কমরেড মুজফ্ফর আহমদ: আজীবন সংগ্রাম সংগ্রামী এক কিংবদন্তি
১৯ ডিসেম্বর ২০২৪ ১৬:৪৬
‘আমি হলফ করে বলতে পারি, মুজফ্ফরকে দেখলে লোকের শুষ্ক চক্ষু ফেটে জল আসবে। এমন সর্বত্যাগী, আত্মভোলা, মৌন কর্শ, এমন সুন্দর প্রাণ, এমন ধ্যানী দুরদৃষ্টি, এমন উজ্জ্বল প্রতিভা এমন উদার বিরাট বিপুল মন নিয়ে সে কি করে জন্মালো বাংলায় তা ভেবে পাইনে।’– কাজী নজরুল ইসলাম
গতকাল (১৮ ডিসেম্বর) ছিল বিশ্ববরেণ্য বিপ্লবী রাজনীতিবিদ, ভারতের কমিউনিষ্ট পার্টির অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা ও কমিউনিষ্ট আন্দোলনের কিংবদন্তি নেতৃত্ব কমরেড মুজফ্ফর আহমদের ৫১তম মৃত্যুবার্ষিকী।
ভারতীয় উপমহাদেশের কমিউনিস্ট আন্দোলনের তার উত্তরসূরী নেতৃবৃন্দ তাকে ‘কাকাবাবু’ বলেই ডাকতেন। এই নামেই তিনি বেশ সুপরিচিতিও পেয়েছিলেন।
১৮৮৯ খ্রিস্টাব্দের ৫ আগস্ট কমরেড মুজফ্ফর আহমদ বাংলাদেশের দক্ষিণাঞ্চলে অবস্থিত চট্টগ্রাম জেলার সন্দ্বীপের মুসাপুর গ্রামে এক দরিদ্র কিন্তু অভিজাত মুসলিম পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। অনন্য রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ত্ব, মানবিক রাজনীতির অমর মানুষ কমরেড মুজফ্ফর আহমদের স্মৃতির প্রতি জানাই বিনম্র শ্রদ্ধা।
উল্লেখ্য যে, কমরেড মুজফ্ফর আহমদ ১৯৭৩ সালের ১৮ ডিসেম্বর কলকাতায় মৃত্যুবরণ করেন। সব দিক দিয়েই একজন পরিপূর্ণ, অনুকরণীয় অনন্য সংগ্রামী মানুষ ছিলেন কমরেড মুজফ্ফর আহমদ। আবার আমাদের প্রিয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের স্মৃতির সাথেও তিনি জড়িয়ে আছেন গভীরভাবে। তিনি আজীবন মানুষের কল্যাণের জন্যে রাজনীতি করে গেছেন। যুক্তি ও বিচার-বিশ্লেষণী মানুষ ছিলেন তিনি। কুসংস্কারমুক্ত মন ছিলো তার।
২.
ভারতের কমিউনিস্ট আন্দোলনের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা ও সংগঠক কমরেড মুজফ্ফর আহমদ বিশ্বাস করতেন যে, মানসিক উদারতার জন্য সংবাদপত্র ও বাকস্বাধীনতা এবং নতুন ধ্যান-ধারণায় উৎসাহ প্রদানে অভিজ্ঞতার আদান-প্রদান অত্যন্ত জরুরি। তিনি প্রেস, সংবাদপত্র ও গ্রন্থের বিষয়ে ছিলেন অত্যন্ত সাবধানী এবং এতে ছিল তার অগাধ ভালবাসা। ন্যাশনাল বুক এজেন্সি এবং গণশক্তি প্রেস তারই সৃষ্টি। তার বিভিন্ন বিষয়ের উপর লেখা অসংখ্য প্রবন্ধ বিভিন্ন জার্নাল ও ম্যাগাজিনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে।
কৃষকদের বিভিন্ন সমস্যা নিয়ে তার লেখা এবং তার গ্রন্থ ‘Communist Party of India: Years of Formation 1921-1933’ এবং ‘Myself and the Communist Party of India’ সমসাময়িক রাজনীতি সম্বন্ধে আলোকপাত করে। কমরেড মুজফ্ফর আহমদের কিছু কিছু চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য সবারই দৃষ্টি আকর্ষণ করে। শ্রমিক শ্রেণির আন্তর্জাতিকতার প্রতি তার গভীর অনুরাগ, গণতন্ত্রের প্রতি দৃঢ় প্রত্যয়, নারীর সম-অধিকারের প্রতি তীব্র আগ্রহ সব মিলিয়ে তাকে একজন মহান বিপ্লবীতে পরিণত করে। পার্টি ব্যবস্থাপনা, গণআন্দোলন, নির্বাচনের টানাপোড়ন ইত্যাদি সম্বন্ধে ছিল তার পরিষ্কার ধারণা।
তিনি মার্কস ও লেনিনের রচনাবলী ও কর্মজীবন সম্পর্কে বিশদভাবে জানতেন এবং দেশে প্রচলিত আইন ও নিয়ম-কানুন সম্পর্কে সম্যকভাবে অবহিত ছিলেন। তিনি নির্বাচনী প্রচারণায় খুঁটিনাটি সমস্ত নিয়মই অনুসরণ করতেন এবং ১৯৩৭ সাল থেকে ১৯৭১ সাল পর্যন্ত সব নির্বাচনেই সক্রিয় নেতৃত্ব প্রদান করেন। তিনি ছিলেন শ্রমিক শ্রেণির আর্ন্তজাতিকতাবাদের অনুসারী। বাংলাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলন নিয়ে তিনি গর্ব করতেন। আমাদের জাতীয় কবিকে জানতে কমরেড মুজফ্ফর আহমদের ‘কাজী নজরুল ইসলাম: স্মৃতি কথা’ একটি আকর গ্রন্থ।’দৈনিক গণশক্তি’ (১৯৬৬) প্রকাশে তার অবদান স্মরণীয়। কমরেড মুজফ্ফর আহমদের গুরুত্বপূর্ণ গ্রন্থ ‘আমার জীবন ও ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি’ (১ম খণ্ড ১৯৬৯, ২য় খণ্ড ১৯৭২)।
৩.
