যেভাবে বেঁচে আছি, একে বাঁচা বলে?
৪ ডিসেম্বর ২০২৪ ১২:২৩
এখন আমাদের পুকুর নেই। আছে পাকা দালান। খাল নেই। আছে আরসিসি ঢালাইয়ের খালপাড়। নদী নেই। আছে চোখধাঁধানো সেতু। পাকা দালানে বসে আমরা চাষের মাছ খাই। বাজারে গিয়ে খুঁজি দেশী মাছ। বিক্রেতা আমাদের ধোঁকা দেন। চাষের মাছ দেশী বলে বিক্রি করেন। তার দোষ কী? আমরাই তো স্বজ্ঞানে নদী-খাল মেরে চাষের মাছ খেয়ে বেঁচে থাকার আয়োজন করেছি।
সম্প্রতি ঢাকার পাশের দুটি জেলা ভ্রমণের সুযোগ হয়। কিশোরগঞ্জ ও মুন্সিগঞ্জ। আমার বর্তমান বসবাস ঢাকার কেরানীগঞ্জে। পৈতৃক নিবাস ঢাকার পাশের জেলা চাঁদপুরে। আমি যেখানে থাকি, যেখানে থাকতাম—কোথাও কোনও পুকুর নেই। খাল নেই। নদী নেই। আছে কেবল আবর্জনা। ময়লা। বর্জ্য। দুর্গন্ধ। কিশোরগঞ্জ আর মুন্সিগঞ্জে গিয়ে আমি হন্যে হয়ে খুঁজেছি একটি পুকুর-খাল-নদী। আমাকে হতাশ করে, অবাক করে, চমকে দিয়ে জানানো হলো, এখানে কোনও পুকুর নেই, কোনও খাল নেই, কোনও নদী নেই। তবে আমি দেখেছি নদীর মতো আঁকাবাঁকা স্রোত। কিন্তু সেখানে কোনও পানি নেই। আছে বর্জ্য। সভ্য মানুষের ফেলে দেওয়া অসভ্য বর্জ্য। কিশোরগঞ্জ-মুন্সিগঞ্জ দুই জেলায়ই আমি দেখেছি বর্জ্যের নদী। আবর্জনায় ঠাসা খাল। ময়লাভর্তি পুকুর।
আমার শৈশব কেটেছে পুকুরে সাঁতার কেটে। নদীতে মাছ ধরে। বিলে শাপলা তুলে। খালে নৌকা বেয়ে। বউ চুরি আর গোশত চুরি খেলে কেটেছে বিকাল। কানামাছি-লুকোচুরি ছিল আমাদের জনপ্রিয় খেলা। গোসলের সময় হাত দিয়েই ধরা যেত কেজি দুইয়ের মতো মাছ। সেগুলো রান্না হতো। বাড়ির সবাই খেত। তখন বাজারে গিয়ে মাছ কিনতে হতো না। ঘরে খাবার নেই। পুকুরে বড়শি ফেললেই হয়ে যেত দুপুরের আয়োজন। বিলে জাল মারলেই পাওয়া যেত যা কয়েক দিন খাওয়া যেত। মা সেসব জিইয়ে রাখতেন। ধীরে ধীরে আমরা খেয়ে থাকতাম।
এখন আমাদের পুকুর নেই। আছে পাকা দালান। খাল নেই। আছে আরসিসি ঢালাইয়ের খালপাড়। নদী নেই। আছে চোখধাঁধানো সেতু। পাকা দালানে বসে আমরা চাষের মাছ খাই। বাজারে গিয়ে খুঁজি দেশী মাছ। বিক্রেতা আমাদের ধোঁকা দেন। চাষের মাছ দেশী বলে বিক্রি করেন। তার দোষ কী? আমরাই তো স্বজ্ঞানে নদী-খাল মেরে চাষের মাছ খেয়ে বেঁচে থাকার আয়োজন করেছি।
আমাদের সভ্যতা নেই। আমাদের নদী নেই। আমাদের কোনও নৌকাও নেই। আমাদের খাল নেই। আমাদের কোনও খেয়াও নেই। আমাদের পুকুর নেই। আমাদের কোনও তরীও নেই। আমাদের কিছুই নেই। আমাদের ভদ্রতা নেই। আমাদের নম্রতা নেই। আমাদের মায়া নেই। আমাদের মমতা নেই। থাকার কথাও নয়। যে জাতি নিজ হাতে নদী হত্যা করে গলাটিপে, সে জাতির সভ্যতা উড়ে যায় অজানা দেশে। যে জাতি পানির বয়ে চলা বন্ধ করে দেয় স্বজ্ঞানে, সে জাতির মমতার স্রোতধারা চলে যায় অন্য কোথাও। যে জাতি লোভের বিষে পুড়িয়ে ফেলে সব পানি, সে জাতির মনের গহীন শুকিয়ে যায় সব মায়া।
