিতে হবে। অবকাঠামো বিশেষজ্ঞদের আশঙ্কা পদ্মা সেতু সংযোগ রেলপথটিও লোকসানি প্রকল্প হয়ে উঠছে।
যে কোনওও প্রকল্প বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে সেগুলোর আর্থসামাজিক সম্ভাব্যতা যাচাই করা দরকার। বিশেষত যখন দেশের অর্থনীতি দীর্ঘদিন সংকটে থাকে তখন অর্থনৈতিক লাভ বিবেচনা করাটা আবশ্যক। ঋণ নিয়ে এসব প্রকল্প বাস্তবায়নের চেয়ে যদি বিদ্যমান যোগাযোগ অবকাঠমোর যথাযথ ব্যবহার নিশ্চিত করা যেত তবে সেটি বেশি কার্যকর হতে পারত টেকসই যোগাযোগ ব্যবস্থায়। এর পরিপরিপ্রেক্ষিতে এখনও যেসব প্রকল্প শুরু হয়নি তা পুনর্মূল্যায়ন করা দরকার। অবকাঠামো নির্মাণের আগে বিজ্ঞানভিত্তিক গবেষণা নিশ্চিত করতে হবে।
সড়ক ও জনপথ অধিদপ্তরের অধীন সড়ক গবেষণা ল্যাবরেটরি রয়েছে। সেখানে নিয়মিত ও যোগ্য গবেষকের মাধ্যমে গবেষণার কাজটি সম্পন্ন করতে হবে। সড়কপথের পাশাপাশি রেল ও নৌপথকেও সমান গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করে যাতায়াত ব্যবস্থাকে টেকসই করে গড়ে তোলা প্রয়োজন। এর জন্য লোকসানি অবকাঠামো না তৈরি করে বরং মনোযোগী হতে হবে সব পথের সব যানের সুষ্ঠু পরিচালন ব্যবস্থাপনায়। এক্ষেত্রে পরিকল্পনা কমিশনের সক্ষমতা বিশেষভাবে প্রযোজ্য। কারণ বাস্তবমুখী পরিকল্পনার অভাবে বর্তমানে প্রকল্পগুলোর এ দৈন্যদশা দাঁড়িয়েছে। তাই দক্ষ ও অভিজ্ঞ পরিকল্পনাবিদদের নিয়োগ নিশ্চিত করাটা জরুরি। প্রকল্প বাস্তবায়নের আগে চুলচেরা বিশ্লেষণ করে এর সম্ভাব্যতা নিশ্চিত করতে হবে। তবে বর্তমানে জরুরিভিত্তিতে এসব ব্যয়বহুল প্রকল্পের ব্যাপারে সিদ্ধান্তে আসতে হবে। নয়তো ঋণ পরিশোধ ও পরিচালন ব্যয় মেটাতে গিয়ে দেশের অর্থনীতির পুনরুদ্ধার কঠিন হয়ে উঠবে।
লেখক: বিশ্লেষক, কলাম লেখক
সারাবাংলা/এসবিডিই