আমরা জানি, মৃত্যু অনিবার্য। জীবনের চলার গতি এক সময় রুদ্ধ হবেই, অনিবার্য। কিন্তু কিছু মানুষের জীবন ও কর্ম তার মৃত্যুকে কোনো কোনো সময় অতিক্রম করে যায়। জীবনের গতির ধারা যেন অব্যাহত থাকে তার বর্ণময় কাজের মধ্যে দিয়ে। তিনি নানাভাবে ছড়িয়ে থাকেন তার চেনা পরিজন বা অনুগামীদের মাঝেই। কমরেড কমরেড মুজফ্ফর আহমদ ছিলেন এমনই একজন পরিপূর্ণ, আলোকিত মানুষ। মানুষের সেবায়, কল্যাণের তরে একজন একনিষ্ঠ রাজনৈতিক কর্মী হিসেবে তিনি নিজের জীবনের সবটাই উৎসর্গ করে দিয়েছিলেন। তার আদর্শ সত্যিই অনুসরণযোগ্য। কমরেড কমরেড মুজফ্ফর আহমদকে স্মরণ করা মানেই এই উপলব্ধিকে ছুঁয়ে যাওয়া মনে, অন্তরে। তাকে তাই অনুভূতির মধ্য দিয়ে স্পর্শের বাইরে রাখলে চলবে না, তার জীবন ও কাজ থেকে শিক্ষা নিয়ে এগিয়ে যেতে কাজ করতে হবে। কারণ মানব কল্যাণের রাজনৈতিক কাজের প্রতি তার সততা, নিষ্ঠা সত্যিই বিরল বলেই অনুসরণযোগ্য। তার ছিল অগাধ পাণ্ডিত্য। কিন্তু তিনি নিরহঙ্কারী ছিলেন। একদিকে রাজনৈতিক জ্ঞান, অন্যদিকে সাহিত্যকীর্তি—দু’য়ের মেলবন্ধনে সমৃদ্ধ হয়েছে তার জীবনবৃক্ষ। তার সারাজীবনের কাজের মধ্যদিয়ে তিনি যে ছাপ রেখে গিয়েছেন তা শিক্ষণীয় ও উদ্দীপনাময়। কমরেড কমরেড মুজফ্ফর আহমদকে ভালোবাসলে আমাদের অব্যাহত রাখতে হবে তার সেই মানবতাবাদী রাজনীতির চিরায়ত ঘরানা।
৪.
ভালোবেসে, বুঝেশুনেই রাজনীতিকেই জীবনের পেশা হিসেবে বেছে নিয়েছিলেন কমরেড মুজফ্ফর আহমদ। তিনি লিখেছেন, ‘আমার জীবনের পেশা কি হবে,- সাহিত্য, না, রাজনীতি এই নিয়ে আমি পুরো ১৯১৯ সাল ভেবেছি। সত্য কথা বলতে, আমার মনের ভিতরে সাহিত্য ও রাজনীতির দ্বন্দ্ব চলেছিল। কবি আমি ছিলেম না। গল্প লেখক বা ঔপন্যাসিক হওয়ার স্বপ্ন আমি কোনোদিন দেখিনি। সেই ভাষা কোনদিন আমার আয়ত্তে ছিল না। আমার প্রবল বাসনা ছিল যে আমি একজন প্রবন্ধকার হব। আমার পরবর্তী জীবনেও, অর্থাৎ রাজনীতিক জীবনে তা হওয়ার পথে কোনো প্রতিবন্ধক ছিল বলে আমার মনে হয় না। তবুও আমি প্রবন্ধকারও হতে পারিনি, যদিও আমি খবরের কাগজ চালিয়েছি। আমার মনে যে সাহিত্য ও রাজনীতির দ্বন্দ্ব চলেছিল তাতে শেষ পর্যন্ত জয় হলো রাজনীতির। একটা কিছুতে নিজেকে যে বিলিয়ে দেব সে তো আগেই স্থির করেছিলাম। সেইজন্যই তো আমি ‘বঙ্গীয় মুসলমান সাহিত্য সমিতি’র সব সময়ের কর্মী হতে পেরেছিলাম। ১৯২০ সালের শুরুতে আমি স্থির করে ফেললাম যে রাজনীতিই হবে আমার জীবনের পেশা। আমি রাজনীতিক সভা-সমিতি ও মিছিলে যোগ দেওয়া শুরু করেছিলাম তো ১৯১৬ সাল হতে”। (‘আমার জীবন ও ভারতের কমিউনিষ্ট পার্টি’-কমরেড মুজফ্ফর আহমদ, পৃষ্ঠা-৩৯)।
৫.
কমরেড কমরেড মুজফ্ফর আহমদ বাংলা ১২৯৬ সালের শ্রাবণ মাসের কোন এক সোমবার সন্দ্বীপের মুছাপুর গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তাদের দরিদ্র পরিবারের কারুরই জন্মবার্ষিকী পালিত হত না। তার জন্ম তারিখও কোনোদিন পালিত হয়নি। তাই জন্মের তারিখ তার মনে নেই। মায়ের মুখে শুনে শুধু সাল, মাস ও বারের কথাই তার মনে আটকে রয়েছে। ১২৯৬ সালের শ্রাবণ মাসের ৭, ১৪, ২১ ও ২৮ তারিখ সোমবার ছিল। খ্রিস্টীয় সনের হিসাবে এই তারিখগুলো ১৮৮৯ সালের ২২ জুলাই, ২৯ জুলাই, ৫ আগস্ট ও ১২ আগস্ট ছিল। এই চারটি তারিখের মধ্যে কোনটি ছিল তার প্রকৃত জন্মদিন তা জানার আর কোন সম্ভাবনা নেই। সাধারণত আগস্ট মাসকেই তিনি তার জন্মের মাস বলে থাকেন। পরে তিনি ৫ আগস্টকে নিজের জন্মদিন বলে মনস্থির করেন।
৬.
তার বাবা মুন্সি মনসুর আলি (১৮২৭-১৯০৫) সন্দ্বীপের আদালতে আইন ব্যবসা করতেন। মা চুনা বিবি। চুনা বিবি মুন্সী মনসুর আলির দ্বিতীয় স্ত্রী। মনসুর আলির দুই পরিবারে ৪টি ছেলে সন্তানের জন্ম হয়। দ্বিতীয় স্ত্রী চুনা বিবির ঘরে মুজফফর আহমদের জন্ম। তিনি ছিলেন ভাইদের মধ্যে সবার ছোট। তার বর্ণমালার হাতেখড়ি বাবার কাছে। তারপর মদনমোহন তর্কালঙ্কারের কাছে শিশুশিক্ষা প্রথম ভাগ শেষ করেন। ১৮৯৭ সালে তিনি গ্রামের প্রাইমারি স্কুলে ভর্তি হন। ১৮৯৯ সালে প্রাইমারি পড়াশুনা সমাপ্ত করে হরিশপুর মডেল ইংলিশ স্কুলে ভর্তি হন। কিন্তু এই স্কুলে দু’বছরের বেশি পড়াশুনা করতে পারেননি। স্কুলের বেতন বকেয়া পড়ার কারণে তার নাম কাটা যায়। এ সময়ে তিনি কিছুদিন কোরান পাঠ শেখেন। পারিবারিকভাবে তিনি ফার্সি ভাষা জানতেন। কিছুদিন পর বামনির আখতারিয়া মাদ্রাসায় ভর্তি হন। এখানে পড়াশুনার সময় ১৯০৫ সালে তার বাবা মারা যান। তখন তার বয়স ছিল ১৬ বছর। সংসারের অভাব অনটনের মধ্যে তার পড়াশুনা বন্ধ হয়ে যাওয়ার পালা। এই সময় একদিন ডেপুটি স্কুল ইন্সপেক্টর উমেশ চন্দ্র দাশগুপ্ত মুজফফর আহমদকে ইংরেজি পড়ার জন্য উৎসাহ দিলেন। তিনি মুজফফর আহমদকে আগে থেকেই চিনতেন। তার পরামর্শে তিনি বরিশালের বুড়িরচর গ্রামে যান। সেখানে তিনি এক কৃষক পরিবারে শিশুদের গৃহশিক্ষক নিযুক্ত হন। উদ্দেশ্য, কিছু টাকাকড়ি সঞ্চয় করে বরিশালের কোন স্কুলে ভর্তি হওয়া। ইতিমধ্যে বড় ভাই মকবুল আলি খোঁজ-খবর নিয়ে বুড়িরচরে গিয়ে মুজফফর আহমদকে সন্দ্বীপে ফিরিয়ে নিয়ে আসেন। দীর্ঘ ৫ বছর পর বড় ভাই তাকে সন্দ্বীপের স্কুলে ভর্তি করে দেন। পড়াশুনার পাশাপাশি তিনি লেখালেখি করার চেষ্টা করতেন। ১৯০৭ সালে কলকাতার সাপ্তাহিক ‘সুলতান’-এ তার প্রথম লেখা প্রকাশিত হয়। তিনি সন্দ্বীপ থাকার সময় ওই পত্রিকায় স্থানীয় খবর পাঠাতেন। সম্পাদক মাওলানা মনিরুজ্জামান ইসলামাবাদী তাকে লেখালেখি করার জন্য উৎসাহ দিতেন।
৭.
