Saturday 14 Dec 2024
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

বুদ্ধিজীবীদের তালিকা প্রণয়ন দ্রুত শেষ হোক

রাকিবুল ইসলাম
১৪ ডিসেম্বর ২০২৪ ১৮:০৭

পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী তাদের পরাজয় আসন্ন জেনে স্বাধীন ও সার্বভৌম দেশের অভ্যুদয়ের পূর্বমুহূর্তে দেশকে মেধা, শিক্ষা, সংস্কৃতিশূন্য করার উদ্দেশে পাকিস্তানি বাহিনী তাদের দেশীয় দোসর রাজাকার, আলবদর ও আলশামস বাহিনীর সহায়তায় মানব সভ্যতার অন্যতম বর্বর ও কাপুরুষোচিত হত্যাকাণ্ডের ঘটনা ঘটিয়েছিলো। ন্যাক্কারজনক এই পৈশাচিক হত্যাকাণ্ড কোনো সভ্য রাষ্ট্র ও সমাজে কল্পনাও করা যায় না। তাদের এই নৃসংশতা হার মানায় বন্য হায়েনার আক্রমণকেও।

বিজ্ঞাপন

বুদ্ধিজীবী হত্যার পূর্বপরিকল্পনা থাকলেও প্রধানত বুদ্ধিজীবী হত্যা শুরু করে ১০ ডিসেম্বর থেকে। আর ১৪ ডিসেম্বর বেশিসংখ্যক বুদ্ধিজীবীকে ধরে নিয়ে মোহাম্মদপুর ফিজিক্যাল ট্রেনিং ইনস্টিটিউটে স্থাপিত আলবদর ঘাঁটিতে নির্যাতনের পর রায়েরবাজার বধ্যভূমি ও মিরপুর কবরস্থানে নিয়ে বাংলার শ্রেষ্ঠ সন্তানদের হত্যা করে।

তাই ১৪ ডিসেম্বরই শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবস ঘোষণা করেন বাংলাদেশের প্রথম প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ।

