দেশের স্বার্থে অটুট থাকুক জাতীয় ঐক্য
৬ ডিসেম্বর ২০২৪ ১৮:২৪ | আপডেট: ৬ ডিসেম্বর ২০২৪ ১৮:২৫
স্বাধীনতার পর থেকেই ভারতের সঙ্গে প্রতিবেশিসূলভ সম্পর্ক বজায় রাখছে বাংলাদেশ। সম্পর্কের টানাপোড়েন থাকলেও কখনো দুই দেশের সম্পর্ক বিচ্ছিন্ন হওয়ার মত পরিস্থিতি হয় নি। কিন্তু ৫ আগস্টের ঐতিহাসিক গণবিপ্লবের পর ঘটা করেই বাংলাদেশের সাথে সম্পর্কে পিছটান দেয় ভারত। অস্থিতিশীল পরিস্থিতির কথা উল্লেখ করে বাংলাদেশে দেশটির ভিসা আবেদন কেন্দ্রগুলো অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ ঘোষণা করে ভারত। এরপর নানা ইস্যুতে বাংলাদেশের ওপর নেতিবাচক মনোভাবের বহিঃপ্রকাশ করে দেশটি। সম্প্রতি ইসকনের বহিষ্কৃত নেতা চিন্ময় কৃষ্ণ দাস গ্রেফতারের ঘটনায় ভারত যে বিবৃতি দিয়েছে তা কূটনৈতিক শিষ্টাচার বহির্ভূত ও বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপ বলেও আখ্যায়িত করেছেন বিশ্লেষকরা।
আবহমানকাল থেকেই বাংলাদেশ ধর্মীয় সম্প্রীতির এক উর্বর ভূমি। অতীতে এখানে ধর্মীয় কারণে যত বিভাজন ও বিরোধ হয়েছে তার বেশিরভাগই ছিল কিছু স্বার্থান্বেষী মহলের রাজনৈতিক অভিলাষ থেকে সৃষ্ট। হাজার বছর ধরে এ দেশে বিভিন্ন ধর্ম ও সম্প্রদায়ের মানুষ মিলে মিশে চলে আসছে। এখনও গ্রামে গঞ্জে কিংবা শহরে ধর্মীয় সম্প্রীতি বজায় রেখেই চলছে বেশিরভাগ মানুষ। বিয়ে শাদি কিংবা সামাজিক যে কোনো অনুষ্ঠানে হিন্দু মুসলমান একে অপরের বাড়িতে নিমন্ত্রণে যাওয়া একদমই স্বাভাবিক বিষয়। এমনকি এক ধর্মের মানুষ আরেক ধর্মের উৎসবেও শামিল হচ্ছে প্রতিনিয়ত।
অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নেয়ার পরপরই অনুষ্ঠিত হয়েছে হিন্দুদের সবচেয়ে বড় ধর্মীয় উৎসব শারদীয় দুর্গাপূজা। তাদের এ উৎসব শান্তিপূর্ণ করতে সরকারের পাশাপাশি বিএনপি, জামায়াত, ইসলামী আন্দোলনসহ বেশকয়েকটি রাজনৈতিক দলের নেতাকর্মীরা অতন্দ্র প্রহরীর ভূমিকা নেয়। এমনকি মাদ্রাসার শিক্ষার্থীরাও রাত জেগে পুজা মণ্ডপ পাহারা দেয়। যার ফলে স্মরণকালের সবেচেয়ে শান্তিপূর্ণভাবে উদযাপিত হয় দুর্গোৎসব।
সাম্পদ্রায়িক সম্প্রীতির এমন অনন্য দৃষ্টান্তের পরেও বাংলাদেশে সংখ্যালঘু নির্যাতনের অলীক গল্প তৈরি করে ভারতীয় মিডিয়াগুলো লাগাতার অপপ্রচার চালাচ্ছে বলে অভিযোগ বাংলাদেশের। সবশেষ ভারতের আগরতলায় বাংলাদেশ মিশনে ভারতীয় উগ্রবাদীদের হামলার ঘটনায় উদ্বিগ্ন গোটা জাতি। ভারতের কিছু রাজনীতিবিদ বাংলাদেশকে নিয়ে ক্রমাগত উসকানিমূলক বক্তব্য দিয়ে বিভাজন তৈরির চেষ্টা করছে। এমনকি কথিত সংখ্যালঘু নির্যাতন বন্ধে বাংলাদেশে জাতিসংঘের শান্তিরক্ষী প্রেরণের আহ্বানও জানিয়েছেন পশ্চিমবঙ্গের মূখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জি। মমতার এই বক্তব্যকে দেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বের ওপর হুমকি হিসেবে অভিহিত করেছে অন্তর্বর্তী সরকার ও বিএনপিসহ বাংলাদেশের প্রধান রাজনৈতিক দলগুলো। অনেকে মনে করছেন, ভারত সরকার তাদের আস্থাভাজন মিত্র শেখ হাসিনার পতন মেনে নিতে না পেরেই এমন আচরণ করছে।