১৯১০ সালে মুজফফর আহমদ নোয়াখালি জেলা স্কুলে ভর্তি হন। ১৯১৩ সালে ২৩ বছর বয়সে তিনি এই স্কুল থেকে দ্বিতীয় বিভাগে ম্যাট্রিক পাস করেন। এরপর তিনি হুগলি কলেজে আইএ ভর্তি হন। তিনি ছাত্র পড়িয়ে নিজের খরচ ও পড়াশুনার খরচ যোগাতেন। এ ছাড়া তার বড় ভাই কিছু টাকা দিতেন। হুগলিতে পড়াশুনার সময় তিনি ম্যালেরিয়ায় আক্রান্ত হয়ে কলকাতা চলে যান। তারপর তিনি কলকাতার বঙ্গবাসী কলেজে ভর্তি হন। এ কলেজ থেকে আইএ পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন। আইএ পড়াশুনার সময় তিনি কলকাতায় মুসলমান সাহিত্য সমিতির সভ্য হন। ১৯১৫ সালে সমিতির সহ-সম্পাদক নির্বাচিত হন। ১৯১৬ সালে এক বছর ধরে এখানে ওখানে চাকরি করেন। ১৯১৭ সালে যোগ দেন বেঙ্গল গভর্নমেন্ট প্রেসের সহকারী স্টোর কিপার পদে। এ কাজে তিনি এক বছর ছিলেন। মাসিক বেতন ছিল ত্রিশ টাকা। এরপর তিনি মাসিক পঞ্চাশ টাকা বেতনে গভর্নমেন্টের হোম ডিপার্টমেন্টে উর্দু থেকে বাংলা অনুবাদকের কাজ করেন। এখানে তিনি মাত্র একমাস কাজ করেন। পরবর্তী একমাস তিনি কলকাতায় স্কুল পরিদর্শকের অফিসে কাজ করেন। ১৯১৮ সালে তিনি বঙ্গীয় মুসলমান সাহিত্য সমিতির সার্বক্ষণিক কর্মী হন। তিনি উদ্যোগী হয়ে ৩২ নং কলেজ স্ট্রিটে ষাট টাকা ভাড়ায় সমিতির কার্যালয় স্থাপন করেন। এই সময় ত্রৈমাসিক ‘বঙ্গীয় মুসলমান সাহিত্য পত্রিকা’ বের হত। পত্রিকার যুগ্ম সম্পাদক হিসাবে ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ ও মোহাম্মদ মোজাম্মেল হকের নাম ছাপা হলেও সম্পাদকীয়র সব কাজ মুজফফর আহমদই করতেন। ১৯১৯ সালে জালিয়ানওয়ালাবাগের হত্যাকাণ্ডের প্রতিবাদে কলকাতায় অনুষ্ঠিত বিক্ষোভ মিছিলে তিনি অংশগ্রহণ করেন।
৮.
আমরা জানি, বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলামের সাথে মুজফফর আহমদ-এর সুসম্পর্ক তাদের উভয়ের জীবনকেই প্রভাবিত করে। পত্র যোগাযোগের মাধ্যমে কাজী নজরুল ইসলামের সাথে মুজফফর আহমদ-এর বন্ধুত্ব গড়ে ওঠে। ১৯১১ সালে কলকাতায় অবস্থানরত বিভিন্ন মুসলিম ছাত্রের উদ্যোগে বঙ্গীয় মুসলিম সাহিত্য সমিতি গঠিত হয়। কলকাতার ৩২ কলেজ স্ট্রিটে এ সাহিত্য সমিতির অফিস ছিল। ১৯১৮ সালে সমিতির উদ্যোগে বের হয় ‘বঙ্গীয় মুসলিম সাহিত্য পত্রিকা”। ১৯১৮ সালে সমিতির সব সময়ের কর্মী হিসেবে তিনি এর অফিসেই থাকা শুরু করেন। তিনি ছিলেন সমিতির সহকারী সম্পাদক। পত্রিকার কাজ পরিচালনার সময় চিঠিপত্রের মাধ্যমে কবি কাজী নজরুল ইসলামের সাথে তার পরিচয় হয়। ১৯২০ সালের শুরুর দিকে ৪৯ নম্বর বেঙ্গল রেজিমেন্ট ভেঙ্গে দেওয়া হলে নজরুলের সৈনিক জীবনের অবসান ঘটে এবং তিনি কলকাতায় চলে আসেন। তিনি কলকাতায় কমরেড মুজফ্ফর আহমদের সাথে সাহিত্য সমিতির অফিসে থাকতে শুরু করলেন। এসময় মুজফফর আহমদ ও কাজী নজরুল ইসলাম দীর্ঘদিন একসাথে বসবাস করেন। ওই সময় শেরে বাংলা এ. কে. ফজলুল হক ছিলেন কংগ্রেস ও খেলাফতের একজন অন্যতম নেতা। মুজফফর আহমদ তার কাছে একটি পত্রিকা প্রকাশের প্রস্তাব দেন। তিনি সম্মতি প্রদান করেন। তারই ধারাবাহিকতায় ১৯২০ সালের ১২ জুলাই শেরে বাংলা এ. কে. ফজলুল হক প্রতিষ্ঠিত সান্ধ্য দৈনিক ‘নবযুগ’-এর যুগ্ম সম্পাদক হন মুজফফর আহমদ। আর সম্পাদক ছিলেন কাজী নজরুল ইসলাম। এই পত্রিকায় কমরেড মুজফ্ফর আহমদ শ্রমিকদের জীবন-জীবিকার সমস্যা নিয়ে প্রবন্ধ লিখতেন। ওই বছর কমরেড মুজফ্ফর আহমদ বঙ্গীয় খিলাফত কমিটির সদস্য মনোনীত হলেও তিনি তা প্রত্যাখ্যান করেন। ব্রিটিশ বিরোধী লেখা প্রকাশের জন্য ব্রিটিশ সরকার ‘নবযুগ’ পত্রিকার এক হাজার টাকা জামানত বাজেয়াপ্ত করে। মুজফফর আহমদ আবার শেরে বাংলা এ কে ফজলুল হকের কাছে দু’হাজার টাকা নিয়ে জামানত দাখিল করেন। শুরুতে ‘নবযুগ’ চারহাজার কপি ছাপা হত। কাজী নজরুল ইসলামের ‘অগ্নিবীণা’র জাগরণমূলক কবিতাগুলো এ পত্রিকাতেই প্রথম প্রকাশিত হয়েছিল। ‘নবযুগ’ কৃষক-মজুরের অধিকার আদায়ের দাবি সমর্থন করত। এ ব্যাপারে শেরে বাংলা এ কে ফজলুল হকের কাছে কেউ বিরূপ মন্তব্য করেন। ফলে সম্পাদকীয় নীতিমালা বেঁধে দিতে উদ্যোগী হন শেরে বাংলা এ কে ফজলুল হক। যার কারণে ১৯২১ সালের জানুয়ারি মাসে প্রথমে কাজী নজরুল ইসলাম ও পরে মুজফফর আহমদ ‘নবযুগ’ ছেড়ে দেন। কিছুদিন পর পত্রিকাটিও বন্ধ হয়ে যায়।
৯.