অকল্পনীয় নিষ্ঠুর কায়দায় হত্যা করা হয়েছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এ এন এম মুনীর চৌধুরী, ড. জিসি দেব, মোফাজ্জল হায়দার চৌধুরী, আনোয়ার পাশা, ড. জ্যোতির্ময় গুহঠাকুরতা, আবদুল মুকতাদির, এস এম রাশীদুল হাসান, ড. এন এম ফয়জুল মাহী, ফজলুর রহমান খান, এ এন এম মুনীরুজ্জামান, ড. সিরাজুল হক খান, ড. শাহাদাত আলী, ড. এম এ খায়ের, এ আর খান খাদিম, মো. সাদিক, শরাফত আলী, গিয়াসউদ্দীন আহমদ ও আনন্দ ভট্টাচার্য। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক কাইয়ুম, হাবীবুর রহমান, সুখরঞ্জন সমাদ্দার ও ড. আবুল কালাম আজাদ। সাবেক গণপরিষদ সদস্য মসিউর রহমান, আমজাদ হোসেন, আমিনুদ্দীন, নজমুল হক সরকার, আবদুল হক, ডা. জিকরুল হক, সৈয়দ আনোয়ার আলী ও এ কে সরদার। সাংবাদিক সিরাজুদ্দীন হোসেন, শহীদুল্লা কায়সার, খোন্দকার আবু তালেব, নিজামুদ্দীন আহমদ, আ ন ম গোলাম মোস্তফা, শহীদ সাবের, শেখ আবদুল মান্নান (লাডু), নাজমুল হক, এম আখতার, আবুল বাসার, চিশতী হেলালুর রহমান, শিবসদন চক্রবর্তী ও সেলিনা আখতার। চিকিৎসাবিদ মোহাম্মদ ফজলে রাব্বী, আবদুল আলীম চৌধুরী, সামসুদ্দীন আহমদ, আজহারুল হক, হুমায়ুন কবীর, সোলায়মান খান, কায়সার উদ্দীন, মনসুর আলী, গোলাম মর্তুজা, হাফেজ উদ্দীন খান, জাহাঙ্গীর, আবদুল জব্বার, এস কে লাল, হেমচন্দ্র বসাক, কাজী ওবায়দুল হক, আয়েশা বেদৌরা চৌধুরী, মমতাজ উদ্দীন, হাসিময় হাজরা, নরেন ঘোষ, জিকরুল হক, সামসুল হক, এস রহমান, এ গফুর, মনসুর আলী, এস কে সেন, মফিজ উদ্দীন, অমূল্য কুমার চক্রবর্তী, আতিকুর রহমান, গোলাম সরওয়ার, আরসি দাশ, মিহির কুমার সেন, সালেহ আহমদ, অনীল কুমার সিংহ, সুশীল চন্দ্র শর্মা, এ কে এম গোলাম মোস্তফা, মকবুল আহমদ, এনামুল হক, মনসুর (কানু), আশরাফ আলী তালুকদার, লে. জিয়ায়ুর রহমান, লে. ক. জাহাঙ্গীর, বদিউল আলম, লে. ক. হাই, মেজর রেজাউর রহমান, মেজর নাজমুল ইসলাম, আসাদুল হক, নাজির উদ্দীন, লে. নূরুল ইসলাম, কাজল ভদ্র ও মনসুর উদ্দীন। সাহিত্যিক পূর্ণেন্দু দস্তিদার,সাহিত্যিক ফেরদৌস দৌলা, সাহিত্যিক ইন্দু সাহা, কবি মেহরুন্নেসা, শিল্পী আলতাফ মাহমুদ, রাজনৈতিক নেতা দানবীর রণদাপ্রসাদ সাহা, ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত, আয়ুর্বেদ শাস্ত্রী যোগেশ চন্দ্র ঘোষ, চিফ ইঞ্জিনিয়ার শামসুজ্জামান, সরকারি কর্মচারী, মাহবুব আহমদ, মুজিবুল হক, ইঞ্জিনিয়ার খুরশীদ আলম, নজরুল ইসলাম, মোজাম্মেল হক চৌধুরী, মহসিন আলীসহ নাম না জানা আরো বহু বুদ্ধিজীবীকে।

বিজ্ঞাপন

দেশ স্বাধীনের পর ১৯৭২-এর ৩০ জানুয়ারি ভাইয়ের সন্ধানে ঢাকার বিহারি অধ্যুষিত মিরপুরে যান প্রখ্যাত সাহিত্যিক ও চলচ্চিত্র নির্মাতা জহির রায়হান। সেখান থেকে তিনি আর ফিরে আসেননি।

শহিদ বুদ্ধিজীবীদের প্রতি যথাযোগ্য শ্রদ্ধা প্রদর্শন ও দেশ গঠনে তাদের অভাবের প্রতি গুরুত্বারোপ করে ১৯৭২ সালের ১৭ জানুয়ারি গণবাহিনীর উদ্দেশে প্রদত্ত এক বিবৃতিতে প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বলেন, ‘বর্বর হানাদার শত্রুরা আমাদের সমাজের নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিদের হত্যা করার জঘন্য প্রচেষ্টায় মেতেছিল। যেসব মনীষীরা আমাদের সমাজের উন্নতির পথ নির্দেশ করতে পারতেন সেইসব বুদ্ধিজীবী এবং দক্ষ জনশক্তিকে তারা নির্মমভাবে হত্যা করেছে। আমরা অনেক অমূল্য প্রাণ হারিয়েছি। শুধু এই বিরাট ক্ষতি পূরণ করলেই হবে না, উন্নয়নের প্রতিটি ক্ষেত্রে আমাদের নয়া দক্ষ জনশক্তি গড়ে তুলতে হবে।’ (সূত্র: ড. মোহাম্মদ জাহাঙ্গীর হোসেন সম্পাদিত, বঙ্গবন্ধুর ভাষণ, চলচ্চিত্র ও প্রকাশনা অধিদপ্তর, পৃষ্ঠা—২৫)