মায়া-মমতা-সভ্যতা হারিয়ে আমরা হয়ে গিয়েছি হিংস্র বাঘ, পাগলা কুকুর, ক্ষ্যাপাটে ষাঁড়। এখন আমরা শুধু খেতে চাই। আরও খেতে চাই। আরও আরও খেতে চাই। খেতে গিয়ে দেখি মানুষের পাকস্থলী সীমিত। এত খাওয়া সম্ভব নয়। আমরা পাকস্থলী ধার করি। প্রথমেই আমরা স্ত্রীর পাকস্থলী ধার করি। তারপর সন্তান-শ্বশুড়-শাশুড়ি, ভাইবোন, বন্ধু-বান্ধব সবার পাকস্থলী ধার করি। এত এত পাকস্থলী ধার করার পরও আমাদের খাওয়ার চাওয়া শেষ হয় না। কারণ আমাদের তো সভ্যতা নেই। মমতা নেই। মায়া নেই। নদী নেই। খাল নেই। পুকুর নেই। সন্তুষ্টি নেই। আমরা তখন টাকা খাওয়া শুরু করি। সাধারণ মানুষের কষ্টার্জিত টাকা খাওয়ার জন্য আমরা ব্যাংক নামের আরও বড় পাকস্থলী ধার করি। ব্যাংক যখন ভর্তি হয়ে যায় হাজার কোটি টাকায়, তখন আমরা দেশের ব্যাংক খাওয়া শুরু করি। এজন্য ধার করি আরও বড় পাকস্থলী। দেশের বাইরের ব্যাংক। তবু আমাদের খাওয়া শেষ হয় না। আমাদের চাওয়া শেষ হয় না। আমাদের মন ভরে না। প্রাণ জুড়ায় না।
কেন আমাদের এমন হলো? কে আমাদের এ বিকৃত উন্নয়ন শেখাল? আমরা খেতে চাই দেশী মাছ। বিশুদ্ধ বাতাস। সবুজ ফল-শাক-সবজি। আমরা খাচ্ছি বিষাক্ত মাছ। সিসাভরা বাতাস। ফরমালিনযুক্ত সবজি-শাক-ফল। আমরা খাচ্ছি। আর অসুস্থ হচ্ছি। অসুস্থ হচ্ছি। আর খাচ্ছি। আমাদের কষ্টার্জিত উপার্জন পাগলের মতো দিয়ে আসি ডাক্তার আর ফার্মাসিস্টের পকেটে। আমাদের শরীর অসুস্থ। তার চেয়ে বেশি অসুস্থ আমাদের মন। আমরা সবসময় ভয়ে থাকি। এ বুঝি কোনও দুরারোগ্য ব্যাধি বাসা বাঁধছে শরীরে। না-জানি কোনও দুর্ঘটনা বাসায় ফিরতে দেবে না আমাকে। প্রিয়জনের খারাপ সংবাদ এই এলো বলে। এসব ভয়ে আমরা তটস্থ। ভয় থেকে বাঁচতে আমরা ভেজাল বাদ দিয়ে নির্ভেজাল খাওয়া শুরু করি। বিনে পয়সার দেশী মাছ ২ হাজার টাকা কেজিতে কিনে আনি। আঙিনায় অনাদরে বেড়ে ওঠা শাক আমাদের কিনতে হয় হাজার টাকা খরচ করে। বিলের মাছ, খেতের শাক খেয়েও আমরা বাঁচতে পারি না। সব খাঁটির মধ্যেই আমারা ভেজাল ঢুকিয়ে ফেলেছি। এখন খাঁটি বলে আমাদের কিছুই নেই। কিচ্ছু নেই।
আমাদের বাঁচার কোনও পথ নেই। আমাদের সুস্থতার কোনও লক্ষণ নেই। আমাদের শান্তির কোনও আশা নেই। আমাদের ফেরার পথে কে যেন আরসিসি ঢালাইয়ের দেওয়াল তুলে দিয়েছে। যেদিন আমরা সবাই মিলে গলাটিপে প্রমত্তা নদী মেরে ফেলেছি, সেদিনই আমাদের বাঁচার সব পথ বন্ধ হয়ে গেছে। যেদিন আমরা স্রোতস্বিনী খাল আবর্জনায় ঠেসে বন্ধ করে দিয়েছি, সেদিনই আমরা বুক ভরে শ্বাস নিতে ভুলে গিয়েছি। যেদিন আমরা ফসলের মাঠ বালিচাপা দিয়ে হাউজিং বানিয়েছি, সেদিন থেকেই আমাদের মনের ওপর অশান্তি-অতৃপ্তি নামের এক বিশাল পাথর চেপে বসেছে। এখন আমরা বেঁচে আছি অশান্তি আর অতৃপ্তির অসুস্থতা নিয়ে। আমরা বেঁচে আছি কীটের চেয়েও নিকৃষ্টভাবে।
লেখক: কলাম লেখক
সারাবাংলা/এসবিডিই