প্রথম বিশ্বযুদ্ধ শেষে সারা পৃথিবীতে একটা নব জাগরণ সৃষ্টি হয়। এর প্রভাব ভারতবর্ষেও পড়ে। এসময় মৌলানা আবুল কালাম আজাদ কলকাতা টাউন হলে পরপর তিন দিন ছয় ঘন্টা করে বক্তৃতা করেন। মুজফফর আহমদ সেই বক্তৃতা শুনে প্রভাবিত হন। ১৯১৭ সালে রাশিয়ায় যে বিপ্লব হয়, তাও তাকে প্রভাবিত করে। রুশ বিপ্লবের কিছু কিছু তথ্য প্রচারমূলক বই ও মার্কসবাদী সাহিত্য গোপন পথে এদেশে আসতে শুরু করে। মুজফফর আহমদ তা পাঠ করে মার্কসবাদের প্রতি আগ্রহী হয়ে ওঠেন। জনগণের দুঃখ-দুর্দশা লাঘব করার মতাদর্শের সন্ধান পেয়ে তিনি সেই পথের অভিযাত্রী হয়ে যান। ১৯২০ সালের ১৭ অক্টোবর তাসখন্দে প্রথম ভারতের কমিউনিস্ট পর্টি প্রতিষ্ঠিত হয়। উদ্যোক্তা ছিলেন এম. এন. রায়। এই সময় মুজফফর আহমদ আন্তর্জাতিক কমিউনিস্ট আন্দোলনের সাথে যোগাযোগ স্থাপন করেন এবং বিদেশ থেকে অনেক পত্রপত্রিকা সংগ্রহ করতে থাকেন। ১৯২১ সালে এ পার্টি কমিউনিস্ট ইন্টারন্যাশনাল এর অনুমোদন পায়। এই প্রবাসী পার্টির কাজ জার্মানিতেও সম্প্রসারিত হয়। জার্মানি থেকে ১৯২২ সালের ১৫ মে পার্টির পত্রিকা প্রকাশিত হয়। এ পত্রিকা ডাকযোগে ভারতের বিভিন্ন স্থানে বিভিন্ন ব্যক্তির নামে পাঠানো হত। এক সময় এ পত্রিকা পুলিশের হাতে পড়ে। মুজফফর আহমদ তখন পত্রিকার নাম পরিবর্তনের জন্যে এম. এন. রায়কে লেখেন। এম. এন. রায় পত্রিকাটির নতুন নামকরণ করেন। ১৯২১ সালের শেষ দিকে কমিউনিস্ট সংগঠনের সঙ্গে তার যোগাযোগ হয়। একই সময় ভারতবর্ষের বিভিন্ন এলাকায় আরো কয়েকজন মার্কসবাদে আকৃষ্ট হন। তাদের সাথেও মুজফফর আহমদের যোগাযোগ হয়। তারা হলেন, মুম্বাই-এর শ্রীপদ অমৃত ডাঙ্গে, মস্কো থেকে কাবুলে আগত মোহাম্মদ আলি, পেশোয়ার ইসলামিক কলেজের অধ্যাপক গোলাম হোসেন প্রমুখ। এছাড়া ১৯২২ সালের শেষ দিকে মস্কো থেকে কলকাতায় প্রত্যাগত শওকত ওসমানির সাথেও মুজফফর আহমদের পরিচয় হয়। এসময় ভারতবর্ষে যাঁরা কমিউনিজম নিয়ে চিন্তা-ভাবনা করতেন তাদের সাথে মুজফফর আহমদের যোগাযোগ স্থাপিত হয়। ১৯২১ সালের নভেম্বর মাসে মাদ্রাজ, বোম্বাই ও পাঞ্জাবের বিভিন্ন কমিউনিস্ট গ্রুপের সঙ্গে মুজফফর আহমদ যোগাযোগ করার কাজ শুরু করেন। ১৯২১ সালের ডিসেম্বর মাসে ভারতের কমিউনিস্ট পার্টির প্রথম মুদ্রিত ইশতেহার প্রচার করা হয়। আহমেদাবাদে অনুষ্ঠিত জাতীয় কংগ্রেসের অধিবেশনের প্রতিনিধিদের সম্বোধন করে পূর্ণ স্বাধীনতার ডাক দিয়ে এই ইশতেহার রচিত হয়।
১০.
১৯২২ সালের শেষের দিকে আব্দুল হালিমের সঙ্গে মুজফ্ফর আহমদের দেখা হয়। দু’জনে মিলে ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি গড়ার কাজ শুরু করেন। প্রথম যুগে এঁদের সঙ্গে ছিলেন আব্দুর রেজ্জাক খান। ১৯২২ সালের ১৫ মে পার্টির প্রথম পত্রিকা প্রকাশিত হয়। নাম ছিল ‘দি ভ্যানগার্ড অব দি ইন্ডিয়ান ইন্ডিপেন্ডেন্স’। পুলিশের নজর পড়ায় নাম বদলে হয় ‘অ্যাডভান্স গার্ড’। তারপর ভারতের কমিউনিস্ট পার্টির মুখপত্র হিসেবে ‘দি ভ্যানগার্ড’ প্রকাশিত হয়। এই সময়কালেই নজরুল ইসলাম সম্পাদিত ‘ধুমকেতু’ পত্রিকায় দ্বৈপায়ন ছদ্মনামে দেশের রাজনৈতিক সমস্যা এবং কৃষক ও শ্রমিকদের সমস্যা নিয়ে মুজফফর আহমদ বিশ্লেষণাত্মক রচনা লেখেন। ভারতবর্ষের ভিতরে কমিউনিস্ট পার্টি গঠন প্রসঙ্গে মুজফফর আহমদ বলেন, ‘আগে পরে চার জায়গায় ভারতে কমিউনিস্ট পার্টি গড়ার কাজ আরম্ভ হয়েছিল। উদ্যোক্তারা একত্রে মিলিত হয়ে আলোচনা করে যে এই সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন তা নয়, প্রত্যেক জায়গায় পৃথক পৃথকভাবে উদ্যোক্তারা কাজ শুরু করেছিলেন। তাদের একজনের সঙ্গে আরেকজনের পরিচয় ছিল না। ভারতবর্ষ একটি বিশাল দেশ। প্রথম চারটি জায়গা হলো কলকাতা, বোম্বে (মুম্বাই), লাহোর ও মাদ্রাজ। এক জায়গা হতে অন্য জায়গার দূরত্ব এক হাজার মাইলেরও অনেক বেশি। এত দূরে থেকেও আমরা সারা ভারতের পার্টি গড়ার কাজে নেমেছিলাম। কারণ কমিউনিস্ট আন্দোলন আন্তর্জাতিক। আমাদের সকলের মধ্যবিন্দু ছিল কমিউনিস্ট ইন্টান্যাশনাল। তার কেন্দ্র ছিল বহু হাজার মাইল দূরে মস্কোতে। কমিউনিষ্ট ইন্টারন্যাশনালই কোন কোন ক্ষেত্রে আমাদের একজনের সঙ্গে অপরের পরিচয় ঘটিয়ে দিয়েছিলেন’।
১১.