বুদ্ধিজীবীদেরকে নৃশংসভাবে হত্যার বিষয়ে একটি বক্তব্যে বঙ্গবন্ধু বলেন, ‘…ইহারা ডাক্তারের হৃদপিণ্ড টেনে বের করে, সাংবাদিকের হাত কেটে ফেলে, ইঞ্জিনিয়ারের মগজ বের করে হত্যা করে। এমন নৃশংভাবে মানুষ হত্যার দৃষ্টান্ত দুনিয়ার ইতিহাসে নেই। (সূত্র: ইত্তেফাক, ২৩ ডিসেম্বর ১৯৭২)

শহীদ বুদ্ধিজীবীদের তালিকা তৈরির কাজ প্রথমে ১৯৭২ সালে শুরু হলেও, সে তালিকা কখনো সরকারি নথি বা গেজেটভুক্ত হয়নি। স্বাধীনতা লাভের পর পাঁচ দশকেও বুদ্ধিজীবী হত্যার কোন কিনারা আজো হয়নি। বুদ্ধিজীবীদের কে কোথায় কিভাবে শহীদ হয়েছেন তারও কোন কিনারা হয়নি। তাদের পরিবারবর্গও জানতে পারেনি প্রিয় এই মানুষগুলোর লাশ কোথায়?

২০২০ সালে শহীদ বুদ্ধিজীবীর একটি পূর্ণাঙ্গ তালিকা প্রণয়নের কাজ শুরু করেছিল সরকার। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয় এ পর্যন্ত ১ হাজার ৫০০ বুদ্ধিজীবীর নাম তালিকা চূড়ান্ত করেছে। শহীদ বুদ্ধিজীবীদের তালিকা প্রণয়ন দ্রুত শেষ করে গেজেট প্রকাশ করার জোর দাবি জানাচ্ছি।

বুদ্ধিজীবীদের হত্যাকাণ্ড- একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধে মানবতার বিরুদ্ধে সংঘটিত অপরাধগুলোর মধ্যে ঘৃণ্যতম। এসব হত্যাযজ্ঞে যারা নেতৃত্ব দিয়েছে, প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে যারা জড়িত ছিল, তাদের শাস্তি নিশ্চিত করার মাধ্যমেই শহীদ বুদ্ধিজীবীদের প্রতি প্রকৃত শ্রদ্ধা নিবেদন সম্ভব। বাংলাদেশে স্বাধীনতাবিরোধীদের অপতৎপরতা ও অপকর্ম আজও চলমান। স্বাধীনতা বিরোধীরা এখনও নানা অপতৎপরতা চালিয়ে যাচ্ছে দেশে ও বিদেশে। স্বাধীনতার ৫৩ বছরে এসেও দেশের বিভিন্ন স্থানে সাম্প্রদায়িক হামলা, ভাস্কর্য ভেংঙে দেওয়াসহ মুক্তিযোদ্ধাদের ও তাদের পরিবারের উপর হামলার অভিযোগ উঠছে। দেশে বিজয়ের মাসে দেশ ও জাতির বৃহত্তর স্বার্থে আমাদের সবাইকে শপথ নিতে হবে যেকোনো মূল্যে জঙ্গিবাদ, সন্ত্রাসবাদ ও দেশবিরোধী সকল অপতৎপরতাকারীদের রুখে দিতে হবে।

লেখক: সাংবাদিক ও সাংস্কৃতিক কর্মী

সারাবাংলা/এএসজি

বুদ্ধিজীবী হত্যা মুক্তমত রাকিবুল ইসলাম শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবস

বিজ্ঞাপন

আরো

সম্পর্কিত খবর