ইসকনের বহিষ্কৃত নেতা চিন্ময় দাসের গ্রেফতার ঘিরে আইনজীবী সাইফুল ইসলাম আলিফের হত্যাকাণ্ডে পুরো দেশের মানুষ ক্ষুব্ধ হয়। অনেকেরই আশঙ্কা ছিল এই ঘটনার জেরে সাম্পদ্রায়িক সম্প্রীতি বিনষ্ট হতে পারে। কিন্তু বাংলাদেশের মানুষ অসম্ভব বিচক্ষণতা ও ধৈর্যের পরিচয় দিয়ে কোনো সাম্পদ্রায়িক সংঘাতে জড়ায় নি। বিএনপিসহ দেশের বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতাদের অভিযোগ, স্বার্থান্ধ মহলের প্ররোচনায় ইসকন ইস্যুতে দেশে সাম্পদ্রায়িক দাঙ্গা লাগাতে পরিকল্পিতভাবে আইনজীবী সাইফুলকে হত্যা করা হয়েছে।
অনেকে মনে করেন, নানা চেষ্টা করেও দেশে সাম্পদ্রায়িক সম্প্রীতি বিনষ্ট করতে না পেরে ভারতের উগ্রবাদীরা আগরতলায় বাংলাদেশ মিশনে হামলা চালিয়েছে। কিন্তু এ ঘটনার পরেও বিচক্ষণতার পরিচয় দিয়েছে বাংলাদেশ।
কোনো সংঘাতে না জড়িয়ে বাংলাদেশ মিশনে হামলার পর দেশের রাজনৈতিক দল ও বিভিন্ন শ্রেণী পেশার মানুষ রাজপথে নেমে শান্তিপূর্ণ উপায়ে প্রতিবাদ জানায়। খোদ ঢাকা বিশ্বিবিদ্যালয়ের জগন্নাথ হলের সনাতন ধর্মের শিক্ষার্থীরাও হামলার প্রতিবাদে রাজপথে মিছিল করেছে। সনাতন ধর্মের কয়েকজন নেতাও প্রকাশ্যে হামলার প্রতিবাদ জানায়। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে দেখা যায় সর্বস্তরের মানুষের নিন্দার ঝড়। সবমিলিয়ে বাংলাদেশ স্পষ্ট বার্তা দেয়, এ দেশে ধর্মের নামে কোনো বিভাজন করা যাবে না। কারও পাতা ফাঁদে আর পা দিবে না প্রিয় জন্মভূমি।
সামগ্রিক পরিস্থিতিতে ভারতের অপপ্রচার ও আগ্রাসনের বিরুদ্ধে জাতীয় ঐক্য গড়ার ডাক দেন অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ডক্টর মুহাম্মদ ইউনূস। তার ডাকে সাড়া দেন বাংলাদেশের রাজনৈতিক দলের শীর্ষ নেতৃত্ব এবং মুসলিম, হিন্দু, বৌদ্ধ ও খৃস্টানসহ সব ধর্মের নেতারা। বুধবার ও বৃহস্পতিবার পর পর দুই দিন বৈঠক করেন তারা। এতে সবাই একমত হন যে দেশের স্বাধীনতা, সার্বভৌমত্ব, অস্তিত্ব ও মর্যাদার প্রশ্নে কারও কাছে মাথা নত করবে না বাংলাদেশ। সেই সঙ্গে ভারতের অপপ্রচার ও আগ্রাসনের বিরুদ্ধে অটুট রাখা হবে জাতীয় ঐক্য।
দেশের সংকটে সব মত ও পথের মানুষের ঐক্যের বার্তা জাতির মনে নতুন আশার আলো সঞ্চারিত করেছে। নিকট অতীতে এ দেশে জাতীয় ইস্যুতে জাতীয় ঐকমত্য তৈরি হওয়ার নজির খুব একটা নেই। বরং ক্ষুদ্র স্বার্থে বিভাজনের কারণে স্বাধীনতার ৫৩ বছরেও কাঙ্খিত লক্ষ্য অর্জন করতে পারেনি বাংলাদেশ।