১৯২৩ সাল থেকে মুজফফর আহমদ ট্রেড ইউনিয়ন কংগ্রেসের সঙ্গে যুক্ত হন এবং বিভিন্ন স্থানে শ্রমিক আন্দোলনে অংশগ্রহণ করেন। পূর্বে জড়িত হয়েছিলেন ইন্ডিয়ান সীমান্ত এসোসিয়েশনের সঙ্গে। তখন থেকেই গোয়েন্দা বিভাগের লোকেরা তার গতিবিধির উপর নজর রাখতে শুরু করে। ১৯২৩ সালের ১৭ মে পুলিশ তাকে গ্রেপ্তার করে রাজবন্দি হিসেবে কারাগার আটকে রাখে। ওই সময় ভারতবর্ষের পেশোয়ারে প্রথম কমিউনিস্ট ষড়যন্ত্র মামলা চলছিল। ওই মামলায় মুজফফর আহমদকে জড়ানোর চেষ্টা হয়েছিল। কিন্তু প্রমাণাভাবে তা সম্ভব হয়নি। তবে ১৯২৪ সালের মার্চ মাসে কানপুর কমিউনিস্ট (বলশেভিক) ষড়যন্ত্র মামলায় মুজফফর আহমদ, শ্রীপদ আমৃত ডাঙ্গে, শওকত ওসমানি ও নলিনী গুপ্তের চার বছর করে সাজা দেয়া হয়। যক্ষ্মা রোগে আক্রান্ত হওয়ার কারণে ১৯২৫ সালের ১২ সেপ্টেম্বর তাকে মুক্তি দেওয়া হয়। মুক্তি পাওয়ার পর তিনি কৃষকদের মাঝে কাজ শুরু করেন। সংগঠিত করেন কৃষকদের। ১৯২৫ সালের পয়লা নভেম্বর কলকাতায় ‘লেবার স্বরাজ পার্টি’ গঠিত হয়। ১৯২৬ সালে কৃষ্ণনগরে অনুষ্ঠিত কৃষক সম্মেলন তার উদ্যোগে হয়েছিল। ওই সম্মেলনে ‘মজুর-কৃষক পার্টি’ গঠিত হয়। প্রথমে ‘লাঙল’ নামে ‘মজুর-কৃষক পার্টি’র পক্ষ থেকে পত্রিকা প্রকাশিত হয়। পরে ১৯২৬ সালের ১২ আগস্ট থেকে ‘গণবাণী’ সাপ্তাহিক প্রকাশিত হতে থাকে। এই পত্রিকার সম্পাদনার দায়িত্ব পড়ে মুজফফর আহমদের উপর।
১২.
১৯২৭ সালে কলকাতায় ডক-মজুর ধর্মঘট, মেথর ধর্মঘট, চটকল মজুর ধর্মঘট ইত্যাদিতে তিনি প্রত্যক্ষ ভূমিকা পালন করেন। ১৯২৭ ও ১৯২৮ সালে ভারতের বিভিন্ন স্থানে শ্রমিকদের আন্দোলন জোরদার হয়। এসব আন্দোলনে কমিউনিস্ট পার্টি ও ‘মজুর-কৃষক পার্টি’ একযোগে কাজ করে। ১৯২৭ সালের ৩১ মে বোম্বেতে কমিউনিস্টদের এক সম্মেলনে মুজফ্ফর আহমদ যোগদান করেন। ১৯২৮ সালের ২২-২৩ ডিসেম্বর কলকাতায় সর্বভারতীয় ওয়ার্কর্স অ্যান্ড পেজান্টস পার্টির সম্মেলন অনুষ্ঠানের প্রধান উদ্যোক্তা ছিলেন তিনি। এর তিন দিন আগে ঝরিয়ায় অনুষ্ঠিত এ আই টি ইউ সি’র অধিবেশনে প্রতিনিধিদের ভোটে কমরেড মুজফ্ফর আহমদসহ তিনজন কমিউনিস্ট সভাপতি নির্বাচিত হন। ১৯২৯ সালের ২০ মার্চ ব্রিটিশ সরকার বিভিন্ন এলাকা থেকে কমিউনিস্ট নেতাদের গ্রেফতার করে। এসময় মুজফফর আহমদকেও গ্রেফতার করা হয়। তার বিরুদ্ধে ‘মীরাট কমিউনিস্ট ষড়যন্ত্র মামলা’ দায়ের করা হয়। এই মামলায় অভিযুক্ত করা হয় ৩১ জনকে। ৪ বছর ধরে চলে এ মামলা। ১৯৩৩ সালের ৯ জানুয়ারি মামলার রায় হয়। মুজফফর আহমদকে যাবজ্জীবন কারাদন্ড দেওয়া হয়। পরে আপিলে এ সাজা কমিয়ে ৩ বছর করা হয়। এই তিন বছর তিনি মীরাট, নৈনি, আলমোড়া, দার্জিলিং, বর্ধমান এবং ফরিদপুর জেলে ছিলেন। জেল থেকে মুক্ত হবার পর তাকে নজরবন্দিতে রাখা হয়। প্রথমে ফরিদপুর, পরে নিজের গ্রামের বাড়ি সন্দ্বীপে ও মেদিনীপুরের এক গ্রামে তাকে অন্তরীণ রাখা হয়। ব্রিটিশ সরকার সশস্ত্র বিপ্লববাদীদের দমনের জন্য ‘বেঙ্গল অর্ডিনান্স’ আইন চালু করেছিল, সেই আইনে তাকে গ্রেপ্তার করা হয়েছিল। ১৯৩৬ সালের ২৫ জুন তিনি মুক্তি পান। মুক্তি পাওয়ার পর পার্টিকে সংগঠিত করার কাজে নিজেকে নিয়োজিত করেন। যে সব বিপ্লবী কর্মী কারামুক্ত হয়ে আসেন, তিনি তাদের সাথে যোগাযোগ করে বিভিন্ন জেলায় পার্টি গঠনের ব্যবস্থা করেন। ১৯৩৮ থেকে ১৯৪০ সালের মধ্যে যুক্তবঙ্গের ২৮টি জেলাতেই কমিউনিস্ট পার্টি গড়ে ওঠে। এতটুকু সময়ের মধ্যে পার্টির সভ্য সংখ্যা আড়াই থেকে তিন হাজারে উন্নীত হয়।
১৩.
