Sunday 22 Dec 2024
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

মানবাধিকার রক্ষায় বিডিআর হত্যার বিচার জরুরি

সোহানা চৌধুরী
২২ ডিসেম্বর ২০২৪ ১৭:২৮

২০০৯ সালের ২৫ ফেব্রুয়ারি বাংলাদেশের ইতিহাসে সবচেয়ে ভয়াবহ এবং মর্মান্তিক হত্যাকাণ্ড ঘটে রাজধানী ঢাকার পিলখানায়। বিদ্রোহের নামে সীমান্তরক্ষী বাহিনী বিডিআরের (বর্তমানে বিজিবি) সদস্যরা সেদিন ৫৭ জন সেনা কর্মকর্তাসহ মোট ৭৪ জনকে নৃশংসভাবে হত্যা করে। এ ঘটনা শুধু নিরাপত্তা ব্যবস্থার এক গভীর ব্যর্থতাই নয়, বরং এটি মানবাধিকারের চরম লঙ্ঘন এবং জাতির নৈতিক ভিত্তিকে চ্যালেঞ্জ করে। বিদ্রোহের ভয়াবহতা, পেছনের ষড়যন্ত্র, এবং এর প্রভাব এখনো আমাদের রাষ্ট্রীয় কাঠামো এবং বিচারব্যবস্থার অমীমাংসিত প্রশ্ন হয়ে রয়ে গেছে।

বিজ্ঞাপন

পিলখানা হত্যাকাণ্ড জাতির সামনে এমন এক বাস্তবতা তুলে ধরেছিল, যা কেবল শোকের নয়, বরং আত্মপর্যালোচনারও। সীমান্তরক্ষী বাহিনীর সদস্যদের মধ্যে ক্ষোভ এবং বিদ্রোহের অজুহাতে সেদিন যে বর্বরতা চালানো হয়েছিল, তা শুধু ঐ বাহিনীর অভ্যন্তরীণ সমস্যার ফল নয় বরং এটি ছিল দীর্ঘমেয়াদী কাঠামোগত দুর্বলতা এবং বাহিনীর মধ্যে সুশাসনের অভাবে সৃষ্ট আস্থা সংকটের বহিঃপ্রকাশ। সরকারি তদন্ত কমিটির প্রতিবেদন (২০০৯) এবং বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমের প্রকাশিত তথ্যে জানা যায়, বিদ্রোহীরা দাবি করেছিল বেতনবৃদ্ধি, সুযোগ-সুবিধা বাড়ানো এবং সামরিক কর্মকর্তাদের প্রভাব কমানোর মতো বিষয়গুলো নিয়ে। তবে এই দাবি আদায়ের জন্য এমন নির্মম হত্যাকাণ্ড এবং গণবিধ্বংসী কার্যকলাপ কখনোই ন্যায়সংগত হতে পারে না।

বিজ্ঞাপন

এই হত্যাকাণ্ডের পিছনে কি শুধুই বাহিনীর অভ্যন্তরীণ অসন্তোষ ছিল? নাকি এর পেছনে আরও গভীর ষড়যন্ত্র কাজ করেছে? অনেক গবেষক এবং বিশেষজ্ঞ মনে করেন, এটি কেবল একটি বাহিনীর অভ্যন্তরীণ ঘটনা ছিল না। বরং দেশের নিরাপত্তা এবং স্থিতিশীলতাকে নষ্ট করার উদ্দেশ্যে একটি বৃহত্তর ষড়যন্ত্রের অংশ। বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, জাতীয় এবং আন্তর্জাতিক রাজনীতির বিভিন্ন কূটকৌশল এই ঘটনার পেছনে প্রভাব ফেলতে পারে। তবে এই ষড়যন্ত্র তত্ত্ব নিয়ে এখনও পূর্ণাঙ্গ এবং স্বচ্ছ তদন্ত হয়নি।

বিদ্রোহ নিয়ন্ত্রণে আনতে সরকার দৃঢ় পদক্ষেপ গ্রহণ করলেও, এর প্রেক্ষিতে শুরু হওয়া বিচার প্রক্রিয়া ছিল বাংলাদেশের ইতিহাসে সবচেয়ে বৃহৎ ও জটিল। ২০১৩ সালে ঢাকার মহানগর দায়রা আদালত এ মামলার রায় দেয়, যেখানে ১৫২ জনকে মৃত্যুদণ্ড, ১৬১ জনকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড, এবং আরও কয়েক শতাধিক ব্যক্তিকে বিভিন্ন মেয়াদে সাজা দেওয়া হয়। এ মামলায় মোট আসামি ছিল ৮৪৬ জন, যা বাংলাদেশের বিচারব্যবস্থার জন্য এক নজিরবিহীন চ্যালেঞ্জ। তবে বিচার প্রক্রিয়ার স্বচ্ছতা এবং মানবাধিকারের প্রতি সম্মান নিয়ে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে গুরুতর প্রশ্ন ওঠে। অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল এবং হিউম্যান রাইটস ওয়াচের মতো সংস্থাগুলো অভিযোগ করে, আসামিদের অনেকে ন্যায়বিচার থেকে বঞ্চিত হয়েছেন এবং তাদের প্রতি আইনি সহায়তা ও মানবিক আচরণ নিশ্চিত করা হয়নি।