৫ আগস্টের গণবিপ্লবের আগে নির্বিচারে শিক্ষার্থী হত্যার প্রতিবাদে আওয়ামী লীগ সরকারের বিরুদ্ধে সব রাজনৈতিক দল এক কাতারে শামিল হয়। কোটা সংস্কারের দাবিতে বৈষম্যবিরোধী আন্দোলন শিক্ষার্থীরা শুরু করলেও ঘটনার পরম্পরায় পরবর্তীতে সরকার পতনের এক দফা দাবিতে দলমত নির্বিশেষে সবাই এক হয়ে রাজপথে নামেন। যার কারণেই গণঅভ্যুত্থানের মাধ্যমে শেখ হাসিনা সরকারের পতন হয়।
জুলাই বিপ্লবে পট পরিবর্তনের পর জনমনে আশা তৈরি হয়েছিল হয়তো জাতীয় ঐক্যের মাধ্যমে দেশকে এগিয়ে নেয়া হবে। বদল হবে মানুষের ভাগ্য। কিন্তু নানা স্বার্থ সংশ্লিষ্ট ইস্যুতে বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের সমন্বয়ক ও রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে দূরত্ব স্পষ্ট হয়ে উঠে। এতে কিছুটা হতাশা নেমে আসে মানুষের মনে। ভারত ইস্যুতে আবারও সব মত পথ ও রাজনৈতিক দলগুলোর মেলবন্ধন অন্যরকম দৃশ্যপটের অবতারণা করেছে। রাজনীতি বিশ্লেষকরা মনে করেন, জাতির সংকটের সময় যে ঐক্য তৈরি হয়েছে তা ধরে রাখতে পারলে আগামীর বাংলাদেশ হবে সব মানুষের জন্য নিরাপদ। এই ঐক্যের স্পিরিট ধারণ করে সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের মাধ্যমে নির্বাচিত সরকার গঠন করতে উদ্যোগ নিতে হবে অন্তর্বর্তী সরকারকে। নতুন সরকার একটি ইনক্লুসিভ সমাজ বিনির্মাণে উদ্যোগ নিলে সব ধর্মের মানুষই সমান অধিকার নিয়ে বাস করতে পারবে।
ভারতের আগ্রাসী নীতির পরেও বাংলাদেশের সরকার ও জনগণ ভারতের সাথে সুসম্পর্ক বজায় রাখতে চায়। ডক্টর ইউনূসের সঙ্গে দেশের শীর্ষ নেতাদের বৈঠকেও এই কথা উঠে এসেছে। তবে সবার একটাই চাওয়া ভারত সরকারও আমাদের সম্পর্কের মূল্যায়ন করতে হবে। একপাক্ষিক প্রেম যেমন টেকসই হয় না তেমনি কূটনৈতিক সম্পর্কের ক্ষেত্রেও দুই পক্ষ সমান আন্তরিকতা না হলে সম্পর্ক সম্মানজনক হয় না।
কেউ কেউ ভাবতে পারেন ভারতের সাথে সম্পর্কের যবনিকাপাত হলে শুধু বাংলাদেশরই ক্ষতি হবে, বিষয়টা মোটেও সঠিক নয়। কমবেশি ভারতও ক্ষতিগ্রস্ত হবে। ভারতের পর্যটন মন্ত্রণালয়ের তথ্যমতে, ২০২৩-২৪ অর্থবছরে বাংলাদেশের প্রায় ১৪ লাখ মানুষ দেশটিতে ভ্রমণ করেছে। এর মধ্যে শুধু মেডিকেল ভিসায় ভারতে ভ্রমণ করা লোকের সংখ্যা প্রায় সাড়ে চার লাখ। এ পরিসংখ্যান থেকে সহজেই অনুমেয় ভারত বাংলাদেশের সম্পর্ক ছিন্ন হলে ভারত বিপুল পরিমাণ রেমিট্যান্স হারাবে। তাছাড়া বিপুল সংখ্যক ভারতীয় নাগরিক বাংলাদেশে চাকরি ও ব্যবসা করে নিজ দেশের অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখছে।