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরু হবার পর ১৯৪০ সালে ব্রিটিশ সরকার আবারও কমিউনিস্টদের প্রতি সন্দেহ পোষণ করে। এ সময় কলকাতার শ্রমিকদের মাঝে মুজফফর আহমদের খুব প্রভাব ছিল। যার কারণে সরকার ওই বছর ফেব্রুয়ারী মাসে তাকে কলকাতা ছেড়ে যাবার আদেশ দেয়। আদেশ অমান্য করায় তার এক মাসের জেল হয়। মুক্তি লাভের পর আবারও তাকে কলকাতা ছাড়ার আদেশ দেওয়া হয়। এবার তিনি প্রকাশ্যে কলকাতা ত্যাগ করে চলে যান। কিন্তু ১৯৪০ সালের ২৩ জুন গোপনে কলকাতায় ফিরে আসেন। তখন থেকে ১৯৪২ সালের ২৩ আগস্ট পর্যন্ত গোপনে পার্টির কাজ চালিয়ে যান। ১৯৪৫ সালে ময়মনসিংহের নেত্রকোণা নিখিল ভারত কৃষক সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। তিনদিনব্যাপী এ সম্মেলনে মুজফফর আহমদ সভাপতিত্ব করেন। ১৯৪৮ সালে কলকাতায় ভারতের কমিউনিস্ট পার্টির একক কংগ্রেস অনুষ্ঠিত হয়। প্রত্যেকটি পার্টি কংগ্রেসে তিনি কেন্দ্রীয় কমিটিতে নির্বাচিত হন। দেশ বিভাগের পূর্বে তিনি বঙ্গীয় পার্টির সম্পাদক ছিলেন। তিনি জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য ছিলেন। এই সম্মেলনে ভারত ও পাকিস্তান কমিউনিস্ট পার্টি আলাদা আলাদা ভাবে কাজ চালানোর সিদ্ধান্ত নেয়।
১৪.
১৯৪৮ সালের ২৫ মার্চ কমিউনিস্ট পার্টি বেআইনি ঘোষিত হলে ভারত সরকার এই আইনে মুজফফর আহমদকে গ্রেপ্তার করে। ১৯৫১ সালের ২৭ এপ্রিল তিনি মুক্তি পান। ওই বছর তিনি রাজ্য পার্টির সম্পাদক হন। ১৯৫৩ সালে তিনি শারীরিক অসুস্থতার কারণে পার্টির সম্পাদক পদ ছেড়ে দেন। তখন জ্যোতি বসু সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেন। ওই সময় সোভিয়েত ইউনিয়ন ও চীনের কমিউনিস্ট পার্টির মতভেদ ভারতের কমিউনিস্ট পার্টির উপর প্রভাব ফেলে। দীর্ঘদিন ধরে চলা মতাদর্শগত বিতর্কের পরিপ্রেক্ষিতে ১৯৬৪ সালে ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি দুই ভাগে বিভক্ত হয়ে যায়। সংশোধনবাদীদের বিরুদ্ধে লড়াই করে কমরেড মুজফ্ফর আহমদের নেতৃত্বাধীন পার্টির প্রকৃত বিপ্লবী অংশ সিপিআই (এম) বা ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি (মার্কসবাদী) নামে পরিচিত হয়। ১৯৬৯ সালে সশস্ত্র কৃষক অভ্যুত্থানের মাধ্যমে ক্ষমতা দখলের ঘোষণা দিয়ে গঠিত হয় সিপিআই (এম-এল) বা ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি (মার্কসবাদী-লেনিনবাদী)। এরা প্রধানত মাও সে তুং (মাও জে ডং)ও চীনের অনুসারী। মুজফফর আহমদ এই সময়েও মস্কো ও পিকিং-এর অন্ধ অনুসরণের বিরোধিতা করেন।
১৫.
১৯৭১ সালে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধকে সিপিআই (এম) পূর্ণ সমর্থন দেয়। ঐ দিনগুলোতে পার্টি মুখপত্র ‘গণশক্তি’র দৈনন্দিন সংবাদ সমালোচনা ও সম্পাদকীয়তে তার স্বাক্ষর মেলে। মুজফফর আহমদের ভাষায়, ‘পশ্চিম পাকিস্তানের অত্যাচার হতে মুক্ত হবার জন্য বাংলাদেশের মানুষেরা যেভাবে সংগ্রাম চালিয়েছেন, তার তুলনা দুনিয়ার ইতিহাসে কম। আমি বাংলাদেশের মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য নিজেকে গৌরবান্বিত মনে করি। আমি একজন অক্ষম অসমর্থ বৃদ্ধ, যদি আমার শরীরে শক্তি থাকত, তা হলে আমিও বাংলাদেশের মুক্তি ফৌজে যোগ দিতাম”।
১৬.
১৯৭১ সাল থেকে ১৯৭৩ সাল পর্যন্ত দীর্ঘ ৫২ বছর কমরেড মুজফ্ফর আহমদ কর্মীদের মার্কসবাদী সাহিত্য অধ্যয়ন, প্রকাশ ও প্রচারের তাৎপর্য ব্যাখ্যা করেছেন। ১৯৩৬ সালে ‘গণশক্তি’ পুনঃপ্রকাশ করেন এবং এরপর ‘আগে চলো’ পত্রিকা প্রকাশ করেন। ১৯৪৫ সালের ডিসেম্বরে বাংলা ও হিন্দিতে দৈনিক ‘স্বাধীনতা’ এবং সাপ্তাহিক ‘মতামত’ প্রকাশ করেন। ১৯৩৯ সালে সুরেন দত্তের সহায়তায় ‘ন্যাশনাল বুক এজেন্সি’ প্রকাশনাকে পার্টির আওতায় আনেন। সুনীল বসু (কাটু) প্রমুখকে সঙ্গে নিয়ে ১৯৪২ সাল থেকে ‘ন্যাশনাল বুক এজেন্সি’কে সুন্দর ও সুষ্ঠুভাবে গড়ে তোলার কাজে তার নাম অবিস্মরণীয় হয়ে আছে। গোপন ছাপাখানার কর্মী কালী চৌধুরী ও সমীর দাশগুপ্তকে নিয়ে তিনি ১৯৫২ সালে ‘গণশক্তি’ প্রিন্টার্স প্রতিষ্ঠা করেন।
১৭.
মুজফফর আহমদের জীবনের বেশিরভাগ সময় কেটেছে পার্টি অফিসে, কারাগারে কিংবা গোপন আস্তানায়। এ ছাড়া পার্টি কর্তৃক ভাড়া করা ঘরে অথবা কর্মস্থলে। নিজের আর্থিক নিরাপত্তার জন্য বা ব্যক্তিগত সম্পত্তি হিসেবে কিছু করেননি। জীবনের শেষ দিনগুলোতে পার্টি কর্তৃক নিয়োজিত একজন কর্মী তার দেখাশুনা করতেন। মৃত্যুর আগে প্রায় সাত মাস তিনি কলকাতায় একটি নার্সিং হোমে ভর্তি ছিলেন। কৃষক-শ্রমিক ও মেহনতি মানুষের মুক্তির লক্ষ্যে আপসহীন এই মানুষটি ১৯৭৩ সালের ১৮ ডিসেম্বর কলকাতায় শেষনিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। কলকাতার গোবরা ৩নং কবরস্থানে কমরেড কমরেড মুজফ্ফর আহমদ শায়িত আছেন। দৈনিক গণশক্তি ভবনে রয়েছে কমরেড মুজফ্ফর আহমদ পাঠাগার।
১৮.