বিচারের এই সীমাবদ্ধতা আমাদের রাষ্ট্রীয় কাঠামো এবং বিচারব্যবস্থার প্রতি জনগণের আস্থা দুর্বল করেছে। একটি সুশাসিত রাষ্ট্রে বিচারব্যবস্থা শুধু অপরাধীদের শাস্তি নিশ্চিত করাই নয়, বরং মানবাধিকার রক্ষার প্রতিও প্রতিশ্রুতিবদ্ধ থাকতে হয়। পিলখানা হত্যাকাণ্ডের মতো জটিল ঘটনার ক্ষেত্রে ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা করতে হলে অপরাধীদের সঠিকভাবে চিহ্নিত করা, পর্যাপ্ত প্রমাণ সংগ্রহ করা এবং প্রতিটি আসামির প্রতি সমান ন্যায়বিচার নিশ্চিত করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ছিল।

এই ঘটনার আরেকটি দিক হলো, ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারগুলোর প্রতি রাষ্ট্রের দায়িত্ব। নিহত সেনা কর্মকর্তারা শুধু তাদের পরিবার নয়, বরং পুরো জাতির জন্য জীবন দিয়েছেন। তাদের পরিবারের সদস্যদের জন্য পর্যাপ্ত আর্থিক সহায়তা, মানসিক সান্ত্বনা এবং সামাজিক মর্যাদা নিশ্চিত করা রাষ্ট্রের নৈতিক দায়িত্ব। একই সঙ্গে, বিদ্রোহের শিকার হওয়া বিডিআর সদস্যদের মধ্যেও যারা নির্দোষ ছিলেন, তাদের প্রতি সুবিচার করা এবং রাষ্ট্রীয় সুরক্ষা প্রদান করা উচিত। এ ব্যাপারে জাতীয় মানবাধিকার কমিশন বারবার আহ্বান জানিয়েছে।

এ ঘটনা আমাদের শিখিয়েছে, সশস্ত্র বাহিনীর মধ্যে যদি বিশ্বাসের অভাব থাকে এবং কাঠামোগত দুর্বলতা থাকে, তবে তা জাতীয় নিরাপত্তার জন্য বড় ধরনের হুমকি সৃষ্টি করতে পারে। ভবিষ্যতে এ ধরনের ঘটনা প্রতিরোধে বাহিনীর মধ্যে সুসম্পর্ক, পেশাদারিত্ব, এবং কার্যকর নেতৃত্ব নিশ্চিত করা জরুরি। একই সঙ্গে, সামরিক ও বেসামরিক বাহিনীর মধ্যে সমন্বয় এবং আস্থার সম্পর্ক গড়ে তোলাও অত্যন্ত প্রয়োজনীয়।

পিলখানা হত্যাকাণ্ডের বিচার একটি দৃষ্টান্তমূলক পদক্ষেপ হলেও, এর সীমাবদ্ধতাগুলো আমাদের আইনের শাসন এবং মানবাধিকারের প্রশ্নে আরও সতর্ক হতে বাধ্য করে। মানবাধিকার সংরক্ষণ এবং ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার জন্য রাষ্ট্রকে দ্বিমুখী দায়িত্ব পালন করতে হবে। অপরাধীদের শাস্তি নিশ্চিত করার পাশাপাশি বিচার প্রক্রিয়ায় যেকোনো ধরনের অনিয়ম প্রতিরোধ করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।

পিলখানা হত্যাকাণ্ডের মর্মান্তিকতা আমাদের ভুলে গেলে চলবে না। এ ঘটনার যথাযথ বিচার, মানবাধিকারের প্রতি অঙ্গীকার, এবং ভবিষ্যতে এ ধরনের ঘটনা প্রতিরোধে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ আমাদের জন্য এক স্থায়ী দায়িত্ব। বিচারহীনতার সংস্কৃতি থেকে বেরিয়ে এসে আমরা যদি ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা করতে পারি, তবেই একটি সমৃদ্ধ, শান্তিপূর্ণ এবং মানবিক বাংলাদেশ গড়ে তোলা সম্ভব হবে।

লেখক: শিক্ষার্থী, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা

সারাবাংলা/এএসজি

পিলখানা হত্যাকাণ্ড মুক্তমত সোহানা চৌধুরী

বিজ্ঞাপন

আরো

সম্পর্কিত খবর