বাণিজ্যের ক্ষেত্রে পেঁয়াজ, রসুন, ডাল, তুলা, শস্যবীজসহ নানা নিত্যপণ্য ভারত থেকে আমদানি করে বাংলাদেশ। ভারত আমাদেরকে এসব পণ্য কিন্তু দয়াদাক্ষিণ্য করে দিচ্ছে না, তাদের রফতানির অংশ এটি। ভারত আমাদের এসব পণ্য না দিলে আমরা যেমন ক্ষতিগ্রস্ত হব তেমনি ভারতের কৃষক ও ব্যবসায়ীরাও ক্ষতির মুখে পড়বে। ভারত যত সহজে ও কম খরচে আমাদের দেশে পণ্য রফতানি করতে পারে অন্য দেশে রফতানি করা কিন্তু এতটা সহজ নয়। তাই দুই দেশের মানুষের জন্যই পারস্পরিক সম্মানজনক সম্পর্ক দরকার।
ভারত যেহেতু বড় রাষ্ট্র, সম্মানজনক ও সমতাভিত্তিক সম্পর্কের ক্ষেত্র তৈরি করতে তাদের উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে। কথায় কথায় সীমান্তে পাখির মত মানুষ হত্যা বন্ধ করতে হবে, তিস্তা নদীর পানির ন্যায্য হিস্যাসহ অভিন্ন ৫৪টি নদীর পানির সুষম বন্টন নিশ্চিত করতে হবে। বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ ইস্যুতে দাদাগিরি মনোভাব থেকে বের হয়ে এসে সহযোগিতামূলক দৃষ্টিভঙ্গি তৈরি করতে হবে। ছোট দেশ বলেই তুচ্ছ তাচ্ছিল্য ও অবহেলা না করে স্বাধীন ও সার্বভৌম দেশ হিসেবে বাংলাদেশকে প্রাপ্য মর্যাদা দিতে হবে। ভারতের মনে রাখা উচিৎ তাদের অতিরিক্ত খবরদারির কারণে প্রতিবেশি কোনো দেশের সাথেই সম্পর্ক ভাল নেই দেশটির। এমনকি বিশ্বের একমাত্র হিন্দু রাষ্ট্র নেপালের সাথেও সুসম্পর্ক নেই ভারতের।
চলমান সংকটে বাংলাদেশেরও উচিৎ হবে অসীম ধৈর্য ও বিচক্ষণতার সাথে পরিস্থিতি মোকাবিলা করা। ভারত সরকারের সাথে আলোচনা করে সমস্যা সমাধানে পদক্ষেপ নেয়া। প্রয়োজনে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় বিশেষ করে জাতিসংঘের সহযোগিতাও চাওয়া দরকার। বাংলাদেশের মানুষ ইতোমধ্যেই বিচক্ষণতার পরিচয় দিয়েছে, সামনে আরও সতর্ক থাকতে হবে। অহেতুক ভারতের বিরুদ্ধে বিদ্বেষমূলক প্রতিক্রিয়া না দেখিয়ে কীভাবে ভারত নির্ভরতা কমানো যায় তা ভাবতে হবে। কৃষিক্ষেত্রে আরও স্বাবলম্বী হতে হবে।
সর্বোপরি এ দেশের আলো বাতাসের ওপর আমাদের যে ঋণ, সে ঋণের দায়বদ্ধতা থেকেই সবার আগে দেশের স্বার্থ দেখতে হবে। মায়ের মতই ভালবাসতে হবে প্রিয় জন্মভূমিকে। নিজের স্বার্থেই ধর্ম বর্ণ নির্বিশেষে দেশকে প্রাধান্য দিতে হবে। মনে রাখতে হবে নগর পুড়লে দেবালয়ও রক্ষা পায় না।
আমি দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি স্বার্থান্বেষী মহলের দাবার গুটি না হলে পথ হারাবে না বাংলাদেশ। নিবন্ধটি শেষ করতে চাই দেশপ্রেমিক কবি আবদুল হাকিমের বঙ্গবাণী কবিতার কয়েকটি চরণ উদ্ধৃত করে। তিনি বলেছিলেন,
‘যে সবে বঙ্গেত জন্মি হিংসে বঙ্গবাণী।
সে সব কাহার জন্ম নির্ণয় ন জানি।।
দেশী ভাষা বিদ্যা যার মনে না জুয়ায়।
নিজ দেশ তেয়াগী কেন বিদেশ ন যায়।।
মাতা পিতামহ ক্রমে বঙ্গেত বসতি।
দেশী ভাষা উপদেশ মনে হিত অতি।।’
লেখক: বিশেষ প্রতিনিধি, নিউজ টোয়েন্টিফোর
সারাবাংলা/এসবিডিই