‘সন্ত্রাসবাদী বিপ্লবীদের অভ্যুদয়’ রচনায় কমরেড মুজফ্ফর আহমদ লিখছেন, ‘আমি অত্যন্ত গরীব ছাত্র ছিলাম। যথাসাধ্য স্বদেশী দ্রব্য আমিও ব্যবহার করতাম। প্রিয়নাথ মুখোপাধ্যায়ের (বিখ্যাত উকিল কুমুদিনীকান্ত মুখোপাধ্যায়ের ছেলে) নোয়াখালী বাজারস্থ ‘স্বদেশী স্টোর্স” (?) হতে মিলের তৈয়ারী ধুতি কিনে আমিও পরতাম। বাঙলায় সন্ত্রাসবাদী বিপ্লবীদের অভ্যুদয় একটি স্মরণীয় ঘটনা। এটা ছিল একটি গোপন আন্দোলন। বঙ্গভঙ্গের আগেই তাদের দল গড়ে উঠেছিল। অবশ্য, বঙ্গভঙ্গ আন্দোলন তাদের বিশেষ প্রেরণা জুগিয়েছিল। এটা বিশেষ লক্ষণীয় যে বাঙলা দেশেই সন্ত্রাসবাদী কার্যকলাপ বিশেষ দানা বেঁধে উঠেছিল। বাঙলার শিক্ষিত ‘ভদ্রলোক’ সম্প্রদায়ের ভিতরেই ছিল তার উর্বর ক্ষেত্র। বাঙলার বাহিরেও সন্ত্রাসবাদী বিপ্লবীদের কর্মপ্রচেষ্টা চলেছে। কিন্তু বাঙলার মতো দীর্ঘস্থায়ী তা কোথাও হয়নি। এই শতাব্দীর দ্বিতীয় দশকে আমার মনের যে অবস্থা ছিল, আর যে-রোমাঞ্চ সন্ত্রাসবাদী আন্দোলনে ছিল তাতে আমার পক্ষে সন্ত্রাসবাদী বিপ্লবী দলে যোগ দেওয়া অসম্ভব ছিল না। কিন্তু তার পথে দুস্তর বাধা ছিল। বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের ‘আনন্দ মঠ” হতে সন্ত্রাসবাদী বিপ্লবীরা প্রেরণা লাভ করতেন। এই পুস্তকখানি শুরু হতে শেষ পর্যন্ত সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষে পরিপূর্ণ। এর মূল মন্ত্র ছিল বঙ্কিমচন্দ্রের ‘বন্দেমাতরম’ গান। তাতে আছে-
বাহুতে তুমি মা শক্তি
হৃদয়ে তুমি মা ভক্তি
তোমার প্রতিমা গড়ি মন্দিরে মন্দিরে।
ত্বংহি দুর্গা দশপ্রহরণ ধারিণী ইত্যাদি।
একেশ্বরবাদী কোনও মুসলিম ছেলে কি করে এই মন্ত্রোচ্চারণ করতে পারত? এই কথাটা কোনো হিন্দু কংগ্রেস নেতাও কোনও দিন বুঝতে পারেননি। বাঙলা দেশের সন্ত্রাসবাদী আন্দোলন নিঃসন্দেহে ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলন ছিল। কিন্তু তা হিন্দু উত্থানের আন্দোলনও ছিল। উদ্দেশ্য ছিল হিন্দু রাজত্বের পুনঃপ্রতিষ্ঠা। রবীন্দ্রকুমার ঘোষও আন্দামান হতে ফেরার পথে এই কথাই লিখেছিলেন। তার সেই পুস্তকখানি এখন দুষ্প্রাপ্য। উনিশ শ’ বিশের দশকে সন্ত্রাসবাদী বিপ্লবীদের মধ্যে ধারণার পরিবর্তন শুরু হয়েছিল। তবুও আমি ১৯২৩-২৪ সালে তাদের একজন বড় নেতাকে দেখেছি, যে-বিকালে তিনি জেলে এলেন তার পরের সকালেই জেল অফিসে একটি সম্ভ্রামাকর্ষক কালীর ছবির জন্য (an imposing picture of Goddess Kali) অর্ডার পাঠালেন। ঊনিশ শ’ ত্রিশের দশকে সন্ত্রাসবাদী বিপ্লবীরা জেলখানায় মার্কসবাদ-লেনিনবাদ পড়েছিলেন এবং তাদের ভিতর হতে বহু সংখ্যক লোক ভারতের কমিউনিস্ট পার্টিতে যোগ দিয়েছিলেন।” (‘আমার জীবন ও ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি’: কমরেড মুজফ্ফর আহমদ,১০ ও ১১ পৃষ্ঠা)।
১৯.
কমরেড কমরেড মুজফ্ফর আহমদ লিখিত ‘সাম্প্রদায়িকতার বিষম পরিণাম’ থেকে তার চিন্তা, যুক্তি পাঠ করা যাক।– ‘ভারতবর্ষে ধর্মগত সাম্প্রদায়িকতার দলাদলি খুবই বেড়ে চলেছে। গত ক’বছরের মধ্যে অনেকগুলি সাম্প্রদায়িক প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠেছে। খিলাফৎ কমিটি, হিন্দু-মহাসভা, জমিয়ৎ-ই-উলেমা, শুদ্ধি-সভা, তব্লীগ সভা, হিন্দু-সংগঠন, তন্জীম্, শিখ্ লীগ ও মুসলিম লীগ প্রভৃতি কত যে হয়েছে তার হিসাব রাখাই মুশকিল। এর প্রত্যেকটি অনুষ্ঠানেরই দ্বারা দেশে অশান্তি ও অসন্তোষ খুব বেশী মাত্রায় বেড়ে গিয়েছে এবং এর সবগুলি অনুষ্ঠানেরই পেছনে সে-সকল লোকের হাত রয়েছে যাঁরা উৎপাদন না করেও উৎপন্ন দ্রব্যের সার ভাগটুকু নিঃশেষে উপভোগ করে থাকেন। দেশের সর্বসাধারণের প্রতিনিধি সভা না হলেও ভারতীয় জাতীয় মহাসমিতি জাতি-ধর্ম নির্বিশেষে সকলের একটা মিলনক্ষেত্র ছিল। সাম্প্রদায়িক অনুষ্ঠানের সংখ্যা বেড়ে যাওয়াতে মহাসমিতিও আজকাল শ্রীহীন হয়ে পড়েছে। সাম্প্রদায়িক অনুষ্ঠানগুলির বিষময় ফল এই হয়ে দাঁড়িয়েছে যে আজকাল বহু সংখ্যক লোক সমগ্রভাবে ভারতবর্ষের কথা চিন্তা না করে কেবলমাত্র একটা বিশিষ্ট গন্ডির বিষয়ই ভাবছে। হিন্দু ভাবছে কি করে মুসলমানকে জব্দ করা যাবে, আর মুসলমান ভাবছে ঠিক তার উল্টো। এই করে ভারতের জাতীয় জীবন অঙ্কুরেই নষ্ট হয়ে যেতে বসেছে।’
২০.
কমরেড কমরেড মুজফ্ফর আহমদ লিখছেন, ‘একটি ধর্মের নিয়ম-কানুনের সহিত আর একটি ধর্মের নিয়ম-কানুনের প্রায়ই মিশ্ খায় না। অধিকাংশ স্থলে এ নিয়ম-কানুনগুলি পরস্পরবিরোধী হয়ে পড়ে। এ অবস্থায় ধর্ম জিনিসটা বিভিন্ন ধর্মাবলম্বীর পক্ষে ব্যক্তিগত সাধনার বস্তু হলে তা সহ্য করতে পারা যায়। কিন্তু, তা না করে যখনি আমরা আমাদের ধর্মকে অপর ধর্মাবলম্বীর সহিত বোঝাপড়ার ব্যাপারে পরিণত করি তখনি ধর্ম সাধারণভাবে সমগ্র দেশের পক্ষে অসহ হয়ে ওঠে। ভারতবর্ষে তথাকথিত ধর্মগুলি আজকাল একেবারেই অসহ হয়ে পড়েছে। এক ধর্মাবলম্বী অপর ধর্মবলম্বীকে বলছে তোমাকে আমার ধর্মের বিধি-বিধানগুলো মেনে চলতেই হবে। কেন যে চলতে হবে তার যুক্তি হচ্ছে লাঠির গুঁতো। সাধারণ লোকের মধ্যে এমনি সব মনোবৃত্তির উৎকর্ষ সাধন করে দিয়ে যাদের বিন্যস্ত স্বার্থ রয়েছে তারা খুবই মজা লুটছে। ভারতবর্ষের জনসাধারণের শোষিত হওয়া কপাল। সকল দিক থেকে সকলরূপে তারা কেবলই শোষিতই হচ্ছে। ধর্মসমূহের মধ্যে সারবস্তু কি আছে না আছে তা জানিনে, কিন্তু এদেশে প্রতিনিয়ত চোখে দেখতে পাচ্ছি যে বেশী ধার্মিক হওয়ার মানেই হচ্ছে বেশী সংকীর্ণ হওয়া। আমি যত বেশী ধার্মিক হব তত বেশী অন্য ধর্মাবলম্বীকে ঘৃণা করব, এই হচ্ছে আমার ধার্মিকত্বের পরিচয়। হিন্দু শুধু হিন্দু বলেই মুসলমান তাকে ঘৃণা করে, আর মুসলমানকেও হিন্দু ঘৃণা করে থাকে কেবল সে মুসলমান বলে। হ’ক না কেন উভয়েই মানুষ, তাতে কি এসে যায়—হিন্দু কিংবা মুসলমান তো নয়।’
২১.
কমরেড কমরেড মুজফ্ফর আহমদ লিখছেন, ‘এই যে ধর্মগত সংকীর্ণতা, এটা কেটে যেতে পারত যদি এদেশের বিভিন্ন ধর্মাবলম্বী লোকের জন্যে একটা সাধারণ মিলনক্ষেত্রের সৃষ্টি হ’ত। রাষ্ট্রের ক্ষেত্রেই ছিল একমাত্র মিলনক্ষেত্র যে ক্ষেত্রে হিন্দু-মুসলমান, বৌদ্ধ-খৃষ্টান অর্থনীতিক কারণে, সমস্বার্থের জন্যে মিলিত হওয়ার সম্ভাবনা ছিল। ঠিক এইরূপ একটা রাষ্ট্রীয় জীবন গড়ে ওঠার পরে সাম্প্রদায়িক গণ্ডিগুলি আপনা হতেই ভেঙে যেত। কিন্তু এমন একটা প্রচেষ্টা আজো পর্যন্ত করা হয়নি। কংগ্রেসের ভিতর দিয়ে এরূপ রাষ্ট্রীয় জীবন গড়ে ওঠা উচিত ছিল বটে, কিন্তু তা হয়নি। প্রথম কথা, কংগ্রেসের সহিত কখনো দেশের সর্বসাধারণের জীবনের যোগ সাধিত হয়নি। ভদ্র ও অভিজাত শ্রেণীর লোকেরাই কংগ্রেসের সর্বেসর্বা, জনসাধারণ তার কেউ নয়, দ্বিতীয়ত, মহাত্মা গান্ধী কংগ্রেসকে একটা ধর্মচর্চার ক্ষেত্র করে তুলেছিলেন। এই অসম জিনিসের একত্র সমাবেশ করার চেষ্টার অবশ্যম্ভাবী বিষময় ফল এখন দেশে ফলেছে।’
২২.
কমরেড কমরেড মুজফ্ফর আহমদ আরো লিখছেন, ‘আবারো বলছি—ধর্মগতভাবে অনুষ্ঠিত যতগুলি সঙ্ঘের নাম আমরা করেছি তার সবগুলিরই মূলে একই শ্রেণীগত স্বার্থ রয়েছে। এই দেশের জনসাধারণ যাতে কোনো প্রকারে আপনাদের অবস্থা সম্বন্ধে সচেতন না হতে পারে তারি জন্যে শোষকশ্রেণীর আপ্রাণ প্রচেষ্টা হচ্ছে—এই ধর্মগত সঙ্ঘগুলোর অনুষ্ঠান ও তারি ফলস্বরূপ সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা-হাঙ্গামা। এই করে দেশের সর্বসাধারণের সর্বনাশ করা হচ্ছে। এদেশের যুবকগণ দেশের মুক্তির জন্যে কম নিগ্রহ ভোগ করেননি। ফাঁসিকাঠে ঝুলে আপনাদের প্রাণ তারা হাসিমুখে বলি দিয়েছেন, কারাবরণ তারা করেছেন এবং আরো কত প্রকারে যে নির্যাতিত তারা হয়েছেন কে তার খবর রাখে। কিন্তু বর্তমানে দেশের এ দুর্দিনে তাদের কি কোনো কাজ নেই করার? তারা দেশের সর্বসাধারণকে তাদের অবস্থা সম্বন্ধে সচেতন করে তুলুন। সকল প্রকার সাম্প্রদায়িকতাকে পরিহার করে তাদের উচিত জনসাধারণকে বোঝানো কি ক্ষতিই না স্বার্থপর লোকেরা তাদের করছে। এ অচেতন-জনগণকে খুব ভাল করে বুঝিয়ে দিতে হবে যে তাদের রক্ত নানা উপায়ে যে সকল লোক শোষণ করছে সে-সকল লোক কোনোদিনও তাদের বন্ধু হতে পারে না।’
কমরেড মুজফফর আহমদ সর্বক্ষণের রাজনৈতিক কর্মী হিসেবে যে জীবন শুরু করেছেন, একটানা ৫৩ বছর রাজনৈতিক জীবনে তা আত্মত্যাগ ও অবদানে ক্রমভাস্বর হয়ে ওঠে। প্রচন্ড আর্থিক অনটন, অর্ধাহার, অনাহারের মধ্যে এবং মতাদর্শগত সংগ্রামে মার্কসবাদ –লেনিনবাদের বিশুদ্ধতা রক্ষার জন্য বলিষ্ঠ ভূমিকা, মানুষ ও কর্মীদের প্রতি গভীর মমত্ববোধ, দেশের প্রতি ও আন্তর্জাতিকতাবাদের প্রতি গভীর ভালবাসা, সুলেখক ও সংগঠক হিসেবে তার অবদান তাকে ইতিহাসের পাতায় করে তুলেছে মহান। কমরেড মুজফফর আহমদের মৃত্যু নেই। তার আত্মত্যাগ ও অবদান ভারতের কমিউনিস্ট আন্দোলনের ইতিহাসে স্বর্ণাক্ষরে লেখা থাকবে।
লেখক: মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক গবেষক, সাংবাদিক ও কলামিস্ট
সারাবাংলা/এএসজি